ইনসাইড দ্যা ডোর পর্ব ৪

0
2371

ইনসাইড দ্যা ডোর পর্ব ৪
সাইবা চৌধুরী

শাড়ী পড়ানো শেষে সুন্দর ভাবে খোঁপা করে বেলীফুলের মালাটা খোঁপায় জড়িয়ে দেয় সোহান। নীল চুড়িগুলো খুলে একটা একটা করে হাতে পড়িয়ে দেয়। কাটা হাতে চুড়ি পড়াতে গিয়ে দুচোখ পানিতে ভরে ওঠে সোহানের।
অভিমানের সুরে তাবিয়াকে বলে,
-তোমাকে দেখাশোনা করার জন্য এ বাসায় এতো মানুষ থাকা সত্তেও তোমার রুমের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনটা কি বলো তো?
তাবিয়া সোহানের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না।
সবকিছু পরিয়ে দেয়ার শেষে তাবিয়াকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় সোহান। তাবিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে।
” সবকিছু ঠিকঠাক শুধু একটা কমতি, তোমার কপালে ছোট্ট একটা টিপ। ”
নীল রঙের ছোট্ট একটা টিপ পড়িয়ে সোহান বলে,
“এখন তোমাকে পরিপূর্ণ লাগছে নীলপরি। আজ তোমাকে নিয়ে সুন্দর একটা জায়গায় ঘুরতে যাবো। বাসায় থেকে থেকে অনেক গম্ভীর হয়ে যাচ্ছো। তুমি একটু বসো আমি ঝটপট তৈরি হয়ে আসি।” তাবিয়াকে বিছানায় বসিয়ে রেখে ডাঃ সোহান ওয়াশরুমে চলে যায়।
অনুভূতিহীন হয়ে বসে থাকে তাবিয়া। বিছানায় বসে বসে নিজের কাছে প্রশ্ন রাখে, “ভালোবাসা খোঁজে তো কতো জনে , কিন্তু এমন অভিশপ্ত ভালোবাসা কি কেউ চায়? অভিশপ্ত ভালোবাসা কেন বলি!ভালোবাসা কি কখনো অভিশপ্ত হয়?
যেই ভালোবাসাকে অভিশপ্ত মনে হবে সেটা ভালোবাসা কিভাবে হয়? ”
আবারও কয়েকফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে তাবিয়ার।
.
.
.

তাবিয়া ব্যান্ডেজ করা হাতটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালো করে ঢেকে দেয়। বাসায় তালা দিয়ে তাবিয়াকে নিয়ে বাইরে পা বাড়ায় সোহান।
গেটের কাছে যেতেই একটা মেয়ের সাথে খুব জোরে ধাক্কা লাগে তাবিয়ার। ধাক্কা সামলে উঠতে না পেরে প্রায় পরেই যাচ্ছিলো তাবিয়া। সোহান দু’হাতে শক্ত করে জাপ্টে ধরে তাবিয়াকে। ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে তাবিয়া। সোহান প্রচন্ড রাগ নিয়ে ভয়ংকর অগ্নি দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকায়। কালো শার্ট ও টাইট জিন্সের প্যান্ট পরা মেয়েটি। চোখে কালো সানগ্লাস ও কাঁধে ঝোলানো ছোট একটা ব্যাগ। চুলগুলো ববকাট দেওয়া। সোহানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপরিচিত মেয়েটি সানগ্লাসটি খুলে হাতে নেয়। তার মাঝে কোনো ভয়ের প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।
নিজের ভুলের জন্য দুঃখিত জানাতে তাবিয়ার কাছে এগিয়ে যেতেই সোহান তাবিয়াকে নিজের আরো কাছে টেনে নিয়ে বিরক্তির দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটিও আর কিছু না বলে সোহানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিয়ে সানগ্লাসটি পড়ে ভেতরে চলে যায়।
.
.
.
.
চারতলার জানালা দিয়ে সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছিলেন সাহেরা বেগম। আরিকাকে আসতে দেখে সাহেরা বেগম খুব খুশি হন। আরিকা হলো সাহেরা বেগমের বান্ধবী জোহরা চৌধুরীর মেয়ে।
প্যারানরমাল কোনো ঘটনা ও রহস্যের পেছনে ছুটে বেড়ানোই তার কাজ। ইতিমধ্যে প্যারানরমাল বিষয়ক অনেক জ্ঞান ও সে অর্জন করেছে। আরিকার মতে , যেখানে পজিটিভ আছে সেখানেই নেগেটিভ অস্তিত্ব বিদ্যমান। দোতলার ওই বাসা নিয়ে বরাবরই বেশ চিন্তায় ছিলেন সাহেরা বেগম। ডাঃ সোহান আসার পর থেকে সবকিছু তার কাছে আরো বেশি অদ্ভুত লাগছে।তিনি এ সবকিছু আলোচনা করেন তার বান্ধবী জোহরা চৌধুরীর সাথে। তার কাছ থেকেই সবকিছু জানতে পারে আরিকা। পুরো বিষয়টির মাঝে অদ্ভুত এক রহস্যের গন্ধ পায় সে। সবকিছু শোনার পরে আরিকা নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে ছুটে চলে আসে রহস্যের টানে।
.
.
.
.
বাসায় ঢুকেই আরিকা সাহেরা বেগম ও আতিক সাহেবকে সালাম জানায়। আতিক সাহেবকে দেখে আরিকা দোতালার ঘটনার বিষয়ে কোনো কথা বাড়ায় না। সাহেরা বেগম আরিকাকে রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে বলে। আতিক সাহেবকে জানায়,
-“পাশেই একটা কাজে এসেছে আরিকা৷ জোহরা বললো আশেপাশে একটা হোটেলে থাকবে। আমাদের বাসা এতো কাছে থাকতে ও একটা হোটেলে থাকবে ব্যাপারটা কি ভালো দেখায় বলো? তাই আমি জোর করেই বললাম,কাজ শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকতে।”

