উড়ো_পার্সেল(পর্ব -৭)

0
248

গল্প :#উড়ো_পার্সেল(পর্ব -৭)
লেখা:#নাজিফা_তাবাসসুম।

নিশাত তার বাবা বাসায় আসার আগেই বাসায় ঢুকে পড়েছে। ঈশিতা আগে থেকেই তার জন্য দরজা খুলে রেখেছিল।নিশাত ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই ঈশিতা তাকে নিয়ে তাদের ঘরে চলে আসলো।কিছুক্ষণ পর ইকবাল হোসেন বাসায় আসলেন। তিনি বাইরের দরজা খোলা দেখে বেশ বিস্মিত হয়ে গেলেন।
ঈশিতা এবং নিশাত দুজনে বাবার আসার শব্দ পেয়ে তাড়াহুড়া করে বাবার সামনে চলে এলো।
ইকবাল হোসেন তার দুই মেয়েকে এত অস্থির হতে দেখে বললেন, কি হয়েছে? তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে তোমরা আমাকে দেখে খুব ভয় পাচ্ছো! কোন অঘটন ঘটিয়েছো নাকি?
নিশাত কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল; তার আগেই ঈশিতা ফট করে বলে উঠলো, তোমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে? তবে বাবা,তোমার না ট্রেনিং ছিল ময়মনসিংহে? তুমি চলে আসলো কেন হঠাৎ?

ইকবাল হোসেন অবাক হয়ে তার দুই মেয়েকে বললেন, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বাসায় চলে আসাতে তোমরা খুবই বিপদে পড়ে গেছো!!

নিশাত উত্তর দিল, না বাবা… কোন সমস্যা নেই, আমরা তো কিছুই করিনি।
ইকবাল হোসেন তার বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেন, নিশাত বেশ সাজগোজ করে আছে। সাধারণত তার মেয়ে খুবই সাধারণ ভাবে থাকে, তার ভিতরে সাজগোজ করার প্রবণতা খুবই কম।
তিনি অবাক হয়ে নিশাতকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কোথাও গিয়েছিলে নাকি এত সাজগোজ করেছো দেখছি!
নিশাত প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। সে কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। সে এখন কি উত্তর দিবে ঠিক করে উঠতে পারছে না।
এমন সময় ঈশিতা বলল, না বাবা… আপু কোথায় যাবে! আপুতো বাসায় ছিল। ওই আমি আপুকে কিছু ছবি তুলে দিয়েছিলাম; এজন্য আপু একটু সাজুগুজু করেছে আর কি!!
– হঠাৎ ছবি তোলা?
– হ্যাঁ.. হ্যাঁ, ঐদিন বড় ফুপু কিছু ছবি চেয়েছিল আপু বিয়ের জন্য। সেজন্যই তুলেছিলাম আর কি!!

নিশাত অবাক হয়ে তার ছোট বোনের এত গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলা দেখছে। সে কখনোই এত সহজে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারে না।
অথচ তার ছোট বোন সাধারণ একটা কথাকে অতিরঞ্জিত করে সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারে। এই ক্ষমতা সে কোথা থেকে পেয়েছে.. কে জানে? হয়তো বা বড় ফুপুর কাছ থেকেই তার ভেতরে এসেছে!!

ইকবাল হোসেন তার ছোট মেয়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না। এরপর তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, এরপর থেকে যদি তোমাদের ফুপু নিশাতের কোন ছবি চায়… তাহলে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আর পড়াশোনার বাদ দিয়ে সময় নষ্ট করার কোন দরকার নেই।এসব বিষয় নিয়ে এত মাতামাতি করবে না।এত তাড়াতাড়ি নিশাতের বিয়ে দিচ্ছি না আমি।এখন তোমরা ঘরে যাও।

বাবার কথা শুনে ঈশিতা এবং নিশাত নিজেদের ঘরে চলে যাচ্ছিল। ইকবাল হোসেন তার ছোট মেয়ে ঈশিতাকে পিছু ডেকে হাতে একটা বই দিলেন।

ঈশিতা বইটির লেখকের নাম দেখে আনন্দ উচ্ছসিত হয়ে উঠলো। বাবা তুমি এই বইটা কিনেছো!! জামশেদ হায়দারের নতুন বই!!

