উড়ো_পার্সেল #পর্ব_১_ও_২

0
845

উড়ো_পার্সেল
#পর্ব_১_ও_২
নাজিফা_তাবাসসুম

“আরেকটা উড়ো পার্সেল এসেছে”!! “আরেকটা উড়ো পার্সেল এসেছে”!! নিশাত আপু এদিকে আসো! মা এদিকে আসো! তাড়াতাড়ি আসো, বলেই ঈশিতা চেঁচিয়ে ডাকতে থাকলো। রাহেলা বেগম মাত্র চুলায় কড়াই বসিয়ে গরম তেলে ইলিশ মাছ ভাজার জন্য ছেড়েছেন… এমন সময় ছোট মেয়ের এতো জোরে চিৎকার শুনে তিনি ভয়ে তিনি তাড়াহুড়া করে খুন্তি হাতে নিয়েই বসার ঘরে চলে এলেন। নিশাত পাশের রুমে বসে ছিল; সেও তাড়াহুড়া করে আসতে গিয়ে দরজায় পা আটকে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে সে বেশ সে ব্যাথাই পেল।
রাহেলা বেগম তার ছোট মেয়ে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজও কি ৫০ লিটার সয়াবিন তেল পার্সেল এসেছে?

ঈশিতা জোড়ে চেঁচাতে চেঁচাতে গলা ভেঙে ফেলেছে। তাই তার গলা দিয়ে শো শো করে শব্দ বের হতে লাগলো।
নিশাত বেশ রেগে তার দিকে তাকিয়ে বলল, এই কি এমন পার্সেল এসেছে যে এত জোরে চিৎকার করছিস? তার কথা শেষ হবার পরক্ষণেই রাহেলা বেগম এবং তার বড় মেয়ে নিশাত দুজনেই দেখলো ঈশিতার হাতে উজ্জল কাঁচের মতো কিছু একটা চকচক করছে।
‘এই তোর হাতে এটা কিরে’? রাহেলা বেগম প্রশ্ন করলেন।
ঈশিতা তার হাত উঁচু করে জিনিসটা ওপরে তুলে দেখালো। তার হাতে একটা একটা নেকলেস। নেকলেসে সূর্যের রশ্মি পরার সাথে সাথেই সূর্যের আলোতে নেকলেসটি ঝলমল করে উঠলো।

রাহেলা বেগম এবং নিশাত দুজনেরই চোখ কপালে উঠে গেল।
নিশাত ভালো মতোই বুঝতে পারছে জিনিসটা কি! তারপরও সে ক্ষীণ গলায় তার ছোট বোনকে জিজ্ঞেসা করলো, ‘ঈশিতা এটা কি’?

ঈশিতা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে বললো আপু বুঝতে পারছো না এটা কি? এটা ডায়মন্ডের নেকলেস!!
ঈশিতার কথা শেষ হতেই রাহেলা বেগম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। চিৎকার করে বলতে চাচ্ছিলেন, “ডায়মন্ডের নেকলেস”? আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে দ্রুত তিনি বাম হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন এবং তার ডান হাতে থাকা খুন্তি টি মেঝেতে রেখে দিলেন। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন,’আজ ও নিশাতের জন্য ডায়মন্ডের নেকলেস পার্সেল এসেছে’।’এত একটা দামী জিনিস কেউ দিতে পারে নিশাতকে’?

নিশাত তার মায়ের এরকম পাগলপ্রায় দশা দেখে মায়ের পাশে গিয়ে বলল, মা…’এবার কিন্তু আমার ভয় লাগছে.. এবার পার্সেল হয়ে এত দামি একটা ডায়মন্ডের নেকলেস এসেছে’।

বড় বোন এরকম ভয়ার্ত স্বরে কথা শুনে ঈশিতা তার মায়ের পাশে গিয়ে বসে বলল, ‘আরে মা!তুমি এত চাপ নিচ্ছ কেন? তুমি কি বুঝতে পারছ না’?
এর আগেরবার যখন তেলের দাম যখন বেশি ছিল। তখন তুমি রান্নায় খুব কম তেল দিয়ে রান্না করতে। আপু একদিন রাতে তোমার রান্না খেয়ে বলল, মা এ কি রান্না করেছো?এত কম তেল দিয়ে।

তারপরের দিনইতো ৫০ লিটার সয়াবিন তেল এসেছিল। সেটা দেখেই আমরা কত খুশি হয়েছিলাম। আর এখন তো দেখো একটা ডায়মন্ডের নেকলেস এসেছে। এটা কি বিশ্বাস করা যায়?

