ইফ্রিতে_মুসনাত পর্ব- ১৫

1
5057

ইফ্রিতে_মুসনাত
পর্ব- ১৫
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আয়ানা খুব ই আঘাত পেল মুহসীনের কথায়। অনেকক্ষণ মেঝেতে বসে চিৎকার করে কাদল। চোখের পানি ফেলে ভাবতে লাগল, আজ যদি আয়াশ ওর সন্তান হত, কেউ কি এভাবে কথা শুনিয়ে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারত! আল্লাহ কেন যে ওর থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে ওকে নিঃস্ব রেখে দিয়েছেন? না পেল স্বামীর সাথে সংসার করার সুখ না নিজের বাচ্চার মুখে মা ডাক শোনার সুযোগ। কেউ বিশ্বাস করেনা সে একটি জীবিত সন্তান জন্ম দিয়েছিল, নারী অবয়ব তার বাচ্চাটিকে নিয়ে চলে গেছে। ডাক্তার সবাইকে বলেছে ও মৃত সন্তান প্রসব করেছে। কিন্তু ডাক্তার এমন মিথ্যা কথা কেন বলল! সে তো নিজের কানে বাচ্চার কান্না শুনেছে, শরীর অবশ করা হয়েছিল কিন্তু ওর মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ সচল ছিল। কে এমন নিষ্ঠুর কাজ টা করেছে, সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তান কে তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিল! আয়ানা এসব ভেবে কোনো উত্তর ই মিলাতে পারলনা। তার জীবনটা যেন এক রহস্যময় গোলকধাধায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
দুইদিন হয়ে গেল, আয়ানার কাছে আয়াশ আর আসেনা। এই বিকেল সময়টা আয়ানার প্রচন্ড খারাপ লাগে, আয়াশকে কাছে পেতে ইচ্ছে হয়। কয়েকবার আয়াশের বাসার দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে আসে শুধু ওকে একনজর দেখার জন্য। কিন্তু দেখতে পায়না, দরজায় নক দেওয়ার ও সাহস হয়না। দরজার সামনে ঘুরতে গিয়ে মুহসীন সামি তাকে দেখে ফেলে।
” আপনি এখানে?” আয়ানা আমতা আমতা করে বলল,
” আয়াশকে একবার দেখতে এসেছিলাম।”
” আয়াশ বোধহয় ঘুমাচ্ছে।”
” প্লীজ একটিবার ওকে দেখতে দিবেন। আমি একবার দেখেই চলে যাব।”
মুহসীন সামি আয়ানার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “আসুন ভিতরে।”
” অসংখ্য ধন্যবাদ।”
আয়ানা রুমের ভেতরে ঢুকে দেখে আয়াশ তার দেওয়া চকোলেটস এর বক্সটা আকড়ে ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আয়ানা আয়াশের মাথার পাশে গিয়ে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে আয়াশের হাতে-গালে কয়েকবার চুমু খায়। ভীষণ ইচ্ছে করছিল তার, আয়াশ কে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে। মুহসীন সামি বলল,
” আপনার দেখা শেষ?” আয়ানা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
” জ্বী। আমি এবার আসি।”
” আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। ড্রয়িংরুমে চলুন, চা খেতে খেতে বলা যাক।”
আয়ানা আরেকবার আয়াশের দিকে তাকায়। কপালে চুমু খায়, সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে মুহসীনের পিছনে পিছনে ড্রয়িংরুমে আসে। পুরো ঘর জুড়ে একটা চেনা মিষ্টি গন্ধ পায় আয়ানা। এই গন্ধটা ওর খুব পরিচিত, এই গন্ধের মোহে সে হারিয়ে যেত। সোফায় বসতেই বাসার হেল্পিং হ্যান্ড দুইকাপ চা দিয়ে যায়।
“আপনি কি বিবাহিত?”
মুহসীন সামির কথায় আয়ানা চমকে উঠে। তারপর বলে,
” জ্বী।”
” ওহ। আপনি নিশ্চয়ই এটা জানেন, কারো বাচ্চাকে মা-বাবার অনুমতি ছাড়া নিজের কাছে এভাবে রাখা উচিত নয়।”
” জানি। কিন্তু আয়াশ আমার কাছে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, আমিও ওর সাথে থাকলে খুব ভাল থাকি। নিজের সন্তানের মত ভালোবাসি ওকে।”
” নিজের সন্তান আর অন্যের সন্তানের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শিখুন মিসেস. আয়ানা। বুঝলাম, আয়াশ আপনার কাছে যায়, মিশে। এমনিতে আপনাকে আমরা কেউ ঠিকমত চিনিনা, ওর যদি কোনোরকম কিছু হয় তার দায় কি আপনি নিবেন! আমার ছেলে অনেক সেনসিটিভ। ওর সবকিছুই আলাদা ধাচের। ওর কোনো কিছুতে ব্যতিক্রম হলে ওর ওভাররিয়েকশান গুলো আপনি নিতে পারবেননা। তাছাড়া, আমি বাহিরের মানুষ ভরসা করতে পারিনা। এইজন্য আমি চাইনা, আয়াশ আপনার সাথে খুব বেশী মিশুক।”
কথাগুলো শুনে আয়ানার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। তাও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আয়াশের মা কোথায়?”
” আপনাকে আমি পারসোনাল ব্যাপারে অবগত করতে বাধ্য নই। আপনি এখন আসতে পারেন, আর আশা করি কখনো আয়াশের সাথে মিশতে আসবেননা।
নিজের সংসার নিয়ে সুখে থাকুন।”
আয়ানা কিছু না বলে চলে এল। আয়ানার ব্যাপারে সবটা জানলে এভাবে হার্ট করে লোকটা কথা বলতে পারতনাম। আয়ানার রুমে এসে সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিল। আসলেই আজ যদি ওর নিজের সংসার থাকত, তাহলে ওকে কেউ এভাবে অপমান করতে পারত। লোকটার ধারণা, আয়ানা নিজের সংসার থেকে উনার সন্তানের প্রতি বেশী আকৃষ্ট। তাকে কি করে বোঝাবে আয়ানা! আয়াশকে সত্যিই ও নিজের থেকে বেশী ভালোবেসে ফেলেছে। আয়ানা নিজের মন শক্ত করে নিল, যেহেতু আয়াশের বাবা চায়না আয়ানা আয়াশের সাথে মিশুক সেহেতু আয়ানা নিজেকে আয়াশের থেকে দূরে রাখবে।
আয়ানা অফিসে যাওয়ার সময় খেয়াল করল আয়াশ তাকে ডাকতে ডাকতে পিছু আসছে। আয়ানা সেটাকে পাত্তা না দিয়ে চলে এল। যদিও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কিছুই করার নেই। অফিস থেকে ফিরে এসে যেই ভিতরে ঢুকতে যাবে, দেখে আয়াশ তার ফ্লোর ম্যাটের উপর শুয়ে আছে। আয়াশকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি এখানে শুয়ে আছো কেন আয়াশ?”
” আন্টি তুমি আজ আসতে এত দেরী করলে কেন? তোমার অপেক্ষা করতে করতে আমি এখানে ঘুমিয়ে ই পড়েছিলাম।”
আয়ানা আয়াশকে বুকে টেনে নিল। কেন জানি তার মনে হচ্ছে আয়াশ ওর নিজের ছেলে। আয়ানা তার নিজের মা।
.
আয়ানা আয়াশের মাথার পাশে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর জলপট্টি দিচ্ছে। আয়াশ জ্বরের ঘোরে আয়ানাকে “আম্মু আম্মু” বলে জড়িয়ে ধরছে। সেদিন আয়াশকে তার বাবা জোর করে আবার নিয়ে চলে যায়। আয়ানাকেও অনেক কিছু বলে অপমান করে। সেই জের ধরে আয়ানা কিছুদিন আয়াশের মুখোমুখি হয়নি, খুব সকালে বেরিয়ে যেত আর রাতে ফিরত। আজ অফিস থেকে ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল, এমন সময় কলিংবেল এর আওয়াজে উঠতে হল। দরজা খুলতেই দেখে মুহসীন সামি কাদো কাদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে, ” আয়াশ হঠাৎ কেমন জানি করছে। ডাক্তার আসতে সময় লাগবে।”
আয়াশের কথা শুনে আয়ানা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি, আয়াশের কাছে ছুটে আসে। এসে দেখে ছেলেটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, ছটফট করছে খুব।
মুহসীন সামি দরজায় টোকা দেওয়ায় আয়ানার ভাবনায় ছেদ পড়ল।
” আসুন।”
” আয়াশের এখন কি অবস্থা?”
