ইফ্রিতে_মুসনাত(পর্ব-৬)

0
2134

ইফ্রিতে_মুসনাত(পর্ব-৬)
#আস্থা_রাহমান_শান্ত্বনা

অনেক ভেবেচিন্তেও আয়ানা কিছুতেই কূল-কিনারা পেলনা যে সাদের বাসায় মেয়েদের ওড়না আর কানের দুল কিভাবে এল! সাদ বিবাহিত বলেও মন মানতে চাচ্ছেনা আয়ানার। সে মনে মনে চিন্তা করল, মাহবুব ভাই তো সাদের ব্যাপারে অনেককিছুই জানেন। উনি নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, সাদ বিবাহিত কিনা!
এই ভেবে আয়ানা মাহবুবের রুমের দিকে গেল। এই ছেলেটার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে হয়না ওর, তাও আজ সাদের জন্য নিজে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাচ্ছে। এখন মাথা খারাপ না করলেই হয়। মাহবুব নিজের বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ফোনে গেইম খেলছে। দিনের অধিকাংশ সময় ই ফোনেই ব্যস্ত থাকে, উনি যে কিভাবে ব্যবসায় করে কে জানে! আয়ানা একটু জোরে গলা ঝাড়ল।
” আরেহ আয়ানা, হঠাৎ আমার রুমে!! এসো, ভিতরে এসো।”
“ধন্যবাদ। একা একা লাগছিল তাই গল্প করতে এলাম। এই বাড়িতে আসার পর তো আপনার সাথে তেমন কথা ই হলনা।”
মাহবুব একটা লজ্জার হাসি দিয়ে বলল, “তা অবশ্য ঠিক। আমি এতে খুব খুশি।”
আয়ানা দাত কটমট করে মনে মনে বলল, “সে তো হবি ই। আমার মাথা খাওয়ার ধান্দা থাকিস সারাক্ষণ।”
মাহবুবের দু একটা প্রশংসা করার পর আয়ানা বলল, ” আচ্ছা, মাহবুব ভাই। সাদ ভাই কি বিবাহিত?” আয়ানার এমন প্রশ্নে মাহবুব আচমকিত হয়ে আয়ানার দিকে তাকাল। তারপর বলল,
” হঠাৎ এই কথা?”
” না দেখি, সাদ ভাই পুরো বাসায় ই একা ভাড়া নিয়েছেন। বাসা থেকেও তেমন বের হননা। ”
” আরেহনা, ভাই এখনো বিয়ে করেনি। উনি কখন বের হন, ফিরেন সেটা কেউ টের পায়না। তাই তুমিও দেখোনি।”
সাদ বিয়ে করেনি শুনে আয়ানা কিছুটা আশ্বস্ত হল। এতক্ষণ যেন বিষাদে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আয়ানা “ওহ” বলে আবার জিজ্ঞেস করল,
” উনি কি বাসাটায় একা ই থাকেন?”
” হ্যা।” আয়ানা আর কথা বাড়ালনা। মায়ানকে ডাকার অযুহাতে মাহবুবের রুম থেকে বেরিয়ে আসল। মন থেকে একটা বোঝা আলগা হল, কিন্তু মস্তিষ্কে যে প্রশ্ন টা ঘুরছে সেটার সমাধান এখনো পেলনা। সাদ যেহেতু একা ই থাকে, তাহলে তার বাসায় কোনো মেয়ের ওড়না-কানের দুল আসবে কোথা থেকে!! কি জানি, এটা নিয়ে যত ভাবছে ততই মাথা বিগড়ে যাচ্ছে।
” আপনি এত রাতে এখানে কেন?”
” আপনার জন্য।”
সাদ অবাক হয়ে আয়ানার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটু কৌতূহল নিয়ে বলল, ” আমার জন্য কেন?”
