উল্টো চালে উল্টো পথে,প্রথম পর্ব
#সানজিনা_সায়েদ_খান
“উল্টো পথে”
উল্টোদিকের ফ্ল্যাট থেকে ছুটির দিনে দুপুরে তুমুল হইচই চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসলে সোহেলী বাধ্য হলো সেদিকে নজর দিতে। এমনিতে এই ফ্ল্যাট থেকে প্রায়শঃই চিৎকার-কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা যায়। সেটা ওই ফ্ল্যাটের অল্পবয়সী বউটার কান্নার আওয়াজ আর সেই সাথে ওর স্বামীর চাপা গলার গর্জন। বউটার নাম সেলিনা। থাকে ওর স্বামী পারভেজ আর শাশুড়িকে নিয়ে। সেলিনার পড়ালেখা বেশি দূর নয়। বর্তমানে বয়স ২২-২৩ এর কাছাকাছি হলেও, বিয়ে হয়েছে আরও আগেই। ১৫-১৬ হতেই বাপ-মা বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। আর গ্রামের অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে করিয়ে এনেছে ওর শাশুড়ি যাতে করে মেয়ে হাতের মুঠোয় রাখা যায়, কোনোকিছুতে যাতে সহজে রা কাড়তে না পারে। এসব সোহেলী জেনেছে ওদের বউ এবং শাশুড়ি দু’জনের কাছে থেকেই, আলাদা আলাদা ভাবে আলাদা সময়ে, যে যখন ওর ফ্ল্যাটে এসেছে ঘুরতে, তখন। নিয়ম করেই মারধোর খায় সেলিনা ওর স্বামীর হাতে। মারের সময় আঘাতে কঁকিয়ে ওঠার আওয়াজ থেকে শুরু করে মার শেষ করে পারভেজ বেরিয়ে যাওয়ার পরে বহুক্ষণ পর্যন্ত চিকন সুরে কান্না শোনা যায়। সেই সাথে থাকে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির চৌদ্দ গুষ্টিকে শাপ-শাপান্ত। তবে আজকের শোরগোলটা নিঃসন্দেহে ভিন্ন। এবং সেটা দরজার ওপাশে ভেতরে নয়, বাইরে।
হাইরাইজ এই বিল্ডিংয়ের প্রতি তলায় ৪টি করে ফ্ল্যাট। সেলিনা আর সোহেলীরা ছাড়াও বিল্ডিংয়ের এই ষষ্ঠ ফ্লোরে আরেকটি ফ্ল্যাটে থাকে একটি তরুণ দম্পতি। নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের। দু’জনেই চাকরিজীবী। ছেলেটির বাবা-মা ওদের একতলা ওপরেই আরেকটা ফ্ল্যাটে থাকেন, সপ্তম ফ্লোরে। এই ফ্ল্যাটটি কিনে ছেলে-ছেলের বউয়ের সংসার পাতার জন্য দিয়েছেন। এই ৩ পরিবার ছাড়া আরেকটি ফ্ল্যাট বর্তমানে খালি ওদের ফ্লোরে। সোহেলী আর সেলিনাদের ফ্ল্যাট দু’টো মুখোমুখি। দুপুরে সবে খাবারের আয়োজন করে দুই মেয়ে আর স্বামী রাশেদকে নিয়ে খেতে বসেছিলো সোহেলী। তার মধ্যে এই তুলকালাম। খুলবে না খুলবে না করেও দরজা খুলে উঁকি দিতে বাধ্য হলো বিষয়টা দেখতে।
দরজাটা খুলে যা দেখলো তাইতে সোহেলীর চোখ কপালে উঠে গেলো। রাশেদের মুখ হাঁ। দুই মেয়ে, মিতালী আর পিয়ালীর দু’জোড়া চোখে অপার কৌতূহল। সেলিনাদের দরজার বাইরে মাটিতে পড়ে আছে পারভেজ, আধাশোয়া অবস্থায়। চোখমুখের অবস্থা সঙ্গীন, বিব্রতভাব আর আতঙ্ক ফুটে আছে সেখানে। ঠিক দরজায় দাঁড়ানো সেলিনা। গালে চড়ের দাগ। ঠোঁটের কোণে কেটে গেছে। মাথার চুল দেখে যে কেউ বুঝবে এইমাত্র চুলের মুঠি ধরে ভালমতো ঝাঁকুনি দিয়েছে কেউ। পরণের কামিজ কাঁধের কাছে ছেঁড়া। গায়ের ওড়না একপাশে লুটাচ্ছে। প্রচন্ড হিংস্রতা নিয়ে চেয়ে আছে মাটিতে পড়ে থাকা স্বামীর দিকে। ডান হাতে শক্ত করে ধরা বিছানা ঝাড়ার ঝাঁটা। জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার ফলে দ্রুত উঠছে নামছে বুক।
সেলিনার শাশুড়ি দাঁড়ানো দরজার কাছেই। বিস্ফারিত চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি। সেলিনার পেছনে ঘরের ভেতর ওর ৩ বছর বয়সী ছেলেটা মেঝেতে বসে হাতে খেলনা ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে যাচ্ছে একঘেয়ে ভাবে। নাকের পানি, চোখের পানিতে একাকার।
সোহেলীরা দরজা খুলে বুঝতে পারলো ওরাই দর্শক হিসেবে এই ফ্লোরের শেষ। অর্থাৎ, অন্য ফ্ল্যাটের ছেলে-মেয়ে দুটোও বেরিয়ে এসেছে আরও আগেই, হাতে ওদেরও ভাত, মানে খেতে বসেছিলো ওরাও। এমনকি ওপর তলা থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত নেমে এসেছেন ছেলেটার বাবা-মাও হইচই শুনে।
সোহেলীদের দরজা খোলার একটু পরেই সেলিনাদের ঘরের ভেতর কোথা থেকে যেন সেলিনার ননদ, হ্যাপী বেরিয়ে এলো ওর ৪/৫ বছর বয়সী ছেলেটার হাত ধরে। মাকে পাশ কাটিয়ে টুপ করে ফ্লোরে পড়ে থাকা ভাইকে ডিঙিয়ে খুব তাড়ার সাথে বললো, “আম্মা আমি আজকে যাই…”। সেলিনার সাথে নানা সময়ের গল্পের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সোহেলী জানে যে সেলিনাকে মার খাওয়ানোর পেছনে এই হ্যাপীর হাত থাকে অনেক সময়েই। আজকের ঘটনার আগামাথা কিছু এখন পর্যন্ত না বুঝলেও বিস্মিত সোহেলীর মনে সন্দেহ নাড়া দিয়ে গেলো যে এই ঘটনার সূত্রপাত হ্যাপীর মাধ্যমেই হয়েছে। হ্যাপীর মধ্যে এই মুহূর্তে ভাইকে মেঝে থেকে ওঠানোর বা সেলিনার সাথে ঝগড়া করার মতো বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না, চঞ্চল চোখে মুখে কেবল ভীষণ ব্যস্ততা। ওর যাওয়ার কথায় বরং ওর মা কেঁদে উঠলেন, “হ্যাপীরে… আমগোরে কিসের মইদ্যে রাইখা তুই কস তুই যাইতাসস গা!… তর ভাইয়ের বউয়ে আইজ তুই গ্যালে গা আমারে মাইরাই না ফালায় রে!…”।
