ঊষালগ্নে পর্ব-২

0
389

ঊষালগ্নে
পর্ব-২

“সে এক কল্পলোকের অলীক দিনের কথা! যেন এক মিষ্টি ভোরে স্বপ্নঘোরে তারে এক ঝলক দেখতে পাওয়ার ব্যথা!”

ডায়েরির পাতায় সেই সন্ধ্যার কথা লেখার আগে এই লাইন দুটিই জায়গা নিয়েছে। কবিতা আমার ভালো আসে না, তবু যা আসে সেটুকু শুধু নিজের জন্য বলেই লিখি।

চা খাওয়ার জন্য ডাকলেও আমরা চায়ের দোকানে গেলাম না। না বলা বক্তব্য অনুযায়ী হাঁটতে থাকলাম পাশাপাশি। ঢাকার রাস্তা তখনো ব্যস্ত৷ কত লোক কত কাজে ঘুরছে! তাদের দিকে অবশ্য নজর দেবার সময় আমার নেই। আমি পাশের মানুষের কথা ভাবছি। আঁড়চোখে খেয়াল করছি তাকে। হালকা নীল শার্টে অন্যরকম লাগছে। পরিণত লাগছে। সেদিন বাসে একটু অস্থির প্রকৃতির মনে হচ্ছিল। আজ তেমন লাগছে না। তার পাশে হাঁটতে ভয় হচ্ছে, আবার ভালোও লাগছে। সে এক দারুণ রকম অদ্ভুতুড়ে অনুভূতি! যেন পেটের ভেতর মৃদু চালে উড়ছে কয়েকটা প্রজাপতি।

সেই প্রথম কথা বলল, “ডেকে এনে ডিস্টার্ব করলাম না তো?”

আমি গলা স্বাভাবিক রেখে বললাম, “তা একটু করেছেন।”

“কী করতেন এখন?”

“এই সময় মানুষ কী করে? পড়াশোনা করতাম!”

“কোন ইয়ারে আপনি?”

“মাস্টার্সে। পরীক্ষা দিলেই শেষ।”

“তারপর ঢাকা ছেড়ে চলে যাবেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “জানি না। পরের কথা পরে।”

“আচ্ছা। একটা জিনিস দেখবেন?”

সে তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে আমাকে দেখাল আমার নাম্বার, ‘বোতলওয়ালী’ লিখে সেভ করা। আমি হেসে ফেললাম।

সে বলল, “অন্য কোনো মেয়ে হলে রেগে যেত।”

“আমি এত সহজে রাগ করতে পারি না। রক্তে রাগ নেই।”

“জেদও নেই?”

“খুব একটা না। জেদ দেখানোর মতো কোনো মানুষ কখনো পাইনি।”

“নিজের নাম না বললে কিন্তু বোতলওয়ালী রয়ে যাবেন।”

“থাকি। সমস্যা নেই।”

“উফ! নাম জানতে চাই। বলুন না।” কথায় কেমন যেন অস্থিরতা। ঠিক বাচ্চা ছেলেদের মতো।

“আপনি নাম আন্দাজ করুন?”

“লক্ষ কোটি নামের মধ্যে আন্দাজ করা কিভাবে সম্ভব? সাদিয়া, তানিয়া, মুনিয়া, জিনিয়া, মেরিনা, ফারিনা এনিথিং ক্যান বি!”

হেসে ফেললাম আমি। “আচ্ছা, সহজ করে দিচ্ছি। আমার নামও ফুলের নামে।”

“হোয়াট আ কো-ইন্সিডেন্স! আপনার নাম কী পারুল?”

“উহু।”

“বকুল?”

“না।”

“সে অনেকটা সন্দেহ নিয়ে ঢোক গিলে বলল, পলাশ?”

আমি খিলখিল করে হেসে ফেললাম। “না না৷ আমার নাম শিউলি। অনেক ব্যাকডেটেড নাম তাই না? কিন্তু আমার ভালো লাগে। ফুলটা পছন্দ তো তাই।”

“আমারো পছন্দ। আর এটা পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ নামের একটা।”

আমার হাত আর পায়ের পাতা শিরশির করে উঠল! শুধু এতটুকু কথাতেই!

নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আপনার কথা বলুন।”

আমরা তখন টিএসসি ছাড়িয়ে নীলক্ষেতের রাস্তা ধরেছি। ফুরফুরে বাতাসে হাঁটতে অসম্ভব ভালো লাগছে। জাদুর শহরের উজ্জ্বল বাতির আড়ালে ঢাকা পড়া চাঁদের আলোর মতো একটা মানুষের পাশে হাঁটছি যেন!