” আপনার দেখা পাইনি দুদিন ধরে। দিনে কয়েকবার এসে ফিরে গেলাম আপনি বাসায় ই থাকেননা। দেখা না পেয়ে মনটা ছটফট করছিল। তাই সন্ধ্যা থেকে আপনার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি কখন আপনি ফিরবেন সেই আশায়।”
সাদ পকেট থেকে ফোন বের করে টাইমটা দেখে নিল, ১১টা বেজে ২০ মিনিট।
আজ সে হালকা আকাশী রঙ্গের শার্ট পড়েছে, শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো। সাথে অফ-হোয়াইট গেভাডিং প্যান্ট। চোখ বড় গোল ফ্রেমের কাচের চশমা, চশমায় চোখের সৌন্দর্য ঢাকা পড়লেও তার সৌন্দর্য আজ অনেক বেশী ই বেড়ে গেছে। সাদ আয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল,
” এসব কি পাগলামী? আপনি এতক্ষণ বাসায় বাহিরে, আপনার বাসার মানুষ কিছু বলেনি! আমি তো আপনাকে অপেক্ষা করতে বলিনি।”
আয়ানা সাদের হালকা বকা খেয়ে চুপ করে রইল। ছেলেটার বকা ও ভাল্লাগে, এইদিকে আকাশের অবস্থা ও ভালনা। কেমন জানি গুমোট ভাব, থেকে থেকে ভীষণ বাতাস বয়ছে। পাহাড়ী অঞ্চলে শীতকালেও বৃষ্টির দেখা মেলে বটে।
সাদ আয়ানার চুপ থাকা দেখে বলল,
” বাসায় যান, এক্ষুণি বৃষ্টি নামতে পারে।”
” বাসায় কেউ নেই, আমার একা একা ভয় করছে।”
” সবাই কোথায়?”
” মাহবুব ভাই শহরের বাহিরে গেছে সকালে। আর আন্টির শরীর খারাপটা খুব বেড়েছে, তাই আপু তাড়াহুড়ো করে তাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছে। আমিও যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপু এত দৌড়ঝাপের মধ্যে নিয়ে যেতে চাইলনা।
মায়ান খুব কান্না করছিল তাই বাধ্য হয়ে তাকেও সাথে নিয়ে গেছে।
আমি আগে কখনোই একা বাসায় থাকিনি, তাই ভীষণ ভয় ভয় লাগছে।”
সাদ কন্ঠ কিছুটা নরম করে বলল, “আচ্ছা চলুন, আমি আপনার সাথে বাসায় যাচ্ছি। খালাম্মারা ফেরা অবধি আমি আপনার সাথে আছি।”
আয়ানা ভাবতেই পারেনি সাদ তাকে সঙ্গ দিবে। তাই মনে মনে সে খুব উৎফুল্ল বোধ করল। তবে সত্যি এটাই তার একা বাসায় ভীষণ ভয় লাগছিল, যদি জ্বীনটা আবার তার কাছে আসে।
আয়ানার পিছু পিছু সাদ মাহমুদের বাসায় ঢুকল। সাদকে সোফায় বসতে বলে আয়ানা বলল, ” আপনি নিশ্চয়ই ডিনার করেননি?”
” আমার ক্ষুধা নেই, ধন্যবাদ।”
” তাহলে চা দিই?”
” উম, দিতে পারেন। চিনি ২ চামচ দিবেন।”
আয়ানা রান্নাঘরে এসে চায়ের পানি বসাল। পানি গরম হতে হতে সে ভাবতে লাগল, “সাদের প্রতি এত অনুভূতি-টানের কারণ আয়ানা এখন বুঝতে পারছে। সাদ কে ২ দিন না দেখে সে পাগল হয়ে গিয়েছিল, মনটা ভীষণ আনচান করেছিল শুধুমাত্র একবার সাদের দেখা পাওয়ার জন্য। কখন যে নিজের অজান্তেই সে সাদ কে ভালোবেসে ফেলেছে সেটা সে নিজেও টের পায়নি।”
আচ্ছা সাদ কি তার এসব পাগলামীর কারণ বুঝতে পারে? বুঝতে পারে সাদকে একপলক দেখার জন্য আয়ানা কতটা ব্যাকুল হয়ে থাকে? বুঝতে পারুক আর না পারুক মনের কথাটা সাদকে জানানোর জন্য আয়ানার অধীর হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, এই কথাটা না বলতে পারলে সে ভিতরে ভিতরে গুমরে মরবে। আচ্ছা আজ যদি সাদকে মনের কথাটা জানাই, ও উত্তরে কি বলবে!!
সাদের মনের ভিতরের অনুভূতি দূরে থাক সাদের বাহিরের দিকটাও আজ পর্যন্ত আয়ানা বুঝতে পারলনা। সাদ কি তাকে পছন্দ করে নাকি আদৌ করেনা সেটাও আয়ানা উপলব্ধি করতে পারলনা। এত চাপা স্বভাবের কোনো মানুষ হয়!