“বাসা তো ফাঁকাই পড়ে থাকে। ও আসাতে তো ভালোই হলো। তোমার একাকিত্বটা একটু কমবে” সাহেরা বেগমকে কথাগুলো বলে এ বিষয়ে আর কোনো কথা বাড়ালো না আতিক সাহেব।
.
.
.
.
আসরের নামাজের জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলেন আতিক সাহেব। এই সুযোগে আরিকা সাহেরা বেগমের কাছে আসে।
“আন্টি আপনাকে যেটা বলেছিলাম মনে আছে? আমি যদি ভুল না হই, একটু আগেই হয়ত ডাঃ সোহান ও তার স্ত্রী বের হয়েছে। দেখে মনে হলো,হাতে বেশ সময় নিয়েই বের হয়েছে। ফিরতে অনেক সময় লাগবে তাদের। এটাই সুযোগ।
দোতলার ডুপ্লিকেট চাবিটা আমাকে দিন। আমি ফিরে আসা অব্দি জানালা দিয়ে গেটের দিকে লক্ষ্য রাখা আপনার কাজ।”
কথাগুলো বলে আরিকা হাঁপাতে থাকে৷ এবার একটু বেশিই এক্সাইটেড সে। সোহানের অগ্নিদৃষ্টিতে অনেক রহস্যের আনাগোনা দেখেছে আরিকা। যে করেই হোক ও যত দ্রুত সম্ভব এ রহস্যের শেষ পর্যন্ত যেতেই হবে তাকে।
সাহেরা বেগম দোতলার ডুপ্লিকেট চাবিটা আরিকার দিকে এগিয়ে দেয়। আরিকাও আর দেরি না করে ব্যাগ থেখে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
.
.
.
.
দোতলার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই একঝাঁক অন্ধকার এসে আরিকাকে জাপ্টে ধরে। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে দরজা ঠেলে দিয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে সে। দিনের বেলায়ও বাসা কতোটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে অল্প আলোর ছোট ছোট দু একটা লাল লাইট জ্বলছে। লাল লাইটের মৃদু আলো পরিবেশটাকে আরও বেশি ভয়ংকর করে তুলেছে। আরিকার ভেতরে অনেক উত্তেজনা কাজ করতে লাগলো। সে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো লিভিং রুমের দিকে। লিভিং রুমে ঢুকেই আরিকার বুকটা ধুক করে কেঁপে উঠলো। আরিকা দেখলো লিভিং রুমের সোফায় বসে আছে একজন বয়স্ক মহিলা। পড়নে সুন্দর একটা শাড়ী ও দামি দামি কিছু গহনা।
“কিন্তু আন্টি তো বলেছিলো এই বাসায় ডাঃ সোহান ও তার স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ থাকে না!” বিশাল এক দ্বিধায় পরে যায় আরিকা। কোনো নড়াচড়া ও শব্দ না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কিন্তু মহিলাটির মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখতে পায় না সে৷ পলকহীন চোখে একদিকে তাকিয়ে তখন থেকে একইভাবে বসে আছে। হঠাৎই আরিকার মনে পড়ে যায় সাহেরা বেগমের বলা সেই পুতুলের কথা যেগুলো দেখতে একদমই মানুষের মতো। আরিকা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তবে এনাকে দেখে কোনোভাবেই পুতুল মনে হচ্ছে না৷ বিষয়টা ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখতে আরিকা পুতুলটার কাছে এগিয়ে যায়। নাহ! এটা সত্যিই প্রাণ হীন।
কিন্তু এটাকে কাছ থেকে দেখে পুতুল বলা একদমই অসম্ভব। ভয়ে ভয়ে পুতুলটার চোখের দিকে টর্চের আলো ফেলে। আলো ফেলতেই আরিকার পুরো শরীর কাঁপতে থাকে। সে ভালো করেই বুঝতে পারে এটা কোনো সাধারণ পুতুল নয়। এটার চোখ কোনো পুতুলের চোখের মতো নয় চোখগুলো দেখতে জীবন্ত মানুষের মতো৷ আরিকা ভয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়। তবে ভয় পেয়ে থেমে থাকার মতো মেয়ে আরিকা নয়৷ এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত সে গিয়েই ছাড়বে এতে যত বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয় হোক।

