উড়ো_পার্সেল (পর্ব -৩)

0
234

গল্প :#উড়ো_পার্সেল (পর্ব -৩)
লেখা:#নাজিফা_তাবাসসুম

নিশাতের বেশ মজা লাগলো চিরকুটটি পড়ে। একটু লজ্জা অনুভব করলো নিশাত। এমন সময় ঈশিতা তার পিছন থেকে এসে তার হাত থেকে চিরকুটটি টেনে নিয়ে বলল,’আপু তুমি আরো একটা উড়ো পার্সেল পেয়েছো’!!
আর আমাকে বলোনি। আরে, আপু তুমি তো দেখছি লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছো। লাল থেকে আস্তে আস্তে বেগুনি হয়ে যাচ্ছ…!!

-অ্যাই তুই আমার জিনিস নিয়েছিস কেন?
-ও মাই গড! এই কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার জিনিস হয়ে গেলো এইগুলো। আপু তোমার ভিতরেতো কোনো না কোনো ব্যাপার অবশ্যই আছে …

নিশাত ঈশিতার এসব কথাবার্তা উড়িয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে চিরকুট এবং ডায়েরী দুটো নিয়েই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। আর ঈশিতাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিল। এই ফাজিলটার জন্য কিছু দেখার উপায় নেই। পিছন থেকে লাফ মেরে চলে আসে!

বেশ কয়েক ঘন্টা পর,
ঈশিতা বাইরে থেকে বারবার তাকে ডাকছে।
– আপু প্লিজ দরজা খুলো। রাত হয়ে গেছে। ঘুমাবো না।
– ‘ফুপু কোথায়’?

– ফুপুতো সেই কখন চলে গেছে। এখন‌তো দরজা খোলো।
নিশাত দরজা খুলে দিল।

– আপু সেই কখন থেকে দরজা বন্ধ রেখে ছিলে। এখন খুললে। এতক্ষন বসে বসে কি দেখছিলে?

– এত কথা বলিস কেন? কথা বলা ছাড়া থাকতে পারিস না? বাচাল মেয়ে একটা!!
– হ্যাঁ। এখন তো আমি বাচাল হয়েই গেলাম। সত্যি কথা বললে তো বাচাল!!তাই না?
– চুপ করে থাক। তুই বেশি কথা বলিস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুইবোনের ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে। এমন সময় নিশাত দেখতে পেল তার মা হাতে বালিশ নিয়ে তাদের ঘরে চলে এসেছে।
নিশাত বলল, মা তুমি বালিশ নিয়ে এখানে কেন? ঘুমাওনি এখনও?
– না আজকে আমি তোদের সাথে শোবো।
– কেন কি হয়েছে? বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?

নিশিতার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই; ঈশিতা বলল, হ্যাঁ। আপু মায়ের বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে। ফুপু যে বারবার খালি তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে বাসায় আসে; সেজন্যই তো বাবার সাথে মায়ের ঝগড়া বেঁধেছে।

নিশাত বেশ রেগে গেল। সে বলল, এই আমি কি তোর কাছে জানতে চেয়েছি? আমি মার কাছে জিজ্ঞাসা করেছি। মুখের কথা টেনে নিয়ে কথা উত্তর দিস কেন?

তাদের দুজনের কথায় বিরক্ত হয়ে গিয়ে রাহেলা বেগম বললেন, এত ঝগড়া করলে কিন্তু ; আমি তোদের সাথে শোবো না। আমি ড্রইং রুমের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ছি।

এছাড়া তখন ঈশিতা তার মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা…তুমি আজকে আমার সাথেই ঘুমাবে! সব কতদিন তোমার সাথে ঘুমাই না।
অনেকদিন পর দুই মেয়ে এবং তাদের মা বেশ আনন্দ করে রাতে ঘুমাতে গেল।

পরদিন সকালে নিশাত ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করল তার মায়ের ভীষণ জ্বর এসেছে; সে প্রচন্ড চিন্তিত বোধ করল। সে জন্য সকালে মাকে কোন কাজ করতে না দিয়ে বাসার সব কাজ একই সে করতে লাগলো। ঈশিতা যখন দেখতে পেল সে মায়ের জ্বর এসেছে, নিশাত সব কাজ করছে তখন বুঝতে পারল, এখন যদি সে বাসায় থাকে; তবে তারও কাজ করা লাগবে।

সেজন্য সে কাজ ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে স্কুলে চলে গেল। নিশাত তাকে আজকে বাসায় থেকে যেতে বললেও সে তার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের বাহানা দিয়ে চলে গেল।

নিশাত বিষয়টা বুঝতে পেরে ও কিছু বলল না। কারণ সে জানে তার বোন কিছুটা এই ধরনের। তাকে বদলানো তার পক্ষে সম্ভব না।