ভাবতে ভাবতে চা বানিয়ে নিয়ে আসল আয়ানা। সাদের হাতে চা দিয়ে পাশে বসল আয়ানা। সাদ একচুমুক দিতেই মুখের মানচিত্র চেঞ্জ হয়ে গেল তার। কিন্তু মূহুর্তেই তা স্বাভাবিক করে নিয়ে পুরো চা টা শেষ করল। তারপর আয়ানাকে জিজ্ঞেস করল, ” আপনি এখনো রান্না জানেন না তাইনা!”
কথা শুনে আয়ানার বুঝতে বাকি রইলনা সাদের মুখের অবস্থা তখন ওরকম হয়ে গেল কেন! কোনোরকম আমতা আমতা করে বলল,
” না, এখনো ঠিকমত শিখা হয়নি তো।”
সাদ আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেল। আয়ানার ভীষণ অভিমান হল, এই মানুষটা চুপ মেরে গেলে ওর আর একটু ভালোলাগেনা। যতক্ষণ কথা বলে, মুচকি মুচকি হাসে ততক্ষণ ই অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে আয়ানার। এমনসময় তীব্রগতিতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, সেই সাথে লোডশেডিং। জানালার পাল্লাগুলো বাতাসে জোরে জোরে দাপাদাপি করতে লাগল, জানালা বন্ধ করতে ছুটে গেল আয়ানা। বাতাসের গতির জন্য জানালা আটকাতে বেগ পেতে হচ্ছে তার। এক পাল্লা আটকালে অন্য টা ছুটে যাচ্ছে, এই ছোটাছুটির খেলাতে আয়ানার গায়ে বৃষ্টির ছাট পড়ে সে ভিজে যাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে সাদ ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ছুটে এল। আয়ানাকে একটু সাইডে সরিয়ে সে জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আয়ানা নিজের ভেজা ওড়না ঝাড়তে ঝাড়তে রুমের দিকে তাকাতেই অন্ধকারে জ্বলজ্বল করা লাল বর্ণের দুটো চোখ স্পষ্ট দেখতে পেল। ভয়ে চিৎকার করে সাদকে জড়িয়ে ধরল আয়ানা। সাদ একটু ঝটকা খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” কি হয়েছে আপনার?”
” ওখানে লাল বর্ণের দুটো চোখ জ্বলজ্বল করতে দেখলাম।”
সাদ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে পুরো রুমটা দেখে নিয়ে বলল,
” এখানে এমন কিছুই নেই। এটা হয়ত আপনার মনের ভুল।”
” নাহ, আমার খুব ভয় লাগছে। প্লীজ আমাকে ছাড়বেননা।”
” আচ্ছা আচ্ছা। আপনি মাথার সামনের দিকটা মুছে নিন। বৃষ্টির ছাট পড়ে ভিজে গেছে, ঠান্ডা লেগে যাবে নয়ত।”
” উহু, আমি এখন কিছুতেই আপনাকে ছাড়বনা। ছাড়লেই আপনি সরিয়ে যাবেন, আর অন্য কেউ আমার উপরে ঝাপিয়ে পড়বে।”
সাদ আর কিছু বললনা। হয়ত সে বুঝতে পেরেছে আয়ানা সিরিয়াসভাবেই ভয় পেয়েছে। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে সে আস্তে আস্তে ঘষে আয়ানার মাথা মুছে দিতে লাগল। আয়ানা পরমশান্তিতে সাদের বুকে নাক ডুবিয়ে আছে, ভীষণ উষ্ণ আর নরম একটা জায়গা পেয়ে ওর অনেক আরাম লাগছে। সাদের শরীর থেকে একটা মাতাল করা সুঘ্রাণ আসছে, যেটা পৃথিবীর যেকোনো বিখ্যাত পারফিউমের ঘ্রাণ কে হারিয়ে দিতে পারে।
আয়ানা সাদকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পরমশান্তিতে চোখ বুজে ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,
” আচ্ছা সাদ, আপনি কি কিছুই বুঝেননা?”
” আপনি কিসের কথা বলছেন আয়ানা?
” এত অবুঝ কেউ হয়? আপনি বুঝেননা আমার মনের কথা? আমি আপনাকে কতটা চাই। আপনার জ্বলজ্বল করা অদ্ভুত চোখগুলো আমাকে ভীষণ টানে। জানেন, আপনাকে একপলক দেখার জন্য আমি কতটা ব্যাকুল হয়ে থাকি!
