উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৫৬

0
3497

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৫৬
(নূর নাফিসা)
.
.
৫২.
বৃষ্টির বিয়ের পর বেশ কিছুদিন কাটিয়ে মেঘ নাফিসা সিলেট চলে এসেছে। মোহিনীও একবার এসেছে বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে আবার চলে গেছে। তারা এখন থেকে সিলেটই থাকবে। রায়হান চৌধুরীকেও বলেছিলো ঢাকার ব্যবসা ছেড়ে সিলেট চলে যেতে। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকার ব্যবসায়ে ব্যবস্থাপক রেখে সিলেট যাবেন। মাঝে মাঝে এসে এখানে ঘুরে যাবেন। আর সেদিকে রিসোর্টের দিকটা সামলে নিবে মেঘ।
নাফিসার প্রেগ্ন্যাসির ছয় মাস চলাকালে একদিন সকালে মেঘ ভেজা গায়ে কাপতে কাপতে বাড়িতে ফিরেছে। শীতকাল ফুরিয়ে গেলেও আবহাওয়া ঠান্ডা। নাফিসা তাকে দেখে বললো,
– এ কি অবস্থা তোমার! এতো সকালে ভেজা গায়ে!
– ঝর্ণার ধারে হাটতে গিয়েছিলাম। রূপে মুগ্ধ হয়ে আর থাকতে পারলাম না! একেবারে গোসল সেড়ে এলাম।
– যখন তখন এতো শখ জাগে কেন! তারাতাড়ি বাথরুমে যাও আমি জামাকাপড় নিয়ে আসছি।
– গোসল করবে নাকি এখন?
– পাগল হইনি আমি, যে এতো সকালে গোসল করবো!
মেঘ হেসে বললো,
– পাগল কেন হতে যাবে! পাগলের বউ তুমি। জামাকাপড় আমিই নিয়ে যাবো। চুপচাপ বসে থাকো এবং নড়াচড়া কম করো তুমি।
আজ বিকেলে নাফিসা খাটে বসে বই পড়ছিলো। মেঘ রুমে এসে হাত থেকে বই রেখে নাফিসাকে নামালো। নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
মেঘ তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে সেই দেয়ালের কাছে নিয়ে গেলো যেটার পর্দা সরাতে নিষেধ করেছিলো মেঘ। নাফিসা কিছু বুঝতে না পেরে মেঘের দিকে তাকাতেই মেঘ বললো,
– চোখ বন্ধ করো মেঘা।
– কেন?
– আমি বলেছি তাই।
নাফিসা চোখ বন্ধ করলো এবং মেঘ পর্দা সরিয়ে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– হ্যাপি বার্থডে সুইটহার্ট। নাউ ওপেন ইউর আইস।
নাফিসা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো গ্লাসের বিপরীতে সবুজ অরণ্যের মধ্যে লাল চালা সমৃদ্ধ এক ঘর! যেটা গাছের উপর অবস্থিত! অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে! চমকে উঠে নাফিসা বললো,
– মেঘ এটা কারা তৈরি করেছে?
– এটা কেমন কথা বললে! অন্যের জিনিস তোমাকে দেখিয়ে সারপ্রাইজ দিবো! এটা তোমার বার্থডে গিফট, এটা তোমার বাড়ি। এর কারণেই তোমাকে পর্দা সরাতে নিষেধ করেছি।
– আমি যেতে চাই সেখানে!
