উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ১৫

0
3104

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
বৃষ্টি কান্না করতে করতে বলছে কথাগুলো। এদিকে আকাশ পাথরের মুর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। হাতটা উঠিয়ে বৃষ্টিকে সান্ত্বনা পর্যন্ত দিচ্ছে না! বৃষ্টি তাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। আকাশের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে আকাশের বুকে দুতিনটা ধাক্কা দিয়ে বললো,
– পাষাণ হয়ে গেছো তুমি? কোন অনুভূতি নেই তোমার মাঝে? তুমি কি মানুষ না পাথর!
বৃষ্টি দৌড়ে জঙ্গলের দিকে যেতে নিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। চোখ পড়লো অর্ধ উদিত লাল সূর্যের দিকে! সে দৌড়ে আবার আকাশের কাছে চলে এলো।
– তিন মিনিট তোমার গা ঘেঁষে দাড়াবো, সরাবা না প্লিজ!
বৃষ্টি আকাশের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে আকাশের দুইটা হাত তার পেটের উপর আনলো। গভীর অনুভূতি নিয়ে বৃষ্টি আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে সূর্যোদয় দেখলো! মুহুর্তটা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করলো সে। আকাশ তাকে স্বেচ্ছায় কাছে টেনে দাড়ালে হয়তো সেটা আরও গভীর হতো!
সূর্যোদয় দেখতে তার তিনমিনিট লেগেছে নাকি আরও বেশি সময় লেগেছে তার জানা নেই! সূর্যোদয় দেখে বৃষ্টি আকাশকে ছেড়ে আবার দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর চলে গেলো। আকাশ সূর্যের দিকে তাকিয়েই আছে। মেয়েটা অনেক কথা জানে! যতবারই তার কাছে আসে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির জন্ম দিয়ে যায়! এমন কেন সে! বড়সড় এক নিশ্বাস ফেলে আকাশও তাবুর উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো।
রওনক আর অভ্রের হাতে বাজার আনিয়ে সবাই মিলে সকালের নাস্তা তৈরি করে ফেললো। এর মাঝে বৃষ্টির চেহারা দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেছে তার কি হয়েছে। কিন্তু সে নিজের কষ্টটা লুকিয়ে বিদ্রুপস্বরূপ উত্তরে বলেছে তাকে ভুতে ধরেছে। সবাই এ নিয়ে নানান উপহাস শুরু করেছে শুধু আকাশ ছাড়া। আকাশ শুধু এটাই লক্ষ্য করছে বৃষ্টি তার কষ্ট লুকিয়ে সবার সাথে নিজেকে নিয়েই মজা করছে! খাওয়ার সময় বৃষ্টি এলো না তাদের কাছে। তার ভালো লাগছে না এই বলে সে অন্যদিকে হাটতে লাগলো। সবারই একটু খারাপ লাগছে। মেয়েটি কাল রাতেও খায়নি এখনও খাচ্ছে না। কিছু হয়েছে তা সবাই বুঝতে পারছে। সিমির কথায় সবাই খাওয়া শেষ করে নিলো। বৃষ্টি হাটতে হাটতে সেই গাছের নিচে এসে বসলো, যেখানে আকাশ ডালে ঝুলেছিলো।
খাওয়া শেষ করে সিমি বৃষ্টির জন্য প্লেটে খাবার নিলো। আকাশ দুইটা মুরগির রোস্ট তুলে দিলো প্লেটে। সিমি তার দিকে তাকাতেই আকাশ বললো,
– কাল রাতেরটা সহ দিলাম।
সিমি হেসে প্লেট নিয়ে বৃষ্টির কাছে এলো। পিছু পিছু রিজভীও দৌড়ে এলো। সিমি বৃষ্টির কাছে এসে গাছের শিকড়ে বসলো।
– না খেয়ে চলে এলে কেন! খেয়ে নাও।
– খাবো না আপু। ভালো লাগছে না।
– রাতেও খাওনি, এজন্যই ভালো লাগছে না। তারাতাড়ি খেয়ে নাও। না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
– আপু জোর করো না প্লিজ। এমনিতেই বমি বমি লাগছে।
– খালি পেটে আছো বলেই বমি বমি লাগছে।
হঠাৎ রিজভী বলে উঠলো,
– ওমা! বমি বমি লাগছে! পেটের ভেতর কি আছে গো?