“আমার কথা বলার মতো তেমন কিছু নয়৷ মোটামুটি একটা চাকরি করি৷ একা থাকি। পৃথিবীতে আমার কেউ নেই জানেন?”

“কেউ নেই বলতে?”

“কেউ নেই।”

“বাবা, মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কেউ না?”

“না।”

“ওহ।”

আমার ধারণা হলো মানুষটা হয়তো অণাথ আশ্রমে বড় হওয়া৷ বুকের ভেতর একটা ছোট্ট ক্ষত তৈরি হলো। কী অদ্ভুত! আমি কখনো নিজের বা পরিবারের মানুষ ছাড়া অন্য কারো জন্য মনে ক্ষত জন্মাতে দেইনি। এই মানুষটা কত সহজে আপনজনের তালিকায় ঢুকে গেল!”

সে আচমকা বলে উঠল, “আপনি আমার একা হবার ঘটনাটা শুনবেন?”

“বলুন। শুনব।”

“অনেক দেরি হয়ে যাবে কিন্তু!”

আমি নিজেকেও অবাক করে দিয়ে বেপরোয়াভাবে হাত উল্টে বললাম, “হোক না। তাতে কী?”

সে আমার দিকে চকিতে একবার বিষ্মিত দৃষ্টি ফেলে বলতে শুরু করল, “আমার সবই ছিলো৷ এই বছর চারেক আগেও। মা, বাবা, ভাই, আপা সব। সবাই একই দিনে একই সাথে মারা গেছে।”

“কিভাবে?”

“পানিতে ডুবে। মাঝ নদীতে নৌকাডুবি। ওরা সবাই আমার এক চাচাতো ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছিল। আমি বেঁচে গেছি নেহায়েত কপালের জোরে। পরীক্ষা ছিল বলে ঢাকায়ই ছিলাম৷ যাওয়া হয়নি।”

“ইশ!”

“জানেন, আমি সবার কবর দিয়েছি৷ এই হাত দুটো দিয়ে।”

সে হাত দুটো চোখের সামনে ধরল। চোখভর্তি বিষাদের ছোপ আঁকা। আমার মনের ক্ষতটা বড় হলো অনেকটা। মনে মনে বললাম, “মায়াবী অশ্রু, কেন তোমার এত দুঃখ?”

আমি তাকে বললাম, “বাদ দিন। বাকিটা অন্যদিন শুনব।”

“ঠিক আছে।”

“এখন ফেরা যাক। অনেকটা চলে এলাম তো।”

“আপনার কথা শুনি তাহলে?”

“আমার কথা বলবার মতো কিছু নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বোরিং লাইফ লীড করা দশটা মানুষের তালিকা করলে লিস্টে আমার নাম অবশ্যই থাকবে।”

সে একটু রহস্য করে হাসল। বলল, “আপনি আমার সাথে খুব একটা কম্ফোর্টেবল না। তাই কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। যেদিন স্বাভাবিক হবেন, সেদিন সব গল্প শুনব। বোরিং হলেও শুনব!”

“মনে হয় না সেটা কখনো সম্ভব।”

“কেন নয়? আরে..আপনাকে ডেকে এনে কিছু খাওয়াব, তা না, কথা বলে যাচ্ছি। কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসি চলুন?”

“না না, ওসব নয়। খাওয়াতে চাইলে ফুচকা খাওয়ান।”

“পেট খারাপ হয় ওসব খেলে।”

“আমার কখনোই হয় না।”

“আচ্ছা বাবা চলুন।”

এই ফুচকাওয়ালা মামার ফুচকা বরাবরই অনেক মজা হয়। গোল গোল বড় বড় ফুচকার কোটরে খানিকটা ঘুগনি, মিহি কুচি করে কাটা শসা আর গাজর, ওপর দিয়ে ছড়ানো গুঁড়ো মরিচের ঝাঁঝ, আর দুটো ধনেপাতার টুকরো ভাসতে থাকা তেঁতুলের টক!

আমি একটা ফুচকা মুখে দিয়ে চোখ বুজে ফেললাম। চেয়ে দেখি সে মিটমিট করে হাসছে।

খাওয়া শেষে আবার হাঁটতে শুরু করেছি। এবার গতি একটু ধীর। সে আপনমনেই বলে উঠল, “আমার প্রেমিকা আপনার মতো ফুচকা ভালোবাসতো। বোধহয় সব মেয়েদের একই অবস্থা। কী পান ওইটুকু জিনিসে? আমি আগে ভাবতাম চাকরিবাকরি না পেলে মেয়েদের হলের সামনে ফুচকার দোকান দেব। রাতারাতি বড়লোক!” বলে শব্দ করে হেসে ফেলল সে।

আমি তার হাসিতে যোগ দিতে পারলাম না। “আমার প্রেমিকা” শব্দটা মাথায় ধাক্কা খেতে লাগল।

জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “কোথায় আপনার প্রেমিকা?”

