উড়ো_পার্সেল #পর্ব_৫_ও_৬

0
568

উড়ো_পার্সেল
#পর্ব_৫_ও_৬
লেখা_নাজিফা_তাবাসসুম।

মাঝরাতে নিশাতের ঘুম ভাঙ্গে গেলো তীব্র চিৎকারের শব্দে। সে হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়লো। আচমকা এভাবে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে তার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। সে আবিষ্কার করলো চিৎকারের শব্দটি তাদের বাসায় নিচ থেকে আসছে। নিশাত বিছানা থেকে নেমে পড়ল। ঈশিতাকে তার পাশে দেখতে না পেয়ে নিশাত তাকে ডাকতে লাগলো। ঈশিতার কণ্ঠস্বর বারান্দা থেকে ভেসে আসলো। নিশাত বারান্দায় এগিয়ে গিয়ে দেখলো, সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে কিছু একটা দেখছে। নিশাত তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

– কি দেখছিস ঈশিতা? আর নিচে এত শব্দ কিসের? কেউ চিৎকার করছিল আর মনে হল!!
– আমাদের কেয়ারটেকার নাকি বাসার সামনে দিয়ে একটি চোরকে যেতে দেখেছে। তাই সে চেঁচিয়ে উঠেছে।
-তুই কিভাবে জানলি?
– নিচে দেখলাম.. এতক্ষণ ধরে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো।
– তুই এখনো ঘুমাসনি? কি করছিলি এতক্ষণ? বারান্দায় বসেছিলি নাকি?
– এত প্রশ্ন একসাথে করো না তো… উত্তর দিতে পারছি না।
– ঈশিতা তোর আবার কি হলো?এমন করছিস কেন?

ঈশিতা নিশাতের কথার কোন প্রকার উত্তর না দিয়ে নিজেদের ঘরে ঘুমানোর জন্য চলে গেল। নিশাত তার ছোটবোনের এমন আচরণের ভীষণ বিস্মিত হল। তার বাচাল বোনটার হঠাৎ করে কি এমন হল? এত নিশ্চুপ হয়ে গেল কেন!

আজ বাসায় ঈশিতা আর নিশাত ছাড়া কেউ নেই। বাবা-মা এখনো হসপিটালে আছে। আগামীকালকে হয়তো মাকে রিলিজ দেওয়া হবে। পুরো বাসায়
মা-বাবা না থাকার কারণে বাসার ভেতর নিশাতের চলাফেরা করতে গা ছমছম করতেই লাগলো।

নিশাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাত তিনটা বাজে। এখন আর রাস্তা থেকে তেমন শোরগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। সে এবারে বেশ কৌতুহলী হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

রাস্তায় কিছু সংখ্যক মানুষের জটলা বেঁধে আছে। তাদের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু একটু আগে তারা একটি চোরকে চুরি করে পালিয়ে যেতে দেখেছে। চোরের সমস্ত শরীর কালো কাপড় দিয়ে মোড়া ছিল সেই জন্য চোরের চেহারা দেখা যায়নি।
নিশাতদের বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকার বেশ রসিয়ে রসিয়ে রসিয়ে অতিরঞ্জিত করে ঘটনাটির বর্ণনা আশেপাশের মানুষজনের কাছে করছে। এসব দেখে সে প্রচন্ড বিরক্ত হলো।
নিশাত জানে এই লোকের স্বভাব চরিত্র এরকমই। সাধারণ একটা বিষয়কে ডালপালা লাগিয়ে এমন ভাবে মানুষের কাছে বর্ণনা করবে.. যেন রূপকথার কাহিনী রচনা করতে বসেছে।

নিশাত বেশ বিরক্তি নিয়ে আবার ঘুমোতে গেল। কিন্তু তার আর ঘুম আসছে না। সে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় উঠে পড়ল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে তিনটা বাজে। সে বুঝে গেল আজ রাতটাও তার অনিদ্রায় যাবে। একবার যখন ঘুম ভেঙে যায় তার তখন দ্বিতীয়বার আর ঘুম আসে না।

নিশাত প্রথমে রান্নাঘরে গিয়ে একমগ কফি বানিয়ে নিলো। তারপর সে বসার ঘরের সোফায় বসে টিভি চালু করলো। কফি খেতে খেতে সে টিভি দেখছে।
এমন সময় নিশাতের ফোনে টুং করে মেসেজ আসার শব্দ হলো। নিশাত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে তার কাছে মেসেজ এসেছ।

মেসেজে লেখা, “নিশাত তোমার কি ঘুম আসছে না”?

মেসেজটি দেখে নিশাত প্রচন্ড অবাক হলো। তবে সে বুঝতে পারছে, মেসেজটি তাকে জায়ান নামের সেই যুবক ছাড়া আর কেউ করেনি। তারপরও সে না বোঝার মত ভাব করলো।

সে সেই মেসেজের প্রত্যুত্তরে লিখল, “আপনি কে”?

প্রায় সাথে সাথেই রিপ্লাই চলে আসলো। নিশাত বেশ আগ্রহ সহকারে সেখানের লেখাটি পড়ল,

“চিনতে পেরে ও না চেনার ভাব করছ কেন”?

নিশাত এবার মেসেজের রিপ্লাই দিলো না; সে মোবাইলটা তার পাশে রেখে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পর আরও একটি মেসেজ আসলো। সে এবারে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল,সেখানে লেখা নিশাত তুমি তো এখনো উত্তর দাওনি; তুমি কি আমার সাথে দেখা করবে?

