ইতি মাধবীলতা – ১০ (২য়)

0
1010

ইতি মাধবীলতা – ১০ (২য়)
আভা ইসলাম রাত্রি

আর কিছুক্ষণ পর ঝলমলে জমিদার বাড়ি স্তব্ধ হয়ে যাবে। জমিদারের বড় পুত্র বাড়ি ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। রেখা দেবী আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়ে ক্রন্দন করছেন। শত-সহস্র অভিযোগ পুষে রাখছেন মনের অন্তঃস্থলে! পুত্র বিদায়ের শোক এ মাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলমান। জমিদার বাবুর বেলায় বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো! মাধবীকে সঙ্গে করে শহরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তার একটুও ভালো লাগেনি। গ্রামে ছেড়ে চলে গেলে, তিনি নিলাংসুর আড়ালে এই বেদের মেয়ের কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু বড় পুত্রের রাগ এবং মেজাজ সম্পর্কে তিনি অবগত বিধায় এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলার জো হয়নি তার। তাই মুখটি বুজে শুরু থেকে সব সহ্য করছেন।

নিলাংসু নিজ কক্ষে বসে নতিপত্র ব্যাগে ঢুকাচ্ছে। মাধবী একপাশে ঠাঁট মেরে দাড়িয়ে রয়েছে। শহরে যেতে তার একটুও মন মানছে না। এই পাষাণ লোকের সাথে একা থাকবে ভাবতেই মনটা রুক্ষতায় পূর্ণ হয়ে উঠছে। মাধবী নিলাংসুর সামনে বসল। কোনোরূপ ভণিতা না করে সোজাসাপ্টা বললো,
— আমি যেতে চাইনা আপনার সাথে। আপনি আমায় নিজ বাড়ি রেখে আসুন।

নিলাংসুর ভ্রু কিছুটা কুঞ্চিত হলো। সে মাথা তুলে মাধবীর পানে চোখ রাখলো। সহসা গম্ভীর কণ্ঠে জানালো,
— নিজের পরিবারের ক্ষতি চাইলে এখানে থেকে যেতে পারো। আমার কোনো আপসোস হবে না। বরং আজ থেকে প্রতিটা মুহূর্ত নরক যন্ত্রণায় কাটানোর জন্যে প্রস্তুত হও।

মাধবী স্তব্দ হয়ে পড়ল। নিলাংসুর এহেন জঘন্য কথা তার শিরদাঁড়া অব্দি কম্পিত করে তুললো। মাধবী অবাক কণ্ঠে বললো,
— আমার-আপনার সম্পর্কে আমার পরিবারকে টানছেন কেনো?
— তোমার পরিবারকে আমি না, বরং তুমি টানছো। কোনোরূপ বাক্য ক্ষয় না করে আমার সাথে শহরে চলো, তোমার পরিবারকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার!

মাধবী কথা ভুলতে ভুলে গেলো। মানুষটা বাইরে যতটা সুন্দর ভেতরটা ঠিক ততটাই বিশ্রী! এরূপ প্রাণ কাঁপানো বাক্য বলতে তার কি একটুও দ্বিধাবোধ হলো না? মাধবীর চক্ষু থেকে দুফোঁটা জল বিসর্জন গেলো। মাধবীর গালে অশ্রুর উপস্থিতি লক্ষ্য করতেই শশব্যস্ত হয়ে উঠলো নিলাংসু। মাধবীর সামনে বসে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
— আরে, আরে! কাঁদছ নাকি?
মাধবী ঘৃণায় মুখ আড়াল করলো। নিলাংসু কিঞ্চিৎ হাসলো। মাধবীর মাখনের মত গাল নিজ হাতের আজলায় নিয়ে নিবিড়ভাবে চুমু খেল তার চোখের ঠিক নিচটায়। ওষ্ঠ দ্বারা শুষে নিল মাধবীর চোখের নোনা জল। মাধবীর রাগ হলো খুব। ধাক্কায় সরিয়ে দিতে চাইলো এ পাষাণ লোককে। তবুও নিজের থেকে এক চুলও সরাতে পারলো না নিলাংসুর ভারী দেহখানা। হার মেনে নখের ধারালো আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলো নিলাংসুর হস্ত। তবুও পুরুষটা নির্বিকার। নিলাংসুর এমন অনুভূতিপূর্ণ স্পর্শে ঘৃনায় চোখ বুজে এলো মাধবীর। মাধবী বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
— পাষাণ, নিষ্ঠুর লোক! ঘৃনা করি আপনাকে।

