উল্টোরথে-২,০৩,০৪
০২
পারভেজের বাসা একই রোডে, দীর্ঘদিন একই এলাকায় থাকায় দুই পরিবারের আলাপ আছে৷ তিথিকে পারভেজের ভাবী, ভাই বা মা কেউ পছন্দ করে নিয়ে গেলেন না। তবে পারভেজ খুব চেয়েছে বলে সবাই মনের বিরুদ্ধে রাজী হয়েছে।
পারভেজের মা আমিনা বেগম তার বড় ছেলে সোহেলের বউ ইশিতাকে বললেন, শোনো মা, যার সংসার সে পছন্দ করে আনছে, আমি তুমি কেউ থাকব না ওদের সাথে। খারাপ ব্যবহার করার দরকার নেই, আর উড়নচণ্ডী মেয়ের সাথে আলগা খাতিরেরও দরকার নেই।
ইশিতা বলল, মা, আপনি যে কি বলেন, দুই বাচ্চা নিয়ে আমি নিজেই নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পাই না। ওর পেছনে লাগব কখন!
বিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে হয়েছে। মসজিদে কলেমা পড়িয়ে বউ বাসায় নিয়ে এসেছে। এলাকার মানুষ গা টেপাটেপি করলেও আলোচনার সুযোগ পায় নি।
পারভেজ ঘরে ঢুকল বিকেলের দিকে। তিথি একটা শাড়ি পরে বসে আছে। তেমন গয়না গাটি কেনা হয় নি। পারভেজের মা বলেছেন আস্তে আস্তে কিনে দিবেন।
তিথি,
বলো।
খুব ঝামেলা গেল তোমার উপর দিয়ে!
নাহ, ঝামেলার কি আছে!
এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হলো, কোনো শপিংও হয় নি ভালো করে। আস্তে আস্তে সব কিনে দেব।
তোমার কি মনে হয়, জিনিসপত্র শাড়ি গয়নার উপর আমার খুব লোভ?
না তা বলছি না। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
তিথি উত্তর দিলো না। পারভেজকে তার ভালো লাগছেই না। কিন্তু এমন চিপায় পড়ে ছিল!
পারভেজকে ভালো লাগার কোনো কারণ নেই, খুব বেশি লম্বা না, কালো আর গোঁফ আছে, চোখের উপর একটা মোটা চশমাও আছে। লতুপুতু মেয়েরা টাকা দেখে এরকম জামাই পছন্দ করে, তিথি সেরকম না। একটা অপরাধ বোধও হচ্ছে।
তিথি শোনো, আমার বাসার কারো সাথে বিশেষ করে মা ভাবী কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না কখনো।
বাপরে, অর্ডার করছ প্রথম দিনই!
নাহ, বলে রাখলাম। কেউ যেন আমাকে বলতে না পারে, তোর বউ খারাপ!
তোমার বউ তো খারাপই, খারাপ মেয়েছেলে বিয়ে করলে কেন!
তিথি, তোমাকে আমি কোনো বাইন্ডিংস দিচ্ছি না, তুমি শুধু সবার সাথে মিষ্টি ব্যবহারটুকু কইরো।
আচ্ছা।
তোমাকে সুন্দর লাগছে। চেইন্জ করে নাও?
তুমি কি শুতে চাও আজই?
পারভেজ বিব্রত হয়ে বলল, সেরকম কিছু না। আর কথা সুন্দর করেও বলা যায়।
অসুন্দর কিছু সুন্দর করে বলার নেই। শুতে চাইলে বলো, আমি চেইঞ্জ করে আসছি।
নাহ, চাই না।
হুম ভালো। আমারও সময় প্রয়োজন। হুট করে একটা নতুন সম্পর্ক আমি এবসর্ভ করতে পারব না, এমনিই চাপে আছি!
নতুন!!
পারভেজ বলেই লজ্জা পেল, প্রেমিকের সাথে দুইদিন কক্সবাজার ছিল, তার কাছে এরকম কিছু নতুন হয় কি করে! সে তো জেনে শুনেই বিয়ে করেছে।
তোমার কি মনে হয় ওই হারা★মিটার সাথে আমি থেকেছি? আমাকে এত বলদ মনে হয়!