নিশাত কোন উত্তর দেবে না… চিন্তা করেও কিছুক্ষণ পর সে রিপ্লাই দিয়ে বসলো ‌। নিশাত লিখলো, আমি ভেবেচিন্তে দেখবো।
মেসেজে নিশাত এটা লিখলেও নিজ মনে সে প্রচন্ড কৌতূহলী এই মানুষটিকে একবার দেখার জন্য। তবে সে তার কৌতূহলকে মাটিতে চাপা দিয়ে, সে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।

ভোরের দিকে নিশাতের ঘুম আসলো। বেশ বেলা করে দুপুরের দিকে দরজার তালা খোলার শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে নিশাত বেশ অবাক হয়ে গেল এখন সাড়ে বারোটা বাজে। সে বাসায় ঈশিতাকে দেখতে পেল না। ঈশিতা তাকে না বলে কোথায় গেল? এমন সময় বাসায় সে মা-বাবা এবং ঈশিতাকে ঢুকতে দেখলো।

ঈশিতা তাকে তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, আপু, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই তোমাকে ডাকিনি। আমি গিয়েই বাবা-মাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছি। বাইরের দরজা কেমন তালা মেরে আমি হসপিটালে গিয়েছিলাম।

নিশাত বিষয়টা বুঝতে পেরে তার ছোট বোনের দিকে বিস্মিত হয়ে তাকালো। তার ছোট বোনটি কবে থেকে আবার এতটা দায়িত্বশীল ব্যক্তি হয়ে গেল! সব কিছু এভাবে বুঝতে শিখলো!

নিশাতের মা রাহেলা বেগম বেশ আনন্দ করেই ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
আর ক্ষণে ক্ষণে মন খারাপ করে গলায় বললেন, আমি নেই তাই ঘরের একি অবস্থা? ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করিসনি? মেঝেতে এত ময়লা কেন? ঘর পরিষ্কার করতে পারিস না! ইশ্.. রান্না ঘরের কি অবস্থা?

মায়ের হাজারো অভিযোগ শুনেও নিশাতের বুকের মধ্যে আনন্দ ঝড় বয়ে যাচ্ছে‌। অন্য সময় হলে সে ভীষণ বিরক্ত হত মায়ের এসব কথাবার্তায়। তবে মাকে সুস্থ দেখে এসব কথা যেন তার কান দিয়ে ঢুকছেই না।

নিশাত শুধু তার মাকে বলল, মা তুমি একদন্ড বসো।
বিশ্রাম নাও। সবে হসপিটাল থেকে আসলে, এখনই এত পরিশ্রম করবে না। তোমার কিন্তু আবার শরীর খারাপ হয়ে যাবে।
রাহেলা বেগম তার বড় মেয়ের কথায় কান না দিয়ে, ঘরের কোথায় কোন ময়লাটা সে পরিষ্কার করেনি সেই অভিযোগগুলো করতে থাকলো এবং নিজে ঝাড়ু নিয়ে এসে ঘর ঝাড়ু দিতে থাকলো।

নিশাত অসহায় দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশিতা তার পাশে এসে কানে কানে বলল, মাকে হাজার নিষেধ করলেও সে এখন কিছুই শুনবে না।

ইকবাল হোসেন তার স্ত্রীকে বাসায় রেখে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।‌ যা যা ওষুধ পত্র প্রয়োজন ছিল সবকিছুই তিনি তার মেয়েদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন এবং কোনটা কোন সময় খাওয়াতে হবে সেটাও বলে দিয়ে গেলেন।

বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেছে,

এ কয়েকদিন আর তেমন কোন উড়ো পার্সেল নিশাতের কাছে আসেনি। এসব নিয়ে ভাবার ফুসরত নিশাতের মেলেনি। সে ভীষণ ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে। ঈশিতা ও এত বেশি বাড়াবাড়ি করছে না। সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষা।সেও পড়াশোনা নিয়ে অতি ব্যস্ত দিন পার করছে। সারা বছরের পড়াশোনা যেন তার এখন এসে বেঁধেছে।

তবে জায়ানের সাথে নিশাতের নিয়মিতই কথা হয় মেসেজে। তার সাথে নিশাতের একটা বেশ ভালই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গেছে। অবশ্য কখনো তার সাথে ফোনে কথা হয়নি তার।
এমনই এক দিন নিশাতের হঠাৎ করেই তার অচেনা বন্ধুটির সাথে দেখা করতে ইচ্ছা করলো। সে কিভাবে জায়ানকে বলবে বুঝতে পারল না।
তবে অনেক কিছু ভেবেচিন্তে সে জায়ানকে একটি মেসেজ পাঠিয়ে দিল,
“আপনার সাথে দেখা চাই”! জায়ান!!

বিকেলের ঠিক একটু আগে জায়ান মেসেজটি দেখতে পেল, এক ধরনের অন্যরকম আনন্দ তাকে ছুঁয়ে গেল। কিন্তু; সে এতদিন যে দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিল সেদিনটি আজ চলে আসলো , সে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড নার্ভাস অনুভব করতে লাগলো। কোনো এক অজানা কারণে তার নিশাতের সামনে তার যেতে ইচ্ছা করছে না।
সে চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করতে পারছে না, তার কি করা উচিত? সে কি যাবে দেখা করতে নিশাতের সাথে ? তাকে উচিত হবে?
কিন্তু, সেইতো প্রথমে অতি আগ্রহী ছিল নিশাতের সাথে দেখা করার জন্য। নিশাতই মূলত প্রথমে রাজি ছিল না। এখন সে রাজি হয়েছে । তার কি এখন উচিত না… নিশাতের সাথে দেখা করতে যাওয়া!

অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে জায়ান সিদ্ধান্ত নিতে পারল না তার এখন কি করা উচিত…. সে তার বন্ধু হিমেল কে ফোন দেওয়ার চিন্তা করল। কারণ একমাত্র হিমেলই নিশাতের সম্পর্কে জানে। এই মুহূর্তে হিমেলের সাথে আলোচনা করাটাই তার কাছে বেশি শ্রেয় মনে হলো। তাই সে কোন কিছু চিন্তা না করেই হিমেলকে কল দিল। প্রথম কয়েক বার রিং হওয়ার পর হিমেল ফোন ধরল না। পরক্ষণে সেই জায়ানকে কল করলো।

– হ্যালো?
-হ্যালো জায়ান?
-হ্যাঁ।
-কি ব্যাপার হঠাৎ ফোন দিলি যে। নিশাতের কোন ঘটনা ঘটেছে নাকি?
– না তেমন কিছু না। ও আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। আমার যাওয়া উচিত হবে?
– কি বলছিস তুই!! যাওয়া উচিত হবে না মানে? গত দেড় বছর ধরে তুমি ওর সাথে দেখা করতে চাচ্ছিস। শেষ পর্যন্ত ওই তোর সাথে দেখা করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে আর তুই দেখা করবি না!!

– আমি চিন্তা করছি, নিশাতকে আমার সম্পর্কে সব সত্যি কথা বলে দেবো।
– কেন এত তাড়াতাড়ি বলার কী আছে? আসতে ধীরে বলবি। প্রথম দেখাটা সবচেয়ে স্পেশাল হতে হয়। এখনই এসব কিছু বলার কি দরকার।

– আমি জানিনা… আমার নিজের কাছে খুবই অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি ওকে ঠকাচ্ছি।
আমি যে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো নই এটা নিশাতের জানার দরকার।

– তুই এভাবে বলছিস কেন? এমন কোনো অস্বাভাবিক কিছুই তোর মধ্যে নেই, যে তুই নিজেকে অন্যভাবে চিন্তা করিস। এসব নেগেটিভ চিন্তা বাদ দে। ও যখন তোর সাথে দেখা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, ওকে সুযোগটা তুই দে। দেখা কর সাথে।

কথাগুলো বলেই হিমেল ফট করে কল কেটে দিল।
জায়ান বেশ অস্বস্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে, নিশাতকে মেসেজ দিয়ে বলতে যাবে , হ্যাঁ সে দেখা করতে চায়।
কিন্তু তার আগেই নিশাত তাকে মেসেজ দিল, “আমি আসলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত”। “আজকে আমি দেখা করতে যেতে পারছি না”, একটু কাজ পড়ে গেছে।

সে যেন নিশাতের মেসেজটা দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বুকের উপর থেকে যেন শক্ত হয়ে চেপে থাকা পাথরটা সরে গেল। জায়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুটা সময় পাওয়া গেল নিশাতের সাথে দেখা করার আগে।এটাই বা কম কি!!
তবে নিশাত হঠাৎ করে দেখা করতে না করল কেন? তার কি কোন সমস্যা হয়েছে?

অন্যদিকে নিশাতের বেশ মন খারাপ লাগলো, আজকে তার সাথে দেখা হলো না। হবেই বা কি করে… হঠাৎ করেই দুপুরে বড় ফুপু তাদের বাসায় চলে এসেছে। এসে তিনি যা সাধারণত করে থাকেন তাই শুরু করে দিলেন। নিশাতের বিয়ে নিয়ে যত ধরনের ভবিষ্যৎবাণী করা সম্ভব সবগুলো একটা একটা করে করতে থাকতেন।

নিশাতকে দেখে তিমি প্রথমেই বললেন, তোর এই কি অবস্থা? গায়ের চামড়া তো পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে বিয়ে হবে কিভাবে? কালো মেয়েকে কে বিয়ে করবে? প্রতিদিন চন্দন মাটি মাখবি। কাঁচা হলুদ মাখলে তো চামড়ার রং একটু সাদা হয়।
বিয়ের বাজার এখন এমনিতেই ভালো না। তুই তো এমনিই জন্মগত শ্যামলা। এখন যদি আরো কালো হয়ে যাস, তবে বিয়ে হবে কি করে তোর?

