উড়ো_পার্সেল #পর্ব_৩_ও_৪

0
477

উড়ো_পার্সেল
#পর্ব_৩_ও_৪
লেখা_নাজিফা_তাবাসসুম

নিশাতের বেশ মজা লাগলো চিরকুটটি পড়ে। একটু লজ্জা অনুভব করলো নিশাত। এমন সময় ঈশিতা তার পিছন থেকে এসে তার হাত থেকে চিরকুটটি টেনে নিয়ে বলল,’আপু তুমি আরো একটা উড়ো পার্সেল পেয়েছো’!!
আর আমাকে বলোনি। আরে, আপু তুমি তো দেখছি লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছো। লাল থেকে আস্তে আস্তে বেগুনি হয়ে যাচ্ছ…!!

-অ্যাই তুই আমার জিনিস নিয়েছিস কেন?
-ও মাই গড! এই কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার জিনিস হয়ে গেলো এইগুলো। আপু তোমার ভিতরেতো কোনো না কোনো ব্যাপার অবশ্যই আছে …

নিশাত ঈশিতার এসব কথাবার্তা উড়িয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে চিরকুট এবং ডায়েরী দুটো নিয়েই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। আর ঈশিতাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিল। এই ফাজিলটার জন্য কিছু দেখার উপায় নেই। পিছন থেকে লাফ মেরে চলে আসে!

বেশ কয়েক ঘন্টা পর,
ঈশিতা বাইরে থেকে বারবার তাকে ডাকছে।
– আপু প্লিজ দরজা খুলো। রাত হয়ে গেছে। ঘুমাবো না।
– ‘ফুপু কোথায়’?

– ফুপুতো সেই কখন চলে গেছে। এখন‌তো দরজা খোলো।
নিশাত দরজা খুলে দিল।

– আপু সেই কখন থেকে দরজা বন্ধ রেখে ছিলে। এখন খুললে। এতক্ষন বসে বসে কি দেখছিলে?

– এত কথা বলিস কেন? কথা বলা ছাড়া থাকতে পারিস না? বাচাল মেয়ে একটা!!
– হ্যাঁ। এখন তো আমি বাচাল হয়েই গেলাম। সত্যি কথা বললে তো বাচাল!!তাই না?
– চুপ করে থাক। তুই বেশি কথা বলিস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুইবোনের ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে। এমন সময় নিশাত দেখতে পেল তার মা হাতে বালিশ নিয়ে তাদের ঘরে চলে এসেছে।
নিশাত বলল, মা তুমি বালিশ নিয়ে এখানে কেন? ঘুমাওনি এখনও?
– না আজকে আমি তোদের সাথে শোবো।
– কেন কি হয়েছে? বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?

নিশিতার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই; ঈশিতা বলল, হ্যাঁ। আপু মায়ের বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে। ফুপু যে বারবার খালি তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে বাসায় আসে; সেজন্যই তো বাবার সাথে মায়ের ঝগড়া বেঁধেছে।

নিশাত বেশ রেগে গেল। সে বলল, এই আমি কি তোর কাছে জানতে চেয়েছি? আমি মার কাছে জিজ্ঞাসা করেছি। মুখের কথা টেনে নিয়ে কথা উত্তর দিস কেন?

তাদের দুজনের কথায় বিরক্ত হয়ে গিয়ে রাহেলা বেগম বললেন, এত ঝগড়া করলে কিন্তু ; আমি তোদের সাথে শোবো না। আমি ড্রইং রুমের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ছি।

এছাড়া তখন ঈশিতা তার মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা…তুমি আজকে আমার সাথেই ঘুমাবে! সব কতদিন তোমার সাথে ঘুমাই না।
অনেকদিন পর দুই মেয়ে এবং তাদের মা বেশ আনন্দ করে রাতে ঘুমাতে গেল।