ইকবাল হোসেন বললেন, ‘হ্যাঁ। আসার সময় বইয়ের দোকানে দেখলাম বইটা। তোমার তো পছন্দের রাইটার।‌ এজন্য তোমার জন্য নিয়ে আসলাম’।

– ‘থ্যাঙ্কস বাবা’।

ঈশিতা আনন্দে লাফাতে লাগলো। তার আনন্দ দেখে ইকবাল হোসেন আরো বেশ ভালো লাগলো।

নিশাত রাতে ঘুমানোর সময় লক্ষ্য করল তার বোন গভীর মনোযোগ সহকারে বাবার তার আনা বইটি পড়ছে।
– ‘কিরে রাতে ঘুমাবি না?নাকি সারারাত বই পড়বি’?

– “ধুর আপু… এখন কি আর ঘুম আসে নাকি? জামশেদ হায়দারের নতুন বই… আর আমি না পড়ে ঘুমাতে যাবো”!!
– “বইয়ের নাম কি”?
– “ডিপ্রেশন”।
– ‘কেমন লাগছে পড়ে’?
– তেমন ভালো লাগছে না। আবার খারাপও লাগছে না। তবে সাধারণত সে থ্রিলার জনরায় লেখে। এই বইটা সম্পূর্ণই আলাদা। পাতায় পাতায় শুধু পরামর্শ!!

– তোর তো আবার পরামর্শ ভালো লাগেনা…পড়ছিস কিভাবে?
– “তা লাগে না বৈকি। তবে জামশেদ হায়দারের পরামর্শ আমি অবশ্যই শুনবো। আচ্ছা, আপু আজকে কি হলো কিছুতো বললে না… সে কেমন দেখতে? বলো না… কি হলো”?
– “পরে বলব। এখন বলতে ইচ্ছা করছে না”।

ঈশিতা আর কোন প্রশ্ন না করে, মনোযোগ দিয়ে বই পড়তে থাকলো।
নিশাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভাগ্যিস বাবা বইটা এনে দিয়েছিল তাকে। নাহলে তার বোন আজ সারারাত প্রশ্ন করতে করতে পাগল করে দিত তাকে।

নিশাত বারান্দায় গিয়ে বসলো, তার ফোনটি বেজে উঠল। নিশাত দেখল, জায়ান তাকে কল করেছে। এই প্রথম জায়ান তাকে কল করেছে। নিশাত কলটা রিসিভ করল এবং পাশের বিল্ডিংটির দিকে তাকালো। জায়ানতো বলেছিল সেখানেই থাকে!!
কোন ফ্লোরে থাকে সে? দশতলা বিল্ডিং এর প্রত্যেকটা ফ্লোরের দিকে নিশাত চোখ বুলিয়ে হতাশ হয়ে গেল। জায়ানকে দেখা গেল না… কিংবা দেখা গেলেও সে বুঝতে পারল না।

– ‘হ্যালো নিশাত’?
– ‘হুম’।
– ‘কি করছো’?
– ‘তেমন কিছু করছি না। বারান্দায় বসে আছি। আপনি তো বলেছিলেন, আপনি আমার সামনেই থাকেন। কয় তলায় আছেন আপনি’?

– আচ্ছা… ঠিক আছে। বলছি। তুমি খেয়াল করো তোমার সামনে একটা বাসার আলো বার বার জ্বলছে নিভছে। আমি লাইট অফ অন করছি ।

নিশাত সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তার সামনের বিল্ডিংটির ছয় তলার একটি বাসার আলো বারবার জ্বলছে নিভছে। সে বুঝতে পারল এখানেই জায়ান আছে। নিশাত মৃদু হাসলো। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে।

হঠাৎ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে জায়ান নিশাতকে হঠাৎ করে বলল, “শুভ জন্মদিন নিশাত”।
” তোমার জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত সুন্দর হোক”।
নিশাত চমকে উঠলো। পরক্ষণেই সে দৌড়ে ঘরে এসে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত বারোটা বেজে গেছে…হ্যাঁ আজকে তার জন্মদিন! অথচ তার নিজেরই মনে ছিলোনা।