কথাগুলো শুনে নিশাতের রাগে শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। তাও সে ফুপুর কথার কোন উত্তর দিল না। সে মুখে হাসি এনে বলার চেষ্টা করল, এ কয়েকদিন মা অসুস্থ ছিল। রান্না বান্নার সব কাজ আমিই করেছি। সেই জন্যই হয়তো একটু কালো দেখাচ্ছে আমাকে।

ফুপু যেন তার এই কথাটির জন্য অপেক্ষা করছিল। নিশাতের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই.. তিনি ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলেন, কেন রান্নাবান্না কি তুই শুধু একা করিস? রুমি করেনা? রাকিবের বউ একা হাতে সব রান্না করে। আবার নিজের যত্নও করে। প্রতিদিন কত কিছু মাখে। ভাগ্য করে এমন একটা বৌমা পেয়েছি। রাকিব তো ওর বউকে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে ভুলেও তাকায় না। এরকম একটা ছেলের বউ হলে ছেলেরা কখনো বউয়ের আঁচলের তল থেকে সরে না।

নিশাত তার ফুপুর কথার কোন উত্তর দিল না। সে জানে, ফুফুকে যে উত্তরই দেওয়া হোক না কেন… সেই উত্তরটিকেই তিনি খারাপ ভাবে উপস্থাপন করে; নিজের টাকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরবেন।

তার সাথে কথাবার্তা বলাই বৃথা। এ ধরনের মানুষের সাথে যে কথাই বলা হবে না কেন… সেই কথাই ভুল প্রমাণিত হবে। তাই বৃথা সময় নষ্ট না করে নিশাত তার কাজের বাহানা দেখিয়ে ফুপুর কাছ থেকে সরে নিজের ঘরে চলে আসলো।

ঘরে আগে থেকে বসে ঈশিতা বসে আছে। সে পড়াশোনা করছিল। কিন্তু ফুপুর কথাগুলো তার কান এড়িয়ে যায়নি। ঈশিতার মন ভীষন খারাপ হয়ে গেল, সে ছোটবেলা থেকেই তার বড় বোনের সাথে এমনটা হয়ে আসতে দেখছে। ফুপু সব সময় তাকে এবং তার বোনকে আলাদা করে দেখে। ঈশিতার গায়ের রং একটি উজ্জ্বল হওয়ায় ফুপু সবসময় তাকে আলাদা নজরে দেখে। এ বিষয়টি তার কাছে খুবই খারাপ লাগে।

সে নিশাতের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলল, ফুপুকে আমি পছন্দ করি এটা সত্যি। তবে আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। হয়তো কখনো প্রকাশ করি না। তোমার জন্য আমার ভালোবাসা কখনোই কম ছিল না আপু। কিন্তু নিশাত আপু, তোমার কষ্ট আমার দেখতে ভালো লাগে না।
তোমাকে যে কষ্ট দিবে তাকে আমি কখনো আনন্দ পেতে দিব না। ফুপু আজকেই বুঝবে এই ঈশিতার বড় বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার করার সাজা কি!!

ঈশিতার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। এই মুহূর্তে তার মাথায় একটি দুষ্টু বুদ্ধির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই তার মুখের হাসি বেঁকে যেতে লাগলো।

নিশাত পড়তে বসেছিল। হঠাৎ বসার ঘর থেকে চিৎকারের শব্দ তার কানে ভেসে আসলো। নিশাত বই বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।
দ্রুত পা চালিয়ে এসে বসার ঘর এসে দেখলো, ফুপু চিৎকার করে তার ছেলের বউকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে, এবং কপাল চাপড়াচ্ছে।

এমন দৃশ্য দেখে নিশাত বিস্মিত হল, সে কিছুই বুঝতে পারল না। কিন্তু ফুফুর এরকম অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে তার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতে সাহস হলো না।

ঈশিতাকে তার পাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসতে দেখে, নিশাতের সন্দেহ হলো। ফুপুর এ ধরনের ঘটনা ঈশিতার আবার কোন হাত নেই তো?

– ঈশিতা, তুই কিছু করেছিস নাকি?
– না আপু। করতে তো চেয়েছিলামই , তবে সেটার আর সুযোগ হলো কই? প্রকৃতিই তো ফুপুকে তার অন্যায়ের সাজা দিয়ে দিয়েছে।
– কি হয়েছে?
ঈশিতা বেশ হাসি হাসি মুখে তাকে উত্তর দিল, আপু টিভির দিকে তাকিয়ে দেখো।

নিশাত টিভিতে দেখতে পেল, একটি টিভি চ্যানেলে কোন একটা নিউজ পুনঃপ্রচার হচ্ছিল। নিউজটা আর কারোর না তার বড় ফুপুর একমাত্র গুণধরপুত্র রাকিবের। নিউজে দেখানো হচ্ছে, একটি আবাসিক হোটেল পুলিশ রেড চালিয়ে হোটেলে অনৈতিক কার্যকলাপের জন্য বেশ কিছু মানুষকে এরেস্ট করছে। সেখানে রাকিব এবং একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে।
মেয়েটিকে দেখে নিশাত চিনতে পারল। মেয়েটি রাকিব ভাইয়ের প্রাক্তন প্রেমিকা!

নিশাতের চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল। সে চাপা গলায় ঈশিতাকে প্রশ্ন করল, যদি ঘটনা এটাই হয় তাহলে তো রাকিব ভাইতো আসল দোষী, তাহলে ফুপু রুমি ভাবীকে কেন দোষারোপ করছে?

ঈশিতা সহজ গলায় উত্তর দিল, কারণ… রুমি ভাবি, রাকিব ভাইকে তার শাড়ির আঁচলের সাথে বেঁধে রাখতে পারেনি তাই!!