আপনার জন্য আমার কত-শত অনুভূতি কাজ করে।
আপনার শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণ শুকলেই আমি অন্য জগতে হারিয়ে যাই।”
সাদের মুখ থেকে প্রতিউত্তর শোনার জন্য আয়ানা একটু থামল। কিন্তু কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর ও যখন সাদ কিছু বললনা। আয়ানা সাদের জ্বলজ্বল করা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ” সাদ! আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। অনেক নাহ অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি।”
কথাটা শুনে সাদ তার বুকের কাছ থেকে আয়ানাকে সরিয়ে ফেলল। আয়ানা অবাক হয়ে সাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তখন ই বিদ্যুত চলে এল।
আয়ানা একটু লজ্জা পেল আবেগাপ্লুত হয়ে সাদকে সে নিজের মনের কথাগুলো বলে ফেলেছে। কিন্তু সাদ এখনো কিছু বলছেনা কেন!!
আয়ানা একদৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকিয়ে রইল। সাদ একটু কপাল কুচকে বলল,
“দুদিন একটা ছেলেকে দেখলেন, ভালোলাগল আর সেটাই আপনি ভালোবাসা ভেবে নিলেন। পাগলামির এক পর্যায় থাকে সেটা আপনি ওভারকাম করছেন। আপনার এই ভালোলাগায় আমি সায় দিতে পারলামনা।
আমার পক্ষে সম্ভব না আপনার পাগলামীগুলো প্রশ্রয় দেওয়া। এই অবধি আপনি যা যা করেছেন, তা আপনার বাচ্চামী ভেবে মেনে নিয়েছি। তার মানে এটা না যে আমি এইগুলো উপভোগ করছি, সত্যি বলতে আপনার এসবে আমি খুব ই বিরক্তবোধ করছি।
ভদ্রতার খাতিরে আপনাকে এতদিন আমি কিছু বলিনি, কিন্তু আপনি সেই ভদ্রতার মূল্যায়ন করলেননা। দয়া করে, এই ধরণের চিন্তাভাবনা কিংবা মানসিকতা নিয়ে আমার কাছে আসবেননা। অনেক হয়েছে, এসব পাগলামী বন্ধ করুন। আপনার ফ্যামিলি মেম্বার এসব জানলে তাদের কাছে আমি কতটা ছোট হব আপনি বুঝতে পারছেননা। আমার আর কিছুই বলার নেই। আশা করি আমার কথাগুলো বুঝতে পারবেন। আমি আসছি।”
বলে সাদ বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। আয়ানা যে অবস্থাতে ছিল সেই অবস্থায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ওর চোখে পানি টলমল করছে। সাদ যে ওকে এভাবে বলবে বা সাদের মনে তার জন্য বিরক্তি জন্ম নিয়েছে সেটা আয়ানা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। আয়ানা এসব কথা সাদকে বলতে চায়নি, কিন্তু তখন কিসের মোহে আবেগাপ্লুত হয়ে কখন এসব বলে ফেলেছে সে নিজেও জানেনা।
খুব কান্না পাচ্ছে তার, সেইসাথে ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের উপর। তার আগেই বুঝা উচিত ছিল সাদ তাকে অপছন্দ করে, তার এসব পাগলামীতে সে খুবই অস্বস্তিবোধ করে। মেঝেতে বসে অনেকক্ষণ কাদল আয়ানা, সে কখনোই ভাবতে পারেনি সাদ তাকে এভাবে কঠিনস্বরে কিছু বলতে পারে। এর জন্য দায়ী সে নিজেই। না, সে আর কখনোই সাদকে বিরক্ত করবেনা।
.