” জ্বর অনেকটা কমেছে। জেগে গেলে কিছু খাইয়ে তারপর মেডিসিন দিতে হবে।”
” দুঃখিত আপনাকে এতরাতে বিরক্ত করার জন্য। আসলে আমার মাথা কাজ করছিলনা, হেল্পিং হ্যান্ড ও আজকে ছুটিতে আছে। ডাক্তারকেও কলে পাওয়া যাচ্ছিলনা। আয়াশের অবস্থা যদি এখন ভালো পর্যায়ে থাকে আপনি যেতে পারেন অসুবিধা নেই।”
আয়ানা ছলছল চোখে ধরাগলায় বলল, “আজ রাত টা আমি আয়াশের কাছে থাকি? প্লীজ না করবেননা।”
মুহসীন সামি একটু চুপ থেকে চলে গেল।
হঠাৎ আয়ানার মনে হল খুব ঠান্ডা একটা হাত তার গলা চেপে ধরেছে। আয়ানা কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা, তাও মনে হচ্ছে কেউ তার গলা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। কারো ক্রোধমিশ্রিত নিঃশ্বাস তার গায়ে পড়ছে। আয়ানা দোয়া পড়তে গেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেয়। আয়ানা তক্ষুনি মেঝেতে পড়ে যায়। খেয়াল করে একটা ভারী ফুলদানি শুণ্যে ভেসে ভেসে তার মাথা বরাবর আসছে। আয়ানার মাথা বরাবর পড়ার আগে সে গড়াগড়ি দিয়ে সরে যায়, আর ফুলদানি মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক টুকরো ছিটকে এসে আয়ানার গাল বরাবর ঢুকে যায়। যন্ত্রণায় কোকড়িয়ে উঠে আয়ানা।
সাথে সাথে আবার জোরে গলা চেপে ধরে কেউ। আয়ানার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। ঠিক তক্ষুণি লাল লাল দুটো চোখ দৃশ্যমান হল। আয়ানা হতবাক হয়ে বলল, “সাদ!!”
একটা নারী কন্ঠের হাসির আওয়াজে পুরো ঘর কেপে উঠল। মুহসীন সামি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আয়ানাকে মেঝে থেকে উঠায়।
” এসব কি হচ্ছে? তুমি ওকে মারছো কেন!”
সাথে সাথে একটা ভয়ংকর মুখশ্রীর নারী দৃশ্যমান হল। যার মুখটা দুইপাশে কান পর্যন্ত ছিড়ে আছে। মাথায় একপাশে ঘিলু বের হয়ে আছে, সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। আয়ানা ভয়ে মুহসীনের টি-শার্ট চেপে ধরে।
ভয়ংকর গলায় নারীটি বলল, “আমার বাচ্চাকে যে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে আসবে তাকেই আমি শেষ করে ফেলব।”
” কেউ তোমার বাচ্চাকে কেড়ে নিচ্ছেনা। এসব বন্ধ করো।”
” আমাকে বোকা পেয়েছো তুমি? নিজের স্ত্রীকে এতবছর ফিরে পেয়ে এখন দুজন মিলে আমার বাচ্চাকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাইছো। সেটা তো আমি কিছুতেই হতে দিবনা। ওকে যদি আমার থেকে কেড়ে নাও আমি নিজের হাতেই আগে ওকে মারব, তারপর নিজে মরব।”
কথাটা শুনে আয়ানা মুহসীনের দিকে তাকাল। মুহসীন সেটা খেয়াল করল কিন্তু কিছু বলতে পারলনা। আয়ানা বলল,
” আপনি এসব কি বলছেন? আমি আয়াশকে কেড়ে নিতে আসিনি। ওকে ভালোবাসি আর আদর করি বলেই নিজের কাছে আগলে রাখি।”
” তোকে আমি বিশ্বাস করিনা। তোর থেকে তোর সন্তানকে কেড়ে নিয়ে ওকে আমি সবটুকু দিয়ে এতবছর বাচিয়ে রেখেছি। শুধুমাত্র এই ইফ্রিতে মুসনাত কে আমার হাতে রাখার জন্য, ওকে প্রকৃত ইফ্রিত বানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার জন্য।”
আয়ানা কিছু বলার আগে মুহসীন বলল,
” ওর বাচ্চাকে কেড়ে নিয়েছিস মানে কি!”
মহিলাটা আতঙ্কে চোখ সরিয়ে জানালার পাশে সরে এল। মুহসীন তাকে বাধা দিয়ে বলল, “আজ যদি তুই এখান থেকে পালিয়ে যাস, তবে আয়াশ কে তুই কখনো খুজে পাবিনা। এত বছর তুই যে উদ্দেশ্য নিয়ে আয়াশকে আগলে রেখেছিস, তাও হাসিল হবেনা। এখনো সময় আছে, সত্যিটা বল।”
নারী জ্বীনটা মূহুর্তে আয়ানার পাশে এসে বলল, “আয়াশ তোর সন্তান আর এই যে দাঁড়িয়ে আছে ও তোর স্বামী সাদ।”
আয়ানা অবাকদৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকাল, তারপর ছুটে এসে সাদের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, “এটা কি সত্যি? তুমি আমার সাদ! যদি সাদ ই হও তাহলে এতদিন কেন আসোনি আমার কাছে? কেন আমার সন্তানের কাছ থেকে আমাকে দূরে রেখেছো?”
” তুমি তো বিয়ে করে নতুনভাবে নিজের জীবন শুরু করে নিয়েছিলে। আমার কোনো অস্তিত্ব ছিল তোমার জীবনে?”
” আমি বিয়ে করিনি সাদ, তুমি ভুল বুঝছো।”
” আমি নিজে গিয়েছিলাম তোমার বাড়ীতে, সেখানে তোমার বিয়ের আয়োজন চলছিল। আমাকে তোমার মা তোমার কথামত দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল।”
” আমার মতের বিরুদ্ধে আমার মা আমার বিয়ে ঠিক করেছিল, কিন্তু আমি পালিয়ে এখানে চলে এসেছি। তুমি আমার সন্তানকে এভাবে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এলে কেন?”
” আমি জানতাম না আয়াশ আমার নিজের সন্তান।”
জ্বীন নারীটি জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলল, ” এমন অনেককিছুই আছে যেটা তোমরা কেউ জানোনা। আজ সব বলব তারপর এখান থেকে আয়াশ কে নিয়ে আমি চলে যাব। আগে আমার পরিচয় দিই। আমি সাদের বোন হুমায়রা।”
আয়ানা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, ” সাদ তুমি না বলেছিলে ও মারা গেছে।”
” হাহাহা, ইফ্রিত জ্বীনকে মারা এত সহজ নয়। আমি তো কেবল রাফেজী সর্দারের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের ভাইকে ধোকা দিয়েছি কেবল। পরেও ভাই তুমি সেটা জানোনি, জেনেছো আমাকে রাফেজী জ্বীন বন্ধী করে তোমাকে ধোকা দিয়েছে।”
আয়ানাকে সাদের দিকে একনজর তাকাল। সাদ ভীষণ রাগে ফুসছে। আয়ানা সাদের হাতের উপর হাত রেখে তাকে শান্ত হওয়ার ইশারা করল। পুরো কাহিনীটা আয়ানা আজ জানতে চায়। কেন সাদ আর তার সন্তানকে তার থেকে কেড়ে নেওয়া হল।
” আমি চেয়েছি আরেকটা ইফ্রিতে মুসনাত, যাকে আমি পরিচালনা করে নিজের স্বার্থ হাসিল করব। কি স্বার্থ সেটা তোমাদের অজানা ই থাক। কিন্তু সাদ ভাই সেটা কিছুতেই হতে দিচ্ছিলনা, সে তার ইফ্রিত রুপ ব্যবহার করে তোমার সাথে শারীরিক মিলন করবেনা। যার ফলে তোমাদের সন্তান ও ইফ্রিতে মুসনাতের বংশধর হবেনা। কিন্তু সেটা তো আমি হতে দিতে পারিনা। তাই রাফেজী জ্বীনের সাথে হাত মিলিয়ে ভাইয়ের ইফ্রিত রুপটা পরিচালনা করিয়ে তোমাদের মিলন ঘটিয়েছি। আর অজ্ঞান অবস্থায় ভাইকে রাফেজী জ্বীনকে দিয়ে বন্দি করিয়ে রেখেছি। অপেক্ষায় ছিলাম তোমার বাচ্চাটার জন্য। তার জন্য কত পরিশ্রম করেছি জানো? যারা তোমার বাচ্চা নষ্ট করতে চেয়েছিল তাদের ভয় দেখিয়েছি, ডাক্তারকে ভয় দেখিয়ে তোমার মা-বাবাকে মিথ্যা বলিয়েছি।
সবশেষে নিজের ভাইকে মুক্ত করে এনে তোনার বিয়ের দিন তোমার বাড়ীতে পাঠিয়েছি, তোমার মায়ের রুপ ধরে তোমাদের সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছি। আয়াশকে যেহেতু আমি আমার এই রুপ দিয়ে লালন পালন করতে পারবনা, তাই ভাই কে আয়াশকে আগলে রাখার দায়িত্ব দিয়েছি।বলেছিলাম, এই বাচ্চাটাকে ইফ্রিত রাজ্য থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। ওদেরকে তোমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছি।
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলনা, তোমার সাথে দেখা হয়েই গেল। ভাইকে কসম করালাম, কোনো মেয়ে মানুষের ছায়া যেন আয়াশের উপর না পড়তে দেয়, তোমার মত বেঈমানির সাথে ভাই যেন কোনো সম্পর্ক না রাখে। আমার ভাই আমার সব কথা ই শুনেছে। কিন্তু তোমার প্রতি ভালোবাসাটা মেরে ফেলতে পারেনি, লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে৷, আয়াশকেও তোমার থেকে দূরে রাখতে পারেনি।”
” তুমি তো অর্ধেক বিকলাঙ্গ ছিলে?”