ফুপুর মরাকান্নায় তাদের বাসা কাঁপতে থাকলো। নিশাত কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে, তার মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রাহেলা বেগম নিশাতকে বললেন, তোর বাবাকে একটা ফোন দে তো…

নিশাত তোর বাবাকে ফোন দেওয়ার উদ্দেশ্যে মোবাইলটা হাতে তুলে নিতেই… তার ফোনে জায়ানের একটি মেসেজ আসলো।
মেসেজের লেখা,
নিশাত, ‘কেমন লাগলো এই নাটক’? তোমার ফুপু কিন্তু তার উচিত শিক্ষা পেয়ে গেছে। “অহংকার পতনের মূল”। এখন থেকে তার পতন শুরু হল।

নিশাত জায়ানকে মেসেজ করল, “আপনিই কি এসব করেছেন? কিভাবে করলেন”?
প্রায় সাথে সাথেই জায়ানের নাম্বার থেকে ফিরতে মেসেজ আসলো।

সবকিছু যদি জানতে চাও…. তবে আগামী কাল রাত আটটায় তোমার বাসার সামনের “আলো- ছায়া” ক্যাফেতে চলে আসো।
“আমাদের প্রথম দেখার সাথে সাথে…. তোমার জমে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। হয়তোবা আমাকে ঘিরে থাকা রহস্য একটু হলেও উন্মোচন করতে পারবে”!!

#পর্ব_৬

আধা ঘন্টার বেশি সময় হবে নিশাত ক্যাফেতে বসে আছে। সে বেশ চিন্তিত হয়ে বসে আছে।বার বার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে‌। আটটা পাঁচ বাজে এখন। এখনো তার দেখা নেই। নিশাত অস্থির হয়ে ক্যাফের এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ঈশিতা তাকে সাহায্য না করলে হয়তো আজ আর আসাই হতো না। আজ তার বাবা অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছে তার আসতে দুদিন লাগতে পারে। সেজন্যেই বের হওয়াটা সহজ হয়েছে। তবে ঈশিতা তাকে বের করার সময় মাকে অনেকটা ব্যস্ত রেখেছিল সেজন্য তার বের হওয়াটা সহজ হয়েছে। না হলে মায়ের হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হতো এত রাতে বাসার বাইরে যাওয়ার কারণে। কিন্তু; অদ্ভুত বিষয় নিশাত জায়ানকে বারবার বলেছিলো সকালবেলা দেখা করার কথা কিন্তু জায়ান বারবারই এই সময়টির কথাই বলছিল। তাই নিশাতের আর করার কিছু ছিল না। সেও রাজি হয়ে গিয়েছে।
সে একটা বিষয় লক্ষ্য করল,
এ ক্যাফের ডেকোরেশনটা যেন অনেকটা বদলে গেছে। আশেপাশে দেয়াল মেঝের সবকিছুই মেরুন রঙের এবং বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে ক্যাফেটি সাজানো হয়েছে। বিষয়টি বেশ অবাক করার মতো। এই “আলো-ছায়া” ক্যাফেতে নিশাতের কলেজ জীবনে অনেক আসা-যাওয়া হতো। কলেজের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ছুটির পর এই ক্যাফেতে এসে এক কাপ এক্সপ্রেসো কফি না খেলে তার চলতোই না।
তবে বেশ অনেকদিন হয়ে গেছে, এখানে আসা হয় না।নিশাতের স্মৃতি পাতায় এই ক্যাফেটি একটা বড় স্থান জুড়ে আছে।
নিশাত আবারও তার হাত ঘড়ির দিকে অস্থির হয়ে তাকালো, আটটা দশ বাজে। ক্যাফেতে সে ছাড়া আর কেউ নেই। সাধারণত এমনটা হওয়ার কথা না। এই ক্যাফে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত জমজমাট থাকে। এখানের কফির জুড়ি মেলা ভার।তাই এই ছোট্ট ক্যাফেটাতে অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ কফি খেতে এবং আড্ডা দিতেই আসে।

শূন্য ক্যাফেতে একা বসে থেকে তার হালকা ভয় লাগছে। তবে সে ভয় ভাবকে লুকিয়ে রেখে শক্ত মুখে বসে আছে।
এমন সময় তার সামনের টেবিলের ওপর একজন ওয়েটার এসে এক কাপ এক্সপ্রেসো কফি এবং নীল একটি খাম রেখে চলে যাচ্ছিল। নিশাত তাকে থামালো।

– আমি তো কফির অর্ডার করিনি। আসলে একজনের আমার সাথে দেখা করার কথা। সে আসলেই আমি অর্ডার করবো।

– ম্যাডাম, স্যার এগুলো আপনার জন্য পাঠিয়েছে।
নিশাত বেশ অবাক হয়ে ওয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোন স্যার’?
– ‘জায়ান আহমেদ স্যার’।

নিশাত বিস্মিত হয়ে গেল। তারপরও সে বিস্ময় চাপা রেখে বলার চেষ্টা করল,’আজকে ক্যাফেতে কাউকে দেখছি না কেন’?