– অবশ্যই। চলো।
মেঘ নাফিসাকে সাথে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। ঘরের সামনে এসে নাফিসা চরম অবাক! তিনটা মোটা গাছ আর আলাদা খুটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মোটামুটি বড়সড় এক ঘর! সুন্দর করে কাঠের সিড়ি বাধানো। ঘরের সামনের দিকে আছে সরু রোয়াক। সিড়িতে বাশের রেলিংয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে লাল ফিতা বাধানো আর সেখানে ঝুলছে বার্থডে কার্ড। মেঘ কাচি এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ফিতা কাটো আর তোমার ঘরে পদচিহ্ন ফেলে আমার প্রচেষ্টা সার্থক করো বেগম সাহেবা। ধরো।
নাফিসা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। মেঘ কাচি ধরতে ইশারা করলে নাফিসা কাচি নিয়ে ফিতা কাটলো। মেঘের হাত ধরে একে একে সিড়ির ধাপ অতিক্রম করে পৌছে গেলো তার স্বপ্নের ঘরে। মেঝেতে স্টিলের পাটাতন বিছানো তার উপর কাঠের আস্তরণ। টিনের লাল চালা। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো কাচের চারি দেয়াল। চারিদিকে রোয়াক সমৃদ্ধে ঘেরা মাঝখানে একটা রুম। রুমের চারি দেয়ালে সজ্জিতভাবে বিভিন্ন ফ্রেমে বন্দী করে রাখা হয়েছে তাদের কিছু স্মৃতিচারন মুহূর্ত। সুর্যাস্ত, সূর্যোদয়, সাজেকের মেঘ ছোয়া, ঝর্ণার ধারে হাটা, চা বাগানে কাটানো সময়, গায়ে জ্যোৎস্না মাখানো ও সবুজ পাহাড়ের বুকে আঁচল ছড়িয়ে বসে থাকা। ছোট ছোট তারা আটকে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ দেয়াল জুড়ে আর ঘরের মাঝামাঝিতে ছোট একটা বিছানা। সবশেষে দৃষ্টি সরিয়ে মেঘের দিকে তাকাতেই দেখলো মেঘ মুচকি হেসে দাড়িয়ে আছে। প্রতুত্তরে সে ও মুচকি হেসে মেঘের কাছে এসে বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। মেঘ তাকে আঁকড়ে ধরে বললো,
– কেমন লাগলো সারপ্রাইজটা?
– এটা তো সারপ্রাইজ ছিলো না! এটা স্বপ্ন ছিলো। আমার স্বপ্নের রাজা তুমি। এটা আমাদের রাজ্য। আর আল্লাহর রহমতে সেখানে অতি শীঘ্রই আসতে চলেছে রাজকন্যা বা রাজপুত্র।
– ওগো মোর রাজরানী, বলো তো এখন। এক কাপ চা হলে কেমন হয় এই রোমাঞ্চকর বিকেলে?
– মন্দ হয় না রাজামশাই।
– আজ কিন্তু আমরা এখানে রাত কাটাবো। থাকো তুমি এখানে, আসছি আমি।
– কোথায় যাচ্ছো?
– চা নিয়ে আসি।
মেঘ চা নিয়ে এলে দুজন রোয়াকে বসে গল্প করতে করতে চায়ের মাধুর্য উপভোগ করলো। সন্ধ্যায় আম্মির কাছে বলে মেঘ খাবার ও কম্বল নিয়ে এলো তাদের স্বপ্নের বাড়িতে রাত কাটানোর জন্য। ঘুমানোর সময় বিছানায় এলে মেঘ নাফিসার হাতে একটা প্যাকেট দিলো।
– এটা কি?
– খুলে দেখো।
নাফিসা প্যাকেট খুলে দেখলো একটা কাচের বোয়াম এবং এর মধ্যে মিটিমিটি জ্বলছে জোনাকি পোকা! নাফিসা অবাক হয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
– এগুলো কোথায় পেলে!
– চা বাগানের পাশ থেকে দুজন ছেলেকে পারিশ্রমিক দিয়ে ধরিয়েছি।
– ছেড়ে দেই?
– এক মিনিট অপেক্ষা করো।
মেঘ সবগুলো পর্দা টেনে দিয়ে লাইট অফ করে দিলো। সাথে সাথে দেয়ালে আটকানো তারাগুলো জ্বলে উঠেছে! এগুলো তাহলে সেই জিনিস যেগুলো অন্ধকারে জ্বলে থাকে! মেঘ পাশে এসে বললো,
– এবার ছেড়ে দাও।
নাফিসা বোয়াম খুলে জোনাকি পোকাদের উন্মুক্ত করে দিলো। সাথে সাথে জোনাকি পোকা ঘরের এদিকসেদিক ছড়িয়ে পড়েছে! সারাঘরে আলোতে ঝিকিমিকি করছে! মেঘের বুকে মাথা রেখে নাফিসা কৃত্রিম তারকা ও জোনাকি পোকার খেলা দেখতে লাগলো। এ যে স্বর্গীয় সুখ এনে দিয়েছে মেঘ তার জীবনে! সে কি এতো সুখের প্রাপ্য ছিল! একফোঁটা দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে মেঘের বুকে!