পরদিন সকালে নিশাত ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করল তার মায়ের ভীষণ জ্বর এসেছে; সে প্রচন্ড চিন্তিত বোধ করল। সে জন্য সকালে মাকে কোন কাজ করতে না দিয়ে বাসার সব কাজ একই সে করতে লাগলো। ঈশিতা যখন দেখতে পেল সে মায়ের জ্বর এসেছে, নিশাত সব কাজ করছে তখন বুঝতে পারল, এখন যদি সে বাসায় থাকে; তবে তারও কাজ করা লাগবে।

সেজন্য সে কাজ ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে স্কুলে চলে গেল। নিশাত তাকে আজকে বাসায় থেকে যেতে বললেও সে তার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের বাহানা দিয়ে চলে গেল।

নিশাত বিষয়টা বুঝতে পেরে ও কিছু বলল না। কারণ সে জানে তার বোন কিছুটা এই ধরনের। তাকে বদলানো তার পক্ষে সম্ভব না।

নিশাতের বাবা সকালে অফিসে যাওয়ার সময় দেখলেন তার স্ত্রীর ভীষণ জ্বর। তিনি অফিস থেকে ছুটি নিতে চাইলেন, কিন্তু তার অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং থাকার জন্য তাকে যেতে হল। নিশাতের কাছে তিনি নিশাতের মায়ের দায়িত্ব অফিসে উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

বাবা অফিসে চলে যাওয়ার পর, নিশাত এক মগ কফি বানিয়ে নিল। তারপর মার পাশে বসে মাকে জলপট্টি দিতে থাকলো ।

নিশাতের চোখের কোনে পানি জমছে। কারন সে জানে তার মায়ের এমন জ্বর প্রায়ই হয় এর কারণটা কারোর আর অজানা নয়। রাহেলা বেগমের এক বছর আগে ব্রেন টিউমারের অপারেশন হয়েছিল। তিনি তারপরও পুরোপুরি সুস্থ হননি। বরং আস্তে আস্তে তার শরীরে স্থিরতা চলে আসছে। নিশাত তার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসে । মায়েরা এমন অবস্থা তার দেখে বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে।

তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। যদি অপারেশন করাতে হয় , তাহলে সে টাকা জোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার মায়ের প্রথমবার অপারেশন করার সময় অনেক টাকা ধার দিয়েছিলে তার বড় ফুপু।

সেজন্যই হয়তোবা বড় ফুপু তাদের পরিবারের উপর অতিরিক্ত চাপ দেয় এবং তিনি হাতের মুঠোয় রাখার চেষ্টা করেন। তার বাবাও কিছু বলতে পারেন না। বেতনের অর্ধেকের বেশি টাকাই তার ধার দেনা পরিশোধ করতে চলে যায়। যার ফলে মাস শেষে তাদের সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে।

নিশাত তার মাকে সকালের নাস্তা খাইয়ে দিল ; কারণ ঔষধ খেতে হবে। তিনি একদমই খেতে চাচ্ছিলেন না, তারপরও সে জোর করে খাইয়ে দিল।

কিছুক্ষণ পর, রাহেলা বেগমের বেশ কয়েকবারই বমি হল। নিশাত তার মায়ের জ্বর মেপে দেখল ১০৪° ডিগ্রি… সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। মাকে দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে এটা সে বুঝতে পারছে।

তাই সে তার বাবাকে ফোন দিতে গেল। কিন্তু ফোন দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলো,তার মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। তার মাকে রেখে সে কোথাও যেতে পারছেনা।
নিশাত দ্রুত বালতিতে করে পানি নিয়ে এসে তার মায়ের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। কিন্তু তার জ্বর যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে। তাই সে তার মাকে সে অবস্থায় রেখেই , দ্রুত পাশের বাসায় সে বাসায় গিয়ে একটা ফোন করার জন্য মোবাইল চেয়ে নিয়ে আসলো।
কিন্তু; বাবাকে ফোন করতে গিয়ে দেখল তার বাবা ফোন ধরছে না।

সেই একই মুহূর্তে ইকবাল হোসেন তার অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিংয়ে থাকার কারণে তিনি ফোনটা ধরতে পারছিলেন না।