নিশাত এবার তার বোনকে জিজ্ঞেস করল, এই পার্সেলটা তুই কোথায় পেলি?

– বিছানার উপর পড়েছিল।
-বলিস কি? আমাদের বাসায় কি আজকে কেউ এসেছিল নাকি? বিছানায় কি করে পার্সেল আসবে?

-জানিনা আপু। এই যে, এই ছোট বাক্সটা। এতেই ছিল।
– আপু জানো, ‘আমার না এখন খুব ভালো লাগছে। তোমাকে কেউ পছন্দ করে এত সুন্দর সুন্দর গিফট পাঠাচ্ছে। তাকে যদি একবার দেখতে পেতাম’!!

রাহেলা বেগম তার বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশাত , আমার মোবাইলটা একটু নিয়ে আয় তো। তোর বাবাকে ফোন দিয়ে বলি। ‘আমার না বুকের ভিতর ব্যথা করছে, এই নেকলেস দেখে’।

নিশাত কিছু বলার আগেই তার ছোট বোন এসে তাদের মায়ের কাছে গিয়ে বলল, মা তোমার একটা জিনিস পেতে না পেতেই তোমার বাবার কাছে বলতে হবে? একটু সময় দাও না। আগে একটু জিনিসটা দেখি। দেখো কত সুন্দর নেকলেসটা!কত বড় পাথর গুলো…দেখো কত বড় বড় পাথর!!
– এটা যে ডায়মন্ডের নেকলেস তুই সেটা কি করে বুঝতে পারছিস?
– আপু আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর যে এটা ডায়মন্ডের নেকলেস।

তার কথা শেষ না হতেই বসার ঘরে বসে থাকা তিনজনেরই নাকে একটি পোড়া গন্ধ ভেসে আসলো। রাহেলা বেগম লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
তিনি বললেন, ‘ইলিশ মাছ তেলে ছেড়ে চলে এসেছি’। ‘পুড়ে গেছে’! বলেই তিনি দৌড়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন

তার পিছে পিছে দুই মেয়ে রান্নাঘরে গেল। গিয়ে দেখলো… রান্নাঘরের বেহাল দশা। রান্নাঘর ধোঁয়ায় ধূসরিত হয়ে গেছে। মাছ পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

রাহেলা বেগম বেশ মন খারাপ করা গলায় বললেন তোদের বাবা কত শখ এত বড় ইলিশ মাছ এনেছিল ইশ্ , মাছটা পুড়ে গেল!!

ঈশিতা বলল, মা তুমি মাছ নিয়ে আছো? কিন্তু তুমি দেখছো না যে আমরা কি পেয়ে গিয়েছি? তুমি কি বুঝতে পারছ না এই ডায়মন্ডের নেকলেস বেঁচে আমরা সারা জীবন হাজারটা বড় ইলিশ মাছ খেতে পারবো!!