” সব টাই অভিনয়। অনেক হয়েছে, আজ আমি আয়াশকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। ওর মধ্যে এখনি ইফ্রিত জ্বীনের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। ২১ বছরে সে পরিপূর্ণ ইফ্রিত হয়ে উঠবে।”
সাদ ভয়ংকর রেগে গিয়ে বলল, “এসব কিছু তোকে আমি কিছুতেই করতে দিবনা। অনেক খারাপ কাজ করেছিস তুই। আপন বোন হয়ে নিজের ভাইয়ের ক্ষতি করেছিস। বোন হিসেবে তুই আর ক্ষমা পাবিনা।”
” তুই আমার কিছুই করতে পারবিনা ভাই। তুই এখন একটা সাধারণ জ্বীন মাত্র, আর আমার মাঝে এখনো ইফ্রিত শক্তি আছে। আমার সাথে তুই পেরে উঠবিনা।”
আয়ানা হাত জোড় করে বলল, “বোন এতবছর পর আমি আমার স্বামী আর ছেলেকে ফিরে পেয়েছি, তুমি ওদেরকে আমার থেকে কেড়ে নিওনা। আল্লাহর দোহাই লাগে অনেক কিছুই করেছো, যাতে আমরা সবাইকে কষ্ট পেয়েছি। এইটুকু ছেলেও তার মা ছাড়া জীবন পার করেছে। এখন যদি ও মায়ের স্নেহ না পায় তাহলে ও অচিরেই শেষ হয়ে যাবে।
তুমি কি পারবে ওকে মায়ের স্নেহ দিতে? এই রুপ নিয়ে ওকে লালন-পালন করতে?”
” আমার আয়াশকে চাইইইই।”
” এক মায়ের কোল তুমি খালি করে দিতে পারবে? তাতে তুমি আয়াশকে ভালো রাখতে পারবে?”
নারী জ্বীনটা কয়েকবার আয়াশের দিকে তাকাল। জ্বরে ভূগে ছেলেটার চেহারার মলিনতা হারিয়ে গেছে, কেমন জানি হয়ে গেছে। যা দেখে হুমায়রার অন্তরাত্মা কেপে উঠল। আয়াশ না থাকলে ও নিজের স্বার্থ কি করে হাসিল করবে। এতগুলো বছরের সাধনা বিফলে যাবে!!
” এক শর্তে আমি আয়াশকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিব।”
সাদ বলল, “কি শর্ত?”
” আমি আবার যেকোনো সময় তোমাদের কাছে ফিরে আসব। তখন চাওয়ামাত্র ই আয়াশকে আমার কাছে দিয়ে দিতে হবে। কোনো অযুহাত খাটবেনা।
যদি শর্ত মানতে রাজি না থাকো আয়াশকে আমি এক্ষুণি মেরে ফেলব, তারপর নিজেকেও মারব।”
আয়ানা একবার সাদের দিকে তাকাল। সাদ অসহায়দৃষ্টিতে আয়ানাকে বারণ করল। আয়ানা শক্ত কন্ঠে বলল,
” আমাদের আর কোনো উপায় নেই সাদ। ওর শক্তির সাথে আমরা পারবনা, আর আয়াশকেও আমি আর হারাতে পারবনা।”
” আমি তোমার শর্তে রাজি। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে ততদিন আয়াশ বা আমাদের কাছাকাছি তুমি আসবেনা।”
” কথা দিলাম। আমি যাচ্ছি, ঠিকসময় ফিরব।”
.
আয়মান শাফির বাড়ী আজ আনন্দে পরিপূর্ণ। আয়ানা সাদ আর তার সন্তানকে নিয়ে ফিরে এসেছে। সবাই আয়াশকে নিয়ে ব্যস্ত। যদিও তাদেরকে সাদ আর আয়াশের ব্যাপারে মিথ্যা বুঝ দিতে আয়ানার একটু কষ্ট হয়েছে।
তাও আজ ও অনেক খুশি।
সাদকে ব্যালকুনিতে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ানা এগিয়ে এসে সাদের কাধে মাথাটা এলিয়ে দেয়। সাদ হালকা চমকে উঠে তারপর পাশ ফিরে আয়ানার কপালে হালকা চুমু দিয়ে আয়ানার হাতটা শক্ত করে ধরল।
” তোমাকে মিথ্যা ভুল বুঝার জন্য দুঃখিত।”
” এতে তোমার কোনো দোষ ছিলনা।”
“এত বড় একটা কথা তুমি কি করে দিয়ে দিলে? ও তো সত্যিই ফিরে আসবে আয়াশকে নিয়ে যেতে।”
” অনেক ভেবে-চিন্তেই দিয়েছি। আচ্ছা এমন কোথাও আমরা চলে যেতে পারিনা? যেখানে ও আমাদের খুজে পাবেনা। আয়াশকে নিয়ে সুন্দর একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব।”
” এমন জায়গা আছে কিনা আমার আদৌ জানা নেই।”
” তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা। আমি সব গুছিয়ে নিব, আয়াশের উপর ওর ছায়া আমি কখনো পড়তে দিবনা। অনেক দূরে চলে যাব তোমাদের নিয়ে। দেখো আর কোনো খারাপ কিছু আমাদের জীবনে আসবেনা।”
সাদ আয়ানার নাকটা কামড়ে দিয়ে বলল,
” বুদ্ধিমতী বউ আমার।” আয়ানা আউচ্চচ শব্দ করে বলল, “আবার!!!”
আয়াশ দৌড়ে এসে তাদের মাঝখানে ঢুকে বলল,
” আব্বু আমি বুদ্ধিমতী না?? আমাকেও নাকে কামড় দাও।”
আয়ানা আর সাদ হাসতে হাসতে আয়াশকে কোলে নিয়ে দুইগালে চুমু দিয়ে সাদ বলল, ” তুমি তো আমার বুদ্ধিমান ছেলে।”
আয়ানা সাদের হাত জড়িয়ে ধরে সাদের এক কাধে মাথাটা এলিয়ে দিল। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এবার বুঝি তাদের সুখী জীবন শুরু হবে।”
.
(সমাপ্ত)#ইফ্রিতে_মুসনাত
পর্ব- ১৫
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আয়ানা খুব ই আঘাত পেল মুহসীনের কথায়। অনেকক্ষণ মেঝেতে বসে চিৎকার করে কাদল। চোখের পানি ফেলে ভাবতে লাগল, আজ যদি আয়াশ ওর সন্তান হত, কেউ কি এভাবে কথা শুনিয়ে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারত! আল্লাহ কেন যে ওর থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে ওকে নিঃস্ব রেখে দিয়েছেন? না পেল স্বামীর সাথে সংসার করার সুখ না নিজের বাচ্চার মুখে মা ডাক শোনার সুযোগ। কেউ বিশ্বাস করেনা সে একটি জীবিত সন্তান জন্ম দিয়েছিল, নারী অবয়ব তার বাচ্চাটিকে নিয়ে চলে গেছে। ডাক্তার সবাইকে বলেছে ও মৃত সন্তান প্রসব করেছে। কিন্তু ডাক্তার এমন মিথ্যা কথা কেন বলল! সে তো নিজের কানে বাচ্চার কান্না শুনেছে, শরীর অবশ করা হয়েছিল কিন্তু ওর মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ সচল ছিল। কে এমন নিষ্ঠুর কাজ টা করেছে, সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তান কে তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিল! আয়ানা এসব ভেবে কোনো উত্তর ই মিলাতে পারলনা। তার জীবনটা যেন এক রহস্যময় গোলকধাধায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
দুইদিন হয়ে গেল, আয়ানার কাছে আয়াশ আর আসেনা। এই বিকেল সময়টা আয়ানার প্রচন্ড খারাপ লাগে, আয়াশকে কাছে পেতে ইচ্ছে হয়। কয়েকবার আয়াশের বাসার দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে আসে শুধু ওকে একনজর দেখার জন্য। কিন্তু দেখতে পায়না, দরজায় নক দেওয়ার ও সাহস হয়না। দরজার সামনে ঘুরতে গিয়ে মুহসীন সামি তাকে দেখে ফেলে।
” আপনি এখানে?” আয়ানা আমতা আমতা করে বলল,
” আয়াশকে একবার দেখতে এসেছিলাম।”
” আয়াশ বোধহয় ঘুমাচ্ছে।”
” প্লীজ একটিবার ওকে দেখতে দিবেন। আমি একবার দেখেই চলে যাব।”
মুহসীন সামি আয়ানার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “আসুন ভিতরে।”
” অসংখ্য ধন্যবাদ।”
আয়ানা রুমের ভেতরে ঢুকে দেখে আয়াশ তার দেওয়া চকোলেটস এর বক্সটা আকড়ে ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আয়ানা আয়াশের মাথার পাশে গিয়ে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে আয়াশের হাতে-গালে কয়েকবার চুমু খায়। ভীষণ ইচ্ছে করছিল তার, আয়াশ কে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে। মুহসীন সামি বলল,
” আপনার দেখা শেষ?” আয়ানা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
” জ্বী। আমি এবার আসি।”
” আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। ড্রয়িংরুমে চলুন, চা খেতে খেতে বলা যাক।”
আয়ানা আরেকবার আয়াশের দিকে তাকায়। কপালে চুমু খায়, সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে মুহসীনের পিছনে পিছনে ড্রয়িংরুমে আসে। পুরো ঘর জুড়ে একটা চেনা মিষ্টি গন্ধ পায় আয়ানা। এই গন্ধটা ওর খুব পরিচিত, এই গন্ধের মোহে সে হারিয়ে যেত। সোফায় বসতেই বাসার হেল্পিং হ্যান্ড দুইকাপ চা দিয়ে যায়।
“আপনি কি বিবাহিত?”