“জানি না তো। আর সে প্রাক্তন হয়ে গেছে। তার গল্প শুনবেন?”

“বলুন।”

“একদম পুতুলের মতো দেখতে ছিল কুসুম রঙা মেয়েটা। ‘কুসুম রঙা’ আমার তৈরি উপমা। কেমন বলুন তো?”

“ভালো।”

“কুসুম মানে ফুল। তার গায়ের রঙ এত ফরসা ছিল যে গালগুলো লাল হয়ে থাকত সবসময়। ফুলের পাপড়ির মতো দেখাত।”

আমার খুব কষ্ট লাগতে শুরু করল। প্রাক্তন প্রেমিকার গল্প কেন শোনাচ্ছে আমায়? নাকি আমি ভালো দেখতে নই সেটা বোঝাতে চাচ্ছে?

সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে, বলল, “কিন্তু মজার বিষয় হলো এখন তার কথা ভাবলেও আমার মাথা গরম হয়ে যায়। সুন্দর মানুষ সবসময় সুন্দর হয় না শিউলি। মানুষ মানেই সীমাবদ্ধতা।”

“বিচ্ছেদ হলো কী করে?”

“সে অনেক কাহিনী। পরে কখনো বলব। শুধু বলি, সম্পর্ক অনেক তিক্ত হয়ে গিয়েছিল। এতটা, যাতে মিষ্টতা আনা মোটামুটি অসম্ভব।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। কষ্টের না স্বস্তির নিজেও জানি না।

টিএসসিতে এসে আমি তাকে নিয়ে গেলাম চা খেতে। দুই কাপ চা অর্ডার দিয়ে দাম মিটিয়ে দিতেই সে হই হই করে উঠল। “আপনি কেন টাকা দিলেন? কথা ছিল আমি খাওয়াব।”

“কোন কথা? কবেকার কথা?”

“সে না হোক, কিন্তু আপনি দেবেন কেন?”

আমি একটু বিদ্রুপ করে হেসে বললাম, “মেয়েরা এত দরিদ্র নয় যে সামান্য চায়ের বিল দিতে পারবে না।”

“না, সেটা বলছি না।”

“আপনি আমাকে ফুচকা খাওয়ালেন, আমি চা খাওয়াচ্ছি। শোধবোধ।”

“বাহ, খুব হিসেবী মেয়ে আপনি।”

“তা তো অবশ্যই।”

আমরা মাটির ভাড়ে চা নিয়ে ঘাসের ওপর বসলাম। চায়ে এক চুমুক দিয়ে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম সব গ্লানি। কী অপূর্ব পরিবেশে বসে আছি! পাশে একটা স্বপ্ন মূর্তির মতো মানুষ, আকাশে গোল চাঁদ, মৃদুমন্দ হাওয়া, রিকশার টুংটাং, একদল ছেলের গলা ছেড়ে গাওয়া গান, “একদিন স্বপ্নের দিন,
বেদনার বর্ণ বিহীন
এ জীবনে যেন আসে,
এমনই স্বপ্নের দিন….”

একটা সময় আমরা উঠলাম। রওনা দিলাম হলের দিকে। সে তখন থেকে মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। কারন জিজ্ঞেস করতে বলল, “আমার চয়েজ ভালো বুঝলেন?”

“কোন চয়েজ?”

“বললে তো রাগ করবেন।”

“করব না। বলুন।”

সে একটু থেমে বলল, “আপনি।”

আমি একবার সামান্য কেঁপে উঠলাম। সে খেয়াল করল না অবশ্য। হলের গেট পর্যন্ত এসে সে আমাকে বিদায় জানিয়ে উল্টোদিক ফিরে হাঁটতে শুরু করল। আমি গেটেই দাঁড়িয়ে আছি। সে একবার পিছু ফিরল। হাত নেড়ে বিদায় জানাল। আমি তার যাওয়ার পথের দিকে চেয়েই রইলাম। আমার চোখে পানি চলে আসছে। একটা সামান্য পরিচয়ের মানুষের জন্য কেউ কাঁদে না। অন্তত আমি তো না-ই!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here