সকাল বেলায় ডায়মন্ডের নেকলেসের এরকম অদ্ভুত আগমনে বাসায় থাকা দুই মেয়ে এবং তাদের মায়ের আর সারাদিনে তেমন কোন কাজই হলো না। রাহেলা বেগম যতবারই রান্না ঘরে যাচ্ছেন ততবারই তার মন পড়ে আছে ডায়মন্ডের নেকলেসের দিকে। বারবার ঘরে এসে দেখে যাচ্ছেন।

তার বড় মেয়ে নিশাত যার জন্যই মূলত এই পার্সেল গুলো আসে। সেও আজ পড়াশোনায় মন দিতে পারছে না। আগামীকাল সেকেন্ড সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা।
আর ছোট মেয়ে ঈশিতা সকালে স্কুলেও যায়নি। প্রাইভেট, কোচিং সবকিছুই যেন তার বন্ধ হয়ে গেছে। সামনে তার ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা। তার সেদিকে কোন নজর নেই। তার বোনের জন্য আসা সেই অচেনা কারোর পাঠানো উপহারের দিকেই মন পড়ে আছে। আর ক্ষণে ক্ষণে বোনের কাছে গিয়ে আফসোস করে বলছে, আপু তোমার জন্য কত সুন্দর ভাগ্য। এত এত গিফট আসে।

নিশাত তার ছোট বোনের কথায় বিরক্ত হয়ে গেছে। তবে এত সব কিছুর মাঝে কারোর আর খেয়ালই থাকলো না, ডায়মন্ডের নেকলেসের বাক্সে একটা ছোট চিরকুট ও ছিল।

সন্ধ্যার সময় রাহেলা বেগম ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে সেই চিরকুটটি পেলেন।
তিনি চিরকুটে হাতে পেয়েই তার বড় মেয়ে কে ডাক দিলেন, নিশাত মায়ের কাছে এসে বলল, কি হয়েছে মা? ডাকছো কেন?

-এই দেখতো.. এই বাক্সে একটা চিরকুট ছিল আগের বারের পার্সেল গুলোর মত। পড়ে দেখতো কি লেখা আছে এখানে। আমি এখনো পড়ে দেখিনি ভালো করে।

নিশাত তার মায়ের হাত থেকে চিরকুটটি নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করলো চিরকুটে লেখা,

“প্রিয় নিশাত”,
‘তুমি খুব ভালো আছো’ জানি। কিন্তু আমি খুব একটা ভালো নেই, আমার মন খুব খারাপ। আমি জানি তুমি আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছো। তুমি জানতে চাও কে সেই অচেনা ব্যক্তি; যে তোমাকে গত তিন মাস ধরে গিফট দিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো না সময় আসেনি সব কিছু বলার। আমি জানি, তোমার বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতে তুমি আগামীকাল যাবে পরীক্ষা শেষ করে। কিন্তু তোমার তেমন কোনো অর্নামেন্টস নেই বার্থডে পার্টিতে পরার মতো। সেজন্যই এই ছোট্ট উপহার টা তোমার জন্য পাঠালাম। প্লিজ, এটা কিন্তু পরবে। আমার খুব ভালো লাগবে।
ইতি,
তোমার অচেনা কেউ….

চিঠিটি পড়া শেষ হতেই নিশাতের মা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। পাশের ঘর থেকে ঈশিতা কান খাড়া করে, পুরো চিঠি পড়া শুনে সে দরজার কাছে একলাফে চলে এসে;দুই হাতের তালু কচলাতে কচলাতে বলল , “হাউ রোমান্টিক”…”হাউ সুইট” আপু । তোমার লাইফটা পুরো সেট হয়ে গেল।

ছোট বোনের কথা এবার নিশাত আর চুপ করে থাকতে পারল না। প্রচণ্ড রেগে গেল। হাতের পাশে শোপিসটা তাকে দিকে ছুড়ে মারতে গেল। ঈশিতা দৌড়ে পালিয়ে গেল।

রাতে ইকবাল হোসেন অফিস থেকে বাসায় এসে দেখতে পেলেন বাসার পরিবেশ বেশ থমথমে। অন্য সময় তার দুই মেয়ের মধ্যে ঝগড়াঝাটি,মারামারি, খুনসুটি লেগেই থাকে। আজ আবার কি হল?বাসার পরিবেশ এত ঠান্ডা কেন?
এসব ভাবনা চিন্তা করতে করতেই তার স্ত্রীর রাহেলা তার কাছে এসে, তাকে ডেকে পাশের রুমে নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল।

তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন , ফিসফিস করে কথা বলছ কেন? স্বাভাবিক ভাবে কথা বল।

রাহেলা বেগম ফিসফিস করেই বললেন , ‘জানো আজকে নিশাতের নামে কি পার্সেল এসেছে’?
– ‘আজো পার্সেল এসেছে নাকি’?
– হ্যাঁ। আজকে সে নিশাতের কাছে একটা ডায়মন্ডের নেকলেস পাঠিয়েছে।
– বল কি! ইকবাল হোসেন তার স্ত্রীর কথা শুনে চমকে উঠলেন।
রাহেলা বেগম মাথা নাড়লেন।

রাতে খাওয়ার সময় ইকবাল হোসেন তার বড় মেয়েকে বললেন, ‘তোমার কাছে নাকি আজ একটি পার্সেল এসেছে’?
‘নিশাত খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো’।
– যাও তুমি নেকলেসটা নিয়ে আসো আমি দেখব।

নিশাত চেয়ার থেকে উঠার আগেই তার ছোট বোন লাফ মেরে বলল, বাবা আমি নিয়ে আসছি।বলার সাথে সাথে সে লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের ঘরে চলে গেল ।পরমুহুর্তেই নেকলেস হাতে করে বাবার সামনে হাজির হয়ে গেল।

ইকবাল হোসেন এত সুন্দর এবং এত দামি একটা নেকলেস দেখে বিস্মিত হলেন।
ঈশিতা হড়বড় করে বলতে লাগলো, ‘বাবা জানো’? ‘আপু না ঐ দিন টিভিতে একটা হীরার নেকলেস দেখে পছন্দ করেছিল’।

‘আজ দেখো এই হুবহু সেই একই ডিজাইনের নেকলেস বাসায় চলে এসেছে। নেকলেসের সাথে দেওয়া চিরকুটে সে কালকে আপুর বান্ধবীর জন্মদিনে এই নেকলেস পড়ে যেতে বলেছে’।

নিশাত মাথা নিচু করে বসে আছে। তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে।তারই ছোট বোন বাবার সামনে তার আর কোন মান সম্মান রাখবে না; তা বোঝাই যাচ্ছে।
– নিশাত কালকে তোমার বান্ধবীর জন্মদিন?
-হ্যাঁ বাবা।
– তুমি কি যেতে চাচ্ছ?
– তুমি যদি যেতে দিতে পারমিশন দাও। তবেই যাব বাবা।
– পারমিশন নিয়ে তোমার চিন্তা করার কিছু নেই। কিন্তু এই নেকলেস পড়ে যাওয়ার কথা তুমি চিন্তাও করবে না। এসব কিন্তু এবার বড্ড বাড়াবাড়ি লাগছে! কে বা কে, চিনি না। জানি না। এভাবে একটার পর একটা গিফট পাঠিয়েই যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত। আমাদের এখনই পুলিশকে জানানো উচিত।

ইকবাল হোসেন এর কথা শেষ হতেই তার ছোট মেয়ে ঈশিতা কাঁদো কাঁদো হয়ে বাবাকে বললো, বাবা তুমি এমনটা করতে পারো না। তুমি যদি পুলিশকে জানিয়ে দাও তাহলে তো আমরা এরকম উড়ো পার্সেল পাবো না।
ইকবাল হোসেন বেশ রেগে ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উড়ো পার্সেল আবার কি’? গত তিন মাস ধরে তোমার মুখে খালি একই কথা শুনছি।

ঈশিতা স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আগের যুগে মানুষ মানুষকে উড়ো চিঠি পাঠাতো। সেই চিঠিতে কত ধরনের কথাবার্তা লেখা থাকতো। হুমকি থেকে শুরু করে কত কিছু’!!
আর এখানে আপুকে এত সুন্দর সুন্দর পার্সেল করে গিফট পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু কে পাঠাচ্ছে তা আমরা জানিনা। তাহলে এটাকেই তো উড়ো ও পার্সেল বলা যায়; তাই না বাবা!!