মুহসীন সামির কথায় আয়ানা চমকে উঠে। তারপর বলে,
” জ্বী।”
” ওহ। আপনি নিশ্চয়ই এটা জানেন, কারো বাচ্চাকে মা-বাবার অনুমতি ছাড়া নিজের কাছে এভাবে রাখা উচিত নয়।”
” জানি। কিন্তু আয়াশ আমার কাছে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, আমিও ওর সাথে থাকলে খুব ভাল থাকি। নিজের সন্তানের মত ভালোবাসি ওকে।”
” নিজের সন্তান আর অন্যের সন্তানের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শিখুন মিসেস. আয়ানা। বুঝলাম, আয়াশ আপনার কাছে যায়, মিশে। এমনিতে আপনাকে আমরা কেউ ঠিকমত চিনিনা, ওর যদি কোনোরকম কিছু হয় তার দায় কি আপনি নিবেন! আমার ছেলে অনেক সেনসিটিভ। ওর সবকিছুই আলাদা ধাচের। ওর কোনো কিছুতে ব্যতিক্রম হলে ওর ওভাররিয়েকশান গুলো আপনি নিতে পারবেননা। তাছাড়া, আমি বাহিরের মানুষ ভরসা করতে পারিনা। এইজন্য আমি চাইনা, আয়াশ আপনার সাথে খুব বেশী মিশুক।”
কথাগুলো শুনে আয়ানার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। তাও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আয়াশের মা কোথায়?”
” আপনাকে আমি পারসোনাল ব্যাপারে অবগত করতে বাধ্য নই। আপনি এখন আসতে পারেন, আর আশা করি কখনো আয়াশের সাথে মিশতে আসবেননা।
নিজের সংসার নিয়ে সুখে থাকুন।”
আয়ানা কিছু না বলে চলে এল। আয়ানার ব্যাপারে সবটা জানলে এভাবে হার্ট করে লোকটা কথা বলতে পারতনাম। আয়ানার রুমে এসে সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিল। আসলেই আজ যদি ওর নিজের সংসার থাকত, তাহলে ওকে কেউ এভাবে অপমান করতে পারত। লোকটার ধারণা, আয়ানা নিজের সংসার থেকে উনার সন্তানের প্রতি বেশী আকৃষ্ট। তাকে কি করে বোঝাবে আয়ানা! আয়াশকে সত্যিই ও নিজের থেকে বেশী ভালোবেসে ফেলেছে। আয়ানা নিজের মন শক্ত করে নিল, যেহেতু আয়াশের বাবা চায়না আয়ানা আয়াশের সাথে মিশুক সেহেতু আয়ানা নিজেকে আয়াশের থেকে দূরে রাখবে।
আয়ানা অফিসে যাওয়ার সময় খেয়াল করল আয়াশ তাকে ডাকতে ডাকতে পিছু আসছে। আয়ানা সেটাকে পাত্তা না দিয়ে চলে এল। যদিও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কিছুই করার নেই। অফিস থেকে ফিরে এসে যেই ভিতরে ঢুকতে যাবে, দেখে আয়াশ তার ফ্লোর ম্যাটের উপর শুয়ে আছে। আয়াশকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি এখানে শুয়ে আছো কেন আয়াশ?”
” আন্টি তুমি আজ আসতে এত দেরী করলে কেন? তোমার অপেক্ষা করতে করতে আমি এখানে ঘুমিয়ে ই পড়েছিলাম।”
আয়ানা আয়াশকে বুকে টেনে নিল। কেন জানি তার মনে হচ্ছে আয়াশ ওর নিজের ছেলে। আয়ানা তার নিজের মা।
.
আয়ানা আয়াশের মাথার পাশে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর জলপট্টি দিচ্ছে। আয়াশ জ্বরের ঘোরে আয়ানাকে “আম্মু আম্মু” বলে জড়িয়ে ধরছে। সেদিন আয়াশকে তার বাবা জোর করে আবার নিয়ে চলে যায়। আয়ানাকেও অনেক কিছু বলে অপমান করে। সেই জের ধরে আয়ানা কিছুদিন আয়াশের মুখোমুখি হয়নি, খুব সকালে বেরিয়ে যেত আর রাতে ফিরত। আজ অফিস থেকে ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল, এমন সময় কলিংবেল এর আওয়াজে উঠতে হল। দরজা খুলতেই দেখে মুহসীন সামি কাদো কাদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে, ” আয়াশ হঠাৎ কেমন জানি করছে। ডাক্তার আসতে সময় লাগবে।”
আয়াশের কথা শুনে আয়ানা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি, আয়াশের কাছে ছুটে আসে। এসে দেখে ছেলেটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, ছটফট করছে খুব।
মুহসীন সামি দরজায় টোকা দেওয়ায় আয়ানার ভাবনায় ছেদ পড়ল।
” আসুন।”
” আয়াশের এখন কি অবস্থা?”
” জ্বর অনেকটা কমেছে। জেগে গেলে কিছু খাইয়ে তারপর মেডিসিন দিতে হবে।”
” দুঃখিত আপনাকে এতরাতে বিরক্ত করার জন্য। আসলে আমার মাথা কাজ করছিলনা, হেল্পিং হ্যান্ড ও আজকে ছুটিতে আছে। ডাক্তারকেও কলে পাওয়া যাচ্ছিলনা। আয়াশের অবস্থা যদি এখন ভালো পর্যায়ে থাকে আপনি যেতে পারেন অসুবিধা নেই।”
আয়ানা ছলছল চোখে ধরাগলায় বলল, “আজ রাত টা আমি আয়াশের কাছে থাকি? প্লীজ না করবেননা।”
মুহসীন সামি একটু চুপ থেকে চলে গেল।
হঠাৎ আয়ানার মনে হল খুব ঠান্ডা একটা হাত তার গলা চেপে ধরেছে। আয়ানা কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা, তাও মনে হচ্ছে কেউ তার গলা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। কারো ক্রোধমিশ্রিত নিঃশ্বাস তার গায়ে পড়ছে। আয়ানা দোয়া পড়তে গেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেয়। আয়ানা তক্ষুনি মেঝেতে পড়ে যায়। খেয়াল করে একটা ভারী ফুলদানি শুণ্যে ভেসে ভেসে তার মাথা বরাবর আসছে। আয়ানার মাথা বরাবর পড়ার আগে সে গড়াগড়ি দিয়ে সরে যায়, আর ফুলদানি মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক টুকরো ছিটকে এসে আয়ানার গাল বরাবর ঢুকে যায়। যন্ত্রণায় কোকড়িয়ে উঠে আয়ানা।
সাথে সাথে আবার জোরে গলা চেপে ধরে কেউ। আয়ানার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। ঠিক তক্ষুণি লাল লাল দুটো চোখ দৃশ্যমান হল। আয়ানা হতবাক হয়ে বলল, “সাদ!!”
একটা নারী কন্ঠের হাসির আওয়াজে পুরো ঘর কেপে উঠল। মুহসীন সামি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আয়ানাকে মেঝে থেকে উঠায়।
” এসব কি হচ্ছে? তুমি ওকে মারছো কেন!”
সাথে সাথে একটা ভয়ংকর মুখশ্রীর নারী দৃশ্যমান হল। যার মুখটা দুইপাশে কান পর্যন্ত ছিড়ে আছে। মাথায় একপাশে ঘিলু বের হয়ে আছে, সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। আয়ানা ভয়ে মুহসীনের টি-শার্ট চেপে ধরে।
ভয়ংকর গলায় নারীটি বলল, “আমার বাচ্চাকে যে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে আসবে তাকেই আমি শেষ করে ফেলব।”
” কেউ তোমার বাচ্চাকে কেড়ে নিচ্ছেনা। এসব বন্ধ করো।”
” আমাকে বোকা পেয়েছো তুমি? নিজের স্ত্রীকে এতবছর ফিরে পেয়ে এখন দুজন মিলে আমার বাচ্চাকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাইছো। সেটা তো আমি কিছুতেই হতে দিবনা। ওকে যদি আমার থেকে কেড়ে নাও আমি নিজের হাতেই আগে ওকে মারব, তারপর নিজে মরব।”
কথাটা শুনে আয়ানা মুহসীনের দিকে তাকাল। মুহসীন সেটা খেয়াল করল কিন্তু কিছু বলতে পারলনা। আয়ানা বলল,
” আপনি এসব কি বলছেন? আমি আয়াশকে কেড়ে নিতে আসিনি। ওকে ভালোবাসি আর আদর করি বলেই নিজের কাছে আগলে রাখি।”
” তোকে আমি বিশ্বাস করিনা। তোর থেকে তোর সন্তানকে কেড়ে নিয়ে ওকে আমি সবটুকু দিয়ে এতবছর বাচিয়ে রেখেছি। শুধুমাত্র এই ইফ্রিতে মুসনাত কে আমার হাতে রাখার জন্য, ওকে প্রকৃত ইফ্রিত বানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার জন্য।”
আয়ানা কিছু বলার আগে মুহসীন বলল,
” ওর বাচ্চাকে কেড়ে নিয়েছিস মানে কি!”
