উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৪৬

0
2649

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৪৬
(নূর নাফিসা)
.
.
৪৩.
মেঘের আরও দুদিন কাটলো শুধু ব্যস্ততার মাঝে। সিলেটই থেকেছে, নতুন বাড়ির জন্য কাজে ব্যস্ত ছিলো। এখন সে অনেকটা চাপমুক্ত! সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছে। উত্তরাঞ্চল হওয়ায় ঢাকার তুলনায় এখানে শীত অনেক বেশি। রোকসানা গরম পানি করে রেখেছে। মেঘ হাতমুখ ধুয়ে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নাফিসা খাবার নিয়ে এসে এই সময় এভাবে মেঘকে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা চমকে উঠলো! শরীর খারাপ নাকি, তা ভাবতে ভাবতে টেবিলে প্লেট রেখে মেঘের কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো। মেঘ কোনো সাড়া দিচ্ছে না! নাফিসা ভয় পেয়ে আরও জোরে ডাকতে লাগলো! মেঘ চোখ খুলে নাফিসার ভয়ার্ত চেহারা দেখে জোরে হেসে উঠলো। নাফিসার খুব রাগ হচ্ছে, এভাবে ভয় দেখানোর কোনো মানে হয়! মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সে উঠে যেতে চাইলে মেঘ একটানে তারউপর ফেলে দিলো। নাফিসা উঠার চেষ্টা করেও পারছে না! মেঘ বললো,
– খাওয়াদাওয়া যে একদম করো না এই তার প্রমাণ! আমি এক হাতে আটকে রেখেছি তাও ছোটার শক্তি নেই তোমার!
নাফিসা কোনো জবাব দিচ্ছে না! নাকমুখ ফুলিয়ে রেখে মেঘকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তার অযথা সেই চেষ্টা! মেঘকে ছাড়াতে পারছে না! মেঘ হেসে তাকে আরও চেপে ধরে বললো,
– মেডাম ফুলি তো দেখছি অনেক রেগে গেছে! আমি তো শুধু একটু মজা করছিলাম!
নাফিসা এবারও তার কথায় কোনো রিয়েক্ট করছে না! নিজের ব্যর্থ চেষ্টা করেই যাচ্ছে। মেঘ তাকে খাটে নামিয়ে সে আধশোয়া অবস্থায় থেকে বললো,
– মেঘা! এই, তুমি এতো সিরিয়াস কেন! আমি সত্যিই মজা করছিলাম একটু! এখানে এতো রাগ করার কি আছে!
– আপনি এমন মজা কি করে করতে পারেন আমার সাথে! আমি কতোটা ভয় পেয়ে গেছি জানেন আপনি!
কথা বলে নাফিসা কান্না করে দিলো। মেঘ তার গালে গাল ঘষে বললো,
– ওকে সরি, আর কখনো এমন মজা করবো না! হয়েছে তো! এই পাগলি, চুপ করো এবার! এই দেখি, বাচ্চার মা হয়ে গেছে এখনো কাদে! ছি ছি! বাবুরা, দেখো তোমাদের মা কিভাবে কাদছে! লজ্জা নেই একটুও!
নাফিসার কান্না থেমে গেলো। সে উঠতে চেষ্টা করলো কিন্তু মেঘ উঠতে দিলো না! কপালে আলতো স্পর্শ দিয়ে মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো নাফিসার দিকে। নাফিসা বললো,
– সরো।
– কেন?
– উঠবো।
– উঠতে দেবো না।
– আরে, খাবার নিয়ে আসবো আমি।
– তুমি পাশে থাকলে খাবার লাগবে না!
– আশ্চর্য! দরজা কিন্তু খোলা। যেকোনো সময় আম্মি এসে যেতে পারে।
– আসবে না আম্মি।
– কাজের চাপে থেকে মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি!
– তুমি কাছে থাকলে আবার মাথা ঠিক থাকার কথা নাকি!