নিশাত প্রায় পাগল হয়ে গেল; সে এখন কি করবে বুঝতে পারছে না!! সে কি করে মাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে? কারো সাহায্য প্রয়োজন। কিন্ত সে তার মাকে একা রেখে সে যেতেও পারছে না।
এমন সময় নিশাত জোরে জোরে কাঁদতে থাকলো। সে অল্পতেই ভেঙে পড়ে । তার মায়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

সে বাইরের দরজা খোলা রেখেই নিচতলা থেকে একজনকে ডেকে আনতে যাবে। ঠিক তখনই অ্যাম্বুলেন্সের কর্কশ সাইরেন তার কানে ভেসে আসলো।

সে দ্রুত বারান্দায় দৌড়ে দেখলো, নিচে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে । অ্যাম্বুলেন্স থেকে দুইজন ওর্য়াড বয় স্ট্রেচার নিয়ে তাদের বিল্ডিংয়ের দিকেই আসছে।
নিশাত অবাক হয়ে গেল। তবে এখন তার অবাক হওয়ার সময় নেই। সে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে লাগলো, তাদের কাছে যাওয়ার জন্য।
পরক্ষণেই সে বিস্মিত হয়ে গেল কারণ তারাই তার কাছে আসছিল তার মাকে হসপিটাল এ নেয়ার জন্য।

নিশাতের এই মুহূর্তটায় এত প্রশ্ন করার সময় ছিলনা। সে দ্রুত তার মাকে নিয়ে, বাইরের দরজার তালা মেরে, বাসায় থাকা কিছু টাকা নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স উঠে গেল।

অ্যাম্বুলেন্সটি একটি বেশ স্বনামধন্য বেসরকারি হসপিটালের । নিশাত চিন্তিত বোধ করল।
কারণ হসপিটালে বিল পরিশোধ করার মত টাকা সে সাথে করে নিয়ে আসেনি। হসপিটালে মাকে এডমিট করার পর সে অবাক হয়ে দেখল, আগে থেকেই সব বিল পরিশোধ করা আছে এবং তার মাকে এডমিট করানোর সকল ব্যবস্থা করা আছে।

সে জিজ্ঞেস করল কাউন্টারে গিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাসা করল,

– আমার মায়ের নাম কি আগে থেকেই এডমিট করে আছে?
– ‘ম্যাম, সেটা বলতে পারবো না। তবে কেউ একজন ফোন করে আপনার মায়ের নাম এডমিট করে, আপনার আমাদের কাছে এড্রেস দিয়ে দিয়েছিল, আমাদেরকে এম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য’।
‘আমরা ততটুকুই দায়িত্ব পালন করেছি এবং বিল অনলাইনে পেমেন্ট হয়ে গেছে’।

নিশাতের বুঝতে বাকি থাকল না, সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটিই তাকে বিপদে সাহায্য করেছে। সে মনে মনে ভীষণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল তার ওপর।

নিশাত হসপিটালের টেলিফোন থেকে তার বাবাকে ফোন দিল। ততক্ষণে তার মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়ে গিয়েছে। জ্বর আস্তে আস্তে কিছুটা নেমে এসেছে। নিশাতর বাবা তার স্ত্রীর এই অবস্থার কথা শুনে দ্রুত সে হসপিটালে চলে আসলেন। এসে নিশাতকে দেখতে পেলেন।

– তুমি একাই তোমার মাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছো? তুমি আমাকে ফোন দাও নি কেন?

– বাবা, তোমার ধারণা আছে তোমার ফোনে কতবার ফোন দিয়েছি!! তুমি জানো? তুমি ফোন ধরছিলে না।

– আচ্ছা নিশাত, এখন তো হসপিটালের বিল পেমেন্ট করতে হবে?
– না বাবা। সেসব নিয়ে তোমার চিন্তা করার কিছু নেই। কেউ একজন আগে থেকেই সব বিল পেমেন্ট করে দিয়ে গেছে।
– কে করেছে?