– পেটের ভেতর নাড়িভুড়ি আর মলমূত্র আছে।
– তা তো আমাদেরও আছে, কই আমাদের তো বমি বমি লাগছে না! তাছাড়া আর কি আছে তোমার পেটে?
সিমি রেগে বললো,
– তুই যাবি এখান থেকে!
বৃষ্টি রিজভীকে জবাব দিলো,
– আমার পেটে বমিও আছে। এজন্যই বমি বমি লাগছে।
বৃষ্টির উত্তর শুনে রিজভী হাহাহোহো করে হাসতে হাসতে চলে গেলো। সিমি আরও কয়েকবার বললো কিন্তু বৃষ্টিকে রাজি করাতে পারলো না। সিমি প্লেট নিয়ে তাবুর দিকে চলে গেলো। সিমিকে প্লেট নিয়ে ফিরে আসতে দেখে আকাশ সিমির হাত থেকে প্লেট নিয়ে বৃষ্টির কাছে এলো। গাছের শিকরে বসে বললো,
– খাচ্ছো না কেন?
– আপনার কি?
– আমার কিছুনা। খেয়ে নাও। তোমার জন্য খাবার বেশি রান্না করেছি এখন নষ্ট করা যাবে না।
– খাবো না আমি। কে বলেছে বেশি করে রান্না করতে! এমনিতেই তো আপনাদের খাবার অনেক খেয়ে ফেলেছি। আর অতিরিক্ত কোন খাবার আমার জন্য রান্না করতে হবে না।
– এই ব্যাপার! খাবার তো বাচালে, কিন্তু এখনো এখানে আছো কেন? থাকার জায়গা বাচাবে না?
– হ্যাঁ, থাকবোও না। চলে যাবো।
– কোথায় যাবে?
– যেদিকে দু চোখ যায়।
– কখন যাবে?
বৃষ্টি অশ্রুসিক্ত নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
– এখনই চলে যাচ্ছি।
কথাটা বলে বৃষ্টি উঠতে গেলে আকাশ আবার হাত টেনে বসিয়ে দিলো।
– এতো জেদ কেন? চুপচাপ বসো।
আকাশ এখনো একহাত ধরে আছে। বৃষ্টি অন্যদিকে ফিরে চোখের পানি মুছছে।
– বৃষ্টি, এদিকে তাকাও। তাকাতে বলছি! দেখো কেউ কিন্তু একটার বেশি রোস্ট খায়নি। তোমার প্লেটে কিন্তু দুইটা।
– বলেছি আমি দুইটা দিতে?
– কাল রাতে খাওনি তাই দিয়েছি। তারাতাড়ি খাও। না হলে আবার সবগুলো আমার পেটে চলে যাবে।
– খাবো না।
– তুমি কি জানো আমাদের রান্না কতো মজা হয়?
– না জানি না। আর জানতেও চাইনা। সরুন, আমি চলে যাবো।
– মাইর দিবো কিন্তু এখন।
– দিন, এটা আর নতুন কি! অলরেডি তো দিয়েছেনই।
ছলছল চোখে বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো। কথাটা শুনে আকাশের ভেতরে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো। শাসনস্বরূপ বললেও এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। গায়ে হাত না তুললেও পারতো সে! সবটা একপাশে ফেলে আকাশ বললো,
– বাঘ আর শেয়ালের গল্প শোনালে খাবে?
বৃষ্টিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে আকাশ আবার বললো,
– তাহলে রূপকথার গল্প শুনাবো?