ঈশিতার বাবা আর ব্যাপার কোন উত্তর দিলেন না। ছোট মেয়ের এমন এমন অকাট্য ,অদ্ভুত যুক্তি শুনে তার উত্তর দিতে ইচ্ছা করল না। তিনি ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

রাতে দুবোন একসাথে ঘুমানোর সময় নিশাত তার ছোট বোনকে বলল, তুই যে এত বেশি ছটফট করছিস এই বিষয়গুলো নিয়ে। এটা কিন্তু ভালো না।

‘কারণ কে বা কে আমাকে এইসব গিফট পাঠাচ্ছে তা জানিনা । তার উদ্দেশ্য বা কি? কোন খারাপ উদ্দেশ্য তো থাকতেই পারে’!
‘তাই না’?
– না আপু। এটা হতেই পারে না ; বলেই দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন নিশাত পরীক্ষা শেষে তার বান্ধবীর বার্থডেতে আর গেল না। সে সোজা বাসায় চলে আসলো। আজকে শেষ পরীক্ষা হল। এ কয়েক দিনে পরীক্ষার চাপে একটু ভালো করে ঘুমানো হয়নি। তাই আজকে সে জমিয়ে করে ঘুমানোর পরিকল্পনা করেছে।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ঈশিতা বসে একটা গল্পের বই পড়ছিল। এমন সময় সে তার মায়ের আর্তচিৎকারে ভয়ে সে দৌড়ে রান্নাঘরে গেল। যতটা ভয় নিয়ে সে গিয়েছিল, সে গিয়ে ততটাই বিরক্ত হলো।

– ‘মা’, ‘তুমি চিৎকার করছিল কেন’?

– ‘দেখছিস না? একটা কালো দাঁড় কাক রান্না ঘরের জানালার এসে বসেছে’ । আমি চা বানাতে এসে দাঁড় কাক দেখে ভয় পেয়েছি। তুই জানিস না? দুপুরে দাঁড় কাক ঘরে এসে বসলে অমঙ্গল হয়?

– মা! তুমি আবার এসব কুসংস্কার কবে থেকে মানা শুরু করলে? বিরক্তিকর!! তুমি যেভাবে করে চিৎকার দিয়েছো। আমি তো ভয়েই ভেবেছি… কি না কি হয়ে গেছে…
সে রাগ দেখিয়ে রান্না ঘর থেকে আসার সময় একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করল। এই দাঁড়কাকটা অন্যসব কাকের মত নয়। কাকটির চোখ সম্পূর্ণই আলাদা লাগলো তার কাছে।
যা সাধারণ কাকের মত নয়। কিছু মুহূর্ত পরেই ঈশিতার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল। কারণ তার আর বুঝতে বাকি থাকল না; এটা আর কিছুই নয় একটি দাঁড়-কাক রূপী ড্রোন ক্যামেরা!!
….
#পর্ব_২

ইকবাল সাহেব সোফায় বসে আছেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার দুই মেয়ে। তাদের বসার ঘরে আজ আলোচনা সভা বসেছে। ইকবাল সাহেব বেশ গম্ভীর হয়ে তার ছোট মেয়ে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি ঈশিতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘প্রথম থেকে আবার বলো কি দেখেছো তুমি’?
ঈশিতা এক মুহূর্ত দেরি না করে বলতে শুরু করল, বাবা, ‘আমি আমাদের বাসার সামনে ড্রোন ক্যামেরা দেখেছি। সেই ক্যামেরাটা কাকের মত দেখতে। সেই ক্যামেরা দিয়ে আমাদের বাসায় ২৪ ঘন্টা নজর রাখা হচ্ছে‌। বাবা আমার তো মনে হচ্ছে এই ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে আপুর উপরেই নজর রাখা হচ্ছে’।

– দেখো ঈশিতা, ‘তুমি বেশি কথা বলবেনা’। যা প্রশ্ন করেছি, সে উত্তরটাই তোমার কাছে আমি শুধু চেয়েছিলাম। তুমি দেখছি অতিরিক্ত কথা বলছো।

