উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৩৮

0
2682

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৩৮
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো! ইগনোর করাতে মেঘের প্রচুর রাগ হচ্ছে! সে নাফিসার বাহু ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে বৃষ্টির কাছে চলে গেলো।
– বৃষ্টি, মেঘার কি হয়েছে?
– কেন, ভাবির আবার কি হবে?
– সেটাই তো জানতে চাইছি! সে তো পরিষ্কার ভাবে কিছু বলছেই না, শুধু আমার সাথে জেদ দেখাচ্ছে আমি কেন তাকে বিয়ে করলাম! কে কি বলেছে তাকে?
বৃষ্টি এবার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে বললো,
– মারিশা আপু এসেছিলো আজ! ভাবির সাথে খোচা মেরে কথা বলেছে।
এবার মেঘের কাছে সবটা পরিষ্কার! মারিশা নিশ্চয়ই নাফিসার বলা পয়েন্টগুলো বলে গেছে! সে বৃষ্টিকে বললো,
– নাফিসা কিছু বলেনি?
– না, ভাবিকে যা প্রশ্ন করেছিলো সেগুলোর উত্তর দিয়েছে শুধু।
– তুই কোথায় ছিলি?
– প্রথমে আমি পাশেই ছিলাম, পরে বাথরুমে হাতমুখ ধোয়ার সময় কি বলেছে জানি না। তবে আমি থাকাকালে দু একটা কথার জবাব দিয়েছিলাম।
– খেতে দেখেছে নাফিসাকে?
– হ্যাঁ, একসাথেই সবাই লাঞ্চ করেছি।
– ওকে। এরপর থেকে মারিশা আসুক আর যে ই আসুক, নাফিসাকে একা রাখবি না কারো পাশে।
– ওকে।
অতপর মেঘ রুমে ফিরে এলো। নাফিসা খাটের একপাশে বসে কান্না করছে! মেঘ দরজা লাগিয়ে পাশে এসে বসলো। নাফিসাকে ধরতেই হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়লো।
– আমাকে সিলেট রেখে আসুন। আমি থাকবো না এখানে।
– এই বোকা মেয়ে! বাইরের কেউ এসে তোমাকে এসব কথা শুনিয়ে গেলো আর তুমি কিছু বলতে পারলে না! তোমার তো উচিত ছিলো উপযুক্ত জবাব দেওয়া!
– প্রয়োজন নেই তো কারো সাথে লাগতে যাওয়ার! কিছু না বলতেই এতো দোষ খুজে বের করে ফেলেছে! আর তখন তো এটাও বলতে পারতো দুদিন হয়নি শ্বশুর বাড়ি এসেছি আর এখনই কেমন চাপা ছাড়ছি! হয়তো আমার পরিবারকেও অপমান করতো!
মেঘ তাকে কাছে টানতে গেলে নাফিসা আরও দূরে সরে গেলো! মেঘ জোর করেই তাকে কাছে টেনে নিজের সাথে বাহুডোরে বেধে রেখে বললো,
– তাহলে এখন আমি বলি! শুনেছি স্বামী ভালো থাকলে নারীদের কাছে আর কোন শক্তির প্রয়োজন পড়ে না! এখন বলো তুমি আমার সাথে এমন জেদ দেখাচ্ছো কেন! আমি কি সঠিক জায়গায় নেই? তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো কেন! আমি তো তোমার সঙ্গী।
– এজন্যই তো আপনার কাছে সব শেয়ার করলাম! এজন্যই তো কেবল আপনার কাছে আমার সব অভিমান অভিযোগ! সারাদিনে আমি আর কারও সাথে এ নিয়ে কোনো কথা বলিনি! নালিশ জানাচ্ছি না, শুধু এইটুকু চাচ্ছি আমি কারো কটু কথা শুনতে পারবো না মেঘ! অযথা কথা শুনতে সহ্য হয় না আমার! আমাকে সিলেট রেখে আসুন!
