উল্টো রথে-১১,১২,১৩
১১
ডিকেন বাসায় ফিরেছে মিনিট দশেক হবে। ইরিন দরজা খুলে একটু হাসল। ডিকেন তাকিয়ে ঘরে চলে গেল। বাইরের পোশাকে ডিকেন বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। পোশাক বদল করার সময় ইরিন ভেতরে চলে এলো!
ডিকেন খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, রুমে নক করে ঢুকতে পারো না!
ইরিন অবাক হয়ে বলল, তোমার রুমে আমাকে নক করে ঢুকতে হবে? তুমি কি বাইরের কেউ?
ডিকেন চুপ করে গেল। ওর সাথে কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না! আজ এতগুলো দিন পরে তিথি একটু স্বাভাবিক হয়েছে। ইরিনের দিকে তাকিয়ে ডিকেন দেখল৷ ইরিন একটু কাজল দিয়েছে। মনে হয় ঠোঁটেও কিছু লাগিয়েছে৷ চুল আঁচরানো। এজন্যই ডিকেনের কাছে এসেছে। মানুষের অনুভূতি গুলো খুব অদ্ভুত। যে এত কাছে আসার চেষ্টা করে, তার জন্য মন টানে না! ইরিনের সাথে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা হয়েছে হাতে গোণা কয়েকবার। জীবন তো সিরিয়াল না যে নায়ক নায়িকা এক রুমে এক বিছানায় বছরের পর বছর স্পর্শ না করে ঘুমিয়ে থাকবে! আগুন আর ঘি পাশে থাকলে সেটা জ্বলবেই! ডিকেনের সাথে ইরিনেরও সেরকম সম্পর্ক হয়েছে।
ইরিনের হাতে কিছু একটা আছে।
ডিকেন জিজ্ঞেস করল, কি এনেছ?
গ্লিসারিন আর ভ্যাসলিন একসাথে মিশিয়ে এনেছি। তোমার হাত পায়ে লাগিয়ে দিব। রাতে তো আর হবে না, তাই এখন হাত পা ধুয়ে নিয়েছ, এখন লাগিয়ে দেই। দশ মিনিট বিছানায় বসে থাকো।
ডিকেনের হঠাৎ মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। আজ তিথিও বলেছে, ডিকেন নিজের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছিল! ইরিন খেয়াল করেছে বিষয়টা!
কিছু ভালোবাসা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা হয়তো ঈশ্বর মানুষকে দেন নি। ডিকেনও পারল না ইরিনকে না করতে। ওয়াশরুম থেকে হাত পা ধুয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল। ইরিন নরম একটা তোয়ালে নিয়ে পা মুছিয়ে দিয়ে গ্লিসারিন আর ভ্যাসলিনের মিশ্রণটা লাগিয়ে দিতে লাগল।
ডিকেন মোবাইল স্ক্রল করছে, ইরিন আশা করে আছে ডিকেন একটু গল্প করবে কিন্তু ডিকেন কথা বলছে না।
তোয়ালেটা বেশ নরম- ডিকেন অনেকক্ষণ পরে কথা বলল। বাইরে থেকে ফিরে হাতপা টনটন করছিল, ইরিনের যত্নটা খুব আরাম দিচ্ছে।
এটা বাবুর। ব্যবহার করা হয় নি। আজই ধুয়ে শুকিয়ে নিয়েছি।
ওহ, খুবই সফট!
ভালো লাগছে?
হুম!
ফোনটা রাখবে?
ডিকেন প্রতিবাদ না করে ফোনটা রাখল। ইরিন কনুই অবধি আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে মিশ্রণটা দিয়ে দিচ্ছিল।
ইরিনের মনে হলো এটা সুন্দর একটা মুহুর্ত হতে পারত, কিন্তু ডিকেনের কোনো অনুভূতি তৈরি হচ্ছে না।
দেওয়া শেষ হলে ইরিন উঠে চলে গেল, ডিকেন ডাকল না বা থাকতে বলল না। ইরিনের একটু মন খারাপ হলো, মানুষ এত নিস্পৃহ কেন হবে! নিশ্চয়ই তার মনটা বাইরে কোথাও, হয়তো ওই মেয়েটাই! এই মেয়েগুলোই ঘর ভাঙানি হয়!
ডিকেন বিশ মিনিট পরে উঠে ইরিনকে ডাকল, ইরিন খেতে দিয়ে দাও।
ইরিন টেবিলে খাবার দিয়ে দিলো। ভাবল আজ আর থাকবে না। ডিকেন খেতে বসে জিজ্ঞেস করল, তুমি খেয়েছ? ইরিন ঘাড় নাড়ল, খায় নি।
তাহলে খেয়ে নাও এখন। বাবু তো আম্মার কাছে আছে।
এইটুকু কথায়ই ইরিনের চোখে পানি চলে এলো কিন্তু চট করে লুকিয়েও ফেলল। ইরিন কি অভিমান দেখিয়ে এখন খাবে না? নাকি খেয়ে নিবে, যেন কখনো কিছু হয়ই নি!