– আমাকে কি বাচ্চা মনে হয়?
– মনে হয় না, এখন মনে হচ্ছে। তোমাকে যতক্ষণ ধরে বলছি, এতোক্ষণে বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হয়ে যেত!
বৃষ্টি কান্নার মাঝেও হেসে উঠলো।
– বাচ্চাদের খুব ভালো সামলাতে পারেন দেখছি। ভবিষ্যতে আপনার এতোগুলা বাচ্চাকাচ্চা হোক।
– আচ্ছা, ভবিষ্যৎ আসুক আগে। এখন তো খাও।
– ভালো লাগছে না। খাবো না।
– আমি যদি পারতাম, “ভালো লাগে না” শব্দগুলোকে চিরদিনের জন্য ধংস করে দিতাম। মাছ ধরতে পারো?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে বৃষ্টি চমকে উঠলো। উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিলো,
– ছোট বেলায় ধরেছিলাম একবার!
– পাহাড়ের গোড়ায় বসে মাছ ধরেছো কখনো?
– পাহাড়ের গোড়ায় মাছ!
– হুম। মাছ ধরতে যাবো একটু পর। রওনক সেই ব্যবস্থাই করছে। খাওয়া হলে সাথে যেতে পারবে। না হলে যেতে পারবে না।
বৃষ্টি গ্লাসটা নিয়ে হাত ধুয়ে নিলো। প্লেট হাতে নিয়ে খেতে লাগলো। আকাশ মনে মনে বললো, “এই পদ্ধতি রেখে শুধু শুধু এতোক্ষণ কষ্ট করে যাচ্ছি! আগে জানলে তো মাছ ধরার কথাটাই আগে বলতাম!”
নিজের সাথে কথা বলে মৃদু হাসলো আকাশ। খালি পেটে তৈলাক্ত খাবার কেমন যেন শরীর ঝাকা মেরেছে বৃষ্টির! আকাশ বুঝতে পেরে বললো,
– ঝাল খেতে পারো?
– হুম, মোটামুটি।
– সিদ্ধ মরিচে কামড় দিয়ে খাও।
– আমার দিকে কেউ তাকিয়ে থাকলে খেতে পারি না।
আকাশ মুচকি হেসে উঠে যেতে নিলে বৃষ্টি আবার বললো,
– আমি দুইটা রোস্টও খেতে পারবো না।
– রিজভীকে ডাকবো?
– কেন, আপনি খেতে জানেন না?
– আমি দু প্লেট ভাত খেয়েছি!
– তাই বলে এইটা খাওয়ার জায়গা নেই পেটে!
– ওকে, তারাতাড়ি শেষ করো।
আকাশ একটা রোস্ট নিয়ে খেতে খেতে তাবুর দিকে গেলো। সিমি এসে গানের সুরে বললো,
– কি জাদু করেছো বলোনা? তোমার রানী সহজেই মেনে গেলো কিভাবে বুঝলাম না!
– শাট আপ!
– হিহিহি! কি বলেছিস? যে সহজে মেনে গেছে।
– সহজে! এ তো বাচ্চাদের চেয়েও খারাপ। অবশেষে মাছ ধরার কথা বলে প্লেট হাতে দিয়েছি।
– সাথে আবার রোস্টও ফ্রী! মেয়েটি কিন্তু অনেক ভালো আকাশ। তোর সাথে মন্দ হয় না। ভেবে দেখ!
– সিমি, স্টপ!
– পাষাণ, হার্টলেস!
সিমি চলে গেলো। আকাশের মুখ নাড়াচাড়া দেখে রিজভী দৌড়ে এসে রোস্ট নিয়ে পালালো। অবশ্য আকাশই বেশিরভাগ শেষ করেছে, শেষটুকু রিজভী নিয়েছে। বৃষ্টি আকাশের বলা কৌশল প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ খাবার শেষ করে তাবুতে এলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here