নিশাত আবারো বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ফোন থেকে জায়ানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘কি অবাক হলে নাকি’?
– ‘এবার তেমন অবাক হইনি। আপনি যখন আমার সম্পর্কে সবই জানেন… জন্মদিন জানাটা খুব একটা বিচিত্র কিছু নয়’।

জায়ান হাসলো… বেশ শব্দ করেই হাসলো। নিশাতের কানে জায়ানের হাসি বেজে উঠলো।
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সে নিশাতকে বলল, “নিশাত আকাশের দিকে তাকাও”।

নিশাত তাকালো… মুহূর্তেই আকাশে যেন আতশবাজির ঝড় বয়ে গেল! আতশবাজির আলোতে সম্পূর্ণ আকাশ যেন আলোকিত হয়ে উঠলো, চারিদিকে আলোক রশ্মির ঝলকানি বয়ে গেল। মধ্যরাতে হঠাৎ করে আচমকাই এত আতশবাজির শব্দে আশেপাশের বিল্ডিংয়ের সবাই বারান্দায় এসে ভিড় জমালো, আতশবাজির উৎসব দেখার জন্য। আতশবাজি দেখার জন্য রাস্তায় উৎসুক জনতার ভিড় জমে গেল।

নিশাত হতবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশিতা ঘরে বসে বই পড়ছিল, সেও দৌড়ে বারান্দায় চলে আসলো। নিশাতের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাপি বার্থডে আপু”।এবার বোধহয় জায়ান ভাই আমার আগেই তোমাকে উইশ করে দিয়েছে। কথাটা শেষ করেই ঈশিতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।

নিশাত এতক্ষণ চুপ করে ছিল। কৌতুহল দমিয়ে না রাখতে পেরে জায়ানকে জিজ্ঞেসা করল, “এগুলো কি আপনিই করছেন? আমি খুবই ভালো লাগছে… এত সুন্দর”!!

– “হ্যাঁ, আমি করছি। তবে নিজের বুদ্ধিতে করিনি। ধার করা বুদ্ধি। অনেক সিনেমা নাটকে দেখেছি, নায়িকার বার্থডেতে নায়ক আতশবাজির উৎসব করে… সেখান থেকে এই আইডিয়া চুরি করে তোমার জন্মদিনে এপ্লাই করলাম”।

– ‘আমরা কি নায়ক নায়িকা নাকি’?

– ‘আমার কাছে তো সেরকমই মনে হচ্ছে; আমি আবার মিথ্যা কথা বলতে পারি না’।

নিশাত হাসলো। সে বলল, সিনেমায় এগুলো দেখে যতটা ভালো লাগে… বাস্তবে তার চেয়েও বেশি ভালো লাগে। জীবনটা সিনেমার চেয়েও বেশি নাটকীয়।

সারারাত আর নিশাতের আনন্দে ঘুমই হলো না। তার জীবনের সবচেয়ে স্পেশাল দিন যেন আজকেই। একসাথে আনন্দ সে কখনোই পায়নি। অপরদিকে, ঈশিতা তার পছন্দের রাইটারের বই পড়তে পড়তে আর রাতে ঘুমানোর তাগিদ অনুভব করল না।

মধ্যরাতে ইকবাল হোসেন দুঃশ্চিন্তায় ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন। আজ তার ঘুম আসছে না।তিনি বিছানা দিকে তাকালেন সেখানে তার স্ত্রী রাহেলা বেগম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আজকে তিনি তার জীবনের বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ইকবাল হোসেন তার চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি ধার দেনায় জর্জরিত হয়ে এই মুহূর্তে আছেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডের কিছু সামান্য টাকাই এখন তার সম্বল। এসব টাকায় রাহেলা বেগমের দ্বিতীয় অপারেশন এবং প্রথম অপারেশনের দেনা শোধ করতে হয়তোবা শেষ হয়ে যাবে। দুটি মেয়ের ভবিষ্যৎ এখনো পড়ে আছে। এসব চিন্তা করতে করতে তিনি আর সারারাত ঘুমাতে পারলেন না। হাজারো দুঃশ্চিন্তা যেন তার বুকে চেপেছে। তিনি বুঝতে পারলেন গত কয়েকদিনের মতো আজ রাতটাও তার অনিদ্রায় যাবে।