নাফিসা মেঘকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কাদতে লাগলো! মেঘ বাধা দিচ্ছে না। কাদলে মন হালকা হয়! তাই বুকে চেপে রেখেছে। সে জানে নাফিসা এখনো তার পরিবারের সদস্যদের সাথেও তেমন ফ্রী না। একমাত্র মেঘের উপরই ভরসা করে এখানে আছে সে! নাফিসার কান্নার গতি আস্তে আস্তে কমে এলো। চোখের পানি মুছে দিয়ে মেঘ বললো,
– সবসময় আত্মসম্মান নিয়ে বসে থাকলে চলে না, মেঘা। প্রয়োজনে উপযুক্ত জবাব দিতে হয়। মুখ বুজে বসে থাকলে তুমি বোকা হয়ে যাবে! হ্যাঁ, এটাও ঠিক অতিরিক্ত কিছুই ভালো না! তাই পরিস্থিতি বুঝে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জগৎ বড়ই কঠিন, জানো তো! তাই সময় ও সুযোগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে যেতে হবে, তবেই না সফলতা আসবে! জেদ নিয়ে হার মেনে বসে থাকলে চলবে না! অল্পতে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না, বরং নিজেকে কঠিন করতে হবে। যাও, মুখ ধুয়ে এসো।
নাফিসা মুখ ধুয়ে এসে আবার খাটে বসে পড়লো। মেঘ তাকে খাওয়ার জন্য সাথে যেতে বললো কিন্তু সে গেলো না! জোর করলো তবুও মানাতে পারলো না। তার কথা একটাই, ভালো লাগছে না তাই সে খাবে না! মেঘ খাবার নিয়ে আজ রুমে চলে এলো। নাফিসা বুঝতেই পারছে মেঘ তাকে খায়িয়েই ছাড়বে! মাছের কাটা মেঘ বেছে দিতে নিলে সে প্লেট নিয়ে নিলো। নিজেই মাছ বাছতে লাগলো। মেঘ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে! নাফিসা প্রথম লোকমা গিলে দ্বিতীয় লোকমা আর গিলতে পারলো না! গলায় কাটা আটকে গেছে! তার সাথে মাছের কিসের শত্রু ভেবে পায়না সে! কখনোই শান্তি দিলো না তাকে! এতো দেখে নেওয়ার পরেও কাটা ফুটবেই! মুখ নাড়াচাড়া বন্ধ দেখে মেঘ বুঝে গেছে! নাফিসা দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে বমিই করে দিলো! এদিকে মেঘ রেগে গেছে! এতো জেদ নিয়ে থাকে কিভাবে! ইচ্ছে করছে অনেক কিছু কিন্তু কিছুই করতে পারছে না! নাফিসা মুখ ধুয়ে রুমে এলো। এখন আর কাটা লাগছে না, বেরিয়ে গেছে হয়তো! মেঘের চেহারা ভয়াবহ দেখাচ্ছে! চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট! মেঘ খুব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
– কাটা সরেছে?
– হুম।
– চুপচাপ বসো এখানে।
নাফিসা মেঘের কথা মতো বসে পড়লো। মেঘ নিজ হাতে তার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। মেঘের রাগান্বিত মুখ এখনো স্বাভাবিক হয়নি! তাকে স্বাভাবিক করতে খাবার তুলে দেওয়ার সময় নাফিসা মেঘের হাতের আঙুল কামড়ে ধরে রাখলো! মেঘ টানলেও ছাড়ছে না! মেঘ আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকালো তবুও নাফিসা কামড়ে ধরেই রেখেছে! মেঘ আর রাগ নিয়ে থাকতে পারলো না! মুখ চেপেই হেসে উঠলো! নাফিসা এবার ছেড়ে দিলো। তার মুখও লাজুক হয়ে উঠেছে! মেঘ তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– খাবে না আর? সব খাবার শেষ করতে হবে এখন!
– তুমি খাচ্ছো না কেন?
– খাবো কি করে, রাগিয়ে দিয়েছো আমাকে!
এবার মেঘও খাচ্ছে নাফিসাকেও খায়িয়ে দিচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে নাফিসাই প্লেট নিয়ে গেলো রেখে আসার জন্য। মোহিনী তাকে দেখে বললো,
– মন ভালো হয়েছে নাফিসার?
উত্তরে নাফিসা মুচকি হাসি দিলো। প্লেট ধুয়ে রেখে টেবিলের খাবারও গুছিয়ে রাখলো মোহিনীর সাথে। রুমে আসতেই মেঘ বললো,
– মেঘা, আম্মিও শাড়ি পড়ে মা ও শাড়ি পড়ে। তুমি কি পড়বে না?
