উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৪৮

0
2540

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৪৮
(নূর নাফিসা)
.
.
৪৫.
তারা রিসোর্টের বাইরে এসে দেখলো খুব সুন্দর পাকা রাস্তা। পরিচ্ছন্ন জায়গা, আশেপাশে শুধু সবুজের সমারোহ! দার্জিলিং রিসোর্টের চারিপাশ দেখে মনে হচ্ছে এটা বাংলাদেশের দার্জিলিং শহর! যখন রিসোর্টের ভেতরে প্রবেশ করেছিলো তখন এতোকিছু খেয়াল করেনি। এখন সতেজ মনে দেখে নিলো চারিপাশ।
মেঘের হাত ধরে রাস্তা বরাবর হাটতে লাগলো নাফিসা। ঠান্ডা ঠান্ডা মৃদু বাতাস! দেহের উপরিভাগ স্পর্শ করতে না পারলেও মনের গহীন স্পর্শ করে ফেলেছে! কাছ থেকে কুয়াশা বুঝাই যাচ্ছে না কিন্তু দূরদৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে ঢাকা!
মেঘের দেশে মেঘ তার মেঘার হাত ধরে হাটছে। এটা শুনতে সাধারণ মনে হলেও এই মুহূর্তে তার মনের অনুভূতিটা খুব গভীর! নাফিসাকে সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে জানাতে জানাতে আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করছে মেঘ।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭২০ ফুট উঁচু রুইলুই পাড়া এবং ১৮০০ ফুট উঁচু কংলাক পাড়া নিয়ে গড়ে উঠেছে সাজেক।
তারা আঁকাবাঁকা গিরিপথ বেয়ে উঠে এসেছে পাহাড় চূড়ায়! মেঘের কথামতো মিলিয়ে নিচ্ছে নাফিসা। সত্যিই সাজেকের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠেছে প্রকৃতির অপরূপ সাজ।
এই চূড়ার চারপাশে ঘন সবুজ অরণ্যের ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। সেই সারি সারি পাহাড়ের ওপর ঘন কুয়াশার মতো উড়ছে ধূসর এবং সাদা রঙের মেঘ। আর সেই মেঘের গা ছুঁয়ে আসা বাতাস শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে।
আকাশ ছোঁয়া আর গিরিখাদে নামার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সর্পিল পাহাড়ি সড়ক বেয়ে সাজেকে পৌঁছাতে যে রুদ্ধশ্বাস দশা হয়েছে তাদের, তা নিমিষে উবে দিয়েছে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
যতদূর দুচোখ যায় শুধু সারি সারি পাহাড় আর পাহাড়। কবির কল্পনা ও শিল্পীর ক্যানভাসকে হারমানিয়ে উচু নিচু পাহাড়ী টিলাগুলো চলে গেছে আকাশের দিগন্তে। আর সকালের সোনারোদ আসার আগে সবুজ পাহাড়ের উপর কে যেন ছিটিয়ে গেছে এক চিলতে মেঘের ফালি।
বাংলাদেশে এতো মনোরম জায়গা আছে সেটা আজ স্বচক্ষে প্রথম দেখলো নাফিসা! সিলেটের জায়গাগুলো যে অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর সেটা জানা ছিলো কিন্তু সাজেক ভ্যালিতে তার চেয়েও বেশি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আজ প্রত্যক্ষ দেখা!
হঠাৎই মেঘ তার পেছনে দাড়িয়ে তাকে ডানদিকে ঘুরিয়ে দাড় করালো। নাফিসা সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো! বাতাসের তালে থোকা থোকা মেঘের এক অংশ ভেসে আসছে তাদের দিকে ভাবতে আনন্দ হচ্ছে আবার ভয়ও লাগছে খুব! মেঘ তার দুহাত নাফিসার পেটের উপর রেখে জড়িয়ে ধরে আছে। যার ফলে নাফিসা তার মানব মেঘের কাছে লুকিয়েও ভয়টা জয় করার সুযোগ পাচ্ছে না! মেঘ কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– মেঘা, বি ইজি! কিছু হবে না! শুধু উপভোগ করো মুহূর্তটা! আমি আছি তো!
মেঘের দেওয়া সাহসেও কাজ হচ্ছে না! মনের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে শুধু! সাদা তুলোর মতো মেঘগুলো একেবারে নিকটে আসতেই নাফিসা মেঘের হাত খামচে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। সাথে সাথেই অনুভব করতে পারলো অতি শীতল স্পর্শ! নাফিসা চোখ খুলে তাকালো। সাদা রঙের মেঘের ফালি শীতল স্পর্শ দিয়ে তাদের ভেদ করে যাচ্ছে। পেছনে তার মানব মেঘ সামনে আছে গগনতলে ভেসে বেড়ানো প্রকৃতির দান করা মেঘ! এতো সুখ, এতো গভীর অনুভূতি এ স্পর্শে যা একেবারে মন গহীন শীতল করে গেছে! নাফিসা পেছনে ফিরে দেখলো তুলোর মতো মেঘগুলো তাদের অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে নিজস্ব ধারাবাহিকতার নিয়ম মেনে। এবার তো ইচ্ছে করছে আরেকবার ডেকে আনতে! কখন তার চোখে অশ্রু এসেছে টেরই পায়নি! দৃষ্টি সরিয়ে ছলছল চোখে মানব মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে নাফিসা! মুখে লেগে আছে স্বর্গীয় সুখ! এতো সুখ যে তার ভাগ্যে ছিলো কভু কল্পনা করেনি সে! এ মানুষটা তার জীবনে এসে পুরো পাল্টে দিয়েছে জীবন!