মহিলাটা আতঙ্কে চোখ সরিয়ে জানালার পাশে সরে এল। মুহসীন তাকে বাধা দিয়ে বলল, “আজ যদি তুই এখান থেকে পালিয়ে যাস, তবে আয়াশ কে তুই কখনো খুজে পাবিনা। এত বছর তুই যে উদ্দেশ্য নিয়ে আয়াশকে আগলে রেখেছিস, তাও হাসিল হবেনা। এখনো সময় আছে, সত্যিটা বল।”
নারী জ্বীনটা মূহুর্তে আয়ানার পাশে এসে বলল, “আয়াশ তোর সন্তান আর এই যে দাঁড়িয়ে আছে ও তোর স্বামী সাদ।”
আয়ানা অবাকদৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকাল, তারপর ছুটে এসে সাদের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, “এটা কি সত্যি? তুমি আমার সাদ! যদি সাদ ই হও তাহলে এতদিন কেন আসোনি আমার কাছে? কেন আমার সন্তানের কাছ থেকে আমাকে দূরে রেখেছো?”
” তুমি তো বিয়ে করে নতুনভাবে নিজের জীবন শুরু করে নিয়েছিলে। আমার কোনো অস্তিত্ব ছিল তোমার জীবনে?”
” আমি বিয়ে করিনি সাদ, তুমি ভুল বুঝছো।”
” আমি নিজে গিয়েছিলাম তোমার বাড়ীতে, সেখানে তোমার বিয়ের আয়োজন চলছিল। আমাকে তোমার মা তোমার কথামত দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল।”
” আমার মতের বিরুদ্ধে আমার মা আমার বিয়ে ঠিক করেছিল, কিন্তু আমি পালিয়ে এখানে চলে এসেছি। তুমি আমার সন্তানকে এভাবে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এলে কেন?”
” আমি জানতাম না আয়াশ আমার নিজের সন্তান।”
জ্বীন নারীটি জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলল, ” এমন অনেককিছুই আছে যেটা তোমরা কেউ জানোনা। আজ সব বলব তারপর এখান থেকে আয়াশ কে নিয়ে আমি চলে যাব। আগে আমার পরিচয় দিই। আমি সাদের বোন হুমায়রা।”
আয়ানা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, ” সাদ তুমি না বলেছিলে ও মারা গেছে।”
” হাহাহা, ইফ্রিত জ্বীনকে মারা এত সহজ নয়। আমি তো কেবল রাফেজী সর্দারের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের ভাইকে ধোকা দিয়েছি কেবল। পরেও ভাই তুমি সেটা জানোনি, জেনেছো আমাকে রাফেজী জ্বীন বন্ধী করে তোমাকে ধোকা দিয়েছে।”
আয়ানাকে সাদের দিকে একনজর তাকাল। সাদ ভীষণ রাগে ফুসছে। আয়ানা সাদের হাতের উপর হাত রেখে তাকে শান্ত হওয়ার ইশারা করল। পুরো কাহিনীটা আয়ানা আজ জানতে চায়। কেন সাদ আর তার সন্তানকে তার থেকে কেড়ে নেওয়া হল।
” আমি চেয়েছি আরেকটা ইফ্রিতে মুসনাত, যাকে আমি পরিচালনা করে নিজের স্বার্থ হাসিল করব। কি স্বার্থ সেটা তোমাদের অজানা ই থাক। কিন্তু সাদ ভাই সেটা কিছুতেই হতে দিচ্ছিলনা, সে তার ইফ্রিত রুপ ব্যবহার করে তোমার সাথে শারীরিক মিলন করবেনা। যার ফলে তোমাদের সন্তান ও ইফ্রিতে মুসনাতের বংশধর হবেনা। কিন্তু সেটা তো আমি হতে দিতে পারিনা। তাই রাফেজী জ্বীনের সাথে হাত মিলিয়ে ভাইয়ের ইফ্রিত রুপটা পরিচালনা করিয়ে তোমাদের মিলন ঘটিয়েছি। আর অজ্ঞান অবস্থায় ভাইকে রাফেজী জ্বীনকে দিয়ে বন্দি করিয়ে রেখেছি। অপেক্ষায় ছিলাম তোমার বাচ্চাটার জন্য। তার জন্য কত পরিশ্রম করেছি জানো? যারা তোমার বাচ্চা নষ্ট করতে চেয়েছিল তাদের ভয় দেখিয়েছি, ডাক্তারকে ভয় দেখিয়ে তোমার মা-বাবাকে মিথ্যা বলিয়েছি।
সবশেষে নিজের ভাইকে মুক্ত করে এনে তোনার বিয়ের দিন তোমার বাড়ীতে পাঠিয়েছি, তোমার মায়ের রুপ ধরে তোমাদের সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছি। আয়াশকে যেহেতু আমি আমার এই রুপ দিয়ে লালন পালন করতে পারবনা, তাই ভাই কে আয়াশকে আগলে রাখার দায়িত্ব দিয়েছি।বলেছিলাম, এই বাচ্চাটাকে ইফ্রিত রাজ্য থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। ওদেরকে তোমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছি।
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলনা, তোমার সাথে দেখা হয়েই গেল। ভাইকে কসম করালাম, কোনো মেয়ে মানুষের ছায়া যেন আয়াশের উপর না পড়তে দেয়, তোমার মত বেঈমানির সাথে ভাই যেন কোনো সম্পর্ক না রাখে। আমার ভাই আমার সব কথা ই শুনেছে। কিন্তু তোমার প্রতি ভালোবাসাটা মেরে ফেলতে পারেনি, লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে৷, আয়াশকেও তোমার থেকে দূরে রাখতে পারেনি।”
” তুমি তো অর্ধেক বিকলাঙ্গ ছিলে?”
” সব টাই অভিনয়। অনেক হয়েছে, আজ আমি আয়াশকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। ওর মধ্যে এখনি ইফ্রিত জ্বীনের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। ২১ বছরে সে পরিপূর্ণ ইফ্রিত হয়ে উঠবে।”
সাদ ভয়ংকর রেগে গিয়ে বলল, “এসব কিছু তোকে আমি কিছুতেই করতে দিবনা। অনেক খারাপ কাজ করেছিস তুই। আপন বোন হয়ে নিজের ভাইয়ের ক্ষতি করেছিস। বোন হিসেবে তুই আর ক্ষমা পাবিনা।”
” তুই আমার কিছুই করতে পারবিনা ভাই। তুই এখন একটা সাধারণ জ্বীন মাত্র, আর আমার মাঝে এখনো ইফ্রিত শক্তি আছে। আমার সাথে তুই পেরে উঠবিনা।”
আয়ানা হাত জোড় করে বলল, “বোন এতবছর পর আমি আমার স্বামী আর ছেলেকে ফিরে পেয়েছি, তুমি ওদেরকে আমার থেকে কেড়ে নিওনা। আল্লাহর দোহাই লাগে অনেক কিছুই করেছো, যাতে আমরা সবাইকে কষ্ট পেয়েছি। এইটুকু ছেলেও তার মা ছাড়া জীবন পার করেছে। এখন যদি ও মায়ের স্নেহ না পায় তাহলে ও অচিরেই শেষ হয়ে যাবে।
তুমি কি পারবে ওকে মায়ের স্নেহ দিতে? এই রুপ নিয়ে ওকে লালন-পালন করতে?”
” আমার আয়াশকে চাইইইই।”
” এক মায়ের কোল তুমি খালি করে দিতে পারবে? তাতে তুমি আয়াশকে ভালো রাখতে পারবে?”
নারী জ্বীনটা কয়েকবার আয়াশের দিকে তাকাল। জ্বরে ভূগে ছেলেটার চেহারার মলিনতা হারিয়ে গেছে, কেমন জানি হয়ে গেছে। যা দেখে হুমায়রার অন্তরাত্মা কেপে উঠল। আয়াশ না থাকলে ও নিজের স্বার্থ কি করে হাসিল করবে। এতগুলো বছরের সাধনা বিফলে যাবে!!
” এক শর্তে আমি আয়াশকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিব।”
সাদ বলল, “কি শর্ত?”
” আমি আবার যেকোনো সময় তোমাদের কাছে ফিরে আসব। তখন চাওয়ামাত্র ই আয়াশকে আমার কাছে দিয়ে দিতে হবে। কোনো অযুহাত খাটবেনা।
যদি শর্ত মানতে রাজি না থাকো আয়াশকে আমি এক্ষুণি মেরে ফেলব, তারপর নিজেকেও মারব।”
আয়ানা একবার সাদের দিকে তাকাল। সাদ অসহায়দৃষ্টিতে আয়ানাকে বারণ করল। আয়ানা শক্ত কন্ঠে বলল,
” আমাদের আর কোনো উপায় নেই সাদ। ওর শক্তির সাথে আমরা পারবনা, আর আয়াশকেও আমি আর হারাতে পারবনা।”
” আমি তোমার শর্তে রাজি। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে ততদিন আয়াশ বা আমাদের কাছাকাছি তুমি আসবেনা।”
” কথা দিলাম। আমি যাচ্ছি, ঠিকসময় ফিরব।”
.
