ইনসাইড দ্যা ডোর,পর্ব -৬
সাইবা চৌধুরী।
আরও একটা পুতুলের রহস্য আমার কাছে পরিষ্কার। এখন শুধু অপেক্ষা সময় বুঝে আরও একবার ডাঃ সোহানের বাসায় যাওয়ার। বাকিটা না হয় তাবিয়ার কাছ থেকেই জানা যাবে।”
ভিডিও ডিভাইস, সাউন্ড রেকর্ডার ও সুমনের কিছু ঔষধ নিয়ে খুশি খুশি মনে রুম থেকে বের হয়ে যায় সে।
.
.
.
.
সকাল থেকে গেটের দিকে নজর রেখেছে আরিকা। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল ডাঃ সোহানের বের হওয়ার নামগন্ধও নেই।
“তাহলে কি আজ ডাঃ সোহান বাইরে বের হবে না!
যদি তাই হয় তাহলে আরও একদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। কিন্তু রহস্য সমাধানের নেশা আমাকে কিছুতেই বসে থাকতে দিচ্ছে না।
এভাবে ছটফটিয়ে আরিকা আরও এক ঘন্টা কাটিয়ে দিলো। এর ভেতর ডাঃ সোহানকে বের হতে না দেখে আরিকা ধরেই নিলো আজ হয়ত সে বাইরে যাবে না।
অগত্যা আরিকা কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শরীর ক্লান্ত শরীর নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সে।
.
.
.
.
সময় তখন দুপুর ৩ টা।
সাহেরা বেগম কিছু কাজে বাইরে বের হয়েছিলেন।
কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় সিঁড়িতে দেখা হয় ডাঃ সোহান ও তাবিয়ার সাথে। সাহেরা বেগমকে দেখে ডাঃ সোহান মুখে হাসি টেনে তাকে সালাম জানায়।
সালামের উত্তর দিয়ে সাহেরা বেগম টুকটাক কিছু কথা বলেন। কথা বলার মাঝে “তারা কোথায় যাচ্ছে” জানতে চান সাহেরা বেগম। ডাঃ সোহান জানায়, কোনো এক দরকারে তার বন্ধুর বাসায় যেতে হচ্ছে। ফিরতে একটু লেট হবে তাদের।
সাহেরা বেগম কোনো কথা না বাড়িয়ে তাদের বিদায় জানান। ডাঃ সোহানের সাথে কথা বলার সময় সাহেরা বেগমের চোখ ছিলো তাবিয়ার দিকে। পুরোটা সময় তাবিয়ার দিকে আঁড়চোখে খুব অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। যেটা একদমই ডাঃ সোহানের নজর এড়ায় না।
তবে বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে সোহান তাবিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
.
.
.
.
দোতলায় উঠে সাহেরা বেগম দেখতে পান আজ ডাঃ সোহান বাসায় তালা দিয়ে যায়নি। হয়ত তাড়াহুড়োয় ভুল করে তালা না দিয়েই বের হয়ে গেছে। ডাঃ সোহানের বাসায় ঢোকার প্রবল ইচ্ছে জাগে সাহেরা বেগমের মনে।
হবেই না বা কেন! আরিকাকে তিনি সব বিষয় খুলে বলেছিলেন একটা কারণেই, যাতে করে সে সব রহস্যের পর্দা খুলে তার সামনে রাখতে পারে। কিন্তু কি অদ্ভুত বিষয়! দু’দিন হয়ে গেল আরিকা তাকে কিছুই জানালো না।
এমন কি সেদিন এ বাসায় ঢুকে কি দেখেছিলো, তাবিয়ার বিষয়ে কতটুকু জানতে পেরেছে কিছুই জানায় নি তাকে। জিজ্ঞেস করলে আরিকার একটাই কথা ছিলো, সময় হলে সে নিজের থেকেই সবকিছু বলবে।
আজ এমন একটা সুযোগ হাতের মুঠোয় পেয়ে সাহেরা বেগম কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইলেন না।
আস্তে করে দরজা ঠেলে তিনি ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। চারদিক থেকে অন্ধকার ঘিরে ধরলো সাহেরা বেগমকে।লাইট জ্বালানোর জন্য সুইচ টিপলেন তিনি। লাল রঙ এর একটা ডিম লাইট জ্বলে উঠলো। কিন্তু তাতে অন্ধকার দূর হলোনা। বরং রহস্যময় পরিবেশ আরো ঘনীভূত হল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে টর্চ অন করে সন্তর্পণে সামনের দিকে এগিয়ে যান তিনি।