উনার কান্না বা বিলাপ কোনটাকেই বিশেষ পাত্তা দিতে দেখা গেলো না হ্যাপীকে, সে লিফট আসতে দেরী দেখে সিঁড়ি দিয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন। কিন্তু পগার পার হওয়ার আগেই সেলিনা চেঁচালো, “যাইবিই তো! শ্বশুরের বেটি! বাপের বাড়িত আইয়া প্রত্যেক বেলায় একখান কইরা ভ্যাজাল পাকাইস তুই! এতোদিন কিছু কই নাই… আর যদি আইসস এই বাড়িত, তর ঠ্যাং ভাইঙ্গা হাতে ধরায় দিমু আমি কইলাম… ফকিন্নির ফকিন্নি… দুই দিন পর পর আইসা ‘ভাইজান আমার এইডা লাগবো, ভাইজান আমার ওইডা লাগবো! আম্মা আপনের জামাই এইডা সখ করসে…’ আর সেইগুলা জোগান দেওয়ার বেলায় আমি আর আমার বাপ-ভাই না? আইস আরেক বার এই বাড়িত… পা দিয়া দেখিস!… প্রতিবার আইসা ভাইয়ের কানে ঢং কইরা আমার নামে বিষ ঢালবি আর আমারে মাইর খাওয়াইবি, না? আইজ পর্যন্ত এমন একবার নাই যে তুই বাড়িত আইসস আর আমি মাইর খাই নাই… ডাইনি কুনহানকার!…”।
ওর চেঁচানোর মধ্যেই ছেলের কনুই ধরে টানতে টানতে হ্যাপী উধাও হলো মায়ের প্রচুর ডাকাডাকি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। ও অদৃশ্য হওয়ার পরে সেলিনা নজর দিলো চিৎকাররত শাশুড়ির দিকে, এক ধমকে থামালো উনাকে, “চুপ! এক্কেরে চুপ! রোজ রোজ পোলারে দিয়া আমারে মাইর খাওয়ানো আইজকা আমি বাইর করমু তুমার! মাইয়া আসলে ত্যাল বাড়ে না? এখন কই তুমার মাইয়া? ভাগসে না ফালায়? ঝাঁটা খাওনের লাইগা থামসে? রইসে তুমার লগে? তোমাগো ত্যাল আমি আইজ ছুডামু!…”
এই সময় গর্জন করে উঠলো পারভেজ, “শালী তর এত্তোবড় সাহস তুই আমার মা’র মুখে মুখে কথা কস!…”, কিন্তু পারভেজের মুখের কথা মাটিতে পড়তে পারে নাই, ওর গলার আওয়াজ ঢেকে গেলো তীক্ষ্ম ‘ফট্টাস… ফট্টাস’ আওয়াজে! গর্জন রূপ নিলো চিঁচিঁ তে। উঠে দাঁড়াচ্ছিলো পারভেজ, ধপাস করে আবার ফ্লোরে বসে পড়লো বউয়ের হাতে মজবুত ঝাঁটার দ্রুতগতির কয়েকটা বাড়ি খেয়ে। গায়ের জোরে মারছে সেলিনা। সোহেলীর মনে প্রশ্ন জাগলো কোনটার উপর আসলে অত্যাচারটা বেশি হচ্ছে, ঝাঁটা, নাকি পারভেজের পেছন দিক। পরমুহূর্তে এই প্রশ্নকেই প্রশ্ন করতে বাধ্য হলো সোহেলী, ‘আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো! এইগুলা আমি কি ভাবছি!’ নিজের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো নিজের মেয়েদের চুড়ান্ত ফাজিলের মতো খিক খিক হাসির আওয়াজে। চোখ গরম করে তাকানোর চেষ্টা করলো সোহেলী, কিন্তু আজকে তাতেও কোনও লাভ হলো না। হওয়ার কথাও না! স্বামীকে ঝাঁটাপেটা করছে স্ত্রী, এ দৃশ্য তো দৈনন্দিন জীবন তো দূরের কথা, কমেডি ফিল্মেও খুব একটা দেখা যায় না! জীবনে একবারের বেশি দুইবার এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনটাই আর উপস্থিত কারও হবে কিনা সেটা সন্দেহের বিষয়।
সেলিনার দিকে এবার ভালো করে তাকালো সোহেলী। সেলিনা এমনিতে মুখরা মেয়ে। স্বামী-শাশুড়ির অত্যাচার সহ্যও করে, আবার মুখও চলে ওর একই সাথে। প্রতিবেশী কেউ কেউ সে কারণে বলে যে ওর মুখের কারণেই মার খায় ও রোজ। সোহেলী বোঝে সেলিনার অসহায়ত্বটা। চঞ্চল একটা মেয়ে, অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে এসে পড়েছে কুটিল আর ক্রূর সংসারের জটিলতার ভেতর। খোঁটা শোনে, হেয় করে বলা কথা কিছু হয়তো গায়ে মাখে, কিছু মাখে না, গাল খায়, মার খায়, যখন সহ্যের বাইরে চলে যায় তখন সেও মুখ খোলে, কথার পিঠে কথার দু’টো জবাব দিয়ে দেয়, ফলাফল স্বরূপ গায়ের জোরে তখন ওর মুখ খোলার শাস্তি চলে। কাঁদে, আবার উঠে সংসারের কাজে হাত দেয়, আবার কোনও ভুল ত্রূটির জন্য অথবা অযথাই কথা শোনে, আবার চলে সেই একই চক্র। কিন্তু যে পরিবেশে সেলিনার জন্ম, যে ধরণের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে যেভাবে ওর বেড়ে ওঠা, তাইতে এটাকেই ও ওর জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম ধরে নিয়েছে। স্বামী মারবে, স্বামীর গায়ে হাত তোলার অধিকার আছে। বিবাহিতার যে সামাজিক পরিচয়, ওর সন্তানের বাবার পিতৃত্বের যে পরিচয়, এবং ওর ভাত-কাপড় তুলে দেয়ার যে দায়িত্বের পালন, তার বিনিময়ে এই অসম্মান, এই অত্যাচারটা মেনে নেয়াকে ও নিয়তি ধরে নিয়েছে। ও যখন চেঁচামেচি করে গাল শুনে বা মার খেয়ে, সেখানে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ যতটা না থাকে, সোহেলী জানে, তার চাইতে বেশি থাকে বেঁচে থাকার জন্য একধরণের খাবি খাওয়া আকুতি। যেন জানান দেয়ার প্রচেষ্টা যে সে রক্তে-মাংসে গড়া একটা প্রাণী, এবং জীবিত। সে ব্যথা পায়, সে আঘাত পায়, তার সহ্যের সীমা আছে।