– ‘স্যরি বাবা’।

ইকবাল হোসেনের বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ ব্যাপারে তোমার মন্তব্য কি’?
নিশাত তার বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘বাবা আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিনা’।
আমার কোন ধারণা নেই… যে কে আমাদের ফ্যামিলির দিকে নজর রাখছে।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি তাহলে ঘরে যাও। আরেকটা কথা, ‘এখন থেকে যা কিছুই হবে না কেন আমার কাছে বলবে।
কোন কিছুই লুকিয়ে রাখবে না’। ‘লুকিয়ে রাখার অভ্যাস কিন্তু একদমই ভালো না। এটা পরবর্তীতে অনেক বড় সমস্যায় ফেলবে তোমাকে’।
নিশাত বসার ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা ফেলবে এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। ঈশিতা দৌড়ে দরজা খোলার জন্য চলে গেল। সে ভীষন ছটফটে এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারেনা। অন্যদিকে নিশাত তার সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের; প্রচন্ড চুপচাপ এবং ধীর-স্থির মানুষ সে।
সবাই অপেক্ষা করছিল কে কলিং বেল দিয়েছে সেটা দেখার জন্য। পরবর্তী সবার কানে একটি মোটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো তার সাথে সাথে ঈশিতার অনবরত কথা।
ঈশিতা বসার ঘরে প্রবেশ করল তার পিছনের মানুষটি ঘরে ঢুকতেই সবাই হতাশ হয়ে গেল । কারণ মানুষটি আর কেউ নয়। ইকবাল হোসেনের বড়বোন সুমাইয়া এসেছেন। নিশাতের এবং ঈশিতার বড় ফুফু।
হঠাৎ তার এই আকস্মিক আগমনে ইকবাল হোসেন তার বড় বোনকে জিজ্ঞেসা করলেন, ‘বড় আপা’… তুমি হঠাৎ আমার বাসায়?

– কেন? আমি কি যখন তখন তোর বাসায় আসতে পারিনা? নাকি টিকিট কেটে, রেজিস্ট্রেশন করে, তোর বাসায় আসতে হবে?
ইকবাল হোসেন তার বড় বোনকে ভীষণ ভয় পান। তাই তিনি আস্তে করে বললেন, না মানে… তুমি আসার কথা আগে জানিয়ে দিলে আমরা কিছু আয়োজন করতাম ।
– ‘কেন আমি কি মেহমান নাকি? যে যখন তখন আসতে পারি না’?
‘আমি তো তোদের কে তো আপন ভাবি। আর তোরা আমাকে পর ভেবে ঠেলে দিচ্ছিস’?

অনবরত প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি রুমাল বের করে প্রত্যেকবারের মতো চোখের কোন মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন, ‘তোরা আমাকে পর ভাবিস’!! অথচ আমি তোদেরকে কত ভালোবাসি!!কত ভালোবাসি!!

নিশাত বিরক্ত হয়ে তার বড় ফুপুর এই ন্যাকা কান্না দেখতে থাকলো। তার ফুপু স্বভাবতই এরকম।
তিনি প্রত্যেকবারই কোন না কোন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের বাসায় আসেন এবং একইভাবে সেম ডায়লগ গুলো বলতে থাকেন। “তোরা আমাকে পর ভাবিস”!! “আমি তোদের আপন কত ভাবি”!! “তোরা নিষ্ঠুর”…”তোরা পাষান্ড”!!