আয়ানা সিএনজি থেকে নেমে বাসার গেইটের সামনে দাড়াল। অনেকদিন বাড়ি থেকে দূরে ছিল, তাই এখন একটু প্রশান্তি অনুভব করছে। ঘটনার পরেরদিন আয়ানা সায়মাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলে। সায়মা বারবার জিজ্ঞেস করল যে, “আয়ানা হঠাৎ এভাবে কেন ফিরে যেতে চায়?” আয়ানা ভালোলাগছেনা, বাড়ীর কথা মনে পড়ছে এসব বলে কাটিয়ে নিয়েছিল।
সত্যি বলতে, আয়ানা সেখানে আর থাকতে চাচ্ছিলনা। সেখানে থাকলে সে সাদের সামনে পড়ে যাবে কিংবা সাদকে দেখার জন্য মন ছটফট করবে। তাই সে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিল। এখন সে আর সাদের বিরক্তির কারণ হবে। সে ভাল থাকলেই আয়ানা খুশি। আর ভালোবাসা টা তার মনে জন্ম নিয়েছে, সেটা মনের এক কোণেই চাপা পড়ে থাকুক। কখনো কেউ আর এই ভালোবাসার কথা জানবেনা। অন্তত এতে সাদ আর সে দুজনেই শান্তি পাবে। অনেকদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে আয়মান শাফি আর সালমা আরা ভীষণ আনন্দিত। সবচেয়ে বড় কথা হল, আয়ানা আগের মত স্বাভাবিক আচরণ করছে। যাতে দুজনেই স্বস্তিবোধ করছেন। এইবার মেয়েটার একটা গতি করে দিতে পারলেই হয়। আয়ানাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় উনাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছিল।
আয়ানা নিজের রুমের ভিতর বসে উদাসমনে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিল।
এমনসময় আয়ানার বাবা আয়মান শাফি এসে বললেন,
” আয়ানা মা।”
আয়ানা নিজের ভাবনা ভেঙ্গে জানালার পাশ থেকে উঠে এসে আব্বুর দিকে মুচকি হেসে বলল, ” হ্যা, আব্বু! আসো ভিতরে আসো।”
” তোর কি মন খারাপ?”
” না আব্বু। একটু বোরিং ফিল করছিলাম।”
” সায়মার ওখানে আরো কয়েকটা দিন থেকে এলেই পারত। সায়মা তো আমাকে জানাল ও কত করে তোকে আর কয়টা দিন থেকে যেতে বলল। তুই ই জেদ ধরে চলে এলি! ওখানে কি খারাপ লাগছিল!”
“না আব্বু তেমন কিছু না। তোমাদেরকে খুব মিস করছিলাম।”
“পাগলী মেয়ে আমার। একটা কথা বলতে এসেছিলাম, সেদিন যে তোকে একটা পাত্রের ব্যাপারে বলেছিলাম। ওরা আজ বিকালে তোকে দেখতে আসবে, সেই সাথে বিয়ের দিনতারিখ ও ঠিক করবে।তোর কি এই ব্যাপারে কিছু বলার আছে?”
আয়ানা শুকনো মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “না আব্বু, তোমরা যা ভাল বুঝো।”
এসবে বাধা দেওয়ার কোনো মানসিকতা আর নেই আয়ানা। যা হচ্ছে হোক, হওয়া ই উচিত। কোনোকিছুতেই ওর আর কিছু বলার ইচ্ছে নেই।
.
সাদ খাম থেকে সাদা কাগজটা বের করল। সাথে একটা জমকালো বিয়ের কার্ড ও ছিল। বিয়ের কার্ডটা খুলে দেখল তাতে আয়ানার বিয়ের তারিখ-স্থান আর আমন্ত্রণ পত্র রয়েছে। বিয়ের কার্ড টা পাশে রেখে চিঠিটা খুলল সাদ। কাচা হাতে কিছু লেখা আছে।

রেদওয়ান সাদ,
আসসালামু আলাইকুম। আশা করি অনেক ভাল আছেন। অবাক হচ্ছেন তাই না! বিরক্তিকর মেয়েটা হঠাৎ চিঠি দিল কেন?
আসলে এসব আপনাকে ফোন করেও বলা যেত। কিন্তু আপনাকে বিরক্ত করার ইচ্ছেটা জাগেনি, তাই ক্ষুদ্র চিঠি লেখে পাঠালাম।

২২তারিখে আমার বিয়ে। আমার খুব সাধ, একজন শুভাকাঙখী হিসেবে এই দিনে আপনি আমার পাশে থাকুন। সশরীরে উপস্থিত হয়ে আমাকে দোয়া করে যান। এটা আপনার নিকট আমার বিনীত আর্জি। আশা করি, দ্বিতীয়বারের মত ফেরাবেননা।
চিঠির ভাষা বড় করে আর বিরক্তির কারণ হলামনা।
ইতি
আয়ানা