আজকে সেলিনার চোখের দিকে তাকিয়ে সোহেলীর বুঝতে দেরী হলো না যে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে মেয়েটার। মারের ঝড় যে ওর উপর দিয়ে প্রচন্ড গেছে সেটা তো কাপড়চোপড় আর চেহারার অবস্থাই বলে দিচ্ছে। চাপা তর্জন-গর্জন আগে থেকেই শুনছিলো ওদের বাসা থেকে মনে পড়লো সোহেলীর। সেটা আরও ঘন্টা দুয়েক আগের কথা। মায়ায় মনটা ভিজে উঠলো সোহেলীর। আহা রে! না জানি কতক্ষণ ধরে সহ্য করছে মেয়েটা! পারভেজ ওকে অহরহ বেল্ট দিয়েও পেটায়, সেটাও জানে সোহেলী। সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়, গরম খুন্তি চেপে ধরে গায়ে পিঠে। মা আর বোনের উস্কানিতে না জানি আজ কতোটা গালাগালি আর মার চলেছে ওর উপর দিয়ে! শেষ পর্যন্ত বোধহয় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সেলিনা। স্ত্রী সত্তা ছাপিয়ে একেবারে মৌলিক প্রাণীসত্তা জেগে উঠেছে আঘাত থেকে বাঁচার তাগিদে। হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে পুরোপুরি। কার সামনে কি বলছে, কাকে বলছে, কার গায়ে হাত তুলছে, হুঁশ নেই কোনও। ওর চোখের দৃষ্টি সুস্থ না, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সোহেলী। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের বিবেক-বিবেচনা অনুপস্থিত ওর চোখে। কিছুক্ষণ আগের মার খাওয়ার আতঙ্কটা রূপ নিয়েছে তীব্র আক্রোশে। কথায় বলে দেয়ালে পিঠ ঠেকলে ইঁদুরও ঘুরে দাঁড়ায়, আর সেলিনা তো মানুষ।
অন্যদিকে পারভেজের অবস্থা শোচনীয়। একে তো এরকম পরিস্থিতিতে সে পড়তে পারে সেটা দূরের কল্পনাতেও কোনদিন ভাবে নাই ও, তার উপর বউয়ের এই উগ্রমূর্তি ঠান্ডা করতে ওর এখন আসলে কি করা উচিৎ সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। মার খেয়ে পৌরুষে যে আঘাত লেগেছে, সেই অবস্থায় এই এতোগুলো মানুষের সামনে দিশেহারা দশা ওর। আরও মার খাবে, না বউকে ধরে আরও কতগুলো লাগাবে, আবার এতো মানুষের সামনে সেটা উচিৎ হবে কিনা, অন্যদিকে এই ক্ষ্যাপা মেয়েমানুষের সাথে সে পেরে উঠবে কিনা এই মুহূর্তে, কিছুই ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ও। উপস্থিত অনেকেই তাকে বহুবার বউকে মারধোর করতে না করেছেন বিভিন্ন সময়ে। সব থেকে বড় কথা, বউকে ভয় পাচ্ছে ও, কি থেকে যে আবার কি করে বসে এই মেয়ে, সেটাই এখন আতঙ্কের বিষয়। আর এই অনুভূতির সাথে পরিচয় নেই পারভেজের। আক্ষরিক অর্থে তব্দা খেয়ে মেঝেতে বসে আছে সে।
এর মধ্যে দর্শক বেড়েছে ঘটনাস্থলে। নিচতলার কয়েকজন বাসিন্দা উঠে এসেছেন দেখতে কি ঘটছে, কেউ সোহেলীদের মতো খাওয়া ফেলে, কেউ ভাতঘুম ফেলে। পারভেজের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে পাড়ার ডিশের লাইনের দোকানের দুই ছোকরা, বিল চাইতে। ছুটির দিনে বাড়িতে লোকে থাকে বলে আজকেই ওরা ভালো মনে করে এসেছে এই বিল্ডিংয়ের কাস্টোমারদের কাছে পাওনা টাকা চাইতে, তাও দুপুর বেলা। কালোকুলো শুকনো মিষ্টি চেহারার দুই ভাইয়ের গালভর্তি দাঁত গুণতে পারবে উপস্থিত লোকজন চাইলে এই মুহূর্তে। মজা যে পেয়েছে এই ঘটনাতে, সেটা উদ্ভাসিত চোখেমুখে। বিল পাক আর না পাক, এখান থেকে আপাতত নড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ওদের নেই সেটা যে কেউ বলে দিতে পারবে।
সেলিনার কি এই সমস্ত দিকে এক তিল পরিমাণ মনোযোগ আছে? ঘোরের মধ্যে গলা সপ্তমে তুলে ও বকেই যাচ্ছে প্রলাপ বকার মতো। তবে যা বলছে তাতে দর্শকদের নিজের নিজের কাজ ফেলে ছুটে আসা সার্থক হচ্ছে বটে। গুজব-রসনার তৃপ্তি হচ্ছে পূর্ণ। চিৎকার করতে করতে গলা ভেঙে গেছে সেলিনার, তাও বলে যাচ্ছে, “আমার বাপে গলায় রক্ত উঠায় আমার বিয়ার সুময় ফার্নিচার দিসে হেরে! খাট দিসে! ডাইনিং টেবিল দিসে আলমারি দিসে… টিভি দিসে! নগদ টেকা দিসে! হের বইনের বিয়ার সুময় আবার বইনেরে টিভি দেওয়ার সুময় আমার বাপের ধারেই খুঁজছে! খাডাইশ ব্যাডা! ফকিন্নির পুত! কয়বার তর ব্যবসার টেকা খুঁজছস আমার বাপের কাছে? কইত্থে দিবো আমার বাপে? আমার বাপের জমিদারি আছে? না আমার ভাইয়ের টেকার মেশিন আছে? আইজকা হের বইনে আইয়া কয় হের জামাইয়ের টেকা লাগবো… ব্যবসা করবো! আবার টেকা খুঁজস আমার বাপের থেইকা! হ্যাঁ? আমার বাপে টেকা দিসে কি আমার মাইর খাওনের লাইগা? আমার বাপে টেকা দিবো আমার সুখের লাইগা… আর এই আমার সুখের নমুনা? উঠতে মাইর… বইতে মাইর… আমার বাপের টেকায় খাইস-পরিস তরা ভাই-বোইন… আর আমারেই মারোস? নেমকহারামের গুষ্টি! আমার বাপের পয়সায় ব্যবসা কইরা চাউল কিন্যা খাইয়া আমার বাপেরেই গাইল দিয়া আমারে কথা শুনাইস? লোভী! শয়তান!…”