– সেটা বলতে পারবো না , বাবা। আমার ধারণা আমাদের বাসায় যে ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে নজর রাখছিল, সে হয়তো আমাদের এই বিপদে সাহায্য করেছে।

– তোমার মায়ের এখন কি অবস্থা? ডাক্তার কি বলেছে?

– ডাক্তার এখন পর্যন্ত খারাপ কিছু বলেননি। কিন্তু বলেছে তার কন্ডিশন এখনো খারাপ বলা যাচ্ছে না। আরো কিছুদিন তারা দেখবেন । এরপরে যদি মনে হয় অপারেশনের প্রয়োজন রয়েছে, তবেই অপারেশন করাতে হবে।

কথাগুলো শেষ করেই নিশাত লক্ষ্য করল, তার বাবার মুখটা শুকিয়ে গেছে। কারণটাও সে বুঝতে পারল, কারন এখন যদি অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে; তবে সেই টাকাটা তাদের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাহলে কি তার মায়ের অপারেশন টা হবে না?…

হাসপাতালে রাতে নিশাতের বাবা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিশাত এবং ঈশিতাকে তিনি বাসায় পাঠিয়ে দিলেন।
ঈশিতা বিকেলে বাসায় এসে তার মায়ের হসপিটালে থাকার খবর সোজা হসপিটালে চলে এসেছে, তার মায়ের এরকম অবস্থা দেখে সে অনেক অনুতপ্ত হয়েছে। সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছিল।

ঈশিতা কান্না করতে করতে নিশাতকে জড়িয়ে ধরে, বারবার সরি বলছিল।
কারণ ঈশিতার এই খামখেয়ালিপনার জন্য আজ তাদের মায়ের একটি বিপদ হয়ে যেতে পারত।

রাতে তাদের মায়ের জ্বর কমে আসায় তাকে কেবিনের শিফট করা হলো।

নিশাত ঈশিতাকে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় তারা দুজনই অনুভব করল, তাদের দুজনকে কেউ অনুসরণ করছে। বাসার বেশ কাছাকাছি চলে আসার পর বাসায় ঢোকার সময় ঈশিতা দেখতে পেল তাকে, যে এতক্ষণ তাদেরকে অনুসরণ করছিল, সেই মানুষটিকে।
ঈশিতা নিশাতকে সেই মানুষটিকে দেখানোর চেষ্টা করতে গেলেই…. মানুষটি দৌড়ে পালিয়ে গেল।

নিশাত এবং ঈশিতা দুজনেই দেখল, কালো হুডি পড়া একজন যুবক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ঈশিতা দৌড়ে সেই যুবকটির পিছু নিতে গেলে নিশাত তাকে থামিয়ে দিল। ভয়ে তারা দ্রুত বাসার উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো। বাসার সামনে গিয়ে দরজার সামনে গিয়ে নিশাত আরো একটি পার্সেল আবিষ্কার করল!!

নিশাত এবং ঈশিতা দুজনেই দেখল, কালো হুডি পড়া একজন যুবক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ঈশিতা দৌড়ে সেই যুবকটির পিছু নিতে গেলে নিশাত তাকে থামিয়ে দিল। ভয়ে তারা দ্রুত বাসার উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো। বাসার সামনে গিয়ে দরজার সামনে গিয়ে নিশাত আরো একটি পার্সেল আবিষ্কার করল!!
ঈশিতা প্রচন্ড উৎসাহের সাথে পার্সেলটা মেঝে থেকে হাতে তুলে নিল।
সে যতটা উৎসাহের সাথে বাক্সটা হাতে তুলে নিয়েছিল। পরক্ষনেই সে ততটাই হতাশ হয়ে গেল। দুই হাত দিয়ে বাক্সটা সে ঝাকাতে ঝাকাতে নিশাতের উদ্দেশ্যে বলল, বাক্সটা‌ এত হালকা কেন লাগছে? কিছু দেয়নি নাকি?
নিশাত বলল, আচ্ছা.. তোর সমস্যাটা কি বলতো? ফেলে দেতো পার্সেলটা। দরকার নেই। এত আগ্রহ কেন তোর?
ঈশিতা মন খারাপ করে পার্সেলটা হাতে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করল।
নিশাত তাকে বলল, যথেষ্ট হয়েছে ঈশিতা।এবার এসব বিষয় বাদ দে। এত মাতামাতি করার কি আছে? সামান্য একটা পার্সেল নিয়ে!!