– মেঘা?
– হুম?
– কাদছো কেন তুমি?
– বিনা স্বার্থে এতো সুখ দিয়ে যাচ্ছো কেন তুমি? বিনিময়ে আমার কাছ থেকে কি পেয়েছো?
– তোমার ভালোবাসা।
– ভালোবাসতেও তো পারিনা ঠিকমতো।
– পারো তো। এই যে এখনো ভালোবাসছো আমাকে।
নাফিসা বুকের উপর থেকে মাথা উঠিয়ে মেঘের মুখোমুখি বালিশে এলো। ঘরে ছড়িয়ে পড়া অল্প আলোতেই নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। মেঘ বললো,
– কি দেখো?
– বাচ্চাদের বাবাকে দেখি।
– কেন?
– যাতে বাচ্চাগুলো পুরোই তাদের বাবার মতো হয়।
– এটা কি সত্যি? যাকে বেশি দেখবে তার মতো হবে?
– শুনেছি হয় অনেকটা।
মেঘ তড়িঘড়ি করে ফোন বের করে নাফিসার ছবি এনে তার সামনে ধরে বললো,
– তাহলে এটা দেখো, যাতে বাচ্চারা তোমার মতো হয়।
– মেঘ!
– মেঘা আমি কিন্তু সিরিয়াস।
– আমিও সিরিয়াস! ফোন সরাও!
নাফিসা ফোন নিয়ে অন্যপাশে রেখে দিলো আর মেঘকে দেখতে লাগলো কৃত্রিম তারকা ও জোনাকির আলোতে। মেঘও দেখছে তার মেঘাকে।
.
মোটামুটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আজ নাফিসার প্রসব ব্যাথা উঠেছে। মোহিনী ও রোকসানা বাসায়ই ছিলো। মেঘ একটু কাজে বেরিয়েছে আর রায়হান চৌধুরী ঢাকা। মোহিনী মেঘকে কল করে বললে মেঘ কাজ রেখেই গাড়ি নিয়ে চলে এলো এবং নাফিসাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো। নাফিসা এখন অপারেশন থিয়েটারে। সবাই খুব চিন্তিত! মেঘের খুব ভয় করছে। সব ভয়ার্ত মুহুর্তগুলো এখন তার চোখের সামনে ভাসছে। মোহিনী রায়হান চৌধুরী ও বৃষ্টিকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে নাফিসাকে হসপিটালে আনা হয়েছে। সবাই থিয়েটারের বাইরে বসে আল্লাহকে স্মরণ করছে। সুস্থসবল দেহ ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করছে।

কিছুক্ষণ পর অপারেশন শেষ করে হাসিমুখে ডাক্তার বেরিয়ে এলো। সুসংবাদ জানালো তাদের কন্যা সন্তান হয়েছে এবং মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছে। উপস্থিত সবার মুখেই ভুবনজয়ী হাসি। সবাই মহান আল্লাহ তায়ালার সুক্রিয়া জানালো মনে মনে। নাফিসাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হলে তারা মা ও বাচ্চাকে দেখতে পেল। দাদু নানু মহাখুশি তাদের নাতনীকে নিয়ে। নাফিসার জ্ঞান ফিরেনি এখনো। মেঘ তার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আলতো স্পর্শ দিলো। পরক্ষণে নাফিসার পাশে বসে তার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো।
মোহিনী বাচ্চাকে এনে মেঘের কোলে দিলো। মেঘ ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো তার কন্যার দিকে। যেন আকাশের চাঁদ নেমে এসে পুর্নিমা ছড়িয়েছে তার কোলে! আল্লাহর রহমতে মা-বাবার মিশ্রিত রুপে জন্ম নিয়েছে তাদের কন্যা! ভেসে আসছে মেঘের কানে সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার মধুমাখা ধ্বনি! আর এদিকে তার মা শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর নাফিসার জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলেই মেঘকে তার পাশে বসা দেখতে পেল। চোখ খুলে তাকাতে দেখে মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে জিজ্ঞেস করলো এখন কেমন লাগছে। নাফিসা চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো ভালো। বাচ্চা রোকসানার কাছে ছিলো। নাফিসার জ্ঞান ফিরতে দেখে তিনি বাচ্চাকে মেঘের কোলে দিয়ে নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে এককোণে চুমু দিয়ে গেলেন। মোহিনী রায়হান চৌধুরী ও বৃষ্টির কল রিসিভ করতে করতে ক্লান্ত! মেঘ বললো,
– মেঘা দেখো, আমাদের কোলে প্রথম রাজকন্যা এসেছে। আমি কত ভাগ্যবান ভাবতে পারছো তুমি! বাবুর দৈহিক গঠন তোমার আমার সংমিশ্রণ!