আয়মান শাফির বাড়ী আজ আনন্দে পরিপূর্ণ। আয়ানা সাদ আর তার সন্তানকে নিয়ে ফিরে এসেছে। সবাই আয়াশকে নিয়ে ব্যস্ত। যদিও তাদেরকে সাদ আর আয়াশের ব্যাপারে মিথ্যা বুঝ দিতে আয়ানার একটু কষ্ট হয়েছে।
তাও আজ ও অনেক খুশি।
সাদকে ব্যালকুনিতে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ানা এগিয়ে এসে সাদের কাধে মাথাটা এলিয়ে দেয়। সাদ হালকা চমকে উঠে তারপর পাশ ফিরে আয়ানার কপালে হালকা চুমু দিয়ে আয়ানার হাতটা শক্ত করে ধরল।
” তোমাকে মিথ্যা ভুল বুঝার জন্য দুঃখিত।”
” এতে তোমার কোনো দোষ ছিলনা।”
“এত বড় একটা কথা তুমি কি করে দিয়ে দিলে? ও তো সত্যিই ফিরে আসবে আয়াশকে নিয়ে যেতে।”
” অনেক ভেবে-চিন্তেই দিয়েছি। আচ্ছা এমন কোথাও আমরা চলে যেতে পারিনা? যেখানে ও আমাদের খুজে পাবেনা। আয়াশকে নিয়ে সুন্দর একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব।”
” এমন জায়গা আছে কিনা আমার আদৌ জানা নেই।”
” তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা। আমি সব গুছিয়ে নিব, আয়াশের উপর ওর ছায়া আমি কখনো পড়তে দিবনা। অনেক দূরে চলে যাব তোমাদের নিয়ে। দেখো আর কোনো খারাপ কিছু আমাদের জীবনে আসবেনা।”
সাদ আয়ানার নাকটা কামড়ে দিয়ে বলল,
” বুদ্ধিমতী বউ আমার।” আয়ানা আউচ্চচ শব্দ করে বলল, “আবার!!!”
আয়াশ দৌড়ে এসে তাদের মাঝখানে ঢুকে বলল,
” আব্বু আমি বুদ্ধিমতী না?? আমাকেও নাকে কামড় দাও।”
আয়ানা আর সাদ হাসতে হাসতে আয়াশকে কোলে নিয়ে দুইগালে চুমু দিয়ে সাদ বলল, ” তুমি তো আমার বুদ্ধিমান ছেলে।”
আয়ানা সাদের হাত জড়িয়ে ধরে সাদের এক কাধে মাথাটা এলিয়ে দিল। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এবার বুঝি তাদের সুখী জীবন শুরু হবে।”
.
(সমাপ্ত)#ইফ্রিতে_মুসনাত
পর্ব- ১৫
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আয়ানা খুব ই আঘাত পেল মুহসীনের কথায়। অনেকক্ষণ মেঝেতে বসে চিৎকার করে কাদল। চোখের পানি ফেলে ভাবতে লাগল, আজ যদি আয়াশ ওর সন্তান হত, কেউ কি এভাবে কথা শুনিয়ে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারত! আল্লাহ কেন যে ওর থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে ওকে নিঃস্ব রেখে দিয়েছেন? না পেল স্বামীর সাথে সংসার করার সুখ না নিজের বাচ্চার মুখে মা ডাক শোনার সুযোগ। কেউ বিশ্বাস করেনা সে একটি জীবিত সন্তান জন্ম দিয়েছিল, নারী অবয়ব তার বাচ্চাটিকে নিয়ে চলে গেছে। ডাক্তার সবাইকে বলেছে ও মৃত সন্তান প্রসব করেছে। কিন্তু ডাক্তার এমন মিথ্যা কথা কেন বলল! সে তো নিজের কানে বাচ্চার কান্না শুনেছে, শরীর অবশ করা হয়েছিল কিন্তু ওর মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ সচল ছিল। কে এমন নিষ্ঠুর কাজ টা করেছে, সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তান কে তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিল! আয়ানা এসব ভেবে কোনো উত্তর ই মিলাতে পারলনা। তার জীবনটা যেন এক রহস্যময় গোলকধাধায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
দুইদিন হয়ে গেল, আয়ানার কাছে আয়াশ আর আসেনা। এই বিকেল সময়টা আয়ানার প্রচন্ড খারাপ লাগে, আয়াশকে কাছে পেতে ইচ্ছে হয়। কয়েকবার আয়াশের বাসার দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে আসে শুধু ওকে একনজর দেখার জন্য। কিন্তু দেখতে পায়না, দরজায় নক দেওয়ার ও সাহস হয়না। দরজার সামনে ঘুরতে গিয়ে মুহসীন সামি তাকে দেখে ফেলে।
” আপনি এখানে?” আয়ানা আমতা আমতা করে বলল,
” আয়াশকে একবার দেখতে এসেছিলাম।”
” আয়াশ বোধহয় ঘুমাচ্ছে।”
” প্লীজ একটিবার ওকে দেখতে দিবেন। আমি একবার দেখেই চলে যাব।”
মুহসীন সামি আয়ানার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “আসুন ভিতরে।”
” অসংখ্য ধন্যবাদ।”
আয়ানা রুমের ভেতরে ঢুকে দেখে আয়াশ তার দেওয়া চকোলেটস এর বক্সটা আকড়ে ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আয়ানা আয়াশের মাথার পাশে গিয়ে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে আয়াশের হাতে-গালে কয়েকবার চুমু খায়। ভীষণ ইচ্ছে করছিল তার, আয়াশ কে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে। মুহসীন সামি বলল,
” আপনার দেখা শেষ?” আয়ানা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
” জ্বী। আমি এবার আসি।”
” আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। ড্রয়িংরুমে চলুন, চা খেতে খেতে বলা যাক।”
আয়ানা আরেকবার আয়াশের দিকে তাকায়। কপালে চুমু খায়, সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে মুহসীনের পিছনে পিছনে ড্রয়িংরুমে আসে। পুরো ঘর জুড়ে একটা চেনা মিষ্টি গন্ধ পায় আয়ানা। এই গন্ধটা ওর খুব পরিচিত, এই গন্ধের মোহে সে হারিয়ে যেত। সোফায় বসতেই বাসার হেল্পিং হ্যান্ড দুইকাপ চা দিয়ে যায়।
“আপনি কি বিবাহিত?”
মুহসীন সামির কথায় আয়ানা চমকে উঠে। তারপর বলে,
” জ্বী।”
” ওহ। আপনি নিশ্চয়ই এটা জানেন, কারো বাচ্চাকে মা-বাবার অনুমতি ছাড়া নিজের কাছে এভাবে রাখা উচিত নয়।”
” জানি। কিন্তু আয়াশ আমার কাছে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, আমিও ওর সাথে থাকলে খুব ভাল থাকি। নিজের সন্তানের মত ভালোবাসি ওকে।”
” নিজের সন্তান আর অন্যের সন্তানের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শিখুন মিসেস. আয়ানা। বুঝলাম, আয়াশ আপনার কাছে যায়, মিশে। এমনিতে আপনাকে আমরা কেউ ঠিকমত চিনিনা, ওর যদি কোনোরকম কিছু হয় তার দায় কি আপনি নিবেন! আমার ছেলে অনেক সেনসিটিভ। ওর সবকিছুই আলাদা ধাচের। ওর কোনো কিছুতে ব্যতিক্রম হলে ওর ওভাররিয়েকশান গুলো আপনি নিতে পারবেননা। তাছাড়া, আমি বাহিরের মানুষ ভরসা করতে পারিনা। এইজন্য আমি চাইনা, আয়াশ আপনার সাথে খুব বেশী মিশুক।”
কথাগুলো শুনে আয়ানার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। তাও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আয়াশের মা কোথায়?”
” আপনাকে আমি পারসোনাল ব্যাপারে অবগত করতে বাধ্য নই। আপনি এখন আসতে পারেন, আর আশা করি কখনো আয়াশের সাথে মিশতে আসবেননা।
নিজের সংসার নিয়ে সুখে থাকুন।”
আয়ানা কিছু না বলে চলে এল। আয়ানার ব্যাপারে সবটা জানলে এভাবে হার্ট করে লোকটা কথা বলতে পারতনাম। আয়ানার রুমে এসে সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিল। আসলেই আজ যদি ওর নিজের সংসার থাকত, তাহলে ওকে কেউ এভাবে অপমান করতে পারত। লোকটার ধারণা, আয়ানা নিজের সংসার থেকে উনার সন্তানের প্রতি বেশী আকৃষ্ট। তাকে কি করে বোঝাবে আয়ানা! আয়াশকে সত্যিই ও নিজের থেকে বেশী ভালোবেসে ফেলেছে। আয়ানা নিজের মন শক্ত করে নিল, যেহেতু আয়াশের বাবা চায়না আয়ানা আয়াশের সাথে মিশুক সেহেতু আয়ানা নিজেকে আয়াশের থেকে দূরে রাখবে।
আয়ানা অফিসে যাওয়ার সময় খেয়াল করল আয়াশ তাকে ডাকতে ডাকতে পিছু আসছে। আয়ানা সেটাকে পাত্তা না দিয়ে চলে এল। যদিও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কিছুই করার নেই। অফিস থেকে ফিরে এসে যেই ভিতরে ঢুকতে যাবে, দেখে আয়াশ তার ফ্লোর ম্যাটের উপর শুয়ে আছে। আয়াশকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি এখানে শুয়ে আছো কেন আয়াশ?”