তার এবারের উদ্দেশ্য কি? কে জানে? সে কথা চিন্তা করতেই নিশাতের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল।কারণ তিনি যতবারই আসেন… নিশাতের জন্য একটা না একটা পাত্রের সন্ধান নিয়েই আসেন। তিনি কখনো একা আসতে পারেন না। তার হ্যান্ড ব্যাগ ভর্তি পাত্রের ছবি অবশ্যই থাকবে। এবারে তিনি কোন পাত্রের সন্ধান এনেছেন কে জানে!!
নিশাত যেই দুশ্চিন্তা এতক্ষণ করছিল সেটাই যেন কয়েক মুহূর্তের মাঝে সত্যি হয়ে গেল।

নিশাতের বড় ফুপু সুমাইয়া রহমান ঈশিতাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি তার কাছে এনে দিতে বললেন এবং তিনি সোফায় পা তুলে বসলেন।
ঈশিতা তার বড় ফুপুর খুবই বাধ্য। কারণ তারা তার আর ফুফুর স্বভাবে বিশেষ একটা পার্থক্য নেই। দুজনে অতিরিক্ত বাচাল এবং দুজনের মন মানসিকতাও একরকম।

নিশাতের বড় ফুপু সোফায় পা তুলে বসেই ক্ষ্যান্ত হলেন না। তিনি তাঁর হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি ছেলের ছবি বের করে তার বাবার হাতে দিয়ে বললেন, দেখ ইকবাল.. এবার নিশাতের জন্য একটা বড়লোক পাত্রের সন্ধান নিয়ে এসেছি। ছেলে বিরাট বড়লোক। ঢাকায় দুইটা বিল্ডিং রয়েছে। জমিজমার অভাব নেই। ‘নিশাতের সাথে বিয়ে দিলে, নিশাত রাজরানী হয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবে’।

ইকবাল হোসেন তার বড় বোনের সাথে বিশেষ কথা বলতে পারেন না। তিনি মিনমিনে স্বরে বললেন, ‘নিশাতের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবো না’। ‘ও সবে সেকেন্ড সেমিস্টার ফাইনাল দিল’। আরোও কিছুদিন যাক। আগে অনার্সটা কমপ্লিট করুক তারপর এসব নিয়ে ভেবে চিন্তে দেখব।

সুমাইয়া ভীষণ রেগে ঝাঁজালো গলায় তার ভাইকে বললেন, মেয়েকে এখন বিয়ে দিব না.. তখন বিয়ে দিব.. এভাবে করে করে ঘরে বসিয়ে রেখে তো বুড়ি বানাচ্ছিস।

রাহেলা বেগমের এবার তার স্বামীর উপর প্রচন্ড রাগ হল। তিনি বুঝতে পারেন না, তার স্বামী কেন তার বড় বোন কে এত ভয় পান? তাদের মেয়ের বিয়ে তারা কখন দিবে না দিবে সেটি তাদের ব্যাপার। এখানে কেন বাইরের একজন মানুষ এসে খবরদারি করবে এই বিষয়টি রাহেলা বেগম এর কাছে খুব খারাপ লাগল। তারপরও তিনি কিছু বললেন না। হাজার হলেও এই মহিলাটি তার স্বামীর বড় বোন। তার তার সাথে তো আর খারাপ ব্যবহার করা যায় না।

তিনি নিশাতের বিয়ের প্রসঙ্গটা ঘোরানোর জন্য বললেন, ‘আপা আজ দুপুরে কি খাবেন?আপনার পছন্দের চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা করে দেবো’?
– না কিছু খাবো না। আসার সময় কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে এসেছি।
ঈশিতা বলল, ফুপু তুমি একা একা কাচ্চি খেলে আমাকে না জানিয়েই?
– তোকে ও খাওয়াবো। সমস্যা নেই। আচ্ছা সবাই প্রসঙ্গ অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছ কেন? যেই কথায় ছিলাম নিশাতের বিয়ে..
ফুপুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ঈশিতা বলল, নিশাতের বিয়ে হবে না এই তো ফুপু?
– মানে ? কি বলছিস তুই? কেন বিয়ে হবে না? আমি যথেষ্ট ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।