নাফিসার চোখের কোনা গড়িয়ে পানি পড়ছে। একবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার মেঘের দিকে তাকিয়ে সন্তানকে কোলে নিয়ে একজন বাবার অনুভূতি উপলব্ধি করছে ও ভুবন জয়ী আনন্দ দেখছে। আজ প্রথম মেঘকে একটা উপহার দিতে পেরেছে নাফিসা। সেই ভেবে মনে খুব শান্তি লাগছে।
নাফিসার জ্ঞান ফেরার খবর শুনে মোহিনী দ্রুত পায়ে কেবিনে এলো। নাফিসার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
– অবশেষে আমার সময় কাটানোর উপায় এনে দিলি আজ! কেমন লাগছে এখন, মা?
– ভালো, মা।
রোকসানা কেবিনে এলে মোহিনী বললো,
– আপা, এখন কিন্তু আরও বেশি ঝগড়া হবে বলে দিলাম! নাতনি কিন্তু আগে দাদু ডাকই শিখবে।
– আচ্ছা! আমিও প্রস্তুত। দেখা যাবে দাদু ডাক শেখে নাকি নানু!
সবার মুখেই মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। ডাক্তার এসে নাফিসাকে দেখে গেলো তাছাড়া নার্স একটু পর পর আসছে আর খেয়াল রাখছে মা ও বাচ্চার।
সন্ধ্যায় রায়হান চৌধুরী, বৃষ্টি ও আকাশ এসে হাজির। এক এক জন বাচ্চাকে নিয়ে মহাখুশি। বৃষ্টি, মেঘ আর তাদের বাবার তো সারাজীবনই কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া বেধে যায়। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। বাচ্চাকে নিয়ে সে কি হৈ-হুল্লোড়! তারা যে হসপিটাল আছে সেই খেয়ালই নেই তাদের! মোহিনী রেগে ধমকে তাদের থামিয়েছে। রাতে মেঘ ও রোকসানা থাকলো হসপিটালে। বাকিদের বাসায় পাঠায় দিয়েছে মেঘ।
সকালে ডাক্তার নাফিসার চেকাপ করছে আর মেঘ ও রোকসানা কেবিনের বাইরে বসে ছিলো। কারো ফোন আসতেই মেঘ হসপিটালের বাইরে গেলো। একটু পর আবার ফিরে এলো। মেঘ একা আসেনি। মেঘের সাথে এসেছে সৈকত মির্জা ও মারিশা সাথে আরেকটি ছেলে। রোকসানা সৈকত মির্জাকে দেখে চমকে উঠে দাড়ালো! এতো বছর পর তার সাথে দেখা যাকে জীবনে আর কখনো দেখতে চায়নি! যার কারনে সে সিলেটের এই গন্ডি থেকে কখনো বের হয়নি! আজ একদম তার সামনে দাড়িয়ে সে! রোকসানা আঁচলে মুখ ঢেকে অন্যদিকে ঘুরে দাড়িয়ে রইলো। এ কোন পরিস্থিতিতে পড়লো সে! চাইলেও এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারছে না। তার মেয়ে যে এখানে! সৈকত মির্জা এগিয়ে এসে তার কাছে দাড়ালো।
– রোকসানা! একবার ঘুরে দাড়াও। আমি জানি, অনেক বড় অপরাধ করেছি আমি। তোমাদের না জানিয়ে অনেক বড় অপরাধ করেছি। একবার শোনো আমার কথা!