” আন্টি তুমি আজ আসতে এত দেরী করলে কেন? তোমার অপেক্ষা করতে করতে আমি এখানে ঘুমিয়ে ই পড়েছিলাম।”
আয়ানা আয়াশকে বুকে টেনে নিল। কেন জানি তার মনে হচ্ছে আয়াশ ওর নিজের ছেলে। আয়ানা তার নিজের মা।
.
আয়ানা আয়াশের মাথার পাশে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর জলপট্টি দিচ্ছে। আয়াশ জ্বরের ঘোরে আয়ানাকে “আম্মু আম্মু” বলে জড়িয়ে ধরছে। সেদিন আয়াশকে তার বাবা জোর করে আবার নিয়ে চলে যায়। আয়ানাকেও অনেক কিছু বলে অপমান করে। সেই জের ধরে আয়ানা কিছুদিন আয়াশের মুখোমুখি হয়নি, খুব সকালে বেরিয়ে যেত আর রাতে ফিরত। আজ অফিস থেকে ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল, এমন সময় কলিংবেল এর আওয়াজে উঠতে হল। দরজা খুলতেই দেখে মুহসীন সামি কাদো কাদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে, ” আয়াশ হঠাৎ কেমন জানি করছে। ডাক্তার আসতে সময় লাগবে।”
আয়াশের কথা শুনে আয়ানা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি, আয়াশের কাছে ছুটে আসে। এসে দেখে ছেলেটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, ছটফট করছে খুব।
মুহসীন সামি দরজায় টোকা দেওয়ায় আয়ানার ভাবনায় ছেদ পড়ল।
” আসুন।”
” আয়াশের এখন কি অবস্থা?”
” জ্বর অনেকটা কমেছে। জেগে গেলে কিছু খাইয়ে তারপর মেডিসিন দিতে হবে।”
” দুঃখিত আপনাকে এতরাতে বিরক্ত করার জন্য। আসলে আমার মাথা কাজ করছিলনা, হেল্পিং হ্যান্ড ও আজকে ছুটিতে আছে। ডাক্তারকেও কলে পাওয়া যাচ্ছিলনা। আয়াশের অবস্থা যদি এখন ভালো পর্যায়ে থাকে আপনি যেতে পারেন অসুবিধা নেই।”
আয়ানা ছলছল চোখে ধরাগলায় বলল, “আজ রাত টা আমি আয়াশের কাছে থাকি? প্লীজ না করবেননা।”
মুহসীন সামি একটু চুপ থেকে চলে গেল।
হঠাৎ আয়ানার মনে হল খুব ঠান্ডা একটা হাত তার গলা চেপে ধরেছে। আয়ানা কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা, তাও মনে হচ্ছে কেউ তার গলা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। কারো ক্রোধমিশ্রিত নিঃশ্বাস তার গায়ে পড়ছে। আয়ানা দোয়া পড়তে গেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেয়। আয়ানা তক্ষুনি মেঝেতে পড়ে যায়। খেয়াল করে একটা ভারী ফুলদানি শুণ্যে ভেসে ভেসে তার মাথা বরাবর আসছে। আয়ানার মাথা বরাবর পড়ার আগে সে গড়াগড়ি দিয়ে সরে যায়, আর ফুলদানি মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক টুকরো ছিটকে এসে আয়ানার গাল বরাবর ঢুকে যায়। যন্ত্রণায় কোকড়িয়ে উঠে আয়ানা।
সাথে সাথে আবার জোরে গলা চেপে ধরে কেউ। আয়ানার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। ঠিক তক্ষুণি লাল লাল দুটো চোখ দৃশ্যমান হল। আয়ানা হতবাক হয়ে বলল, “সাদ!!”
একটা নারী কন্ঠের হাসির আওয়াজে পুরো ঘর কেপে উঠল। মুহসীন সামি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আয়ানাকে মেঝে থেকে উঠায়।
” এসব কি হচ্ছে? তুমি ওকে মারছো কেন!”
সাথে সাথে একটা ভয়ংকর মুখশ্রীর নারী দৃশ্যমান হল। যার মুখটা দুইপাশে কান পর্যন্ত ছিড়ে আছে। মাথায় একপাশে ঘিলু বের হয়ে আছে, সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। আয়ানা ভয়ে মুহসীনের টি-শার্ট চেপে ধরে।
ভয়ংকর গলায় নারীটি বলল, “আমার বাচ্চাকে যে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে আসবে তাকেই আমি শেষ করে ফেলব।”
” কেউ তোমার বাচ্চাকে কেড়ে নিচ্ছেনা। এসব বন্ধ করো।”
” আমাকে বোকা পেয়েছো তুমি? নিজের স্ত্রীকে এতবছর ফিরে পেয়ে এখন দুজন মিলে আমার বাচ্চাকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাইছো। সেটা তো আমি কিছুতেই হতে দিবনা। ওকে যদি আমার থেকে কেড়ে নাও আমি নিজের হাতেই আগে ওকে মারব, তারপর নিজে মরব।”
কথাটা শুনে আয়ানা মুহসীনের দিকে তাকাল। মুহসীন সেটা খেয়াল করল কিন্তু কিছু বলতে পারলনা। আয়ানা বলল,
” আপনি এসব কি বলছেন? আমি আয়াশকে কেড়ে নিতে আসিনি। ওকে ভালোবাসি আর আদর করি বলেই নিজের কাছে আগলে রাখি।”
” তোকে আমি বিশ্বাস করিনা। তোর থেকে তোর সন্তানকে কেড়ে নিয়ে ওকে আমি সবটুকু দিয়ে এতবছর বাচিয়ে রেখেছি। শুধুমাত্র এই ইফ্রিতে মুসনাত কে আমার হাতে রাখার জন্য, ওকে প্রকৃত ইফ্রিত বানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার জন্য।”
আয়ানা কিছু বলার আগে মুহসীন বলল,
” ওর বাচ্চাকে কেড়ে নিয়েছিস মানে কি!”
মহিলাটা আতঙ্কে চোখ সরিয়ে জানালার পাশে সরে এল। মুহসীন তাকে বাধা দিয়ে বলল, “আজ যদি তুই এখান থেকে পালিয়ে যাস, তবে আয়াশ কে তুই কখনো খুজে পাবিনা। এত বছর তুই যে উদ্দেশ্য নিয়ে আয়াশকে আগলে রেখেছিস, তাও হাসিল হবেনা। এখনো সময় আছে, সত্যিটা বল।”
নারী জ্বীনটা মূহুর্তে আয়ানার পাশে এসে বলল, “আয়াশ তোর সন্তান আর এই যে দাঁড়িয়ে আছে ও তোর স্বামী সাদ।”
আয়ানা অবাকদৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকাল, তারপর ছুটে এসে সাদের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, “এটা কি সত্যি? তুমি আমার সাদ! যদি সাদ ই হও তাহলে এতদিন কেন আসোনি আমার কাছে? কেন আমার সন্তানের কাছ থেকে আমাকে দূরে রেখেছো?”
” তুমি তো বিয়ে করে নতুনভাবে নিজের জীবন শুরু করে নিয়েছিলে। আমার কোনো অস্তিত্ব ছিল তোমার জীবনে?”
” আমি বিয়ে করিনি সাদ, তুমি ভুল বুঝছো।”
” আমি নিজে গিয়েছিলাম তোমার বাড়ীতে, সেখানে তোমার বিয়ের আয়োজন চলছিল। আমাকে তোমার মা তোমার কথামত দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল।”
” আমার মতের বিরুদ্ধে আমার মা আমার বিয়ে ঠিক করেছিল, কিন্তু আমি পালিয়ে এখানে চলে এসেছি। তুমি আমার সন্তানকে এভাবে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এলে কেন?”