সেলিনা এবং সেলিনার পরিবার প্রায় অজপাড়া গাঁয়ের বাসিন্দা, সেকথা সেলিনার মুখেই শুনেছে সোহেলী। গল্পে গল্পে অনেক কথাই জানা হয়ে গেছে ওর সেলিনার আদ্যোপান্ত জীবন সম্পর্কে। মেয়েটার আর কোথাও তো বাইরে যাওয়া বিশেষ হয় না, ও সামনের ফ্ল্যাটের এই সোহেলীর বাসাতেই চলে আসে যখন তখন, সোহেলী বাসায় থাকলে। অনেক সময়েই বিরক্ত হয়েছে সোহেলী, সেলিনার সময়জ্ঞানের অভাবের কারণে। কিন্তু প্রতিবেশী হওয়াতে সহ্য করে নিতে হয়েছে। সেলিনার চিৎকারে আজকে ওর এতোদিনের বলা সমস্ত গল্প, ওদের গ্রাম, ওর মা-বাবা, ভাই-বোন, সব কিছু নিয়ে বলা কথা একবার ভেসে গেলো সোহেলীর মনের চোখের সামনে।
সেলিনার বিয়ের বছরই বলতে গেলে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে ওদের গ্রামে। কিন্তু গ্রাম ওদের অনুন্নত হলেও ওর বাবা-ভাইয়েরা অবস্থাসম্পন্ন কৃষক। জমিজমা, পুকুর, চাষ, গরু-ছাগল-মুরগীর খামার, এসমস্ত মিলিয়ে ওদের আর্থিক অবস্থা মন্দ নয়। কিন্তু বারে বারে বড় মেয়ের জামাইয়ের এই অনুচিৎ আবদার, যখন তখন, এগুলো মেটানো ওর পরিবারের জন্য তবুও কঠিন। সেলিনার বড় দুই ভাই আছে, কিন্তু প্রথম মেয়ে হওয়ায় ওর বিয়েটা বেশ ধুমধাম করেই দিয়েছিলেন ওর বাবা। পারভেজও স্বচ্ছল, বিএ পাশ, রাজধানীর একটা সুপরিচিত শপিং মলে কসমেটিকসের চালু দোকান আছে ওর। বড় জামাই হিসেবে ভালোই খাতির যত্ন পেয়েছে, বা পেয়ে আসছে শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু সেলিনার আরও দু’টো ছোট বোন আছে। এক বোনের জন্ম তো ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ারও পরে। ওর ভাই-বোনদের একটা ভবিষ্যৎ আছে। গ্রামের উন্নতির সাথে সাথে বাকি মানুষের অবস্থারও উন্নতি হয়েছে। গ্রামে টিকে থাকার প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ওদের অবস্থা পড়ে যায় নাই, কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনা তো সবার জন্যই ভাবতে হয় ওর বাবাকে। এক মেয়ের জামাইয়ের খাই-খাই মেটাতেই যদি তাঁকে সর্বস্বান্ত হতে হয়, তাহলে বাকি ছেলেমেয়েদের জন্য কি রেখে যাবেন তিনি? এই সমস্ত আহাজারি বহুবার শুনেছে সোহেলী সেলিনার মুখে। আজ স্রেফ নতুন আঙ্গিকে শুনলো, কি কি আদায় করে ছেড়েছে পারভেজ আর তার পরিবার।
সেলিনার ওদিকে থামার নাম নেই। পারভেজ তার সমস্ত গোমর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে দেখে এর মধ্যে আবারও তেড়েফুঁড়ে উঠতে গিয়েছিলো আরেকবার। সাঁই সাঁই শব্দে বাতাস কেটে ঝাঁটা ছুটেছে আবার। তীক্ষ্ম ফটাশ ফটাশ শব্দ তুলে একেবারে গিয়ে আছড়ে পড়েছে ওর গায়ে মুখে। পারভেজের মা একটু দূরে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে যাচ্ছেন, কিন্তু বউয়ের ঝাঁটার বাড়ি দু’য়েকটা নিজের গায়ে এসে পড়ার আশঙ্কায় সম্মান বাঁচাতে আর ছেলেকে উঠাতে যান নাই এগিয়ে। ফিস ফিস, হি হি চলছে উপস্থিত সবার মধ্যে। সোহেলী মুখে হাত চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। একবার ভাবছে সেলিনাকে ঠেকাতে যাবে কিনা এগিয়ে, কিন্তু কেন যেন ওর পারভেজের দুরবস্থাটা দেখতে ভালো লাগছে বেশ। মনে হচ্ছে, কি দরকার! ওর তো আর কোনও ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না! ঝাঁটা না হয়ে বটি হলে তাও খুনখারাপির প্রশ্ন চলে আসতো। স্রেফ বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ুর কয়েকটা বাড়ি খেলে পারভেজ মরে তো আর যাবে না! মানসম্মান যা খোয়াবার সে এমনিতেও খুইয়েছে। আর এমন লোকের সম্মান থাকলেই কি আর না থাকলেই বা কি! সেলিনা তো রোজ মার খায়, আজকে পারভেজ আরও কিছু খাক না হয়! কথাগুলো মনে হতেই চমকে একবার চারপাশে তাকালো সোহেলী। কেউ আবার ওর মনের কথা বুঝে ফেললো না তো! কিন্তু লোকের চেহারা দেখে মনে হলো অনেকের মনেই এই কথাগুলোই ঘুরছে।
সেলিনার চিৎকার চলছেই। হুঁশে যে নেই তা আরও বোঝা গেলো যখন নিজের ছেঁড়া কামিজ এক হ্যাঁচকা টানে আরও খানিকটা ছিঁড়ে ফেললো পিঠে-কাঁধে আঘাতে আঘাতে প্রায় ঘা হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো দেখাতে গিয়ে। পারভেজ এবার মুখ খারাপ করে গালি দিয়ে উঠলো, “মা*! বেশ্যা! তরে আমি তালাক দিমু এখখনিই! গায়ের কাপড় খুইল্লা দেহাইস তুই ভরা বাজারে!…” পারভেজের মুখের কথা শেষ হলো না সেলিনার চিল-চিৎকারে চমকে গেলো সকলে। চিৎকার করে সে বলছে, “দিবিই তো তালাক আমারে! তর তো ২০ ট্যাকার মাইয়া মানুষ হইলেই চলে! তর বউয়ের দরকার কি?! খারাপ পাড়ায় যাইস তুই! ট্রাকের চিপায় যাস তুই! তুই কি ভাবছস? তর এই কথা আমি কাউরে কমু না? শুনেন সবাই! পাড়ায় গিয়া খারাপ কাম কইরা আইসা এই লুইচ্চা আবার আমারেই সেই কথা শুনায় রোজ রাত্রে! শুনছেন?! পাড়ার মাইয়া মানুষ নাকি তারে সুখ দ্যায়! দিবি তুই তালাক আমারে? দে! দে তালাক! আমারে তালাক দিলেও আইজকা আমি সবাইরে কইয়া যামু তুই কেমন মানুষ! কত্তবড় হারামী! দে তালাক! দে! দে!… এই এলাকার সবাই আইজকা থেইকা জানবো তুই বউয়ের হাতে ঝ্যাঁটা খাওয়া পুরুষ মানুষ!… আমারে তালাক দিয়া তর ইজ্জত থাকবো ভাবছস? তর ইজ্জতও আমি রাখমু না!…”