মেঘের মাথা যে পুরো তালে হিল্লে হয়ে গেছে সেটা বুঝতে বাকি নেই নাফিসার! সে তার সর্বশক্তি দিয়ে মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে পড়লো। মেঘ চিত হয়ে পড়ে হাসতে লাগলো। নাফিসা খাবার নিয়ে এলে উঠে বসে খেতে লাগলো। মাছের কাটা বেছে দিতে গেলে নাফিসা নিষেধ করলো। মাছের গন্ধ একদমই সহ্য হয় না তার! অল্প খেয়েই উঠে যেতে চাইলো কিন্তু মেঘ উঠতে দিলো না। যতক্ষণ পর্যন্ত তার খাওয়া শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নাফিসাকে এখানেই বসে থাকতে হবে এটা মেঘের আদেশ। এবার খাওয়া শেষ হলেও উঠতে দিচ্ছে না মেঘ! বদহজম যাতে না হয় তাই এতোক্ষণ বিরতি দিয়ে নাফিসাকে জোর করে আরও কয়েক লোকমা খায়িয়ে পরে ছাড়লো মেঘ! তাকে নড়াচড়া করতে দিলো না, মেঘ নিজেই প্লেট রেখে এসেছে। পিঠের নিচে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে দুজন গল্প করছে। এর মাঝে নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– তখন এভাবে শুয়ে পড়লে কেন? শরীর খারাপ লাগছিলো?
– উহুম, কাজের চাপমুক্ত হয়ে হাফ ছাড়লাম!
– এতো চাপ নেওয়ার কি আছে! আর এতো তাড়াই বা কেন ছিলো! আস্তে আস্তে কাজ হতো, এতে সমস্যা কোথায় ছিলো!
– সমস্যা ছিলো না আবার! ঢাকা ক’দিনও থাকতে পারোনি, ছুটে এসেছো সিলেট। একবার ঢাকা আবার সিলেট, এভাবে আর কত দৌড়ান যায়! তাই তারাহুরো করেই কাজ সারতে হচ্ছে। যদিও এখানো সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়নি তবে, হয়ে যাবে শীগ্রই। ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?
– উহুম।
– ঝিমাচ্ছো?
– উহুম।
– আমার ঘুম পেয়েছে ভীষণ। চলো ঘুমাবো।
– আমার এখন ঘুম আসবে না। দিনে ঘুমিয়েছি অনেক্ষন।
– তাই নাকি! তাহলে এখন কি করবে?
– কিছুনা।
– দাড়াও আমি তোমাকে কাজ দেই।
– কি?
মেঘ নাফিসাকে ছাড়িয়ে বালিশে মাথা রেখে পা ছড়িয়ে শুয়ে বললো,
– আমাকে একটু আদর করে দাও তো বউ!
– ইশ! ঘুমাও চুপচাপ!
– আজকে আদর না দিলে সারারাতেও ঘুম আসবে না!
– আদর আবার কি!
– জানোনা আদর কি?
– না তো! কি সেটা? খায় না পড়ে?
– দাড়াও তাহলে জানাচ্ছি সেটা খায় না পড়ে!
মেঘ দুষ্টুমি হাসি দিয়ে চালাতে লাগলো তার দুষ্টুমি! তাকে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি নেই নাফিসার তাছাড়া ইচ্ছেও নেই কোনো!
সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে মেঘ আবার শুয়ে পড়েছে। নাফিসা কাছে এসে মেঘের বুকের উপর ডান হাত রেখে বললো,
“এই চলো না, আজ গায়ে কুয়াশা ও সোনালী কিরন মেখে প্রভাতী চাদর পড়ি দুজন!
চলো না, ঝলমলে সূর্যোদয় দেখে মুহুর্তটা উপভোগ করি আবার!
চলো না আবার সেই গিরিপথে, যেখানে তুমি আমি হেটেছিলাম আর ঝর্ণার পানির শব্দ ও পাখির কলোরব ঘিরে ধরেছিলো আমাদের!
কি গো? চলো না যাই, বেলা যে হয়ে আসছে! সোনালী রোদ যে পানিতে ভাসতে চলেছে, আর কতো রবে তুমি এমন আলসেমি করে!”