মেঘ সুখ লেগে থাকা উজ্জ্বল মুখখানা ধরে কপালে কোমল স্পর্শ দিতেই নাফিসা পরম আবেশে জড়িয়ে ধরলো মেঘকে! আর স্পষ্ট সুরে উচ্চারন করলো,
“ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি মেঘ! ভীষণ ভালোবাসি তোমায়! এতো সুখে রাখছো কেন আমাকে? আমি কি এতো সুখের যোগ্য?”
মেঘ জবাব দিলো,
– ভাগ্য তো আমরা তৈরি করি না মেঘা! সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাদের ভাগ্যে লিখে রেখেছেন সুখ! এখন শুধু সেটা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রচেষ্টা করতে হবে আমাদের।
– সবসময় তোমার পাশে একটু ঠাই দিও মেঘ। আমি কখনো তোমার অবাধ্য হবো না।
মেঘ গানের সুরে বললো,
“এ জীবন তোমাকে দিলাম বন্ধু, তুমি শুধু ভালোবাসা দিও। বন্ধু, তুমি শুধু ভালোবাসা দিও!”
নাফিসা একহাতে মেঘের জ্যাকেটের চেইন খুলে বুকের বামপাশে মাথা রাখলো। চোখ বন্ধ করে কান পেতে মেঘের হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো! মাতাল সুরের তান তুলে যাচ্ছে স্পন্দনগুলো। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হতেই মেঘ বললো,
– আরে! তুমি কি ঘুমিয়ে যাচ্ছো এখানে!
মেঘের কথা শুনে নাফিসা কিছুটা রেগে গেলো! সবসময়ই দুষ্টুমি করতে হবে তার! এমন উপভোগ্য মুহুর্তে কি এসব হুটহাট ফাজলামো না করলে তার চলে না! চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ এনে তাকে ছেড়ে দিয়ে জ্যাকেটের চেইন লাগাতে লাগলো। মেঘ বুঝতে পেরে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
– রাগ করছো কেন গো! জায়গাটা তো আর আমার বাপের না! ওই দেখো, এখানে আরও লোক উঠে আসছে। তাদের সামনে আমাকে এভাবে লজ্জা দিবে! আমারও তো একটু একটু লজ্জা আছে!
নাফিসা তাকিয়ে দেখলো সত্যিই কয়েকজন উঠে আসছে গিরিপথ বেয়ে! এবার তার নিজেরই খুব লজ্জা লাগছে! তাদের মাথার উপর দিয়ে আরও মেঘ ভেসে যাচ্ছে কিন্তু সেটা তাদের নাগালের বাইরে! আরও কিছুক্ষণ পাহাড় চূড়ায় কাটিয়ে তারা নেমে এলো। কাশবন রেস্তোরায় গিয়ে সকালের নাস্তা সেড়ে নিলো। সারাদিন সাজেকের আশপাশ ঘুরে বেড়ালো। দুপুরে রিসোর্টে এসে বিশ্রাম নিয়েছে। বিকেলে আবার বেরিয়েছে। কংলাক পাড়ায় কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে সন্ধ্যায় রিসোর্টে ফিরে এলো। আবহাওয়া প্রচুর ঠান্ডা বিধায় সন্ধ্যার পর আর বাইরে হাটাহাটি করলো না। রিসোর্টেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো। সন্ধ্যার পরপরই বৃষ্টি কল করলো। মেঘ বাথরুমে ছিলো তাই রিসিভ করেছে নাফিসা। কথায় কথায় জানিয়ে দিলো তারা সাজেকে এসেছে! বৃষ্টি আরও উৎফুল্ল হয়ে তাদের হানিমুন নিয়ে মেতে গেছে! কখন কি করেছে, কোথায় কোথায় ঘুরেছে সব তথ্য খুটিয়ে খুটিয়ে নিচ্ছে বৃষ্টি! মেঘ এসে থামালো বৃষ্টিকে। বৃষ্টি এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বললো জগন্নাথে তার চান্স হয়েছে। আর নাফিসার বদরুন্নেসা কলেজে চান্স হয়েছে।
বৃষ্টির সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই মেঘ জিজ্ঞেস করলো,
– এখান থেকে কি সোজা ঢাকায় ফিরবে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য?