– ম্যাডাম… জায়ান স্যার একদিনের জন্য ব্যাক্তিগত ভাবে ক্যাফে বুক করে রেখেছেন। তাই ক্যাফেতে বাইরের মানুষ আজকে আসতে পারবে না।

– ঠিক আছে.. তাহলে আপনি এখন যান।

নিশাতের সামনে থেকে ওয়েটারটি চলে গেল। নিশাত প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে তার সামনে থাকে নীল খামটি খুলল। খামটি থেকে একটু চিরকুট বেরিয়ে তার হাতে আসলো। নিশাত তার পাশে থাকা এক্সপ্রেসো কফিটি খেতে খেতে চিরকুটটি পড়তে শুরু করলো।

“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”

লাইন দুটো দেখে নিশাত মুচকি হাসলো। রবি ঠাকুরের লেখা এই দুটি লাইন নিশাতের বেশ পছন্দের। সে কিভাবে জানলো এই দুটি লাইন নিশাতের এত পছন্দের!! নিশাত বেশ কয়েকবার লাইন দুটি পড়তে থাকলো।

হঠাৎ করেই লোডশেডিং হলো, চারিদিকে আকস্মিক ভাবে অন্ধকার হয়ে গেল। নিশাত প্রচন্ড অবাক হলো। কারণ এই ক্যাফেতে জেনারেটর আছে। কারেন্ট চলে যাওয়ার সাথে সাথেই জেনারেটর চালু হয়ে যায়।

তবে আজ কি হল? বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল আলোর কোন দিশা না দেখে নিশাত অবাক হয়ে গেল। সে সুদূরে জানালার পানে চেয়ে দেখলো রাস্তার দৃশ্যপট।
আশেপাশের সব জায়গায় আলো জ্বলছে। তার মানে কারেন্ট যায়নি। নিশাত টেবিলে রাখা তার মোবাইলটি হাতে তুলে নিয়ে ফ্লাশ অন করে সামনের দিকে ধরল।

নিশাত বেশ চমকে উঠলো তার সামনে একটি মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে। ফ্লাশের আলোতে একটি মুখ তার সামনে ভেসে উঠলো। প্রায় সাথে সাথেই কারেন্ট চলে আসলো। নিশাত লক্ষ্য করল, তার সামনে একজন যুবক বসে আছে। তার পরনে মেরুন কালারের শার্ট এবং সাদা প্যান্ট। শার্টের হাতা কুনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা , চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা,বেশ ফর্সা ফ্যাকাশে গায়ের রং, সে সুদর্শন সেটি তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

নিশাত চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। তার আর বুঝতে বাকি থাকলো না, এই সেই ‘জায়ান আহমেদ’।

যুবকটি নিশাতকে হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো। নিজের হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ভরাট কন্ঠ বললো,
– হ্যালো… ‘আমি জায়ান’।

নিশাত বেশ কিছুক্ষণ কিছু বলল না। তারপর সে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল। নিশাত লক্ষ্য করল, জায়ানের হাতে কিছু কাটার ক্ষত দাগ। সে বিষয়টি উপেক্ষা করে বলল, ‘আমি নিশাত’। শব্দ দুটি বলতে গিয়ে নিশাতের গলা কেঁপে গেল।

-নিশাত, তুমি কি ভয় পাচ্ছো?
নিশাত বিব্রত বোধ করল। সে বলল, না… আচ্ছা। আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?

জায়ান হাসিমুখে উত্তর দিল, হ্যাঁ! অবশ্যই তুমি অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারো। আমার সম্পর্কে তুমি অনেক কিছুই জানো না। প্রশ্ন করার অধিকার তোমার আছে।

– আপনাকে আমার বেশ চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি আপনাকে আগেও কখনো দেখেছি। আমাদেরকে আগে দেখা হয়েছিল?
– না, আমাদের আগে কখনোই দেখা হয়নি।

– আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি আমাকে কিভাবে চিনেন? এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এতদিন ধরে আমি এটা ভাবছি। আশা করি উত্তর দিবেন…

জায়ান আহমেদ এবারে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। তার মুখ থেকে হাসি মুছে গেল।
সে স্বাভাবিকভাবে বলল, সেটা একটা লম্বা গল্প। আজকে কি শোনার সময় হবে তোমার? তুমি কিন্তু গতকালকে রাতে আমাকে বলেছিলে, তুমি এক ঘন্টার বেশি সময় দিতে পারবে না।
নিশাত ঘড়ির দিকে তাকালো। আটটা চল্লিশ বাজে।
সে বলল, সমস্যা নেই। আপনি বলুন। সময়টা কোন ফ্যাক্ট না। আমি এটা জানতে চাই।

– ঠিক আছে। তুমি যখন জানতে চাইছো তাহলে বলছি।

– বলুন নিশাত বেশ আগ্রহ সহকারে জায়ান আহমেদের দিকে তাকালো। কিন্তু তার প্রতি ক্ষনে ক্ষনে মনে হতে লাগলো আগেও সে জায়ানকে কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটা মনে করতে পারছে না।

জায়ান নিশাতের দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আমি প্রথম থেকেই শুরু করি।

সময়টা আজ থেকে তিন বছর আগের। তখন আমি অনেক হতাশাচ্ছন্ন ছিলাম। জীবনের এমন একটা সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলাম, যেখান থেকে আমি আমার জীবনটাকে আর সহ্য করতে পারছিলাম না।

মৃত্যুই তখন আমার একমাত্র প্রশান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষ বাঁচার জন্য কত কি করে! তুমি কি জানো নিশাত আমি মরে যাওয়ার জন্য কত কিছু করেছি। এ জীবনটা এতটা কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়াবে আমার জন্য, আমি কখনো ভাবিনি।
আমি প্রথম সুইসাইডের চেষ্টা করেছিলাম, কিভাবে জানো? আমি ৬২ টা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম। তারপরও আমি মারা যাইনি। হয়তোবা সৃষ্টিকর্তাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। দ্বিতীয়বার আমি হাত কেটে ফেলেছিলাম। হাতের শিরা উপশিরা বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিলাম। শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরে ছিল। তারপরও আমি মারা যাইনি।
নিশাত, তুমি হয়তো এসব শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছ। ভাবছো আমি তোমাকে এসব কথা বলছি কেন?