আস্তে আস্তে আরিকা বাসার আরও ভেতরে প্রবেশ করে। সাহেরা বেগমের কথা অনুযায়ী বাসাতে দু’টো পুতুল থাকার কথা । কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় এমন পাঁচটি পুতুল সে দেখতে পায়।এর ভেতরে দুটো পুতুল মহিলাদের অবয়বে তৈরি।কিন্তু দুজনের চেহারা ভিন্ন। দ্বিতীয় মেয়ে পুতুলটা রান্নাঘরে দাঁড় করানো অবস্থায় দেখতে পায়। বাকি তিনটাই পুরুষ পুতুল। এর ভিতরে একটা বয়স্ক পুরুষ পুতুল হাতে নিউজ পেপার নিয়ে চেয়ারে বসে আছে। আরিকা সবচেয়ে অবাক হয় নিউজ পেপারটি দেখে। পেপারটি আজকে সকালেরই। দেখে মনে হচ্ছে পুতুলটি খুব মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়ছে।
আরেকটি পুতুল দেখে আরিকা শিউরে ওঠে।
২৬/২৭ বয়সী একটা ছেলের পুতুল। পুতুলটার শরীরে বিভিন্ন জায়গায় গভীরভাবে কাটার দাগ।
পুতুলটার দুটো চোখ নেই। দুহাতের ৪ টা আঙ্গুল কাটা।
বাকি একটি পুতুল হুবহু সুমনের মতো। আরিকা ধারণা করে এ পুতুলের সাথে হয়ত সুমনের লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার মাঝে কোনো না কোনো সংযোগ আছে। এই বাসাটা কেন এতো ভয়ংকর ভাবে রাখা হয়েছে! এভাবে সাজানোর পেছনে কারণটাই বা কি, তা জানতেই হবে আমাকে।
মনে মনে কথাগুলো বলে এগিয়ে যায় অন্য একটি রুমের দিকে। চারদিকে টর্চের আলো ফেলে বুঝতে পারে এটি বেডরুম। টর্চের আলো বিছানায় ফেলতেই আরও একবার কেঁপে ওঠে আরিকা। সে দেখতে পায়, তাজা রক্তে বিছানা ভিজে আছে। “কার হতে পারে এই রক্ত?”
নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন রাখে আরিকা।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৬:২৫ বেজে গেছে। এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবেনা।
তবে এ বাসায় অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে এখনো, যেগুলো একদিনে বের করা সম্ভব না। আরিকা সাথে করে আনা একটা স্পাই ক্যামেরা সতর্কতার সহিত বাসায় সেট করে দ্রুত বের হয়ে যায়। বাসা থেকে বের হয়ে আরিকা লম্বা একটা নিঃশ্বাস নেয়৷ সে লক্ষ্য করে এখনো তার পা দু’টো কাঁপছে। ঘামে ভিজে আছে পুরো শরীর।
.
.
.
.
সন্ধ্যা ৭:১৫।
ডাঃ সোহান, তাবিয়াকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সোহান থমকে দাঁড়ায়। তাবিয়াকে রুমে যেতে বলে গম্ভীর ভাবে লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সোফায় বসে থাকা পুতুলটার দিকে দৌড়ে চলে যায়। পুতুলটার পাশে বসে পুতুলের হাত ধরে বলে,
-তোমাদের বিরক্ত করতে আবার বাসায় কেউ এসেছিলো তাই না মা?
তুমি রাগ করো না, এতে তো ভালোই হলো তোমাদের মাঝে আরও একজন সদস্য বাড়তে চলেছে।
.
.
.
.
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here