মেঘ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো তার মেঘার কথা! এ ঘরে প্রথম এসে রকমারি বই দেখেই বুঝতে পেরেছিলো নাফিসার মাঝে সাহিত্যের রস আছে! সে যে সাহিত্যে প্রেমী সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলো আর এখন তার প্রত্যক্ষ প্রমান পেয়ে যাচ্ছে। আলসেমি ছেড়ে এক ঠেলায় মেঘ উঠে পড়লো। নিজের শরীরে জ্যাকেট চাপিয়ে নিলো এবং আলমারি থেকে একটা চাদর নিয়ে নাফিসার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো,
” চলো, প্রভাতী চাদর পড়বো আজ তোমায় নিয়ে,
যা দেখে কুয়াশা ও সোনালী কিরন হিংসে করবে!
চলো, ঝলমলে সূর্যোদয় দেখবো একসাথে,
যা দেখে প্রকৃতিও মুগ্ধ হবে!
চলো, শুনবো ঝর্নার তান আর পাখির কন্ঠে গান!
আর মুহুর্ত উপভোগ করে স্বার্থক করে তুলবো প্রকৃতির দান!”
দুজনেই বেরিয়ে গেলো প্রভাতী চাদরে তাদের পবিত্র ভালোবাসাকে জড়িয়ে নিতে। নাফিসার বলা একে একে সব মুহুর্ত উপভোগ করে তারা বাড়িতে ফিরে এলো। শুধু শীতের সকাল হওয়ায় ঝর্ণার পানিতে গোসলটা করা হয়নি! নাফিসাকে বাসায় রেখে আবার মেঘ বাজারে চলে গেলো।
বাসায় ফিরলো শাকসবজি ও গরুর মাংস নিয়ে। নাফিসা হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিতে এলে মেঘ বললো,
– আজ মেঘার হাতের বিরিয়ানি ছাড়া মেঘ মুখে অন্ন তুলবে না!
নাফিসা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো আর মেঘ মুচকি হেসে ঘরে চলে গেলো! নাফিসা বিড়বিড় করতে করতে রান্না ঘরে এলো। “জঘন্য লোক একটা! সবকিছু জেনেও এখন উনার এমন আবদার করতে হবে! খেতে ইচ্ছে করছে যখন আম্মির হাতের বিরিয়ানি বললে কি হতো!”
নাফিসাকে বিড়বিড় করতে শুনে রোকসানা বললো,
– কি বলছিস একা একা?
– কিছু না। উঠো আমি রান্না করবো।
– না, তোকে করতে হবে না। আমিই করছি।
– তুমি করলে কাজ হবে না। আমাকেই করতে হবে। সরে এসো। বিরিয়ানি রান্না করবো।
– মেঘ বলেছে?
– হুম।
রোকসানা সরে এলো এবং নাফিসাকে হেল্প করলো। নাফিসা বেশি করে রান্নার আয়োজন করলো। আজ সারাদিন মেঘকে বিরিয়ানি খাওয়িয়ে তৃপ্তি মিটিয়ে ছাড়বে! দুদিন পর পর তার বিরিয়ানির আবদার রাখা এখন তার পক্ষে মোটেও সম্ভব না! কেননা, মাছ মাংসসহ তৈলাক্ত খাবারের গন্ধ তার একদম সহ্য হয় না! দেখলেই পেটে নাড়াচাড়া শুরু হয়ে যায় আর গড়গড় করে সব উপচে ফেলে!
নাফিসা নাকে ওড়না বেধে রান্না করতে লাগলো। মেঘের ইচ্ছেমতো তাদের সকালের নাস্তা বিরিয়ানি। নাফিসা মেঘকে খাবার দিয়ে বললো,
– নিন বিরিয়ানি! আজ সারাদিন বিরিয়ানি খায়িয়ে রাখবো আপনাকে!
মেঘ হেসে বললো,
– তবুও তৃপ্তি মিটবে না গো, বেগম সাহেবা !
– তৃপ্তি না মিটলে কিছু করার নেই। আগামী এক বছরে বিরিয়ানি রান্নায় আমি আর নেই!
– আচ্ছা, দেখা যাবে! কিন্তু এ কেমন মিশ্রভাষা তোমার! একবার আপনি একবার তুমি!