নিশাত তার এই ধরনের অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে অবাক হলেও সেটি প্রকাশ না করে বললো, না আমি অবাক হচ্ছি না। তবে আপনার কথা শুনে বেশ ভয় পাচ্ছি।

জায়ান নিশাতের কথা শুনে হাসলো। তোমার ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। তোমাকে যেগুলো বলছি সেগুলো আমার অতীত। এখন তুমি আমাকে যেভাবে দেখছ সেটা আমার বর্তমান।

নিশাত বলল, আপনি কেন এত বার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলেন? আপনার ভিতরে কি এমন কষ্ট ছিল?

জায়ান উত্তর দিল, আমি এটার উত্তর দেব। আগে তুমি আমার গল্পটা শোনো। তোমাকে যেটা বললাম, সেটা.. আমার দ্বিতীয়বারের সুইসাইডের চেষ্টা ছিল। তৃতীয়বার আমি সুইসাইডের এটেম নিয়েছিলাম। আমি আবারও বিষ খেয়েছিলাম। কিন্তু সেবার , আমি আর মারা যাইনি সেবারও আমি বেঁচে গিয়েছি। প্রত্যেকটা বার আমি মৃত্যুর চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষবার আমি বাঁচার চেষ্টা করেছি।

– মানে?
তোমার মনে আছে কিনা জানিনা। এক বছর আগে তোমার মায়ের একটা অপারেশনের জন্য, তুমি তোমার মাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছিলে। তখন আমি তোমাকে প্রথমবার দেখেছিলাম।
তোমার চিন্তিত মুখ, প্রিয়জনের কষ্টে ব্যথিত চেহারা আমার ভেতরে এক ধরনের অদ্ভুত পরিবর্তন এনেছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মৃত্যু কখনোই আমার জীবনের সমাধান হতে পারে না।
প্রিয়জন হারানোর কষ্ট… অনেক বড় কষ্ট। আমি যদি আত্মহত্যা করতাম; তাহলে শুধু আমি একা মারা যেতাম না, আমার বাবাও আমার সাথে মারা যেতেন। তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে হয়তোবা তিনি বাঁচতে পারতেন না।
আমি শুধু নিজেকেই হত্যা করতে চাচ্ছিলাম না। আমি নিজের সাথে সাথে আমার বাবাকেও কষ্ট দিয়ে দিয়ে মারতে চাচ্ছিলাম। সেইবারের ঘটনা থেকে আমি বেঁচে ফিরি… নতুনভাবে বাঁচতে শিখি।
এর পিছনে সবচেয়ে বড় হাত তোমার রয়েছে।
ঘটনা শুধু এতোটুকুই নয়। আরো অনেক রয়েছে।তবে আজকে এতোটুকুই নাহয় থাকুক। আস্তে আস্তে তুমি আমার সম্পর্কে সবই জানতে পারবে। “নিশাত তোমাকে অনেক ধন্যবাদ”!!

নিশাত জায়ানের কথাগুলো শুনে চুপ করে থাকলো। তারপর মৃদুস্বরে বললো, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! অসংখ্য ধন্যবাদ।

– কেন? আমি আবার কি করলাম?

– ধন্যবাদ… যে আপনার প্রাপ্য। আমি দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিন আপনি অ্যাম্বুলেন্স না পাঠালে; আমার মাকে হয়তোবা আমি বাঁচাতে পারতাম না। আপনি আমাকে যে সাহায্যটি করেছেন তার জন্য আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো।

জায়ান মৃদু হাসলো। আচ্ছা ঠিক আছে। আন্টি এখন কেমন আছেন?
– জ্বি…অনেক ভালো আছেন।

-“নিশাত তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে”।

নিশাত বেশ লজ্জা পেল। আস্তে করে বললো, ধন্যবাদ। আপনাকেও ভালো লাগছে অনেক।

– তাতো লাগতেই হবে… তোমার ভালোর ফেভারিট কালারের শার্ট পড়ে এসেছি। মেরুন তো তোমার ফেভারিট কালার।

– আপনি কিভাবে জানলেন? মেরুন আমার ফেভারিট কালার? এজন্যই কি আপনি ক্যাফেটার ডেকোরেশন মেরুন রঙের করেছেন?

– হ্যাঁ।
নিশাত বিস্ময় ভরা মুখে জায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিশাতকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জায়ান বললো, চলো, নিশাত কফি অর্ডার করি। তোমার কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
নিশাত কোন উত্তর দিল না।

জায়ান ওয়েটারকে ডেকে বলল, একটা এক্সপ্রেসো কফি আর একটা ব্ল্যাক কফি উইথআউট সুপার।

– আমি এক্সপ্রেসো কফি পছন্দ করি আপনি কিভাবে জানলেন?

– এটা যেন বেশ কঠিন কিছু ছিল না। ধরে নাও এভাবেই জেনে গেছি।

নিশাত জায়ানকে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাবা কি করেন?
– ওনার বিজনেস আছে। ইমতিয়াজ কনস্ট্রাকশন হাউজের।

– ওয়েট.. ওয়েট, আপনার বাবার নাম কি ইমতিয়াজ আহমেদ?
হ্যাঁ।
– আপনি ওনার ছেলে জায়ান আহমেদ!!

