ইনসাইড দ্যা ডোর,পর্ব-৭

0
1861

ইনসাইড দ্যা ডোর,পর্ব-৭
সাইবা চৌধুরী

“জানিনা তুমি কে। তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটাও আমার জানা নেই।
শুধু বলবো, যদি নিজের প্রাণের প্রতি মায়া থাকে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যাও। এতে তোমারও ভালো হবে সাথে আমারও।
তাবিয়ার কথা শুনে আরিকা কান্না থামিয়ে ভয়ংকর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
আরিকার এমন রাগান্বিত চোখের দিকে তাকিয়ে তাবিয়ার গলা শুকিয়ে যায়।
“আমাকে কি তুমি নিজের মতো ভীতু মনে করো?
কিভাবে পারো তুমি এতো অন্যায় সহ্য করে থাকতে? আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম সোহান নামক এই পশুটাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে কবে মুক্ত হয়ে যেতাম।
অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াও সমান অপরাধ সেটা তো নিশ্চয়ই তুমি জানো। তাহলে সোহানের এসব কাজে প্রতিবাদ না করে তুমিও কি তার পাপের সমান ভাগিদার হচ্ছো না?”
তাবিয়াকে উদ্দেশ্য করে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলো আরিকা। তাবিয়া তার কোনো কথার জবাব দিলো না। শুধু মাথা নিচু করে অনবরত চোখের পানি ফেলতে লাগল।
তাবিয়াকে চুপ থাকতে দেখে আরিকা আবার বলে উঠলো,
-“জানো এ বাড়িতে আসার পেছনে আমার উদ্দেশ্য কি ছিলো?
“তুমি”। তুমিই ছিলে আমার প্রথম লক্ষ্য। সাহেরা আন্টি আমাকে সবার প্রথমে বলেছিলেন, তাবিয়াকে দেখে আমার খুব মায়া হচ্ছে। ও বোধহয় কোনো বিপদে আছে, তুমি যেভাবে পারো সকল রহস্য উদঘাটন করে মেয়েটাকে মুক্ত করো।”
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখো, তোমার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা মানুষটা আজ তোমার স্বামীর হাতেই কতোটা নৃশংসভাবে খুন হয়েছে।
কথাগুলো বলার সময়ে দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকলো আরিকার।
আরিকার কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে তাবিয়াও।
তাবিয়ার কান্না দেখে আরিকা ধীরে ধীরে উঠে তাবিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তার কাঁধে হাত রেখে আরিকা বলে,
“আমি জানি, তুমিও এসব থেকে মুক্তি পেতে চাও।
আমার মতো তুমিও চাও না কোনো নির্দোষ মানুষের এমন ভয়াবহ পরিণতি হোক। তুমি চাইলেই পারবে এ সব কিছু আটকাতে।
আমাকে সবকিছু খুলে বলো তাবিয়া, আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে এমন অভিশপ্ত জীবন থেকে খুব শীঘ্রই বের করে নিয়ে আসবো। ”
আরিকার কথা শুনে তাবিয়া শব্দ করে কেঁদে ওঠে। কান্নার এক পর্যায়ে সে আরিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,
-দয়া করে এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যাও।
আমি নিরুপায়, আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারবো না। আন্টির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আমাকেও খুব কষ্ট দিয়েছে কিন্তু শত চেষ্টা করলেও আমরা তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না। আমি চাই না আর কোনো নিরপরাধ মানুষের এমন নিষ্ঠুর পরিণতি হোক। আমি আমার অভিশপ্ত জীবনে যেমন আছি বেশ আছি, এতোদিনে মানিয়ে নিতেও শিখে গেছি। তুমি দয়া করে এসব বিষয় নিয়ে কোনো কথা বাড়িও না। এর ফলাফল একদমই ভালো হবে না।”
তাবিয়ার এমন ধরণের কথা শুনে আরিকা বেশ বিরক্ত হলো। তাবিয়ার থেকে একটু সরে গিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
-আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি তাবিয়া। আমার ধারণা ছিলো ডাঃ সোহানের হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করতে ও তাকে তার কর্মের সাজা দিতে তুমি হয়ত আমাকে সাহায্য করবে।
কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। এখন তো দেখছি এতোগুলো মানুষের মৃত্যুতে তোমার কিছুই যায় আসে না। তবে ভয় পেয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো মেয়ে আমি নই।
ডাঃ সোহানের এমন ধ্বংসাত্মক খেলার ধ্বংস আমি করেই ছাড়বো তাতে আমার যা-ই করতে হোক না কেন আমি সবকিছুতেই রাজি। সবচেয়ে বড় কথা কি জানো তাবিয়া!