বাসায় ঢুকেই নিশাত রাতের খাবার তৈরি করার জন্য রান্নাঘরে চলে। ঈশিতা সোফায় বসে বাক্সটি খোলার চেষ্টা করছে। বাক্সতে যেন হাজারটা স্কচটেপ লাগানো; স্কচটেপ খুলতে খুলতে সে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। ঈশিতা বাক্স খুলে ছোট্ট একটা কার্ড পেল।

কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে সে আবিষ্কার করলো, কার্ডে একটি ইমেইল এড্রেস দেওয়া আছে। একটি চিরকুটে লেখা,
“আমার ইমেইল এড্রেস”

চিরকুটটি দেখে ঈশিতা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। সে এক মুহূর্তও দেরি না করে কার্ডটি নিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে নিশাতের কাছে চলে গেল।
নিশাত চুলায় ভাত বসাচ্ছিল। ঈশিতাকে রান্নাঘরে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, কিরে! কি হয়েছে?

– “জায়ান আহমেদ, জায়ান আহমেদ”!!
– কিহ্… জায়ান, জায়ান করছিস? এখান থেকে যা তো।
– জায়ান…আর কেউ না!! তোমাকে গত তিন মাস ধরে যে মানুষটি উড়ো পার্সেল পাঠিয়ে আসছে সেই!!!

নিশাত এবার একটু সিরিয়াস হয়ে তার বোনের দিকে তাকালো। সে চোখ সরু করে বলল,তুই কিভাবে জানিস তার নাম?
ঈশিতা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার হাতে থাকা কার্ড টা নিশাতের হাতে ধরিয়ে দিল।
– দেখো আপু, এখানে ইমেইল এড্রেসে জায়গায় তার নামটা লেখা আছে তো। খেয়াল করে দেখো।

নিশাত তো এবার দেখতে পেল সেখানে “জায়ান আহমেদ” নামে একটি নাম লেখা।
সে অবাক হয়ে আপন মনে বলল, মানুষটি যেভাবে গত তিন মাস ধরে নিজেকে হাইড করে রাখল। আমি তো ভেবেছিলাম এত তাড়াতাড়ি সে নিজেকে রিভিল করবে না। এত সহজে কার্ড পাঠিয়ে নিজের ইমেইল এড্রেস পাঠিয়ে দিল!

ঈশিতা তাকে বলল, এত কি ভাবছো আপু?
– না। কিছু না।
– তাকে ইমেইল করবে?
– পাগল হয়েছিস!! কখনোই না।

ঈশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশাতের দিকে তাকিয়ে বলল, থাক…তোমার ই মেইল করার দরকার নেই। কার্ডটা আমাকে দিয়ে দাও।
– কেন?
সেটার উত্তর তোমাকে কেন দিব?কথাটি বলেই কার্ডটি আচমকাই ঈশিতা নিশাতের হাত থেকে হ্যাঁচকা টান মেরে নিয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ঈশিতার মূল উদ্দেশ্যই এখন ইমেইল করা।

নিশাত দরজার বাইরে থেকে তাকে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকল, ঈশিতা দরজা খুল! দরজা খুল! খবরদার.. তুই কিন্তু তাকে ইমেল করবি না!

ঈশিতা প্রচন্ড কৌতুহলী হয়ে উঠলো। আজকে সে মেইল না করে ছাড়বে না। অনেকটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যেন হয়ে গেল। নিশাতের সমস্ত নিষেধ অগ্রাহ্য করে সে মেইল পাঠিয়ে দিল।
ঈশিতা মেইলে লিখলো,
“হ্যালো জায়ান, আমি নিশাত। আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন?”