কি হলো বসো।
ইরিন বসে পড়ল। ডিকেন নিজেই খাবার তুলে দিলো। বাইশ মাসের সংসারে আজকের মত এমন কখনো হয় নি!
আর বেশি কথা হলো না। ডিকেন চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
ইরিনও গেল বাবুকে নিতে। ইরিনের মা বললেন, সব ঠিক হবে। পুরুষ মানুষ এমনই হয়, কারো আগে মন ফেরে কারো পরে। কিন্তু ধরতে হয় শক্ত করে।
ইরিন বলল, যদি কারো মনটাই না থাকে আমার দিকে, সেটা কি ঠিক হবে? মনের সাথে জোর জবরদস্তি করে কতদিন থাকতে পারব?
-থাকতেই হবে, আমরা থাকছি, শ্বশুরবাড়ির কত অত্যাচার সহ্য করছি, স্বামীরও মন উড়নচণ্ডী ছিল। সময়ের সাথে সবই বশ হয়।
ইরিন ভাবল, আসলেই কি ঠিক হয়? কই ডিকেন তো আজকে তাকে ডাকতে পারতো। এমনি সময় মাঝে মাঝে ইরিনই যায়, কিন্তু ডিকেন আজ অন্তত ডাকতে পারত।
প্রায় আধঘন্টা পরে ডিকেন এলো রুমে।
বাবু ঘুমিয়েছে?
হ্যা।
-তুমি একটু এসো তো, মাথা ধরেছে খুব।
চলবে
শানজানা আলম
উল্টোরথে-১২
রাতে পারভেজ ফিরে আসার পরে তিথি কাছে গেল না। দূরে দূরেই থাকল। বারান্দায় গিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ।
খাবার সময় হলে পারভেজ ডাকতে এলো।
তিথি, এসো।
আমার খিদে নেই।
না থাক, সবার সাথে বসো।
তিথি উঠে দাঁড়াল। ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে। কিছু করার নেই।
ডিনার টেবিলে ইশিতা বলছিল, কলেজের সব বন্ধুরা গেট টুগেদার করবে। সবাই যাবে।
পারভেজ বলল, তুমিও যাও ভাবী!
কিভাবে যাব, দুজনকে নিয়ে আমি পারব না৷
মায়ের কাছে রেখে যাও একজনকে?
মা পারবে না৷ প্রচন্ড দুষ্টমি করে। পিঠোপিঠি দুইটা না, একজন গেলে আরেকজনও যাবে।
তিথি গলা খাকারি দিয়ে বলল, আমার কাছে রেখে যান ভাবী, আপনি ঘুরে আসুন।
তোমার কলেজ টলেজ নেই? তুমি পারবে না।
পারব, মায়ের বাসা থেকে ঘুরে আসব ওদের নিয়ে।
পারভেজ ভেবেছিল, ইশিতা রাজি হবে না৷ কিন্তু আমতা আমতা করে বলল, ঠিক আছে!
তিথি অনেক রাত অবধি বারান্দায় বসে থাকল। কিছুতেই ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। পারভেজ কতক্ষণ বসে থেকে ঘুমিয়ে পড়ল।
★★★
ইরিন উঠে গেল ডিকেনের ঘরে। ডিকেন ডেকেছে। ডিকেন কেন ইরিনকে ডাকল সেটা সে নিজেও জানে না। ইরিন আসার পরে বিরক্ত লাগছে। নিজেই ডেকেছে, চলে যেতেও বলতে পারল না৷
ইরিন ডিকেনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, ডিকেন ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণ পরেই, ইরিন একটু হতাশ হয়ে গেল। ইরিন ভেবেছিল হয়তো ডিকেন ওকে ভালোবাসবে। কাছে ডাকবে। বসে থাকতে থাকতে ইরিন ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। ডিকোনের ঘুম ভাঙল রাত দুইটার পরে। ইরিন পাশেই ঘুমিয়েছে৷ ফোনটা হাতে নিয়ে তিথির ছবিটা বের করল একবার। তারপর ফোন রেখে দিয়ে ইরিনকে কাছে টানল। ঘুমিয়ে যাওয়া ইরিন ঘুমের মাঝেই ডিকেনকে সাড়া দিলো।
শেষ রাতের দিকে ডিকেনের আর ঘুম এলো না। একটা অদ্ভুত দোটানায় পড়েছে সে। চেয়েছিল তিথিকে নিয়ে আলাদা সংসার করতে কিন্তু ইরিনকে সরিয়ে সেটা কিছুতেই সম্ভব হওয়ার উপায় নেই। তিথিও এখন আর সিঙ্গেল নয়। কি হবে ডিকেন মেলাতে পারছে না।
চলবে
শানজানা আলম
উল্টোরথে-১৩