– ভালো লাগে এক এক সময় এক এক ভাবে সম্মোধন করতে। খেয়ে নিন।
– তুমি কোথায় যাচ্ছো?
– আছি বাড়িতেই। কেন, কিছু লাগবে?
– হ্যাঁ, তোমাকে লাগবে।
– খাওয়া শেষ হলে ডাকবেন!
– কেন, তুমি খাবে না?
– জ্বি না!
– বসো এখানে।
– অনেক কষ্টে রান্না শেষ করেছি, প্লিজ এখন খেতে বলবে না!
মেঘ হেসে বললো,
– তাহলে খায়িয়ে দাও!
মেঘের এমন দুষ্টুমি দেখে নাফিসা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। মেঘ হাত বাড়িয়ে নাফিসাকে কাছে এনে বসালো। হাত ধুয়ে প্লেট নিয়ে একপাশে ইচ্ছে মতো লেবু চিপে নিলো বিরিয়ানিতে। নাফিসার মুখের সামনে এক লোকমা তুলে ধরলো। নাফিসা মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করলো সে খাবে না। মেঘ তার কথা না শুনে বললো,
– হা করো।
নাফিসা বাধ্য হয়ে খাবার মুখে নিলো। মেঘ আবার বললো,
– খাবার বেশিক্ষণ মুখে রাখবে না, তারাতাড়ি গিলে ফেলার চেষ্টা করো। বমি হয় বলে কি, না খেয়ে থাকবে! এভাবে নিজেরসহ বাচ্চার ক্ষতি হবে। একটু পরপর খাওয়ার চেষ্টা করবে। বমির ভয়ে বসে থেকো না!
নাফিসাকে কিছু খাবার খায়িয়ে দিয়ে মেঘ পেট পুড়ে খেলো। দুপুরেও তাকে বিরিয়ানিই খেতে দিলো নাফিসা। তবে মেঘ একা খায়নি, নাফিসাকেও খায়িয়েছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করেই মেঘ নিজ হাতে নাফিসার কাপড়চোপড়সহ নিজের কাপড়চোপড় ব্যাগে নিতে শুরু করলো! নাফিসা দেখে বললো,
– কাপড়চোপড় ব্যাগে রাখছো কেন?
– চলে যাবো, রেডি হও।
– চলে যাবো মানে! কোথায় যাবো?
– কোথায় আর যাবে! যেখানে নিয়ে যাবো সেখানেই যাবে।
– মেঘ, বাবা-মা ক’দিন পর সিলেট আসবে তাহলে আমরা এখন কেন যাবো!
– এতো কথা বলো কেন! রেডি হতে বলেছি, চুপচাপ রেডি হও!
মেঘ ধমক দেওয়ায় নাফিসা মুখ মলিন করে ফেললো! মেঘের হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারছে না! সে বেরিয়ে আম্মির কাছে চলে গেলো। আম্মিকে গিয়ে মেঘের আচরণের কথা বলতেই আম্মি বললো মেঘের কথামতো চলতে! এ কেমন উল্টো বিচার! মেঘ কেন এমন করলো অন্তত সেটা তো জিজ্ঞেস করতে পারতো আম্মি! মেঘ আবার ডাকতেই নাফিসা রুমে এসে তৈরি হতে লাগলো। সকল কর্মেই তার জেদ স্পষ্ট! দুদিন হলো এসেছে, এখনই যাওয়ার জন্য এমন করছে কেন মেঘ! আর ক’টাদিন থাকলে কি হতো এখানে! মন খারাপ করে তৈরি হয়ে গেলো নাফিসা। মেঘ নিজে তৈরি হয়ে আম্মির কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো নাফিসাকে নিয়ে। নাফিসা আম্মিকে ধরে কান্না করছিলো। আম্মি সাবধানে থাকার জন্য বলে দিলেন। বের হওয়ার আগে মেঘ খরগোশ ছানাদের সাথে সাক্ষাৎ করে নিলো। ছানারা এখন আর সেই ছোট্ট ছানা নেই! তারা অনেকটা বড় হয়ে গেছে। তাদের খরগোশই বলা চলে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here