এবার আর তোমাকে নিয়ে আমি একবিন্দুও ভাববো না।
-তোমার যা খুশি করো কিন্তু আপাতত এখান থেকে চলে যাও দয়া করে।
তাবিয়ার কথায় আরিকা রাগে ফেটে পড়লো। তবুও যতোটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে তাড়াহুড়ো করে পুতুলগুলোর কয়েকটা ছবি তুলে হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো সে।
আরিকার যাওয়ার পথে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাবিয়া।
.
.
.
বাসায় ফিরে আরিকা প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে।
সাহেরা বেগমের এমন পরিণতির কথা কিভাবে বলবে সে আতিক সাহেব কে!
আতিক সাহেব একজন হার্টের রুগী। হুট করে এমন একটা খবর তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবেন না। কিন্তু তার থেকে সবকিছু এড়িয়ে যাওয়াও ঠিক বলে মনে হচ্ছে না আরিকার।
কি করবে না করবে বিশাল এক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে সে। ভাবতে ভাবতে গভীর চিন্তায় হারিয়ে যায়। অবশেষে আরিকা সিদ্ধান্ত নেয়, সর্বপ্রথম সে পুলিশকে জানাবে। তারা এসে তদন্ত করে ডাঃ সোহানকে এরেস্ট করার পরে সবকিছু সে খুলে বলবে আতিক সাহেবকে। আরিকা আর কোনো জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চায় না।
ভাবামাত্রই আরিকা নিকটস্থ থানায় কল দিলো।
কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর একটা কন্ঠ ভেসে এলো,
-হ্যালো, আমি ইন্সপেক্টর মুরাদ বলছি।
ইন্সপেক্টর মুরাদের কন্ঠ শুনে আরিকা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। বিচলিত কন্ঠে আরিকা বলে,
-স্যার আমি আরিকা। এইমুহূর্তে আমাদের জন্য আপনার সাহায্যের খুব প্রয়োজন৷ আশা করি একটু সময় করে আমার সম্পূর্ণ কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।
ইন্সপেক্টর বলার অনুমতি দিতেই আরিকা দেরি না করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে গড়গড়িয়ে সব বলতে শুরু করলো।
আরিকার মুখে সব কথা শুনে ইন্সপেক্টর মুরাদ অনেক অবাক হয়। বিস্ময়কর স্বরে বলে ওঠেন ” এটা কি করে সম্ভব! ”
ইন্সপেক্টর মুরাদের প্রতিউত্তরে আরিকা বলে,
“অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। আমি চাই যত দ্রুত সম্ভব আপনারা ডাঃ সোহানের বিরুদ্ধে স্টেপ নিন। নাহলে বড় কোনো বিপদ হতে পারে শীঘ্রই। ”
ইন্সপেক্টর আরিকাকে জানান, হাতের কাজ শেষ করে খুব দ্রুত তিনি আরিকার সাথে যোগাযোগ করবেন।
.
.
.
রুম জুড়ে পায়চারি করতে করতে অপেক্ষার প্রহর গুনছে আরিকা। সবার সামনে ডাঃ সোহানের মুখোশ উন্মোচন না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না সে। ইন্সপেক্টরের ফোনের আশায় আরিকা মরিয়া হয়ে ওঠে।
প্রায় ঘন্টাখানেক পরে আরিকার ফোন বেজে ওঠে।
ফোনের স্ক্রিনে ইন্সপেক্টরের নাম্বার দেখে আরিকা দ্রুত রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরে,
-মিস আরিকা! আমি ইন্সপেক্টর মুরাদ বলছি।
ডাঃ সোহানের বিষয় নিয়ে আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আপনার কথা যদি সত্যি হয় আমরা বাসা সার্চ করলে হয়ত সব প্রমাণ পাবো কিন্তু সার্চ ওয়ারেন্টের জন্য আমাদের কিছু কাগজপত্রের দরকার হয়। শুধুমাত্র একটা ফোন কলের উপর ভিত্তি করে আমরা কারও উপর দোষারোপ করতে পারি না। আপনার কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে?