– ইয়ে.. হ্যাঁ।

নিশাত এবারে বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে গেল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না । তার সামনের মানুষটিকে হঠাৎ করেই সে চিনতে পেরে গেল। সে জায়ান কে চিনতে পেরেছে!!

জায়ান ও মনে হয় বিষয়টি বুঝতে পারল। সেটার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি যেটা ভাবছো সেটাই।

নিশাত বলল, এটা কিভাবে সম্ভব? আমি যেটা ভাবছি সেটাই যদি হয়! তবেতো আপনি মৃত!! আপনি বেঁচে আছেন কি করে? আট বছর আগে তো ইমতিয়াজ আহমেদের ছেলে মারা গিয়েছিল।

– সারা পৃথিবীর সামনে আমি মৃত। কিন্তু আমি বেঁচে আছি।

৮ বছর আগেই তো ইমতিয়াজ আহমেদের একমাত্র ছেলে এবং স্ত্রী অগ্নি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। আপনার ছবিও তখন আমি টিভিতে নিউজে দেখেছিলাম। আট বছর আগের আপনার সাথে এখনকার আপনার মিল পাওয়াটা বেশ কষ্টকর। তারপর ও আমার কাছে চেনা চেনা লাগছিল।

– সারা পৃথিবীর কাছে আমি মৃত হলেও আমি বেঁচে আছি। আমি এভাবেই বেঁচে থাকতে চাই। আমি মানুষকে জানাতে চাই না যে আমি বেঁচে আছি।

– কিন্তু কেন?

জায়ান মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে এসেছিলো। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার আগেই নিশাতের মোবাইলটি বেজে উঠলো। নিশাতার তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক মিনিট মা ফোন করেছে’।

নিশাত জানে ফোনটি করেছে মূলত ঈশিতা। সে কল রিসিভ করল। কলের অপর প্রান্ত থেকে ঈশিতা বলল ,আপু তাড়াতাড়ি আসো।
বাবা বাসায় চলে আসছে। বাবার ট্রেনিং ক্যান্সেল হয়ে গেছে। মা কিন্তু ঘুমিয়ে গেছে। তবে বাবা আসার আগেই চলে আসো।
নিশাত অতি ব্যস্ত হয়ে তার ঘড়ি থেকে তাকিয়ে দেখল রাত দশটা বেজে গেছে। এত দ্রুত সময়টা কেটে যাওয়াতে নিশাত ভীষণ অবাক হয়ে গেল। সে জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে আর থাকতে পারছি না। আমাকে এখন যেতে হবে। আপনার সাথে কথা বলে, অনেক ভালো লাগলো।

জায়ান হেসে বলল, “তোমার সাথে কাটানো দুটি ঘন্টা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দুটি ঘন্টা হয়ে থাকবে। চলো তোমাকে এগিয়ে দেই”।

– আপনার বাসা তো এখানে না। আপনি বলেছিলেন আপনি ঢাকার বাইরে গাজীপুরে থাকেন। তাহলে এখন আর আপনার দেরি হয়ে যাবে আপনি চলে যান।

নিশাত তাড়াহুড়া হ্যান্ড ব্যাগটি নিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে পড়ল। জায়ান নিশাতের নিষেধ অগ্রাহ্য করে তার পিছু পিছু আসতে থাকলো। রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দুজনের মধ্যে বেশ কথাবার্তা হল।

নিশাত তাকে বলল, আপনি এখন চলে যান আমি বাসার কাছে চলে এসেছি।

এখানে তো আমারও বাসা, ওই যে পাশের বিল্ডিংটাতে আমি থাকি। আমি আমার বাসায় যাচ্ছি।
– বলেন কি?আপনি এখানে থাকেন এর মানে কি?

– আসলে প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত আমি এই বাসাটাতে থাকি। রাত দুটোর সময় বাসা থেকে চলে যাই। সেদিন তো তোমাদের সেই কেয়ারটেকার আমাকে চোর বানিয়ে দিয়েছিল ভুলে গিয়েছিলে!!

– কিহহ্.. আপনি এখানে থাকেন!!

– হ্যাঁ…. বলে জায়ান পিছন ঘুরে পাশের বিল্ডিংটির দিকে যেতে লাগলো, একবার পিছন ঘুরে নিশাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

নিশাত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার মানে জায়ান এতদিন ধরে তার আশেপাশেই থাকতো। সে সেটা এতদিন পর টের পেয়েছে। আর কি কি করেছে এই ছেলে!!সেটাই তো এখন সে বুঝতে পারছে না।

এমন সময় নিশাত অন্ধকারে দেখতে পেল, একটি পরিচিত মুখ তার এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারলো এটিই তার বাবা। নিশাত তার বাবাকে দেখে অন্ধকারের মধ্যে সিঁড়ি ভেঙে বাসার দিকে দৌড়ে উঠতে লাগলো।

ইকবাল হোসেন নিশাতকে দেখতে পাননি। তিনি বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, কেউ তাকে দেখে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালো। তাকে দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে? তিনি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক!! অদ্ভুত ব্যাপার… বলেই ইকবাল হোসেন বাসার দিকে যেতে থাকলেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য:(পড়ে কেমন লাগলো অবশ্যই মন্তব্য করে জানাবেন। যদি কোন ভুল ত্রুটি হয় তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ।)

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here