রোকসানা বিপরীতমুখী হয়ে মুখ চেপে রেখেছে। এ যে তার জীবনের অপ্রত্যাশিত দিন! সৈকত মির্জা কোনো সুযোগ পেলো না রোকসানার কাছে, তবুও তিনি স্বচ্ছায় সুযোগ করে নিলেন। কেননা তাকে জানাতে হবে! তাই রোকসানা শুনতে রাজি না হলেও তিনি বলতে লাগলেন,
– বিশ্বাস করো, বাধ্য হয়েছি তোমাকে বিয়ে করতে। অনন্যার সাথে আমার সংসার থাকতেও আমি তোমাকে নিয়ে সংসার বেধেছিলাম। কারণ ছিলো তার পেছনে। অনন্যা প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম ছিলো। একাধিক সন্তানের আশায় বিয়ে করেছিলাম তোমাকে, মিথ্যে বলেছিলাম দিনের পর দিন। বিশেষ করে বংশের প্রদীপ হিসেবে ছেলে সন্তান প্রত্যাশিত ছিলাম। তোমার জীবন নষ্ট করতে চাইনি। ছেলে সন্তান জন্মের পর তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। যাতে বাবা মা সাদরে গ্রহণ করে তোমাকে। কিন্তু আমাদের ঘরে আবার আসে মেয়ে। আমার মেয়েও পছন্দ কিন্তু আমার মায়ের প্রত্যাশা ছিলো ছেলের। মা যদি তখন তোমাকে গ্রহণ না করে সেই ভয়ে নিয়ে যাইনি বাড়িতে। এক্সিডেন্টের কারণে তোমাদের কাছে যেতে পারিনি। সেদিন তুমি আমার বাসায় যাওয়ার পর অনন্যা আমাকে তোমার বর্ননা দিতেই বুঝতে পেরেছি তুমি গিয়েছিলে। অসুস্থ শরীর নিয়েই তোমাদের কাছে যাই কিন্তু তোমাদের পাই না! অনেক খুজেছি তোমাকে। বুঝতে পেরেছি তুমি জেনে অনেক কষ্ট পেয়েছো। পরবর্তীতে অনন্যাকে জানিয়ে দেই তোমাদের কথা। সে নিজে কষ্ট না পেয়ে তোমার কষ্টে সমবেদনা জানায় এবং নিজেও খুজতে শুরু করে। অনেক খুজ নিয়েছি কিন্তু পেলাম না আর। তার দু বছর পরই অনন্যা মারা যায়। আমার বড় মেয়েটাকে একাই লালন করি। প্রত্যেকটা মুহুর্ত তোমাদের মনে করতাম। কোথায় আছো কিভাবে আছো সেসব ভাবতাম। জীবন ফুরিয়ে আসার আগে যেন একবারের জন্য হলেও তোমাদের দেখা পাই আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনাই করেছি। পাপী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে। ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিয়েছে আমাকে। ফিরিয়ে যে নিতে পারবো না সেটা জেনেও এসেছি ক্ষমা চাইতে। রোকসানা একবার ফিরে তাকাও।
রোকসানা ওদিকে ঘুরেই দাড়িয়ে আছে। মুখে আঁচল চেপে রেখে কান্না করছে। সৈকত মির্জা নিজেই ওদিকে এসে তার সামনে দাড়ালো। হাত জোড়া এক করে বললো,
– একবার ক্ষমা করে দাও আমাকে। একবার ক্ষমা করো। না হলে যে মরেও শান্তি পাবো না! সবটা জেনে আমার বড় মেয়েও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এই পৃথিবীতে আমি আজ সবচেয়ে বড় অসহায়। অনেক বড় অন্যায় করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, আমার দুই মেয়েকে কষ্ট দিয়েছি। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে এখনো বাচিয়ে রেখেছেন। তোমরা ক্ষমা না করলে যে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবে না কখনো! এই অসহায়কে ভিক্ষা স্বরূপ ক্ষমা দান করো রোকসানা।
সৈকত মির্জা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে! রোকসানা আর উপেক্ষা করতে পারলো না। কেন জানি অভিমানটার চেয়ে লোকটার আকুতিটাই হৃদয় গহীনে হানা দিয়েছে! অভিমান ভুলে যায়নি তবে উপেক্ষাটা হার মেনেছে! এতো বছর মানুষটাকে ছাড়া কাটাতে পারলেও আজ সামনে দাড়াতে দেখে আর পালিয়ে যেতে পারলো না! এটাই হয়তো প্রকৃত ভালোবাসার ক্ষমতা! সেও চাপা কান্নার সাথে সৈকত মির্জার দু’হাত ধরে বললো,
– এ কি করছেন আপনি! আল্লাহর দোহাই, এসব করবেন না কখনো!