মেইল করার পর অনেকক্ষণ পার হয়ে যাবার পর কোন রিপ্লাই না পেয়ে। ঈশিতা হতাশ হয়ে দরজা খুলে দিল। দরজার অপরপ্রান্তে হিংস্র বাঘিনী হয়ে নিশাত যেন অপেক্ষা করছিল ঈশিতা জন্য। সে ঈশিতার হাত নিজের ফোন দ্রুত ছিনিয়ে নিল। নিশাত রেগে তার ছোট বোনকে কষিয়ে চড় দিয়ে যাবে এমন সময় তার হঠাৎই মনে পড়ে গেল , তার ফোনে এমবি কিংবা ব্যালেন্স দুটির কোনটিই নেই। তাই সে আর ঈশিতাকে মারল না।

– আপু, মারতে গিয়ে মারলে না কেন?
– তোকে অবশ্যই মারতাম। কিন্ত ই মেইল যায়নি বলে আজ তোকে ছেড়ে দিলাম।
– কে বলেছে মেইল যায়নি?
– ফোনে এমবি , ব্যালেন্স কোনটাই নাই তাহলে কিভাবে মেইল যাবে?
– আমি তো দেখলাম মেইল সেন্ড হয়ে গেছে।
– হয়নি।
– হয়েছে!!
-হয়নি!

দুই বোনের আবারো ঝগড়া বেঁধে যাবার জোগাড়। এমন সময় নিশাতের ফোনে টুং করে শব্দ হয়ে ওঠলো। যেমন শব্দ ফোনে মেসেজ আসলে হয়। নিশাত ঝগড়া থামিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো।ফোনের স্ক্রিনে ইমেইল থেকে ফিরতি একটি নোটিফিকেশন ভেসে উঠেছে।
ঈশিতা চাপা গলায় বলে উঠলো, আপু রিপ্লাই চলে এসেছে। নিশাতের চোখ বড় হয়ে গেল। তার বোন কি ইমেইল করছে সে এখনো জানে না। এরই মাঝে রিপ্লাই চলে এসেছে!!
নিশাত এবং ঈশিতা দুজনে রিপ্লাই দেখার জন্য ফোন নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করে দিল। শেষ পর্যন্ত নিশাতই ফোন নিজের কাছে নিয়ে ফেলল।
জায়ান নামের সেই যুবক রিপ্লাই দিয়েছে….
সেখানে লেখা…
“হ্যালো ঈশিতা, আমি জায়ান। না, আমি তোমাকে পছন্দ করি না। আমি তোমার বড়বোন নিশাতকে পছন্দ করি। আশাকরি পরবর্তীতে তুমি নিশাতের অনুমতি ছাড়া তার মোবাইল ধরবে না।”

ইমেইলটি পরে নিশাত হতবিহবল হয়ে ঈশিতার দিকে তাকালো, ঈশিতার ও একই অবস্থা এই ঘটনায় সে ও হতভম্ব হয়ে গেছে।

নিশাত তাকে বলল, আমার ফোনে তো এমবি ছিল না। তুই কিভাবে ইমেইল সেন্ড করেছিস?

– এমবি লোন নিয়েছিলাম;কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সে কিভাবে বুঝল যে মেইলটা আমি করছি? তুমি করোনি?
নিশাত প্রচন্ড রেগে গর্জে উঠল ঈশিতার উপর চেঁচিয়ে বলল, আজকের পর থেকে যদি তুই আমার ফোনে হাত দিস তবে তোর হাত ভেঙে ফেলবো!!
ঈশিতা তার বড় বোনের রাগান্বিত বাণীতে কান না দিয়ে ঘরের এদিক সেদিক তাকাতে থাকল , সে বলতে থাকলো আমাদের ঘরে আবার ক্যামেরা ফিট আছে নাকি? সব খুঁজে দেখতে হবে। না হলে সে কিভাবে বুঝবে যে মেইলটা আমি করেছি!!
পরক্ষণে ঈশিতার চোখ গেল জানালার পাশে তারের উপর থাকা একটা কাকের দিকে। আরে এরকম হুবহু একটা ড্রোন ক্যামেরা সে তো রান্নাঘরে দেখেছিল!! এটা তো সেই একই দাঁড়কাক!