” আমি জানতাম না আয়াশ আমার নিজের সন্তান।”
জ্বীন নারীটি জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলল, ” এমন অনেককিছুই আছে যেটা তোমরা কেউ জানোনা। আজ সব বলব তারপর এখান থেকে আয়াশ কে নিয়ে আমি চলে যাব। আগে আমার পরিচয় দিই। আমি সাদের বোন হুমায়রা।”
আয়ানা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, ” সাদ তুমি না বলেছিলে ও মারা গেছে।”
” হাহাহা, ইফ্রিত জ্বীনকে মারা এত সহজ নয়। আমি তো কেবল রাফেজী সর্দারের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের ভাইকে ধোকা দিয়েছি কেবল। পরেও ভাই তুমি সেটা জানোনি, জেনেছো আমাকে রাফেজী জ্বীন বন্ধী করে তোমাকে ধোকা দিয়েছে।”
আয়ানাকে সাদের দিকে একনজর তাকাল। সাদ ভীষণ রাগে ফুসছে। আয়ানা সাদের হাতের উপর হাত রেখে তাকে শান্ত হওয়ার ইশারা করল। পুরো কাহিনীটা আয়ানা আজ জানতে চায়। কেন সাদ আর তার সন্তানকে তার থেকে কেড়ে নেওয়া হল।
” আমি চেয়েছি আরেকটা ইফ্রিতে মুসনাত, যাকে আমি পরিচালনা করে নিজের স্বার্থ হাসিল করব। কি স্বার্থ সেটা তোমাদের অজানা ই থাক। কিন্তু সাদ ভাই সেটা কিছুতেই হতে দিচ্ছিলনা, সে তার ইফ্রিত রুপ ব্যবহার করে তোমার সাথে শারীরিক মিলন করবেনা। যার ফলে তোমাদের সন্তান ও ইফ্রিতে মুসনাতের বংশধর হবেনা। কিন্তু সেটা তো আমি হতে দিতে পারিনা। তাই রাফেজী জ্বীনের সাথে হাত মিলিয়ে ভাইয়ের ইফ্রিত রুপটা পরিচালনা করিয়ে তোমাদের মিলন ঘটিয়েছি। আর অজ্ঞান অবস্থায় ভাইকে রাফেজী জ্বীনকে দিয়ে বন্দি করিয়ে রেখেছি। অপেক্ষায় ছিলাম তোমার বাচ্চাটার জন্য। তার জন্য কত পরিশ্রম করেছি জানো? যারা তোমার বাচ্চা নষ্ট করতে চেয়েছিল তাদের ভয় দেখিয়েছি, ডাক্তারকে ভয় দেখিয়ে তোমার মা-বাবাকে মিথ্যা বলিয়েছি।
সবশেষে নিজের ভাইকে মুক্ত করে এনে তোনার বিয়ের দিন তোমার বাড়ীতে পাঠিয়েছি, তোমার মায়ের রুপ ধরে তোমাদের সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছি। আয়াশকে যেহেতু আমি আমার এই রুপ দিয়ে লালন পালন করতে পারবনা, তাই ভাই কে আয়াশকে আগলে রাখার দায়িত্ব দিয়েছি।বলেছিলাম, এই বাচ্চাটাকে ইফ্রিত রাজ্য থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। ওদেরকে তোমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছি।
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলনা, তোমার সাথে দেখা হয়েই গেল। ভাইকে কসম করালাম, কোনো মেয়ে মানুষের ছায়া যেন আয়াশের উপর না পড়তে দেয়, তোমার মত বেঈমানির সাথে ভাই যেন কোনো সম্পর্ক না রাখে। আমার ভাই আমার সব কথা ই শুনেছে। কিন্তু তোমার প্রতি ভালোবাসাটা মেরে ফেলতে পারেনি, লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে৷, আয়াশকেও তোমার থেকে দূরে রাখতে পারেনি।”
” তুমি তো অর্ধেক বিকলাঙ্গ ছিলে?”
” সব টাই অভিনয়। অনেক হয়েছে, আজ আমি আয়াশকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। ওর মধ্যে এখনি ইফ্রিত জ্বীনের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। ২১ বছরে সে পরিপূর্ণ ইফ্রিত হয়ে উঠবে।”
সাদ ভয়ংকর রেগে গিয়ে বলল, “এসব কিছু তোকে আমি কিছুতেই করতে দিবনা। অনেক খারাপ কাজ করেছিস তুই। আপন বোন হয়ে নিজের ভাইয়ের ক্ষতি করেছিস। বোন হিসেবে তুই আর ক্ষমা পাবিনা।”
” তুই আমার কিছুই করতে পারবিনা ভাই। তুই এখন একটা সাধারণ জ্বীন মাত্র, আর আমার মাঝে এখনো ইফ্রিত শক্তি আছে। আমার সাথে তুই পেরে উঠবিনা।”
আয়ানা হাত জোড় করে বলল, “বোন এতবছর পর আমি আমার স্বামী আর ছেলেকে ফিরে পেয়েছি, তুমি ওদেরকে আমার থেকে কেড়ে নিওনা। আল্লাহর দোহাই লাগে অনেক কিছুই করেছো, যাতে আমরা সবাইকে কষ্ট পেয়েছি। এইটুকু ছেলেও তার মা ছাড়া জীবন পার করেছে। এখন যদি ও মায়ের স্নেহ না পায় তাহলে ও অচিরেই শেষ হয়ে যাবে।
তুমি কি পারবে ওকে মায়ের স্নেহ দিতে? এই রুপ নিয়ে ওকে লালন-পালন করতে?”
” আমার আয়াশকে চাইইইই।”
” এক মায়ের কোল তুমি খালি করে দিতে পারবে? তাতে তুমি আয়াশকে ভালো রাখতে পারবে?”
নারী জ্বীনটা কয়েকবার আয়াশের দিকে তাকাল। জ্বরে ভূগে ছেলেটার চেহারার মলিনতা হারিয়ে গেছে, কেমন জানি হয়ে গেছে। যা দেখে হুমায়রার অন্তরাত্মা কেপে উঠল। আয়াশ না থাকলে ও নিজের স্বার্থ কি করে হাসিল করবে। এতগুলো বছরের সাধনা বিফলে যাবে!!
” এক শর্তে আমি আয়াশকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিব।”
সাদ বলল, “কি শর্ত?”
” আমি আবার যেকোনো সময় তোমাদের কাছে ফিরে আসব। তখন চাওয়ামাত্র ই আয়াশকে আমার কাছে দিয়ে দিতে হবে। কোনো অযুহাত খাটবেনা।
যদি শর্ত মানতে রাজি না থাকো আয়াশকে আমি এক্ষুণি মেরে ফেলব, তারপর নিজেকেও মারব।”
আয়ানা একবার সাদের দিকে তাকাল। সাদ অসহায়দৃষ্টিতে আয়ানাকে বারণ করল। আয়ানা শক্ত কন্ঠে বলল,
” আমাদের আর কোনো উপায় নেই সাদ। ওর শক্তির সাথে আমরা পারবনা, আর আয়াশকেও আমি আর হারাতে পারবনা।”
” আমি তোমার শর্তে রাজি। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে ততদিন আয়াশ বা আমাদের কাছাকাছি তুমি আসবেনা।”
” কথা দিলাম। আমি যাচ্ছি, ঠিকসময় ফিরব।”
.
আয়মান শাফির বাড়ী আজ আনন্দে পরিপূর্ণ। আয়ানা সাদ আর তার সন্তানকে নিয়ে ফিরে এসেছে। সবাই আয়াশকে নিয়ে ব্যস্ত। যদিও তাদেরকে সাদ আর আয়াশের ব্যাপারে মিথ্যা বুঝ দিতে আয়ানার একটু কষ্ট হয়েছে।
তাও আজ ও অনেক খুশি।
সাদকে ব্যালকুনিতে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ানা এগিয়ে এসে সাদের কাধে মাথাটা এলিয়ে দেয়। সাদ হালকা চমকে উঠে তারপর পাশ ফিরে আয়ানার কপালে হালকা চুমু দিয়ে আয়ানার হাতটা শক্ত করে ধরল।
” তোমাকে মিথ্যা ভুল বুঝার জন্য দুঃখিত।”
” এতে তোমার কোনো দোষ ছিলনা।”
“এত বড় একটা কথা তুমি কি করে দিয়ে দিলে? ও তো সত্যিই ফিরে আসবে আয়াশকে নিয়ে যেতে।”
” অনেক ভেবে-চিন্তেই দিয়েছি। আচ্ছা এমন কোথাও আমরা চলে যেতে পারিনা? যেখানে ও আমাদের খুজে পাবেনা। আয়াশকে নিয়ে সুন্দর একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব।”
” এমন জায়গা আছে কিনা আমার আদৌ জানা নেই।”
” তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা। আমি সব গুছিয়ে নিব, আয়াশের উপর ওর ছায়া আমি কখনো পড়তে দিবনা। অনেক দূরে চলে যাব তোমাদের নিয়ে। দেখো আর কোনো খারাপ কিছু আমাদের জীবনে আসবেনা।”
সাদ আয়ানার নাকটা কামড়ে দিয়ে বলল,
” বুদ্ধিমতী বউ আমার।” আয়ানা আউচ্চচ শব্দ করে বলল, “আবার!!!”
আয়াশ দৌড়ে এসে তাদের মাঝখানে ঢুকে বলল,
” আব্বু আমি বুদ্ধিমতী না?? আমাকেও নাকে কামড় দাও।”
আয়ানা আর সাদ হাসতে হাসতে আয়াশকে কোলে নিয়ে দুইগালে চুমু দিয়ে সাদ বলল, ” তুমি তো আমার বুদ্ধিমান ছেলে।”
আয়ানা সাদের হাত জড়িয়ে ধরে সাদের এক কাধে মাথাটা এলিয়ে দিল। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এবার বুঝি তাদের সুখী জীবন শুরু হবে।”
.
(সমাপ্ত)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here