জন্মদিনের সকালটা এবার নিশাতের ভিন্নভাবে শুরু হলো। সাধারণ জন্মদিনের কথাটাও তার মনে থাকে না। ভার্সিটিতে যাওয়ার পরে কিছু কমন ফ্রেন্ডদের উইশ… আর বাসায় ফিরে মায়ের হাতের পায়েস খাওয়া.. এতোটুকুই হয় প্রতিবার!

কিন্তু আজ যেন তার জীবনে একটি ভিন্নমাত্রা যুক্ত হল। সকালে বাইরের দরজায় নিশাত কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলেই দেখতে পেল, প্রচুর গিফট বক্স। এবার আর উড়ো পার্সেল আসেনি তার কাছে। সে জানে জায়ান এরকম কিছুই তার কাছে পাঠাবে। তবে গিফটের এত বাহার দেখে নিশাতের চোখ কপালে উঠে গেল। এত গিফট!!

ঈশিতা ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল‌। কলিংবেলের শব্দ শুনে সে ঘুম থেকে উঠে এসে.. চোখ ডলতে ডলতে বসার ঘরের এলো। দরজার সামনে এত গিফট আর গিফট গুলোর সামনে তার বড় বোনকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশিতার ঘুম ছুটে গেল।

সে নিশাতের কাছে গিয়ে বলল, আপু, এত গিফট!! জায়ান ভাই নিশ্চয়ই পাঠিয়েছে!
আপু একটা কথা কিন্তু ফাইনাল… এই গিফট গুলোর অর্ধেক কিন্তু আমার আর অর্ধেক তোমার!!

নিশাত কিছু বলল না। সে দরজার সামনে থেকে গিফট গুলো নিয়ে তাদের টেবিলে এনে রাখতে লাগলো। ঈশিতা ও কথা না বাড়িয়ে তার কাজে হাতে লাগলো। গিফটের বাক্স গুলোর সাথে একটা সুন্দর বার্থডে কার্ড পেল নিশাত। সবকিছুই যেন নিশাতের কাছে স্বপ্ন মনে হলো। ঈশিতা গিফটগুলো রাখতে রাখতে একটা নীল খাম পেল। খামটি থেকে একটা চিঠি বের হলো। ঈশিতা শব্দ করে চিঠিটি নিশাতকে পড়ে শোনাতে লাগলো,

প্রিয় নিশাত,
প্রথমেই তোমাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। তোমার এই জন্মদিনটা আমি তোমার সাথে সেলিব্রেট করতে চাই। আমি চাই, এই জন্মদিনটা তোমার জীবনে স্পেশাল হয়ে থাকুক। আজ সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো, তোমাকে একটি বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাব। ঈশিতাকে ও সাথে আনতে পারো।
ইতি,
তোমার বন্ধু জায়ান।

ঈশিতা চিঠিটা পড়ে নিশাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
ও মাই গড…এত তাড়াতাড়ি তোমরা বন্ধু হয়ে গেছো….!! কালে কালে যে আর কত কিছু দেখব!!
আপু…. আমি কিন্তু পিংক কালারের ড্রেস ছাড়া অন্য কোনো ড্রেস পড়ে যাব না। ঠিক আছে?

নিশাত চোখ গরম করে তার ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। রাগ করে সে ঈশিতাকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় আবারও কলিং বেল বেজে উঠল।

নিশাত দরজা খুলতে গেল। ঈশিতা ও তার পিছু পিছু আসলো। দরজা খুলতেই দরজার সামনে তারা কিছু পুলিশ অফিসারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। হঠাৎ করে তাদের বাসায় পুলিশ আসতে দেখে আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। নিশাত ঘাবড়ে গেল। হঠাৎই তাদের বাসায় পুলিশ আসার কারণ কি হতে পারে??
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here