– আরে ফুপু.. ‘তোমার পছন্দ করা পাত্রের সাথে কি মনে করেছ নিশাত আপুর বিয়ে দিব’? আমরা নিশাত আপুর জন্য আরো ভালো ভালো পাত্র পাব।অলরেডি একজন তো ডায়…
ঈশিতা লক্ষ করল কথাটা যখন সে বলছিল, তখন তার বাবা-মা এবং নিশাত আপু তিনজনেই চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এর অর্থ হলো সে যদি কথাটা সম্পূর্ণ করে তাহলে আজ ফুপু চলে যাবার পর বাসায় তার বাসায় শনির দশা আছে ।
তাই সে আর কথাটি সম্পন্ন করল না। সে বলতে চেয়েছিল, ডায়মন্ডের নেকলেস এর কথা।
কিন্তু সে সেটা না বলতে পেরে সেখানে চুপ করে গেল।

এতে করে ঈশিতার অদ্ভুত আচরণে ঈশিতার বড় ফুপু সুমাইয়া রহমানের বেশ খটকা লাগলো তিনি প্রশ্ন করতে থাকলেন। কি বলতে চাচ্ছিলি??
– না ফুপু… কিছু না।
-আরে বল না!! তোকে আমি ডবল কাচ্চি খাওয়াবো!
তুই বল।

– না ফুপু কিছু না।

এমন সময় দরজায় আরেকবার কলিং বেল বেজে উঠলো। ঈশিতা দৌড়ে দরজা খুলতে যাওয়ার আগেই নিশাত দৌড়ে গেল।কারণ সে আর এখানে থাকতে পারছে না। সবার এত ঘন কথায় তার মাথা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। তাই সেখান থেকে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

দরজার সামনে এসে সরু পিনহোলের ছিদ্র দিয়ে সে দেখতে পেল বাইরে কেউ নেই। নিশাত কিছুটা ঘাবড়ে গেল; তারপর সে দরজা খুলে সামনে একটা মাঝারি আকারের বাক্স পেল। আবারো তার কাছে গিফট এসেছে। ঈশিতার কথা মতে “উড়ো পার্সেল”। আচ্ছা তাকে কে এই উড়ো পার্সেল গুলো পাঠাচ্ছে?

নিশাত এই প্রথম তাকে গিফট পাঠানো এই অজ্ঞাত ব্যক্তির ওপর বিরক্ত কিংবা রাগ হলো না। বরং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। কারণ এখন এই পার্সেলটির জন্যই বড় ফুপুর কাছ থেকে সে ছাড়া পেল। নিশাত নিজের রুমে গিয়ে বাক্সটি খুলতেই বেশ অবাক হয়ে গেল…

বাক্সে একটা কালো রংয়ের ডায়েরী এবং ডায়েরীর সাথে একটা চিরকুট যেমনটি প্রত্যেকবারের গিফটের সাথে থাকে। নিশাত চিরকুটটি খুলে পড়তে শুরু করল।

প্রিয় নিশাত,
আজ তোমার জন্য একটা অন্যরকম গিফট পাঠালাম। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার উপর ভীষণ রাগ করছো। আমি তোমাকে গিফট পাঠিয়েই যাচ্ছি সেজন্য…তাইতো? তবে আজ তোমাকে এই ডায়েরী পাঠানোর কারণ হচ্ছে, এইটাইতে তুমি আমার সম্পর্কে… যা যা প্রশ্ন আসবে, তুমি সব লিখবে।তোমার মনের কথাও লিখতে পারো, যা তোমার মনে চায় তাই লিখবে। তারপর এই ডায়েরী তুমি আমাকে গিফট করবে।
কি করবে না? নাকি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো?
ইতি,
তোমার গিফটের প্রতীক্ষায় থাকা একজন হতভাগা…

নিশাতের বেশ মজা লাগলো চিরকুটটি পড়ে। একটুখানি লজ্জা ও অনুভব করলো সে।

এমন সময় ঈশিতা পিছন থেকে এসে তার হাত থেকে চিরকুটটি টেনে নিয়ে বলল,’আপু তুমি আরো একটা উড়ো পার্সেল পেয়েছো’!!
আর আমাকে বলোনি। আরে, আপু তুমি তো দেখছি লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছো। লাল থেকে আস্তে আস্তে বেগুনি হয়ে যাচ্ছ…!!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here