সাদ কিছুক্ষণ চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে রইল। তারপর দুমড়ে-মুচড়ে বিয়ের কার্ডটা সহ ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিল।
এই বিয়েটাতে আয়ানার আগের মত কোনো উচ্ছ্বাস নেই, কেমন মূর্তির মত নতমুখে সব নিয়ম পালন করছে। এখন তাকে মিলে সবাই সাজাচ্ছে, কেউ কেউ মজার মজার কথা বলে টিপ্পনী কাটছে। আগের মত তাকে লাল বেনারসি শাড়ী, গাভর্তি গয়না, খোপায় লালগোলাপ গুজে, হাতভর্তি লাল টকটকে মেহেদী দিয়ে রাঙ্গানো হয়েছে। তবে আগের থেকে আজকের সাজে তাকে বড্ড অসাধারণ লাগছে। সন্ধ্যা নামলেই বিয়ে পড়ানো হবে।
আয়ানার মা এসে কয়েকবার তাড়া দিয়ে গেল তাড়াতাড়ি সাজ শেষ করার জন্য। বর এসে পড়বে। আয়ানার মাথায় শুধু একটা ভাবনা ই ঘুরপাক খাচ্ছে, সাদ কি তার বিয়েতে আসবে! নাকি প্রতিবারের মত বিরক্ত হয়ে চিঠিটার স্থান দিয়েছে ডাস্টবিনে! আজ নিয়নের কথা খুব মনে পড়ছে আয়ানার। নিয়নের প্রতিও তো তার ভালোলাগা ছিল, কিন্তু তা তো কখনোই তেমন তীব্র ছিলনা সাদের প্রতি তার যেমনটা রয়েছে। নিয়ন কে সে দুইমাসের অধিক সময় ধরে চিনত, আর সাদকে চিনে ১৩-১৪দিনের মত। তাহলে এটাকে সে কেন ভালোবাসা হিসেবে নিবেনা! তার বড্ড ভুল হয়েছে সাদকে ভালোবাসাটা। নিয়ন চলে যাওয়ার পর সে যেমন কঠোর হয়েছিল আর কখনো এসব নিয়ে ভাববেনা, তেমন কঠোর থাকলে সাদের প্রতি এত দূর্বল হতে পারতনা।
বাহিরে থেকে শোরগোল শোনা গেল, “বর এসেছে, বর এসেছে”
আয়ানা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাদ বোধহয় আসবেনা, আয়ানাকে সে তার স্মৃতি থেকে উপড়ে ফেলতে চায়। তাই আর আয়ানার মুখোমুখি সে হবেনা।

“এই আয়ানা, তুই এভাবে ঘুমাচ্ছিস কেন?”
সায়মার ডাকে আয়ানা ঘুমোঘুমো চোখ মেলে উঠে বসল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেটা ও টের পেলনা। বিয়ের দিনে এভাবে ঘুমাচ্ছে ভেবে একটু লজ্জা লাগল তার। আয়ানা সায়মাকে জিজ্ঞেস করল,
” কি হয়েছে আপু?”
” কাজী সাহেব এসেছেন তোর সম্মতি নিতে”
” এত দেরীতে!”
” বিয়ের আগে বরপক্ষকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল তাই দেরী করল। কাজী সাহেব আপনি শুরু করুন।”
” আপনি কি এই বিয়েতে সম্মত? রাজি থাকলে ৩বার কবুল বলুন।”
কবুল বলতে আয়ানার ঠোট কাপসে। বলতে গিয়েও কেন জানি সে পারছেনা! মনে হচ্ছে বুকের ভিতরে হাতুড়ি পিটাচ্ছে কেউ, খুব কষ্ট হচ্ছে তার। সায়মা তাড়া দিল, কিরে বল! ১ বার বললেও হবে।
অনেকটা সময় নিয়ে বহুকষ্টে আয়ানা কবুল বলতে সক্ষম হল। সাথে সাথে ওর চোখে টলমল করা পানি গাল বেয়ে নেমে এল। সায়মা চলে যেতে গেলে আয়ানা তার হাত চেপে কাদো কাদো গলায় বলল,
” আপু কেউ কি আমার খোজে এসেছিল? আমার পরিচয় দিয়ে!”
” কই না তো। বিয়েতে শুধু আমাদের পরিচিতরাই এসেছে। আব্বু ছোট্টভাবে সারছেন বিয়েটা। জানিস ই তো, আগের ঘটনা নিয়ে অনেক কানাঘুষা হচ্ছে।”
তুই বস, আমি ওদিকটা দেখে আসি।”
আয়ানা চুপ করে বসে রইল। সত্যিই সাদ এলনা, আর আয়ানাও আজ অন্য কারো হয়ে গেছে। চাইলেও সাদকে আর সবটুকু দিয়ে ভালবাসতে পারবেনা। কিছু ভালাবাসা অপূর্ণতায় ই চাপা পড়ে যায়…
আজকের পর থেকে আয়ানাও এই অপূর্ণতার ডায়েরীর পাতা উলটাবেনা। সাদকে চিরদিনের জন্য মন থেকে মুছে ফেলবে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here