ইন্সপেক্টরের প্রশ্নের উত্তরে আরিকা তার ফোনে তোলা ছবিগুলোর কথা জানায়।
ইন্সপেক্টর আরিকাকে বলেন,
-আপনি যতো দ্রুত পারেন প্রমানগুলো নিয়ে আমার সাথে দেখা করুন। আমি চাচ্ছি আপনার এ সমস্যার দ্রুত কোনো সমাধান দিতে।
ইন্সপেক্টরের কথায় সম্মতি জানিয়ে আরিকা ফোন কেটে দেয়। দেরি না করে সে দ্রুত তৈরি হয়ে ইন্সপেক্টরের দেওয়া ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় ডাঃ সোহানের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে আরিকা মনে মনে বলে,
“খুব শীঘ্রই তোমার সব খেলার সমাপ্ত হতে চলেছে। নিজের চোখে নিজের শেষ দেখার প্রস্তুতি নাও ডাঃ সোহান ”
দোতলায় দাঁড়িয়ে বেশি সময় নষ্ট না করে দ্রুত বের হয়ে যায় আরিকা।
.
.
ছবিগুলো নিয়ে থানায় বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ও মুরাদের দেখা না পেয়ে আরিকা তাকে পুনরায় ফোন করে।ইনেস্পেক্টর মুরাদ জানায় এ এখন তার নিজের বাড়িতে অবস্থান করছে। যদি এ মুহুর্তে দেখা করতেই হয় তবে তার বাড়িতে যেতে হবে আরিকাকে। আরিকা যেতে সম্মত হলে
ইন্সপেক্টর মুরাদ তার নিজের বাড়ির ঠিকানা দেয়৷ ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে যায় আরিকা। সেখানে গিয়ে আরিকা বিশাল এক বাংলো দেখতে পায়। বাংলোর চারপাশ নানারকমের ফুলগাছ দিয়ে অনেক সুন্দর করে সাজানো। তবে এই মুহূর্তে কোনো সৌন্দর্যই মন কাড়ছে না আরিকার। তার মাথায় একটা বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছে, ডাঃ সোহানের শাস্তি।
বাংলোর সামনে গিয়ে আরিকা ইন্সপেক্টর মুরাদকে কল করে জানায় সে এসে গেছে। কিছুক্ষণ পরে একজন ৩৪-৩৫ বয়সী পুরুষ দরজা খুলে ইশারা করে ভেতরে ঢুকতে বলে। আরিকা বুঝতে পারে ইনি ই ইন্সপেক্টর মুরাদ। সে কিছু না বলে ইন্সপেক্টরকে অনুসরণ করে ভেতরে প্রবেশ করে।
বাংলোর ভেতরে ঢুকে আরিকা বেশ অবাক হয়ে যায়। বাইরের থেকে বাংলোটার ভেতরে আরও সুন্দর করে সাজানো। পুরো বাসাটা দামি দামি ঝাড়বাতির আলোয় চকচক করছে। যতদূর চোখ যায় সৌন্দর্যের কোনো অপূর্ণতা নেই। তবে এতোবড় বাংলোতে অন্য কোনো মানুষের সাড়াশব্দ পায় না আরিকা।
“আমার সাথে এসো”
– বলেন মুরাদ। সারিকা ইন্সপেক্টরকে অনুসরণ করতে শুরু করে।
ইন্সপেক্টর মুরাদ একটি দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দেওয়ালের সাথে টানানো একটা ঘড়ি সরিয়ে তার পেছনে লুকানো একটি সুইচ প্রেস করে। সুইচ প্রেস করতেই নিঃশব্দে দেওয়াল থেকে একটা দরজা খুলে যায়। আরিকা বুঝতে পারে সামনেই রয়েছে অন্ধকারময় বিরাট এক কামরা। সবকিছু দেখে অনেক অবাক হয় সে।
দেওয়ালের পেছনে এমন একটা কামরা থাকতে পারে এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। এমনকি দেওয়ালের সাথে যে দরজা যুক্ত আছে এটা বাইরের থেকে দেখে বুঝতে পারাটা একদমই অসম্ভব। কিন্তু ইন্সপেক্টর মুরাদ তাকে এই কামরায় কেন নিয়ে আসলো! নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন রাখলো আরিকা।
ইন্সপেক্টর মুরাদ একটু এগিয়ে একটা সুইচ চাপতেই লাল আলোয় পুরো কামরাটা আলোকিত হয়ে উঠলো। আরিকা কামরার ভেতরের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে।
সে দেখতে পেলো কামরাটার ভেতরে ডাঃ সোহানের বাসার মতো রয়েছে শত শত পুতুল। আরিকা বুঝতে পারলো তাড়াহুড়োর কারণে সে নিজের অজান্তেই খুব বড় বিপদে ফেঁসে গেছে।
.
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here