নিলাংসু ঠোঁট টেনে হাসলো। মাধবীর ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
— চিন্তা নেই, তোমার ঘৃণায়ও ভালোবাসা খুঁজে নেবো আমি।
__________________________
জমিদার বাড়ির সামনে পালকি বসে আছে। রেখা দেবী বরণ ঢালা হাতে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন পুত্র এবং পুত্রবধূকে! মাধবীর মায়াবী চোখ টলমল করছে। এ নারীর দুচোখে কেউ যেনো আস্ত এক সাগর পুষে রেখেছে।

আশীর্বাদ সম্পন্ন হলে রেখা দেবী হাতের ঢালা দাসীর হাতে সোপর্দ করলেন। নিলাংসু মাথা নুইয়ে ফেললো মায়ের সামনে। রেখা দেবী মুচকি হেসে নিলাংসুর ললাটে চুম্বন আঁকলেন। বললেন,
— ভালো থাকিস, বাবু। তোর সকল কর্ম সফল হউক। ভগবান তোর মঙ্গল করুক।

নিলাংসু মৃদু হেসে মাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলল,
— ভালো থেকো। আমি খুব জলদি ফিরবো।

নিজ ক্ষোভের কারণে জমিদার বাবু সেসময় নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে এলেন। নিলাংসু চারপাশে পরখ করে নিজের বাবাকে দেখতে পেলো না। সে মাকে প্রশ্ন করলো,
— মা, বাবা কোথায়?
রেখা দেবী আঁচল দিয়ে ভিজে চোখ মুছলেন। ধরা কণ্ঠে বললেন,
— তোর বাবা পাশের গ্রামে গেছেন, কি একটা কাজে।
নিলাংসু মনেমনে বেশ ক্ষয় হলো। বাবা যে ইচ্ছে করেই তার থেকে দূরে থাকছেন, বিষয়টা নিলাংসুর সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক মুহূর্তেই বুঝে ফেলল। তবে সে কোনো দিরুক্তি করলো না। বাবার যা মন চেয়েছে তিনি তাই করেছেন। এখন নিলাংসুর যা মন চাইবে, সে তাই করবে। অতঃপর, নিলাংসু মাধবীর হাতখানা আকড়ে পা বাড়ালো বাড়ীর বাইরে।

পালকিতে মাধবীকে প্রবেশ করিয়ে পালকির পর্দা মেলে দিল নিলাংসু। মাধবীর শাড়ির আঁচল একপাশে বেরিয়ে ছিল। নিলাংসু অতি যত্নে সে আঁচলটুকু পালকির ভেতরে রেখে দরজা আটকে দিলো। যাওয়ার আগে পেছন ফিরে পুনরায় দেখে নিল জমিদার বাড়িকে। পূর্বে যা ঘটেছিল, তা চাপা দিতে মাধবীর এ বাড়ি পরিত্যাগ করা জরুরি ছিল। নিলাংসু ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। মনেমনে কয়েকবার আওরালো, ‘ যা আমি আড়াল করতে চাই, এ সংসারে কেউ তা প্রকাশ করতে পারে না। আপসোস, কি নির্বোধ এ সংসার! ‘

আজ থেকে মাধবী এবং নিলাংসুর জীবন নতুনভাবে শুরু হবে। এই নতুন জীবনে আসবে নানা চড়াই-উৎরাই। বাঁধাদের হারিয়ে জয় হবে ভালোবাসার। এক নতুন গল্পের সূচনা হবে এবার!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here