নাফিসা চোখমুখ সংকোচিত করে বললো,
– শুধু শুধু ভর্তি হয়ে কি হবে? বাবুর জন্য কি এখন পড়া সম্ভব! না পারবো ক্লাস করতে আর না পারবো ভালো রেজাল্ট করতে! তার চেয়ে বরং বাদ দাও।
– মেঘা, তোমার সমস্যা কি আমি বুঝতে পারছি না! পড়াশোনার প্রতি এতো অবহেলা কেন তোমার! সবসময়ই কি এমনটা করতে! আর যদি এমনটা করেই থাকো তাহলে ইন্টারমিডিয়েট এ ভালো রেজাল্ট এলো কি করে! সবাই পড়াশোনা করার জন্য কত রকমের সুযোগ খুঁজে আর তুমি সুযোগ পেয়েও বলছো পড়বে না! তোমাকে না সেদিনও বুঝালাম, আজ যদি আমার কিছু হয়ে যায় প্রতিষ্ঠিত না হলে তুমি নিজের দায়িত্ব নিবে কিভাবে আর আমাদের বাচ্চার দায়িত্বই বা কিভাবে নিবে!
– মেঘ!
– মেঘা, আমি শুধুমাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। বুঝতে চেষ্টা করো। কার জীবনে কখন বিপদ এসে হানা দেয় আর কার সময় কখন ফুরিয়ে আসে কেউ বলতে পারবে না সেটা! তুমি নিজে প্রতিষ্ঠিত হলে ঝড়ের অনুকূলে ভেঙে না পড়ে নিজেই নিজের খুটি হয়ে দাড়াতে পারবে। অন্যের আশ্রয়ের প্রয়োজন পড়বে না। কারো কাছে হাত পাততে হবে না আর না সহ্য করতে হবে কোনো অবহেলা! আর আমি তো এখন তোমাকে চাকরি করতে বলছি না! শুধু নিজেকে উপযুক্ত ভাবে গড়ে তোলার উপায়গুলো আয়ত্তে রাখো। ভুলে গেছো, গনতন্ত্র কি বলেছেন! “তুমি আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেবো!” তাছাড়া দেখো, পরিবারের সব সদস্য উচ্চশিক্ষিত আর তুমি একা অল্প শিক্ষিত থাকলে সেখানে তোমার মূল্য কতটুকু থাকবে সেটা ভেবে দেখেছো!
– এ বছর তো সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে আগামী বছর চেষ্টা করবো।
– ভুল করবে তুমি। এ বছর নিজেকে পড়াশোনায় যতটা ব্যস্ত রাখতে পারবে আগামী বছর ততটাও পারবে না! কেননা, বেবি এলে আরও বেশি ব্যস্ততা থাকবে তোমার। তখন আরও বেশি অবহেলা করবে পড়াশোনা!
– মেঘ, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আমরা তো সিলেটের নতুন বাড়িতে উঠবো আর সেখানেই থাকবো। আর কলেজ তো ঢাকাতে! তাহলে ক্লাস করবো কিভাবে আর পরীক্ষাই দিবো কিভাবে!
মেঘ পড়ে গেলো টেনশনে! ঠিকই তো, তারা থাকবে সিলেট আর কলেজ ঢাকায়! অনার্স কমপ্লিট করতে লাগবে চার থেকে পাচ বছর! সমস্যাভেদে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। একবার ঢাকা আবার সিলেট এভাবে কি দৌড়াদৌড়ি করে পড়াশোনা সম্ভব! মেঘ বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো এবং দরজা খুলে বারান্দায় এলো। টেনশন করছে বুঝতে পেরে নাফিসাও নেমে এসে তার কাছে দাড়ালো। মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ তার চোখে তাকাতেই নাফিসা বললো,
– আমি বলি, আগামী বছর সুযোগ বুঝে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হবো। কোনো অসুবিধাই হবে না তখন! কথা দিচ্ছি, ইনশাআল্লাহ আমি পড়াশুনা চলমান রাখার চেষ্টা করবো।
মেঘের একটা হাত জড়িয়ে ধরে বললো,
– আর তুমি তো আছোই আমাকে গাইড দেওয়ার জন্য। হুম? কি গো, কিছু বলো!
– ওকে। চলো ডিনার করে আসি।
– তুমি আগে মাথা থেকে টেনশন ঝেড়ে ফেলো, পরে ডিনার।
– আচ্ছা, তাহলে রুমে চলো। বাবু ও বাবুর আম্মিকে একটু আদর করে মাথা থেকে টেনশন ঝেড়ে ফেলি!
– ওফ্ফ! কখন থেকে ক্ষুধা লেগেছে আমার, ডিনার করবে না!
মেঘ হেসে উঠলো এবং বললো,
– রুমে চলো, ক্ষুধা মিটিয়ে দিবো।
– ছি! অসভ্য প্রেমিক! আমি যাই, তুমি থাকো!
নাফিসা নিচে যাওয়ার জন্য হাটতে লাগলো আর মেঘ পেছন থেকে বললো,
” আরে দাড়াও, দরজাটা লক করার সময়তো দাও!”
নাফিসা মুচকি হেসে দাড়িয়ে রইলো। মেঘ দরজা লক করে একসাথে ডিনার করতে গেলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here