ডিকেন তিথিকে ফোন করেছিল কিছুক্ষণ আগে। একটু দেখা করতে বলেছে৷ কিছু কথা বলার ছিল। একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দুই নৌকায় পা দিয়ে কারো জীবনই চলতে পারে না। তিথিকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই কথা গুলো সামনাসামনি বলা প্রয়োজন। তিথি বলেছে আসবে। ডিকেন আবার শেষ মুহুর্তে আটকে গেল একটা কাজে। তিথি বোধহয় অপেক্ষা করছে। সামনে একটা ডে ট্যুর রেখেছে ইরিনের জন্য।ইরিনকে ওইদিন সব বলবে।
তিথি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। ডিকেন ডেকেছে। আজও না এসে পারে নি তিথি। তবে সময় বেশি নেই, ডিকেন এখনো আসছে না দেখে ভাবল চলে যাবে। কেন এসেছে সেটাও জানে না। নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে ইশিতা ভাবীর বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখবে। কিন্তু ডিকেন যখন ফোন করল, ঘন্টাখানেকের জন্য বের হতে হলো। ভাবী বের হবে তিথি ফিরলেই।
ডিকেন আসছে বোধ হয়। এই ছেলেটা দিনে দিনে সুদর্শন হয়ে যাচ্ছে। তিথি চোখ নামাতে পারে না।
পারভেজের সাথে বিয়ে হওয়ার আগ অবধি নিজেকে খুব অসহায় লাগত। আর ডিকেনের কথা ভাবতেই অসহ্য লাগত। কিন্তু এখন আর সেরকম লাগছে না। বরং পারভেজ এত কিছু করার পরেও ওকে ভালোবাসতে পারছে না তিথি। সমাজের দিকে তাকালে নিজের জীবনটাই কোরবানি করে দিতে হবে। এত এত জিনিসপত্র , স্বচ্ছলতা, প্রাচুর্য কিছুই তিথিকে সুখী করতে পারছে না।
কেমন আছ তিথি?
আছি।
তিথি আঁড়চোখে দেখল ডিকেনের হাত পা ঠিক হয়েছে। তার মানে ডিকেন নিজের খেয়াল রাখছিল না ওর সাথে কথা হওয়ার আগে। এখন ভালো আছে। হয়তো ওকে সত্যিই ভালোবাসে।
হতেও তো পারে বিয়েটা নিজের ইচ্ছেতে করে নি। হয়তো ডিকেনও সুখী নয়, সুখ খুঁজতে ওর কাছে আসত!
তুমি কেমন আছ, একটু থেমে তিথি জিজ্ঞেস করল।
ভালো।
ডেকেছ কেন?
একটা জরুরি বিষয়, আমি ঠিক করেছি ইরিনকে সব জানিয়ে ডিভোর্সের কথা বলব। তোমাকেও তো সেরকম প্রস্তুতি নিতে হবে। তোমার স্বামীকে জানাও সব কথা।
তিথি মনে মনে খুশী হলো।
ইরিন রিএ্যাক্ট করবে না?
করবে, কষ্ট পাবে।
তাহলে?
ডিকেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। তিথির চোখ এড়াল না বিষয়টা।
কি ভাবছ?
ইরিন খুব ঘরোয়া মেয়ে, নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
তিথি খেয়াল করল, ইরিনের কথা বলতে ডিকেনের একটা নমনীয়তা আসছে।
ডিকেন, তুমি ইরিনকে ছাড়তে না চাইলে জোর করে ছাড়বে কেন!
আমি কি সেটা বললাম!
তাহলে?
তুমি জিজ্ঞেস করলে বলেই বলা। ওর জন্য তো আমি অসুখী নই, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
বলতে গিয়ে ডিকেন একটু অস্বস্তিতে পড়ল। কই আগে তো এরকম হতো না। এখন এরকম লাগছে কেন!
ইরিন কি ওকে চিনি পড়া খাইয়ে দিলো! কার কাছে যেন শুনেছে, চিনি পড়া খাইয়ে স্বামী বশে রাখা যায়!
তার ইরিনকে মনে পড়ছে কেন, এমন তো কথা ছিল না। তিথিও জোর করছে না তো ইরিনকে ছাড়তে।
সেই তো ছাড়তে চাচ্ছে। তার ই তো ইরিনকে বিরক্ত লাগে!
ডিকেন আজ উঠি। তুমি ভালো করে ভাবো। হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শেষ।
তিথিকে ডিকেন আটকালো না। কিন্তু আগে হলে ঠিকই আটকাত। ডিকেনের কি আরো ভাবা প্রয়োজন! এতদিন কি সব মোহ ছিল! এখন কেন দ্বিধাগ্রস্ত লাগছে!
চলবে
শানজানা আলম