– আমিও তো পড়ি মাঝে মাঝে!
– সবসময় দেখতে ইচ্ছে করে।
নাফিসা আর কোনো জবাব দিলো না। মেঘ ল্যাপটপে কাজ করছে, সে তার কাছেই গিয়ে বসে রইলো।
৩৬.
আজ বৃষ্টি কোচিং সেন্টার থেকে বের হতেই দেখলো গেইটের একটু দূরে আকাশ দাড়িয়ে আছে! আকাশ এখানে কেন ভেবে পাচ্ছে না সে! আকাশ দেয়ালের লেখাগুলোর উপর হাত নাড়ছে আর ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। বৃষ্টি বন্ধুদের কাছে বিদায় নিলো। বন্দুরা চলে গেলো আর বৃষ্টি গেইটের সামনেই দাড়িয়ে আছে, আকাশ কেন এসেছে সেটা দেখার জন্য। আকাশ গেইটের দিকে তাকাতেই বৃষ্টিকে দেখে ফোনে কথা বলা শেষ করলো। বৃষ্টির কাছে এগিয়ে এসে বললো,
– চলো।
বৃষ্টি এক জায়গায়ই দাড়িয়ে আছে। কেননা আকাশ তার কাছে এসে থামেনি, ফোন দেখতে দেখতে দৃঢ় পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিকে কাছে না পেয়ে পেছনে ঘুরে তাকালো। এবার বৃষ্টি তাকে দেখেও না দেখার ভান করে রাস্তার এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো! মনে হচ্ছে সে গাড়ি খুজছে! আকাশ সেখানে থেকেই আবার বললো,
– দাড়িয়ে আছো কেন? যাবে না?
– এক্সিউজমি? আপনি আমাকে কিছু বলছেন?
আকাশ আর কিছু না বলে চুপচাপ সামনে হাটা শুরু করলো। বৃষ্টি এমনিতেই রেগে আছে কালকের আচরণে আর এখন তো আরও রেগে গেছে! কোথায় এসে একটু ভালোভাবে কথা বলে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করবে! তা না করে ফোনের দিকে তাকিয়ে হাটতে হাটতে বলে গেলো “চলো” ! এভাবে বললে কে বুঝবে কাকে বলছে! এখন আবার নিজে বিরক্ত হয়ে একা একা চলে যাচ্ছে! যাক সে চলে! বৃষ্টি মুখ ফুলিয়ে এখানেই দাড়িয়ে আছে। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো থামছে না, এবার সে ই দৌড়ে গেলো। আকাশের পিছু পিছু হাটতে হাটতে বিড়বিড় করতে লাগলো,
– গোমড়ামুখো! একটা দিনও ঠিকমতো কথা বলে না! আসছে আবার দেমাক দেখিয়ে চলে যাচ্ছে! তাহলে এসেছেই কেন শুধু শুধু! কে বলেছে তাকে আসতে! মনে তো চায় ইট দিয়ে একটা মেরে মাথা ফাটিয়ে দেই!
আকাশ পিছু না দেখে সামনে তাকিয়ে হাটতে হাটতেই বললো,
– ইট তো পেছনে ফেলে রেখে এসেছো। নিয়ে এলে না!
বৃষ্টির রাগ কমার বদলে আরও বেড়ে যাচ্ছে! বিড়বিড় করেও শান্তি নেই, শুনে ফেলে! বৃষ্টি আর পিছু পিছু না হেটে তার সমানে হাটতে লাগলো, একটু পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু আকাশ ফোনেই কিছু করছে! আর কতো অবহেলা সহ্য করা যায়! সে তো তার জন্য আসেনি মনে হচ্ছে! তার সমস্ত ব্যস্ততা পড়ে আছে ফোনে! শুধু শুধু তার সাথে হেটে যাচ্ছে কেন! সে তো তাকে একটুও পাত্তা দেয় না! কাকে এতো ভালোবাসে! সমস্ত রাগ এবার অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে! আস্তে আস্তে পায়ের গতি থেমে গেলো। আকাশ তার দিকে তাকিয়ে মুখটা একটু মলিন করে ফেললো। পকেট থেকে রুমাল এগিয়ে দিলো। বৃষ্টি তার কান্ড দেখে নিজের হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে উল্টো পথে দ্রুত পায়ে হাটা ধরলো। অনেক হয়েছে, এবার সে বাসায়ই চলে যাবে! খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু রাস্তায় আছে বিধায় কান্নাও করতে পারছে না! রাস্তার পাশে রিকশা দেখে জিজ্ঞেস করলো যাবে কি-না? রিকশাওয়ালা যেতে রাজি হলেই সে রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশা ঘুরিয়ে নিলে কোথা থেকে লাফ দিয়ে আকাশ এসে উঠে পড়লো! বৃষ্টি অবাক হয়ে বললো,
– আপনি রিকশায় উঠেছেন কেন?