এদিক সেদিক লাইট মেরে বাসার ভেতরের সবকিছু পর্যবেক্ষন করতে থাকেন। হঠাৎ একজন মহিলার পুতুল দেখে বেশ ঘাবড়ে যান তিনি। পুতুলগুলো দূর থেকে দেখে অনেক বড় মনে হয়েছিলো। এবার কাছ থেকে দেখার পর মনে হচ্ছিলো পুতুলগুলো শুধু আকারেই বড় নয়। অনেকটা সত্যিকারের মানুষের মত।এরকম আরো বেশ কয়েকটা পুতুল দেখতে পান তিনি। সবথেকে বেশি ভয় পান সুমনের চেহারার পুতুলটি দেখে।ভয়ে তার বুক ধুক ধুক করে কাঁপতে থাকে। কোনভাবে এ পুতুলগুলো মানুষের লাশ নয় তো! নিজের মনের কোথাও একটা এ প্রশ্ন উঁকি মারতে থাকে বার বার।হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন ডাঃ সোহানের বেডরুমে। সেখানে সাদা কাপড়ের উপরে মেখা থাকা ছোপ ছোপ রক্তের দাগ এবং একটা অদ্ভুত গন্ধে অনেক বেশি
ভয় পেয়ে যান তিনি। মনে মনে ঠিক করেন আজ ডাঃ সোহান বাসায় ফেরার পরে তিনি সোজাসাপটা বাসা ছেড়ে দিতে বলবেন। ভয় ও রাগে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দ্রুত পা ফেলেন সাহেরা বেগম।
হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন কিছু একটার সাথে তার পা পেঁচিয়ে গেছে। পায়ের দিকে আলো ফেলে তিনি একটা রশি দেখতে পান।
রশি থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য পা হেঁচকা টান দিলেন সাহেরা বেগম। এতেই হলো হিতে বিপরীত।
পা টান দিতেই রশিটা তার পায়ের সাথে আরো শক্ত ভাবে পেচিয়ে দ্রুত উপরের দিকে উঠে গেলো।
পা উপরের দিকে ও মাথা নিচ দিকে হয়ে ঝুলে গেলেন সাহেরা বেগম। কোথা থেকে যেন ভারী জাল ও কাপড় উড়ে এসে তাকে পেঁচিয়ে ফেললো সম্পূর্ণ রূপে।চিৎকার করলেও তার মুখ থেকে জোড়ালো শব্দ বের হলোনা৷ ছোটার জন্য ছটফট করতে লাগলেন তিনি। পাশ থেকে শো শো শব্দ করে দুটো তীর ছুটে এসে বিঁধে গেলো সাহেরা বেগমের গায়ে।
একটা তীর মুখের একপাশ থেকে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। অপর তীরটা আঘাত করে বুক বরাবর ।
আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যান তিনি।
মুখ ও বুক থেকে প্রবল বেগে রক্ত ঝড়ে ফ্লোরে রক্তের বন্যা বয়ে যায়।
সাহেরা বেগমের রক্তাক্ত মৃতদেহটা উল্টোভাবে ঝুলতে থাকে ডাঃ সোহানের বাসায়।
.
.
.
টুন টুন করে একটা সিগনাল বেজে ওঠে ডাঃ সোহানের মোবাইল ফোনে। ডাঃ সোহানের চোখ চিকচিক করে ওঠে।
ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি টেনে বলে,
“অবশেষে আমার ট্রাপে শিকার ধরা পড়েছে”
.
.
.
.
আতিক সাহেবের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় আরিকার।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরিকা দেখতে পায় তখন সন্ধ্যা ৭ টা বাজে।
-“তোমার আন্টি কোথায় গেছে তুমি কি জানো? না মানে তোমাকে কি বলে গিয়েছে? দুপুর থেকেই বাসায় দেখছি না। ফোনে রিং দিচ্ছি কিন্তু রিসিভ করছেনা। বুঝে উঠতে পারছি না আজ কি হলো তার৷ কখনোই সে এমন করেনি।”
আতিক সাহেবের কথায় আরিকা বেশ অবাক হয়।
সে দুপুর ১২ টার দিকে বের হতে দেখেছিলো সাহেরা বেগমকে। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, ছোট একটা কাজে বের হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে । কিন্তু সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তবুও সাহেরা বেগমের খোঁজ নেই! ব্যপারটা স্বাভাবিক নয়।
সব আত্নীয় স্বজনের বাসায় খোঁজ নেয় আতিক সাহেব ও আরিকা। যেসব জায়গায় সাহেরা বেগমের আসা যাওয়া ছিলো এমন প্রতিটা জায়গা খুঁজে দেখে দু’জন মিলে কিন্তু সাহেরা বেগমের কোনো খোঁজই তারা পায় না।
দারোয়ানের কাছে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়,
দুপুরের দিকে বাসায় ঢুকতে দেখেছিলো সাহেরা বেগমকে। তারপরে আর সাহেরা বেগমকে বের হতে দেখে নি।
দারোয়ানের কথা শুনে আরিকার মনে খটকা লাগে। বাড়ির ভেতর থেকে হঠাৎ করে একটা মানুষ কিভাবে উধাও হতে পারে? আরিকার মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে।
.