সোহেলীদের মতো পারভেজদেরও এটা নিজেদের ফ্ল্যাট। চট করে বাসা বদলে এলাকা পরিবর্তনের সুযোগ কম সেই দিক দিয়ে। এই অর্ধোন্মাদ অবস্থার মধ্যেও এই কথাটা সেলিনা ঠিকই বলেছে, সোহেলী মনে মনে ভাবলো। আজকের এই ঘটনা এলাকায় ছড়াতে তো সময় লাগবে না! বিল্ডিংয়ের নানান ফ্লোর থেকে লোকজন উঁকিঝুঁকি মারা থেকে শুরু করে এখন ওই ডিশের লাইনওয়ালা এবং কয়েকটা বাসায় দুধ দিতে আসা বাঁধা একজন দুধওয়ালাকেও দেখা যাচ্ছে ভিড়ের মধ্যে। এদের সকলের জন্য এটা যে একটা মুখরোচক আলোচনার বিষয় হবে পাড়ার মোড়ে এবং চায়ের দোকানে, সেটা বোঝার জন্য কল্পনার দরকার হয় না। পারভেজের নাম আজকে থেকে ‘ঝাঁটা-খাওয়া’ পারভেজ হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই। মুখ দেখানো মুশকিল হয়ে যাবে পারভেজের জন্য। ওর আজকে সব দিকই গেলো। বউকে শাসনে রাখতে সক্ষম কঠিন পুরুষের যে ইমেজ ঠিক রাখতে পুরুষেরা সর্বক্ষণ উদগ্রীব থাকে, সেটার বারোটা তো বেজেছেই, এখন চরিত্রহীন হিসেবেও ইজ্জতের ফালুদা করে ছেড়ে দিলো সেলিনা। লুকানো যত বদস্বভাবই থাকুক না কেন, সেটা যে সমাজে বাস করে মানুষ, তার সামনে একেবারে খুল্লামখুল্লা প্রকাশ করতে কেউই চায় না।
এসব ভাবতে ভাবতেই সোহেলীর মনে হলো, ওর মেয়েদের এই সমস্ত নোংরা কথাবার্তা বা ঘটনার মধ্যে আর দাঁড়াতে দেয়া উচিৎ না। আরও কয়েকজন অভিভাবককেও দেখলো নিজেদের ছোট বাচ্চাকাচ্চা সরিয়ে নিচ্ছেন। সোহেলীর মেয়েরা সেই অর্থে শিশু না একেবারে, মিতালী এবার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর পিয়ালী কলেজের প্রথম বর্ষে। তারপরেও সোহেলী গম্ভীরভাবে চাপা গলায় ওদের বললো ভেতরে যেতে। মেয়েদের কারোরই এখান থেকে সরার কোনও ইচ্ছে নেই, মায়ের আদেশ শুনে দুই পা পিছিয়ে দরজার ভেতরে গিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন। সোহেলী জোরে একটা ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। কি দরকার শুধু শুধু এই বিশ্রী পরিস্থিতির ভেতর আবার নিজের গলার স্বর দিয়ে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে!
এর মধ্যে পারভেজ “এক তালাক…” বলে চেঁচিয়ে ওঠা মাত্রই পরিস্থিতি চরমে উঠলো। হিংস্র বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো সেলিনা পারভেজের উপর। মনের ভেতর পুষে রাখা সমস্ত ঘৃণা, আক্ষেপ আর আক্রোশ নিয়ে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললো পারভেজের নাক-মুখ। বাধ্য হয়ে এবার উপস্থিত নারী-পুরুষদের এগিয়ে আসতে হলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। সোহেলীসহ আরও কয়েকজন মহিলা রীতিমতো যুদ্ধ করে সেলিনাকে সরিয়ে আনলো পারভেজের উপর থেকে। পারভেজ আবার সুযোগ বুঝে সেলিনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই কয়েকজন পুরুষ এসে আটকে দিলেন ওকে। এতোক্ষণে সুযোগ পেয়ে পারভেজের গলাবাজি বাড়লো। চিৎকার করে জানান দিতে লাগলো সে যে এই মহিলাকে সে তালাক দিচ্ছে, এখুনি, এর সাথে সে আর সংসার করবে না। এক্ষুনি যেন সেলিনা এক কাপড়ে তার ঘর ছেড়ে চলে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার সাথে যোগ দিলেন পারভেজের মা, সুর করে সেলিনার নানান দোষের বর্ণনা করা শুরু করলেন তিনি।
উপস্থিত লোকজন এতোক্ষণে মধ্যস্ততা করার একটা সুযোগ পেয়ে সবাই নিজের নিজের জ্ঞান জাহির করতে ব্যস্ত হয়েছে। একটু বয়স্ক পুরুষরা পারভেজকে মৃদু ধমকের সুরে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। মহিলারা কেউ কেউ গলা তুলে সেলিনার শাশুড়িকে বলছেন থামার জন্য। এমনিতেই যথেষ্ট ঝামেলা করে ফেলেছে এরা স্বামী-স্ত্রী, এর মধ্যে আর উনার ঘি ঢালার প্রয়োজন নেই, একথা বলতে শোনা গেলো কোনও একজনকে। সেলিনা এখন আর কিছু বলছে না। ওর চোখ এখনও এলোমেলো ঘুরছে সকলের উপর। দৃষ্টি উন্মাদের। এতোক্ষণের উত্তেজনার পর এখন ক্রমেই শরীর ছেড়ে আসছে ওর। সোহেলী খেয়াল করলো এলিয়ে পড়ছে ও সোহেলীর গায়ের উপর। ও যে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে সেটা ধারণা করে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো সোহেলী, তার আগেই পারভেজ এক হুঙ্কার দিয়ে এসে এলোপাথাড়ি কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলো সেলিনার গায়ে-গালে। নিমেষে মেয়েটার নিচের ঠোঁটের মাঝ বরাবর ফেটে গিয়ে রক্ত গড়ানো শুরু হলো। এলোমেলো মারের কিঞ্চিৎ সোহেলীর গায়ে কোণা দিয়ে এসে পড়াতেই সোহেলী বুঝলো চড়ের ওজন। সকলে আবারও হই হই করে উঠলো। বিল্ডিংয়ের ম্যানেজার এসে দাঁড়িয়েছেন কিছুক্ষণ হলো, তিনিও হাঁহাঁ করে উঠলেন। সব কিছু ছাপিয়ে তীক্ষ্ম একটা কণ্ঠ চাবুকের মতো এসে পড়লো যেন।