এসব কথা থাক তিথি, আমি কিছু জিজ্ঞেস করি নি।
হুম থাক, নিজেকে সতী সাধ্বী প্রমাণ করার আমারও কোনো দরকার নেই!
আচ্ছা তুমি রেস্ট নাও, আমি ড্রয়িংরুমে বসি।
তুমি তোমার রুমেই থাকো। আমার কোনোে সমস্যা নেই। আমি একটু ঘুমাব৷
পারভেজ বিছানায় বসল। তিথি নিজে কাপর বদলে এসে শুয়ে পড়ল, সাথে সাথে ঘুমিয়েও পড়ল।
চলবে
শানজানা আলম
উল্টোরথে-৩
দুদিন কেটে গেছে। তিথি ভালো আছে মনে হচ্ছে। কেউ ওকে বিরক্ত করে না। অবশ্য কথাও বলে না অপ্রয়োজনীয়। সকালে পারভেজ অফিসে চলে যায়। তিথি এই দুদিন ওঠে নি, ঘুম ভেঙে গেছে, তাও ওঠে নি। ফেরে রাত নয়টার পরে। তখন তিথি ফোন স্ক্রল করে। পারভেজ চলে যাওয়র পরে নয়টার দিকে কাজের বুয়া এসে ব্রেকফাস্ট করতে ডাকে। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। তিথি খাবার সময় ওর জা পাশে থাকে, কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে চলে যায়, সেটা আন্তরিকতা বিহীন।
দুপুরেও সেম অবস্থা। ভাসুরের লাঞ্চ দিতে হয়। ভাবী খাওয়ার সময় পায় না বাচ্চাদের খাইয়ে বসে একফাঁকে খেয়ে নেয়। শাশুড়ীর সুগার আছে, সোয়া একটার দিকে সে খায়। দুপুরে দুইটার পরে কাজের বুয়া আবার ডাকে, তিথি খেয়ে নেয়। মোটামুটি মনে হচ্ছে তিথি বেড়াতে এসেছে।
কোনো ঝামেলা নেই, এরকম।
তিথি অনার্স শেষ করে এমবিএ ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, এখন আর মনে হয় হবে না। মাস্টার্সে একদিনও কলেজে যায় নি। পরীক্ষার এখনো বেশ বাকি আছে। একটু খোঁজ খবর নেওয়া যেতে পারে।
এবাড়ি থেকে বের হতে কি কারো অনুমতি নিতে হবে?
তিথি কার কাছ থেকে অনুমতি নেবে!
পারভেজকে তাই রাতে বলল, আমার কিছু কাজকর্ম আছে বাইরে।
পারভেজ বলল, মাকে বলে যেও।
আর কোনো কথা হলো না, সপ্তাহখানেক পরে তিথি নাস্তা করার পরে শাশুড়ীর ঘরে গিয়ে নক করল।
তিথি, আসো ভেতরে আসো।
আন্টি আমি একটু বাইরে যাব।
পারভেজের মা বললেন, কোথায় যাবা? তোমাদের বাসায়?
জি না, আমার কলেজে। মনে মনে বলে ফেলল, তাতে আপনার কি দরকার!
আচ্ছা। পারভেজকে বলছ?
তিথি মনে মনে বলল, আমার তো ঠেকা পড়ছে, জনে জনে অনুমতি নিব!
মুখে বলল, বলছিলাম গত সপ্তাহে। আপনাকে বলে যেতে বলল।
আচ্ছা, তাড়াতাড়ি ফিরো।
কেন, কোনো কাজ আছে?
না কোনো কাজ নাই। বাইরে কাজ না থাকলে থাকার দরকার কি!
তিথির রাগ ধরে গেল। ভেবেছিল, সারাদিন বাইরে থাকবে। তাও এখনকার অবস্থা আগের চাইতে বেশ ভালো। ব্যাগে মনে হয় তিনশ টাকা আছে, এই টাকা দিয়ে খুব বেশি থাকা যাবে না বাইরে। যাই হোক, ঢাকা শহরে খালি ব্যাগে ফকির মিসকিনও থাকে না।
তিথি বের হতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলে দুই হাজার টাকা পেল। একটা কাগজে লেখা, তিথির জন্য।
তিথির মেজাজ আবারও খারাপ হলো, ও কি ফকির নাকি!