.
.
.
পরদিন সকাল।
আজও সকাল থেকেই আরিকা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার ধারণা সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ডাঃ সোহানের বাসায়।
হতেও পারে সাহেরা বেগমের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার পেছনে ডাঃ সোহানের হাত আছে। যদি এমন হয় তাহলে এর পরিণাম কতোটা ভয়াবহ হতে পারে সেটা ভেবেই আরিকার বুকটা ধুক করে কেঁপে উঠলো।
একটার পরে একটা অঘটন ঘটেই চলেছে।
অন্যকোনো বিপদ হওয়া আটকাতে যতদ্রুত সম্ভব সকল রহস্য উদঘাটন করতে হবে। আটকাতে হবে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকা সোহান নামক পশুটাকে।
এসব ভাবনার মাঝেই আরিকা,ডাঃ সোহানকে গেট থেকে বের হয়ে যেতে দেখতে পায়। সোহানকে গেট থেকে বের হয়ে যেতে দেখে আরিকা স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে। চিন্তার সাথে সাথে মনের এক কোণে জমা হয় অজানা ভয়ের। অদ্ভুত এক বাসা যার ভেতরে রয়েছে পাঁচটি মৃতদেহ সেই বাসার ভেতরে আবারও প্রবেশ করতে হবে ভেবে আরিকা কিছুটা কেঁপে উঠলো। তবে আজ বাসার ভেতরে আছে তাবিয়া। আরিকা ডাঃ সোহানের বাসার দিকে রওনা হয়।
.
.
সোহানের বাসার সামনে গিয়েই দেখতে পায় দরজাটি হালকা খোলা অবস্থায় আছে। আরিকা ঠিক করল তাবিয়াকে না জানিয়েই ভেতরে ঢুকবে সে।
কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে আরিকা ভেতরে প্রবেশ করে। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে । এমন একটা বাসায় দ্বিতীয়বার ঢোকা সত্যিই একটা দুঃস্বপ্নের মতো। তবুও তার সাহসের সাথে সব ভয়ের মুখোমুখি হতে হবে।
সাহস,ভয়,ও হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে আরিকা ধীরে ধীরে ভেতরে এগিয়ে যায়। একটু ভেতরে ঢুকতেই ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে লাগে তার। নাক চেপে ধরে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায় আরিকা।
সেখানে রাখা সোফার দিকে তাকিয়ে বাসার লাল লাইটের আলোয় আরিকা সোফায় বসা মহিলার পুতুলটার পাশে আরও একটি পুতুল দেখতে পায়। হাতে থাকা টর্চটি পুতুলটার মুখের দিকে ঘুরাতেই চিৎকার করে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে যায় সে। সাহেরা বেগমের এমন ভয়ংকর পুতুল দেখে আরিকা প্রচন্ড রকমের ভয় পায়। মুখের দুই চোয়ালেরই মাংস নেই। বুকে একটা তীর বিঁধে আছে। সাহেরা বেগমের এমন পরিণতি দেখে ফ্লোরের উপর বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আরিকা।
চিৎকার শুনে তাবিয়া ভেতরের রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসে। ডাইনিং রুমের মেঝেতে বসে একটা মেয়েকে কাঁদতে দেখে তাবিয়া অনেক অবাক হয়। মেয়েটাকে সে চেনে। সেদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় এই মেয়েটির সাথেই ধাক্কা লেগেছিল তার। “কিন্তু সে এখানে কি করে?”
নিজের কাছে প্রশ্ন রাখে তাবিয়া। আরিকার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে পুতুলটার দিকে তাকিয়ে তাবিয়া বুঝতে পারে মেয়েটি হয়ত সাহেরা বেগমের কাছের কেউ।
তাবিয়া আরিকাকে কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। আরিকাকে উদ্দেশ্য করে শুধু একটা কথাই বলে,
-“জানিনা তুমি কে। তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটাও আমার জানা নেই।
শুধু বলবো, যদি নিজের প্রাণের প্রতি মায়া থাকে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যাও। এতে তোমারও ভালো হবে সাথে আমারও।
তাবিয়ার কথা শুনে আরিকা কান্না থামিয়ে ভয়ংকর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় তাবিয়ার দিকে।
আরিকার এমন রাগান্বিত চোখের দিকে তাকিয়ে তাবিয়ার গলা শুকিয়ে যায়।
.
.
.
.
.
.
চলবে……..