ভীড়ের মধ্যে কিভাবে যেন জায়গা করে নিয়ে সেলিনার সামনে এসে ওকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে এই ফ্লোরের অল্পবয়সী স্বামী-স্ত্রী দু’জনের মধ্যে মেয়েটা। ওর নাম তিথি। হাতে তখনও ভাত ওর। সটান এসে দাঁড়িয়েছে পারভেজের সামনে। পাঁচ ফুট চার ঋজু দেহটা ধনুকের ছিলার মতো টান, ঘাড় উঁচু, কঠিন মুখের ভঙ্গী। মারমুখী পারভেজের সামনে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে, না কোনও দ্বিধা, না কোনও ভয় ওর আচরণে। “অনেক করেছেন পারভেজ সাহেব! থামুন এবার, নাহলে আমি পুলিশ ডাকবো এই মুহূর্তে!”, এই এক কথায় পারভেজ তো থমকালোই, বাকি সবার মধ্যেও বিস্ময়ে খেলে যাওয়াটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আর তখুনি জ্ঞান হারালো সেলিনা।
“তিথি…!”, কিছু বলতে যাচ্ছিলো তিথির স্বামী, শাফিন। কিন্তু হাত তুলে থামিয়ে দিলো ওকে তিথি, “তুমি বাধা না দিলে এ বাড়িতে এসে ওঠার পরপরই আমি এর ব্যবস্থা নিতাম, শাফিন! আজকে এখন আর তোমার কথা শুনতে পারছি না আমি।“ পারভেজের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো, “বহুদিন থেকেই আপনার এই বউপেটানোর রুটিন দেখে আসছি পারভেজ সাহেব! দেশে নারী নির্যাতন আইন বলে কিছু আছে জানেন তো? আপনার স্ত্রী না সেটা জানলেও এই আইনের আওতায় আপনাকে আনতে কিন্তু আমার খুব একটা কষ্ট করতে হবে না। প্রমাণ হিসেবে আপনার স্ত্রীর গায়ের আঘাতগুলোই যথেষ্ট। ওগুলো যে একদিনে হয়নি সেটা বুঝতে কোনও এক্সপার্টের প্রয়োজন হয় না কিন্তু!”
এ পর্যন্ত শুনেই শুরু হয়ে গেলো পারভেজের তর্জন গর্জন। শুরুতে যেটুকু চমকেছিলো তার দ্বিগুণ পুষিয়ে নিতে চাইলো যে তার গলার জোরে। তিথির স্বামীর উদ্দেশ্যে সে বলতে লাগলো, “ওই মিয়া ওই! আপনের বউরে সামলায়েন কইলাম! আমারে পুলিশের ভয় দেহাইতে আইসে! ওই আপনে আমার কি করবেন সেইডা আমার জানা আসে! আইন শিখাইতে আইসে আমারে!…আপনের বাপেরও ক্ষমতা নাই আমারে টুকা মারার…”
পারভেজের গলাবাজি আরও চলতো নিশ্চিত, কিন্তু ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিথি বলা শুরু করেছে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে, “আপনারা সবাই, আমরা সবাই রোজ এই মেয়েটার কান্না শুনি। আপনারা কেউ কি একটা বারের জন্য পারতেন না ওর জন্য কিছু করতে? যার বউ সে মারলে আমাদের আর কি করার আছে, এই ধরে বসে আছেন সবাই! মুরুব্বী মানুষ এতোজন আছেন এখানে, কেউ কি কিছু করতে পারতেন না আপনারা? উনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না ভালো কথা, এই বিল্ডিংয়ে তো আমরা ভদ্রলোকরা বাস করি, নাকি? আমাদের কমিউনিটির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলেও কি কিছু করতে পারতেন না? এমন একজন নেই এখানে যে এই মেয়েটার আর্ত চিৎকার শোনেননি… একটা কিছু যদি করতেন, তাহলে আজকের এই বিশ্রী ঘটনাটা চোখের সামনে দেখতে হতো না আমাদের! একটা মিটিং ডেকে উনাকে একটা ওয়ার্নিং তো দিতে পারতেন আপনারা মুরুব্বীরা! এখন যখন আমি বলছি পুলিশ ডাকার কথা, আর উনি আমাকেও শাসাচ্ছেন, তখনও আপনারা চুপ করে আছেন… কি বলবেন? উনাদের ঘরের ব্যাপার? না তো! ঘরের ব্যাপার তো এখন আর ঘরের ভেতর নেই! যা ঘটেছে তা আমাদের সবার সামনে উনাদের ঘরের দরজার বাইরে ঘটেছে! এই মেয়েটা মরে লাশ হয়ে যাওয়ার পরে পুলিশের কাছে বয়ান দিতেন? যে মেয়েটাকে রোজ রোজ মারতো? বাচ্চাটা এতিম হয়ে যাওয়ার পরে বলতেন?…”
সোহেলী অবাক হয়ে আজকে তিথিকে দেখছেন। এই মেয়েটাকে এতোদিন তিনি সর্বক্ষণ সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা ন্যাকা ধরণের বড়লোকের দুলালী ভেবে এসেছেন। ও থাকেও খুব টিপটপ হয়ে, ব্র্যান্ডের পার্স, পারফিউম, জুতা ছাড়া ব্যবহার করে না খেয়াল করে দেখেছেন। কারও সাথে খুব একটা আলাপ করতেও দেখা যায় না ওকে। তাই দেখে সোহেলীর ধারণা হয়েছিলো যে খুব অহঙ্কারী মেয়ে। আর বাকী যেটুকু, তা শুনেছেন উনার মেয়েদের কাছ থেকে। উনার চাইতে উনার মেয়েদের সাথে সখ্যতা বেশি এই মেয়ের। বিয়ে হয়ে এসে এই ফ্ল্যাটে সংসার পাতার পর থেকেই মিতালী-পিয়ালীর সাথে তিথির খাতির। তিথি নিজে খুব বেশি সোহেলীদের ফ্ল্যাটে না আসলেও মিতালী আর পিয়ালী অহরহই যায় ওর বাসায়। খুব বড়লোকের এবং প্রভাবশালী কারও মেয়ে সেটাও শুনেছেন তিনি ওদের কাছেই। উনার ধারণা ছিলো ব্যাংকের চাকরীটা এই মেয়ে স্রেফ শখের বশে করে। এই মেয়ে যে এতোটা তেজ জমিয়ে রেখেছে নিজের ভেতর, কখনও টের পান নি তো!