– তোমার সাথে যাবো বলে। মামা, সামনে রেস্টুরেন্টের কাছে যান।
– মামা, রিকশা থামান। আমি নেমে যাবো!
– মামা, রেস্টুরেন্টের আগে রিকশা থামলে আপনার রিকশার চাকা পাঞ্চার হয়ে যাবে। আপনি সোজা চলুন।
রিকশা আর থামলো না। আকাশ বৃষ্টির পেছনে রিকশায় হাত রাখলে বৃষ্টি সরিয়ে দিতে চাইছে। তাই আকাশ বললো,
– আরে! এমন করছো কেন! আমি তো রিকশায় হাত রেখেছি তাতে তোমার সমস্যা কি!
– আমার পেছনে হাত রেখেছেন এটাই আমার সমস্যা!
বৃষ্টি আরও চেপে বসলো আকাশের বিপরীত দিকে। আকাশ তাকে টেনে নিয়ে নিজের সাথে চেপে বসালো।
– পড়ে যাবে তো! এরপর আমাকে ঝামেলায় ফেলে বলবে, যে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি!
মানুষের কান্ড দেখে গা জ্বলে যায়! কেমন মানুষ এটা! রাগ ভাঙানোর জায়গায় একের পর এক রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে! এমন আচরণে কোনো মানুষের ভেতর আঘাত হানতে পারে সেই নূন্যতম অনুভূতিটুকু কি এই লোকটার মধ্যে নেই!
রিকশা এসে রেস্টুরেন্টের সামনে থামলো। বৃষ্টি বসে আছে রিকশায়। চোখ গড়িয়ে এক ফোটা দু ফোটা পানি পড়েই যাচ্ছে আর সে সাথে সাথে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আকাশ নামতে বললো কিন্তু সে নামছে না!
– কি হলো, নামবে না? মামা, আপনার ছেলে আছে? এই মেয়েকে নিয়ে যান তাহলে। বিয়ে দিয়ে দিবেন আপনার ছেলের সাথে। সাংসারিক কাজ সব পারে, তাছাড়া ভবিষ্যৎ ডাক্তার! আপনাদের খুব সেবা করবে।
রিকশাওয়ালা হাসছে আর আকাশ ভাড়া দিচ্ছে। এদিকে বৃষ্টির কান্না আরও বেড়ে যাচ্ছে! সে তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়লো রিকশা থেকে। না থেমে সোজা হাটা ধরলো তার বাসার পথে! আকাশ রিকশা থেকে দ্রুত নেমে বৃষ্টির হাত ধরে ফেললো। বৃষ্টি ছোটানোর চেষ্টা করছে, আকাশ আরও চেপে ধরেছে হাত! সে বৃষ্টিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে যাচ্ছে। বৃষ্টি আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো আকাশের মুখে হাসি! এ তো তার প্রাণ জুড়িয়ে দিতে বাধ্য! কে জানে, হয়তো এই হাসি দেখেই বৃষ্টি তার প্রেমে পড়ে গেছে! তার জীবনে সে তিনজন পুরুষের মুচকি হাসি দেখে মুগ্ধ হয়েছে! এক তার বাবা, দুই তার ভাই মেঘ যার হাসি পুরোপুরি বাবার ফটোকপি! আর তিন এই আকাশ! সর্বদা শুনে এসেছে মেয়েদের হাসি দেখে ছেলেরা পাগল হয়ে যায়, কিন্তু বৃষ্টি ছেলের হাসি দেখে পাগল হয়েছে! এমন ঘটনা খুব কমই শোনা যায় আশেপাশে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here