ঈশিতা নিশাত কে চুপিসারে ইশারা করে বারবার জানালার দিকে দেখাতে থাকলো নিশাত বিষয়টি লক্ষ্য করে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেখানে সত্যিই একটি কাক বসে আছে। তবে কাকটা দেখে তার কোন ড্রোন ক্যামেরা মনে হলো না।
ঈশিতা বুঝতে পারলো তার বোন তার কথা বিশ্বাস করছে না।
তাই সে বোনকে বিশ্বাস করানোর জন্যই হোক আর অন্য যে কোন কারণেই হোক, দ্রুত এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে কাকটির দিকে ছুড়ে মারলো।
পরক্ষণেই কাকটি ঈশিতার সন্দেহকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে দাঁড় কাকটি কর্কশ শব্দে কা কা করতে করতে পাখা ঝাপিয়ে উড়ে গেল।
নিশাত তার ছোট বোনের এই অদ্ভুত কাণ্ডে হাসতে হাসতে ফেটে পড়লো।
নিশাত উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। হাসির জন্য সে কথা বলতে পারছে না।
অনেক কষ্টে হাসির সামলিয়ে বলল, এই তোর ড্রোন ক্যামেরা?শেষ পর্যন্ত এই বেচারা নির্দোষ কাককে তুই ড্রোন ক্যামেরা বানিয়ে দিলি!

ঈশিতা বিমর্ষ হয়ে গেল। লজ্জায় সে বোনের সামনে মুখ দেখাতে পারল না। ঈশিতা দৌড়ে তার মা-বাবার রুমে চলে গেল। তার চোখে পানি চলে আসলো। সত্যি তো সে ড্রোন ক্যামেরাটাকে দেখেছিল। সেটা এখন কাক হয়ে গেল কি করে। তাছাড়া সে যে মেইল করেছিল সেটাই বা জায়ান আহমেদ বুঝলো কি করে!!

“এই মেয়েটি হেসে উঠলে যেন আমার পৃথিবী হেসে ওঠে… ওর হাসি এত সুন্দর কেন!! আমি আস্তে আস্তে ওর প্রেমে ডুব দিচ্ছি।”
আমি হারিয়ে যাচ্ছি… মৃদুস্বরে কথাগুলো জায়ান নিজেকে বলল। সে হাত থেকে বাইনোকুলারটা নামিয়ে টেবিলের উপর রাখল।
সে এখন নিশাতের বাসার সামনে আরেকটা বিল্ডিংয়ের এর ফ্ল্যাটে আছে। সেখান থেকে নিশাতকে দেখছে সে। এই সামান্য সময় টুকুই যেন তার জীবনের মহামূল্যবান সময় হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল….

জায়ানের ফোন বেজে উঠলো। তার বাবা ফোন করেছে। জায়ান ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল।
-হ্যালো, বাবা।
-দেড়টা বেজে গেছে…. বাসায় আসবে না?তোমার কিন্তু আড়াইটার আগেই বাসায় আসার কথা। কথাটা কিন্তু ভুলে যাবে না।
-আমি এখন আসতে পারছি না। দুটোর দিকে গাড়ি পাঠিয়ে দিও , বাসায় আসব। এই আধা ঘন্টা সময়টুকু আমার জন্য ছেড়ে দাও।
– ঠিক আছে দিলাম ছেড়ে। তোমার বিল্ডিংয়ের নিচে গাড়ি ওয়েট করছে। ঠিক দুটোই উঠবে কিন্তু,এক মিনিট দেরি যেন না হয়।

জায়ান আর কোন উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। বারান্দা দিয়ে বাসার নিচে দেখতে পেলো তার সেই কালো থাই গ্লাসের চিরচেনা গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটি রেখে দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় খেয়াল করল নিশাত তাকে মেইল করেছে। জায়ান কৌতুহলী হয়ে মেইলটি পড়ল,

নিশাত তাকে লিখেছে, “আপনি কিভাবে বুঝলেন প্রথমে মেইলটি ঈশিতা করেছিল”?