ওর জন্য টাকা রেখে গেছে, কিন্তু এখন ঝগড়া করতে ইচ্ছে করল না। তৈরি হয়ে রুম থেকেবের হলো, টাকাটা নিলো না সাথে।
পরে মনে হলো, জেদ করা ঠিক হবে না। কারো না কারো হেল্প তো তিথির লাগতোই, বাইরে গিয়ে হয়তো কারো কাছে ধারই চাইত।
পরে টাকাটা ব্যাগে ভরে বের হয়ে গেল।
চলবে
শানজানা আলম
উল্টোরথে-৪
কলেজের দিকে বের হয়ে তিথির একটু হালকা লাগল। এতগুলো দিন বাসায় দম বন্ধ অবস্থা। ডিকেনের সাথে পরিচয়টা বছর দুয়েকের বেশিই ছিল। তিথি দুই বছরে একবারো বুঝতে পারে নি, ওর সাথে আলাপ হওয়ার পরেই ডিকেন বিয়ে করেছে, বউ নিয়ে বিদেশে গিয়েছে, হানিমুনে।
এতটা কিভাবে পারে ছেলেরা! তিথির মত শক্ত, বেপরোয়া মেয়ের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে নরম মেয়েগুলো তো মরে যাওয়ার দশা!
ডিকেন ছিল রোজির ফেসবুক ফ্রেন্ড। ফেসবুক থেকে আলাপের পরে একদিন দেখা করতে চাইল রোজির সাথে৷ রোজি তিথি আর সপ্নাকে জোর করে সাথে নিয়ে গেল, ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে।
ডিকেন একাই এসেছিল, বেশ খানিকটা লম্বা, পোশাকে বেশ কেতাদুরস্ত। একটা সানগ্লাস পরা।তিথির দেখেই ভালো লেগেছিল তবে কাউকে এভাবে ভালো লাগতে পারে তিথি সেটা বোঝেই নি।
ডিকেন বেশ বুদ্ধিমান, তিথির মুগ্ধ দৃষ্টি তার চোখ এড়িয়ে যায় নি।
কি অবস্থা!
রোজিকে প্রশ্ন করলেও মিটিমিটি হাসছিল তিথির দিকে তাকিয়ে।
তিথি অন্যদিকে তাকালেও কয়েকবার ডিকেনের দিকে দেখেছে, আর প্রতিবারই দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে।
রোজি, তোমরা কি খাবে বলো?
তিথি কিছুই নিলো না। ওরা পাস্তা, কোল্ড ড্রিংক নিলো। ডিকেন উঠে গিয়ে তিথির জন্য একটা জুস নিয়ে এলো।
শেষে বের হওয়ার সময়, ডিকেন সবার সামনেই তিথিকে জিজ্ঞেস করল, আপনার ফেসবুক আইডিতে রিকোয়েস্ট পাঠালে আপনি কি মাইন্ড করবেন?
রোজি বলল, কেউই মাইন্ড করবে না। তার তিথি অন্যরকম মেয়ে।
অন্যরকম? মানে কি রকম?
এই প্রেম বিয়ে ডেট এগুলো নিয়ে ও খুব একটা আগ্রহী না।
পুরোটা সময় তিথি কোনো কথা বলে নি। কিন্তু তিথি ভীষণ অবাক হয়েছিল, যখন রাতেই ডিকেন ওকে ফোন করল। শুধু প্রথমবার ফোনেই তিথি ৪০ মিনিট কথা বলেছিল।
তিথি ডিকেনকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিল! আর কক্সবাজারে… থাক সেসব কথা মনে করতেও অস্বস্তি লাগছে। পারভেজকে কেন মিথ্যা বলল প্রথমদিন! তিথি তো এমন না! নিজেকে খুব সতী প্রমাণ করার কি দরকার ছিল! পারভেজকে তো ও ভালোবাসেনি। এখন অবধি বাসে নি। সারাক্ষণই মনে হচ্ছে বাড়ি ছাড়া থেকে এখনকার সময় অবধি সবটাই দুঃস্বপ্ন। এখনি ডিকেন আসবে, এসে ওকে আগের মতোই ভালোবাসি বলবে। বাকি সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে তখন।
চলবে
শানজানা আলম