নিশাতের বাবা সকালে অফিসে যাওয়ার সময় দেখলেন তার স্ত্রীর ভীষণ জ্বর। তিনি অফিস থেকে ছুটি নিতে চাইলেন, কিন্তু তার অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং থাকার জন্য তাকে যেতে হল। নিশাতের কাছে তিনি নিশাতের মায়ের দায়িত্ব অফিসে উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

বাবা অফিসে চলে যাওয়ার পর, নিশাত এক মগ কফি বানিয়ে নিল। তারপর মার পাশে বসে মাকে জলপট্টি দিতে থাকলো ।

নিশাতের চোখের কোনে পানি জমছে। কারন সে জানে তার মায়ের এমন জ্বর প্রায়ই হয় এর কারণটা কারোর আর অজানা নয়। রাহেলা বেগমের এক বছর আগে ব্রেন টিউমারের অপারেশন হয়েছিল। তিনি তারপরও পুরোপুরি সুস্থ হননি। বরং আস্তে আস্তে তার শরীরে স্থিরতা চলে আসছে। নিশাত তার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসে । মায়েরা এমন অবস্থা তার দেখে বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে।

তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। যদি অপারেশন করাতে হয় , তাহলে সে টাকা জোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার মায়ের প্রথমবার অপারেশন করার সময় অনেক টাকা ধার দিয়েছিলে তার বড় ফুপু।

সেজন্যই হয়তোবা বড় ফুপু তাদের পরিবারের উপর অতিরিক্ত চাপ দেয় এবং তিনি হাতের মুঠোয় রাখার চেষ্টা করেন। তার বাবাও কিছু বলতে পারেন না। বেতনের অর্ধেকের বেশি টাকাই তার ধার দেনা পরিশোধ করতে চলে যায়। যার ফলে মাস শেষে তাদের সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে।

নিশাত তার মাকে সকালের নাস্তা খাইয়ে দিল ; কারণ ঔষধ খেতে হবে। তিনি একদমই খেতে চাচ্ছিলেন না, তারপরও সে জোর করে খাইয়ে দিল।

কিছুক্ষণ পর, রাহেলা বেগমের বেশ কয়েকবারই বমি হল। নিশাত তার মায়ের জ্বর মেপে দেখল ১০৪° ডিগ্রি… সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। মাকে দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে এটা সে বুঝতে পারছে।

তাই সে তার বাবাকে ফোন দিতে গেল। কিন্তু ফোন দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলো,তার মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। তার মাকে রেখে সে কোথাও যেতে পারছেনা।
নিশাত দ্রুত বালতিতে করে পানি নিয়ে এসে তার মায়ের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। কিন্তু তার জ্বর যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে। তাই সে তার মাকে সে অবস্থায় রেখেই , দ্রুত পাশের বাসায় সে বাসায় গিয়ে একটা ফোন করার জন্য মোবাইল চেয়ে নিয়ে আসলো।
কিন্তু; বাবাকে ফোন করতে গিয়ে দেখল তার বাবা ফোন ধরছে না।

সেই একই মুহূর্তে ইকবাল হোসেন তার অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিংয়ে থাকার কারণে তিনি ফোনটা ধরতে পারছিলেন না।

নিশাত প্রায় পাগল হয়ে গেল; সে এখন কি করবে বুঝতে পারছে না!! সে কি করে মাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে? কারো সাহায্য প্রয়োজন। কিন্ত সে তার মাকে একা রেখে সে যেতেও পারছে না।
এমন সময় নিশাত জোরে জোরে কাঁদতে থাকলো। সে অল্পতেই ভেঙে পড়ে । তার মায়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

সে বাইরের দরজা খোলা রেখেই নিচতলা থেকে একজনকে ডেকে আনতে যাবে। ঠিক তখনই অ্যাম্বুলেন্সের কর্কশ সাইরেন তার কানে ভেসে আসলো।

সে দ্রুত বারান্দায় দৌড়ে দেখলো, নিচে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে । অ্যাম্বুলেন্স থেকে দুইজন ওর্য়াড বয় স্ট্রেচার নিয়ে তাদের বিল্ডিংয়ের দিকেই আসছে।
নিশাত অবাক হয়ে গেল। তবে এখন তার অবাক হওয়ার সময় নেই। সে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে লাগলো, তাদের কাছে যাওয়ার জন্য।
পরক্ষণেই সে বিস্মিত হয়ে গেল কারণ তারাই তার কাছে আসছিল তার মাকে হসপিটাল এ নেয়ার জন্য।

নিশাতের এই মুহূর্তটায় এত প্রশ্ন করার সময় ছিলনা। সে দ্রুত তার মাকে নিয়ে, বাইরের দরজার তালা মেরে, বাসায় থাকা কিছু টাকা নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স উঠে গেল।

অ্যাম্বুলেন্সটি একটি বেশ স্বনামধন্য বেসরকারি হসপিটালের । নিশাত চিন্তিত বোধ করল।
কারণ হসপিটালে বিল পরিশোধ করার মত টাকা সে সাথে করে নিয়ে আসেনি। হসপিটালে মাকে এডমিট করার পর সে অবাক হয়ে দেখল, আগে থেকেই সব বিল পরিশোধ করা আছে এবং তার মাকে এডমিট করানোর সকল ব্যবস্থা করা আছে।