পারভেজ এবার আরও একবার তিথির বাবাকে টেনে মুখ খারাপ করতেই তিথি শীতল কণ্ঠে ওর হুমকি শোনালো, “আমি কোন বাপের মেয়ে সেটা আপনাকে দেখালে আপনাকে এই শহরে কেন, এই দেশে আর ব্যবসা করে খেতে হবে না। আপনার দোকান তো কোন ছাড়, এই বিল্ডিং আজকে এই মুহূর্তে কিনে নেয়ার ক্ষমতা রাখেন আমার বাবা। আপনাকে, আপনার চৌদ্দ গুষ্টিকে পথে বসাতে এক মিনিটও লাগবে না আমার বাপের। মুখ সামলে কথা বলবেন। আমি আপনার ঘরের বউ নই যে যা খুশি তা বলে বা করে পার পেয়ে যাবেন। আর একবার যদি আপনি এখানে মুখ খারাপ করেন, একবার যদি অভদ্র আচরণ করেন, আমি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। এটা ভদ্র মানুষের এলাকা, ভদ্রলোকদের বাড়িঘর। ভদ্রভাবে চলতে পারলে থাকবেন, নাহলে দূর হয়ে যাবেন এখান থেকে। আর হ্যাঁ, আপনার এই বউয়ের উপর অত্যাচার আজকে এখানেই শেষ হবে। আমি পুলিশ কল করছি…”
পুলিশের নাম শুনে পারভেজ আর এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়ানোটা সঙ্গত মনে করলো না। যে অবস্থায় ছিলো সেই অবস্থাতেই, লুঙ্গি পরা অবস্থায়, খালি পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ছুটে পালালো। সোহেলী এতোক্ষণে আশেপাশের মহিলাদের ডেকে বললো যে সেলিনা অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওরা সবাই যখন ধরাধরি করে সেলিনাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে সোফায় শুইয়ে দিচ্ছে, উপস্থিত অধিকাংশ লোকজনই তখন তিথিকে বোঝাচ্ছে যে এখানে এখন হুট করে পুলিশ ডাকা ঠিক হবে না, সবার রেপুটেশনের জন্য বিষয়টা খারাপ, ভদ্রলোকের বাড়িতে পুলিশ আসলে ভালো দেখায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। দু’একজনের কণ্ঠ চিনতে পারলো সোহেলী, যাঁরা তিথির সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। ওদের ঠিক নিচতলায় থাকেন ফরিদা আপা, বয়স্ক মানুষ, সরকারি স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, সদ্য রিটায়ার করেছেন। জোর গলায় বললেন তিনি অবশ্যই এই দৈনন্দিন অত্যাচারের একটা বিহিত করতে আইনের আশ্রয় নেয়া উচিৎ। এরকম দুএকটা সমর্থনে সাহস পেয়ে আরও দুএকটা কণ্ঠ বাড়লো সেলিনার জন্য কিছু করার স্বপক্ষে।
তিথির ঝাঁঝালো স্বর কানে আসলো সোহেলীর, “ভদ্রলোকের বাড়িতে পুলিশ আসলে ভালো দেখায় না, আর রোজ রোজ বউ পেটালে সেটা খুব ভালো দেখায়? সেখানে ভদ্রতা বজায় থাকে? মারতে মারতে একটা মানুষকে মেরে ফেললে তখন ভদ্রপাড়ার সুনাম বজায় থাকতো আপনাদের? আপনারা আমাকে বোঝাতে এসেছেন, ওই পারভেজকে তো কখনও কিছু বলেননি! আর ও যে শুধু বউ পেটায় তা তো না! ও তো একলা পেলে এই ভদ্র পাড়ার মেয়ে বউদেরকেও বিরক্ত করে! সেটা আপনারা জানতেন না কেউ? আপনারা জানেন না যে ও লিফটে থাকলে আমরা মেয়েরা একা কখনও সেই লিফটে উঠি না? আপনাদের ঘরের স্ত্রী-মেয়েরা কেউ কখনও আপনাদের বলেনি একথা?”
বিস্মিত-স্তম্ভিত সোহেলী সেলিনার মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে শুনছিলো তিথির কথা। সত্যি ও ওর দুই মেয়েকেও সাবধান করেছে পারভেজের ব্যাপারে। ওই লোকের যে চোখের দৃষ্টি ভালো না, সেটা ও নিজেই জানে। সত্যিই তো! জেনে এসেছে সবই, কিন্তু কিছু করার প্রয়োজন তো বোধ করে নি কোনদিন! আর সেলিনা?! আজকে যদি এই মেয়েটা মরে যেতো? সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন মেয়েটার। ওর ছোট্ট ছেলেটা এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মায়ের কাপড় ধরে টানাটানি করছে। ওর দিকে চেয়ে ভীষণ অপরাধবোধে কুঁকড়ে গেলো সোহেলীর ভেতরটা। আজকে সেলিনা নিজেই নিজেকে বাঁচাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যদি সেটা না করতে পারতো? মরে গেলে এই অবোধ শিশুটা মাতৃহীন হওয়ার দায় কিছুটা হলেও কি সোহেলী এবং সোহেলীর মতো বাকি সকলের উপর এসে বর্তাতো না? সব জেনেশুনে, বুঝে চুপ করে থাকার দায়?
সোহেলীর এই সমস্ত ভাবনার মধ্যেই ঘরে এসে ঢুকেছে তিথি। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো সোহেলীকে সেলিনা অবস্থা এখন কেমন, ডাক্তার ডাকবে কিনা। ঘরে ঢুকেছেন সেলিনার শাশুড়িও। হাউ মাউ করে উঠলেন এই বলে যে ডাক্তার ডাকার কোনও দরকার নেই। একটু বাতাস করলেই ঠিক হয়ে যাবে। ঠান্ডা চোখে তাঁর দিকে তাকালো তিথি। একই রকম ঠান্ডাস্বরে তাঁকে জানিয়ে দিলো, “আপনি মুরুব্বী মানুষ, আপনাকে কিছু আমি বলছি না। কিন্তু মনে রাখবেন, সেলিনার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমি আপনাকে এবং আপনার ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়াবো। আমার চাচাতো ভাই র্যাবে আছে। আমি অলরেডি ওকে আসতে বলেছি এখানে। জ্ঞান ফেরার পর সেলিনা যদি আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চায় তো ভালো, না করলেও ভবিষ্যতে সেলিনার কোনধরনের কোনও ক্ষতির জন্য দায়ী থাকবেন আপনারা, পুলিশের কাছে সে রেকর্ড থেকে যাবে।“
এক কথাতেই কাজ হলো। চায়ের কাপে ভেঙে পড়ে যাওয়া বিস্কুটের মতো নেতিয়ে গেলেন সেলিনার শাশুড়ি। ধপ করে বসে পড়লেন একটা খালি সোফায়। কিন্তু ঘরের মধ্যে থাকা একজন মহিলা তিথিকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “কিন্তু তুমি তো বাইরের মানুষ। উনাদের ঘরের ব্যাপারে তুমি কি এভাবে ইন্টারফেয়ার করে পুলিশ ডাকতে পারো? তুমি তো মামলা করতে পারবা না ওদের বিরুদ্ধে, তাই না?”