জায়ান হেসে উঠলো। নিশাতের মেইল দেখে তার মন ভালো হয়ে গেল। সে লিখলো,
“আমি তোমার সব কিছুই জানি, তুমি কিভাবে লিখবে না লিখবে সেটাও জানি।অনেকটা সেভাবেই বুঝতে পেরেছি… ধরে নাও”!!

নিশাত সাথে সাথেই তার মেইলের জবাবটি দেখে অবাক হয়ে গেল। সে আরো কিছু লিখতে চেয়েছিল, কিন্তু আর লিখল না… ফোনের চার্জ শেষ। ফোন চার্জে দিয়ে নিশাত মুচকি হাসলো।
তার বুকের মাঝে এক অচেনা অনুভূতির ঝড় বয়ে যাচ্ছে… আচ্ছা এরই নাম কি প্রেম? সে কি প্রেমে পড়ে গেল!!
জীবনে প্রথমবার নিশাত হাজারো অচেনা অনুভূতি সাথে নিয়ে ঘুমাতে গেল।
পরদিন সকালে নিশাতের ঘুম ভাঙলো অজানা একরাশ আনন্দের অনুভূতি সাথে নিয়ে। আজ সকালটা তার দারুন ভাবে শুরু হলো। সকালে নিশাত তার মাকে দেখতে প্রথমে হসপিটালে গেল। ঈশিতা ঘুমিয়ে ছিল, তাই সে আর ঈশিতাকে ঘুম থেকে
তোলেনি।
হসপিটালে গিয়ে দেখল মা বেশ সুস্থ হয়ে গেছে আগের থেকে। নিশাতের আনন্দ হাজার গুনে বেড়ে গেল, তার মাকে আজ অনেকটা সুস্থ হয়ে বসে থাকতে দেখে।
রাহেলা বেগম আজ সকালে নিশাতকে এতটা হাসি খুশি দেখে বলল কি ব্যাপার তোর মন আজ এত ভালো কেন?
নিশাত হাজার চেষ্টা করেছিল তার মায়ের চোখের সামনে থেকে আনন্দ লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু তার মা কিভাবে যেন বুঝে গেল।আসলে হয়তো মায়েরা এমনই হয়, তাদের কাছ থেকে কোন কিছু লুকানো যায় না।
নিশাত স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করল। সে বলল, মা তোমাকে আজ সুস্থ দেখে খুব ভালো লাগছে। তাই হয়তোবা…
রাহেলা বেগম সন্দিহান চোখে তার বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার তো তা মনে হচ্ছে না। তোর ভিতরে কোন একটা ব্যাপার অবশ্যই আছে। আবারও কি কোন গিফট পেয়েছিস নাকি?
নিশাত তার মায়ের কাছ থেকে গত রাতের ঘটনাটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলো। সে বলল, না মা। তেমন কোন ব্যাপার নেই। আর কোন গিফট আসেনি কালকে।

দুপুরের দিকে নিশাত বাসায় গেল। আজ তার মাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়নি। আরো হয়তো কয়েকদিন পর রিলিজ দেওয়া হবে। বাসায় অনেক কাজ পড়ে আছে। কাজ গুলো সেরে নিশাত কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এমন সময় সে শুনতে পেল কলিং বেল বেজে উঠেছে । ঈশিতা বাসায় নেই কোচিংয়ে গিয়েছে।
সে বাসায় একা। তাই সেই দরজা খুললো। দরজা খুলেই তার বিস্ময়ের সীমা থাকল না। মেঝেতে আরো একটি বাক্স পড়ে আছে। আর একটি উড়ো পার্সেল এসেছে তাহলে তার কাছে!!

নিশাত বাক্সটা খুলে একটা কাগজ দেখতে পেল। কাগজের এক পৃষ্ঠে বড় বড় করে লিখা,

” নিশাত তুমি কি আমার সাথে দেখা করবে?”

নিশাত লেখাটা দেখে কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা। সে কি সত্যিই দেখা করবে এই অচেনা মানুষটির সাথে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here