সে জিজ্ঞেস করল কাউন্টারে গিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাসা করল,

– আমার মায়ের নাম কি আগে থেকেই এডমিট করে আছে?
– ‘ম্যাম, সেটা বলতে পারবো না। তবে কেউ একজন ফোন করে আপনার মায়ের নাম এডমিট করে, আপনার আমাদের কাছে এড্রেস দিয়ে দিয়েছিল, আমাদেরকে এম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য’।
‘আমরা ততটুকুই দায়িত্ব পালন করেছি এবং বিল অনলাইনে পেমেন্ট হয়ে গেছে’।

নিশাতের বুঝতে বাকি থাকল না, সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটিই তাকে বিপদে সাহায্য করেছে। সে মনে মনে ভীষণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল তার ওপর।

নিশাত হসপিটালের টেলিফোন থেকে তার বাবাকে ফোন দিল। ততক্ষণে তার মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়ে গিয়েছে। জ্বর আস্তে আস্তে কিছুটা নেমে এসেছে। নিশাতর বাবা তার স্ত্রীর এই অবস্থার কথা শুনে দ্রুত সে হসপিটালে চলে আসলেন। এসে নিশাতকে দেখতে পেলেন।

– তুমি একাই তোমার মাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছো? তুমি আমাকে ফোন দাও নি কেন?

– বাবা, তোমার ধারণা আছে তোমার ফোনে কতবার ফোন দিয়েছি!! তুমি জানো? তুমি ফোন ধরছিলে না।

– আচ্ছা নিশাত, এখন তো হসপিটালের বিল পেমেন্ট করতে হবে?
– না বাবা। সেসব নিয়ে তোমার চিন্তা করার কিছু নেই। কেউ একজন আগে থেকেই সব বিল পেমেন্ট করে দিয়ে গেছে।
– কে করেছে?

– সেটা বলতে পারবো না , বাবা। আমার ধারণা আমাদের বাসায় যে ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে নজর রাখছিল, সে হয়তো আমাদের এই বিপদে সাহায্য করেছে।

– তোমার মায়ের এখন কি অবস্থা? ডাক্তার কি বলেছে?

– ডাক্তার এখন পর্যন্ত খারাপ কিছু বলেননি। কিন্তু বলেছে তার কন্ডিশন এখনো খারাপ বলা যাচ্ছে না। আরো কিছুদিন তারা দেখবেন । এরপরে যদি মনে হয় অপারেশনের প্রয়োজন রয়েছে, তবেই অপারেশন করাতে হবে।

কথাগুলো শেষ করেই নিশাত লক্ষ্য করল, তার বাবার মুখটা শুকিয়ে গেছে। কারণটাও সে বুঝতে পারল, কারন এখন যদি অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে; তবে সেই টাকাটা তাদের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাহলে কি তার মায়ের অপারেশন টা হবে না?…

হাসপাতালে রাতে নিশাতের বাবা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিশাত এবং ঈশিতাকে তিনি বাসায় পাঠিয়ে দিলেন।
ঈশিতা বিকেলে বাসায় এসে তার মায়ের হসপিটালে থাকার খবর সোজা হসপিটালে চলে এসেছে, তার মায়ের এরকম অবস্থা দেখে সে অনেক অনুতপ্ত হয়েছে। সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছিল।

ঈশিতা কান্না করতে করতে নিশাতকে জড়িয়ে ধরে, বারবার সরি বলছিল।
কারণ ঈশিতার এই খামখেয়ালিপনার জন্য আজ তাদের মায়ের একটি বিপদ হয়ে যেতে পারত।

রাতে তাদের মায়ের জ্বর কমে আসায় তাকে কেবিনের শিফট করা হলো।

নিশাত ঈশিতাকে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় তারা দুজনই অনুভব করল, তাদের দুজনকে কেউ অনুসরণ করছে। বাসার বেশ কাছাকাছি চলে আসার পর বাসায় ঢোকার সময় ঈশিতা দেখতে পেল তাকে, যে এতক্ষণ তাদেরকে অনুসরণ করছিল, সেই মানুষটিকে।
ঈশিতা নিশাতকে সেই মানুষটিকে দেখানোর চেষ্টা করতে গেলেই…. মানুষটি দৌড়ে পালিয়ে গেল।

নিশাত এবং ঈশিতা দুজনেই দেখল, কালো হুডি পড়া একজন যুবক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ঈশিতা দৌড়ে সেই যুবকটির পিছু নিতে গেলে নিশাত তাকে থামিয়ে দিল। ভয়ে তারা দ্রুত বাসার উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো। বাসার সামনে গিয়ে দরজার সামনে গিয়ে নিশাত আরো একটি পার্সেল আবিষ্কার করল!!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here