বাঁকা হেসে তিথি বললো, “আমি কখন বললাম যে আমি মামলা করবো বা অভিযোগ করবো? সেটা করলে করবে সেলিনা। কিন্তু প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবেশীর, অথবা পরিচিত কারও জীবনের আশঙ্কা দেখলে আমি আইনকে ইনফর্ম করতেই পারি! সেটা সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব…”। চুপ হয়ে গেলেন মহিলা। সেলিনার শাশুড়ির শুকিয়ে যাওয়া মুখ আরও শুকনো দেখালো।
সোহেলো এবার মৃদুস্বরে বললো, “ডাক্তার ডাকা দরকার। জ্ঞান হারিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। একে তো খুব দুর্বল, তার উপর এতো আঘাত! কিছু করা দরকার। ড্রেসিং ট্রেসিং করতে হলেও… জ্ঞান থাকলে নাহয় মেডিয়াল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া যেতো…”। সোহেলীর কথার মধ্যেই গোঙাতে গোঙাতে জ্ঞান ফিরে আসলো সেলিনার। কোলের উপর ওর মাথাটা থাকাতে সোহেলী টের পাচ্ছিলো যে ধাঁধানো জ্বর আসছে মেয়েটার। লাফিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। চোখ মেলে তাকালো সেলিনা। কয়েকটা মুহূর্ত লাগলো ওর বর্তমানের সাথে খাপ খাওয়াতে। তারপরেই ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো।
সকলের নানা স্বান্তনা, সহমর্মী কথাবার্তা, উপদেশ, সেলিনার শাশুড়িকে দোষারোপ, পরামর্শ, ইত্যাদির মধ্যেই ডাকা হলো ডাক্তার। ভাগ্যক্রমে মহিলা ডাক্তার একজন বিল্ডিংয়েই ছিলেন, তিন তলায়। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ডাক্তার, কিন্তু মহিলা মানুষের জন্য পরামর্শ নিতে স্ত্রীকেই ডাকা হলো। ছুটির দিনে তিনিও বাসাতেই ছিলেন। তিনি এসে সব শুনে সেলিনার শাশুড়িকে কিছু বকাঝকা করে সেলিনার জন্য খাবার ওষুধ আর গায়ের মলম দু’টোই লিখে দিলেন। ওষুধ কিনতে শাফিনকে পাঠালো তিথি পাড়ার ফার্মেসীতে। বিরক্ত হলেও মুখে সেটা প্রকাশ করলো না শাফিন, ওর চেহারা দেখেই সোহেলী বুঝলো সেটা। নিজের ঘরে ঢুকে হাত ধুয়ে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো ওষুধ আনতে।
শাফিন ফিরে এলো ওষুধ এবং তিথির চাচাতো ভাই, আহসানকে নিয়ে। মধ্য তিরিশের ভদ্রলোক। সিভিল ড্রেসেই এসেছেন আচমকা বোনের ডাক পেয়ে। সেলিনাদের বসবার ঘরে দাঁড়িয়ে তিথির মুখে বেশিরভাগটা, আর বাকি লোকজনের মুখে বাকিটা শুনলেন। ঘটনার সারমর্ম বুঝে নিয়ে তিনি সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলেন সেলিনা অভিযোগ দাখিল করতে চায় কিনা স্বামীর বিরুদ্ধে। কিন্তু সেলিনা এখন সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। হুঁশ যে ফিরেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে ব্যকুল হয়ে কাঁদা দেখে। পুরোটা সময়ে কোনও কথাই সে বললো না। জিজ্ঞেস করার পরেও না। খানিকক্ষণ ওর জবাবের অপেক্ষা করে আহসান সাহেব নিজের কার্ডটা দিলেন সেলিনার সামনে এগিয়ে। হাত বাড়িয়ে সেটা শুধু নিলো সেলিনা। বললেন প্রয়োজনে উনাকে ফোন দিতে। তারপর সেলিনার শাশুড়ির দিকে ফিরে বললেন, বোনের ডাক পেয়ে এসেছেন, আনঅফিসিয়ালি এসেছেন। তাঁর ছেলেকে যেন তিনি সাবধান করে দেন, এধরণের ঘটনা আর একবার ঘটলে, তাঁর কান পর্যন্ত পৌঁছালে খুব খারাপ হবে তাঁর জন্যেও, তাঁর ছেলের জন্যেও। সেলিনার শাশুড়ি ভয়ে আর ক্ষোভে মুখে আঁচল চাপা দিয়েই থাকলেন পুরোটা সময়। কিছু বললেন না।
ভীড় পাতলা হয়েছিলো আরও আগেই। অতি উৎসাহী কয়েকজন বাদে বাকিরা আহসান সাহেব আসার আগেই ফিরে গেছে যার যার ঘরে। এখন আহসান সাহেব এই ঘর থেকে বেরিয়ে বোনের বাসায় গিয়ে ঢুকতেই বাকিরাও যে যার ডেরায় রওনা দিলো। কম বেশি সকলেই বুঝেছে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ না ডাকলেও তিথি আলগোছে একটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলো সেলিনার জন্য, আবার বিল্ডিংয়ের সবার বিরুদ্ধেও গেলো না। আপাতত আর পারভেজ বা ওর মা ওর উপর অত্যাচার করার সাহস করবে না বলে আশা করা যায়।
সোহেলী ফিরলো বাকিরা যার যার ঘরে চলে যাবারও প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর। সেলিনাকে উঠিয়ে ওষুধ খাইয়ে ওর ঘরে শুইয়ে দিয়ে তারপর ফিরলো নিজের ঘরে। ওর পুরো মাথা জুড়ে ঘুরছে সেলিনার কথা, আর তিথির কথা। ওর মগজ যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যে কাকে নিয়ে আগে ভাববে। দু’টো মেয়েই আজ ওর ভাবনার জগৎটাতে ভালমতো নাড়া ফেলেছে।
কিন্তু সোহেলী জানতো না, সেদিনের জন্য ওর ভাবনার খোরাক ফুরিয়ে যায় নি। বরং আরও কিছু যোগ হতে চলেছে।
***
(শেষ পর্ব আগামীকাল)