– ক্ষমা করো আগে, তা না হলে আরও বেশি কিছু হবে।
– ক্ষমা চাইছেন নাকি ধমকি দিচ্ছেন?
– না, ক্ষমা চাই।
– হাত নামিয়ে রাখুন।
– আগে বলো।
– বাচ্চাদের মতো জেদ করছেন কেন! ছেলেমেয়ে দাড়িয়ে আছে সামনে। লজ্জা নেই নাকি!
সৈকত মির্জা মাথা নাড়িয়ে না জবাব দিলো। কান্নার মাঝেও রোকসানার মুখের এক কোনে হাসি ফুটে উঠেছে। সে বললো,
– মেয়ের অভিমান ভাঙ্গাতে পারলেই ক্ষমা পাবেন। তার আগে না।
রোকসানার ইতিবাচক মনোভাব বুঝতে পেরে সৈকত মির্জা বললো,
– কোথায় আমার মেয়ে?
– হসপিটালে কেন এসেছেন?
– অহ, আমার মেয়ে আর নাতনিকেই তো দেখতে এসেছি! এই কেবিনে নাকি?
– হ্যাঁ।
মির্জা সাহেব চোখ মুছে বললো,
– এখন কি যাওয়া যাবে না ভেতরে?
– না। অপেক্ষা করুন।
রোকসানা নিজের চোখ মুছে দেখলো তারা দুজন বাদে বাকি তিনজনের মুখেও লেগে আছে মৃদু হাসি। মারিশার মুখে হাসির সাথে চোখে পানিও। রোকসানাকে তাকাতে দেখেই মারিশা বললো,
– প্রায় দশ বছর আগে নিজের মাকে হারিয়েছি। এখন কি নতুন করে আপনাকে মা ডাকার সুযোগ পাবো?
মারিশার মুখে অনেক মায়া কাজ করছে। রোকসানা ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
– স্কুল পড়ুয়া ড্রেসে দেখেছিলাম যে সেই ছোট্ট মেয়েটা না?
মারিশা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। রোকসানা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– আম্মি ডাক।
– আম্মি!
মারিশা এগিয়ে এসে রোকসানাকে জড়িয়ে ধরে নিশব্দে কান্না করতে লাগলো। রোকসানার চোখেও বইছে অশ্রুধারা। এটা যে সুখের অশ্রু তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এমন সময় আকাশ, বৃষ্টি ও তার মা বাবা এসে গেছে হসপিটাল। তারা নাস্তা করে মেঘ ও রোকসানার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। কিন্তু মারিশা আর রোকসানার এমন ভাব দেখে সবাই হতবাক! সবারই প্রশ্ন তারা কি পূর্বপরিচিত নাকি!
মোহিনী মেঘকে ইশারা করতেই মেঘ বললো,
– মা, আংকেল নাফিসার জন্মদাতা পিতা।
– মানে! নাফিসা যে বললো তার বাবা নেই!
– নেই মানে তাদের কাছে নেই। অভিমান নিয়ে তারা দূরে সরে গেছে।
রায়হান চৌধুরী বললো,
– বন্ধু, অবশেষে পেয়ে গেছো তাহলে! অনেক তো খুজেছিলে কিন্তু আজ কিভাবে সম্ভব হলো!
– সবই মেঘের জন্য। মারিশা জেনেছে মেঘের কাছে আর আমি জেনেছি মারিশার কাছে।
বৃষ্টি আকাশ ও মোহিনী কেউই বুঝতে পারছে না তাদের কথাবার্তা। এদিকে ডাক্তার বেরিয়ে এসেছে কেবিন থেকে। মোহিনী পরিষ্কার জানতে চাইলে মেঘ বললো,
– বিস্তারিত পরে জেনো। আংকেল, চলুন নাফিসার সাথে দেখা করতে পারবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here