ঊষালগ্নে পর্ব-৩

0
315

ঊষালগ্নে
পর্ব-৩

নারীর জীবন বদলের অনেকগুলো পর্যায় থাকে। তার মধ্যে একটি হলো প্রেমে পড়া। এই বদলটা সবার ক্ষেত্রে হয় না। সব ধরণের প্রেমেও জীবন বদলে যায় না। শুধু যে প্রেমে জীবনের নির্যাস থাকে, তাতেই জীবন বদল ঘটে।

তার সাথে সেদিনের পর থেকে নিয়মিত কথা হয়। শুধু যে নিজেদের নিয়ে কথা হয় তা না, কথা হয় দেশ নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে, বদলে যাওয়া পৃথিবীর রূপ নিয়ে। পড়াশোনায় তার আগ্রহ প্রবল। ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য কোনোকিছুতেই সে অজ্ঞ নয়। অল্প হলেও জানে। প্রচুর কথা বলে সে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি।

তার জীবনটা অতি অদ্ভুত। সে এতদিন বেঁচে ছিল কোনো এক খরকুটো পাওয়ার আশায়। আমি নাকি সেটা। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর এসব কথা একটু একটু করে বের করতে পেরেছি। একদিনের কথা।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে অতি করুন মুখে ভিক্ষারত এক বৃদ্ধকে আমি টাকা দিতে চাইলে সে আমাকে নিষেধ করল। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন? সে তখনই উত্তর দিল না। কিছুদিন পর সেই বৃদ্ধকে আমি নিজে পথে পড়ে থেকে নেশা করতে দেখেছি৷ ভালোমতো খেয়াল করে বুঝতে পেরেছি এটি বৃদ্ধও নয়, বড়জোর প্রৌঢ়। অতিরিক্ত নেশা করে এই অবস্থা হয়েছে।

আরেকদিন বেশ সুস্থ দেখতে এক যুবককে সে নিজেই ভালো অঙ্কের টাকা দান করে দিল। আমি সেদিনও অবাক। সেই ছেলের দাবি তার স্ত্রী হাসপাতালে। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে। আর এ ধরনের লোকেরা বেশিরভাগ সময়ই ফ্রড হয়ে থাকে। আমি সেদিনও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এটাকে তোমার জেনুইন মনে হলো?” সে আমাকে উত্তরে বলল, “বিশ্বাস না হলে হাসপাতালে গিয়ে দেখে এসো। এর লিফলেটে হাসপাতালের ঠিকানা আছে।”

আমি হাসপাতালে যাইনি। তার ওপর বিশ্বাস করেছিলাম। একদিন কথায় কথায় বললাম, “তোমার সত্যিই কিছু ক্ষমতা আছে তাই না?”

সে একচোট হেসে নিয়ে বলল, “এক ফোটাও না। মা বাবা মারা যাওয়ার পর আমি সত্যিই মানুষ চিনতে শিখেছি। দেখার দৃষ্টি পরিস্কার হয়েছে, এতটুকুই। এই যেমন নেশাখোর ভিক্ষুকটার শরীর থেকে গাঁজার গন্ধ আসছিল। বোঝাই যাচ্ছিল সে নেশাখোর। আবার যে যুবককে টাকা দিলাম তার চোখমুখে ছিল লজ্জা, আকুতি, জড়তা, আবার স্ত্রীর জন্য ভালোবাসা। ফ্রডরা সাধারণত মা বা ছেলেমেয়ের কথা বলে ভিক্ষা করে। স্ত্রীর কথা ক’জন বলে?

আমি মুগ্ধ হলাম। সে একটু থেমে বলল, “আর সবচেয়ে বড় কথা ভালো মানুষদের চারপাশে একটা ভালোর বলয় থাকে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Aura’। তেমন মানুষদের আশেপাশে গেলে দেখবে সবসময় ভালো বোধ হবে। তুমি জানো তুমিও তেমন একজন?”

আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। সে বলে গেল, “এইযে সেদিন বাস থেকে নেমে হুট করে পরিচয় বিহীন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী করার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম, তার পেছনে কোনো চাতুরী বা বোকামি ছিল না৷ ছিল একটা ভালোলাগার আবেশ। যেটুকু তুমি আমার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলে।”

সেদিন আমার মন তৃপ্ত হলো। তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলাম। সত্যিই যেন দুটো অলীক পাখা জন্ম নিল আমার পিঠ ফুড়ে। আমি উড়ে চললাম মেঘেদের দেশে!

আমাদের দিনগুলো পালতোলা নৌকার মতো তরতর করে বয়ে যায়। আমরা এই একটু আধটু দেখা করি। সে আমাকে ফুল উপহার দেয়। কখনো বা দেই আমি। ফোনে টুকটাক কথা হয় রাতে। তার অফিসের সময়টুকু মেসেজেই ভরসা। আমার পড়াশোনা অনেক বেড়েছে। না পড়লেই বকে। মাঝে মাঝে সে গল্পের বই নিয়ে আসে। আমাকে বলে পছন্দের অংশটুকু পড়ে শোনাতে। আমি শোনাই। সে প্রশংসা করে, তবু আমার নিজের পড়া পছন্দ হয় না। ইউটিউব দেখে শিখি কিভাবে পড়তে হয়। পরের বার যেন আরও সুন্দর করে পড়তে পারি।

সে হোটেলের খাবার খায়। মাঝেমধ্যে আমি রান্না করে বক্সে ভরে দিয়ে দেই। সে তৃপ্তি করে খায়। তারপর বলে,” আমাদের বিয়ের পর তুমি এটা প্রতিদিন রাঁধবে কেমন?”

তার মা বাবা ভাইবোন মারা যাবার পর থেকে সে গ্রামে যায়নি। আত্মীয়স্বজনদের সাথে সম্পত্তি নিয়ে অনেক ঝামেলা হচ্ছিল বলে নিজেই সেসব থেকে চলে এসেছে। ওনারা তাকে ঠকাতে চলেছে বলে সে আর ওমুখো হয়নি। বলে দিয়েছে সম্পত্তি তার চাই না।

আমি প্রথমবার শুনে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু দিনে দিনে বুঝতে পেরেছি সে অসম্ভব রকমের নির্লোভ একটা মানুষ। যে এক কথায় নিজের সবটা দিয়ে দিতে পারে। আমি অবাক হয়ে দেখি কখনো কখনো। ভাবি, আমি কি এমন একটা মানুষকে পাওয়ার যোগ্য?

আমাদের সম্পর্কের বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলেও সে একটিবার আমার হাতটা পর্যন্ত ধরতে চায়নি। কতকিছু শুনি অন্যদের প্রেমিকদের সম্পর্কে! অথচ সে আমার সাথে ভদ্রতার গন্ডি পেরিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি কোনোদিন। আমাকে ভালো রাখতে চেয়েছে, মন খারাপ থাকলে হাসাতে চেয়েছে। আর আমার জীবনটাকে করে দিয়েছে রঙিন পাখির পালকের মতো।

আমিও আস্তে আস্তে নিজের সব কথা তার কাছে বলতে শুরু করেছি। শৈশবের কোনো অতৃপ্তির কথা বলে কেঁদেছি, কিংবা কৈশরের কোনো প্রাপ্তির আনন্দ ভাগ করে নিয়েছি।

অক্টোবরের শেষের দিকে এক ভোরে সে হলের গেটের কাছে এসে ফোন করল। আমি ঘুমে ঘুমে ফোন ধরতেই বলল, “নিচে এসো।”

আমি নিচে নামলাম। একটু চিন্তা হলো। এত সকালে তার আসার কথা নয়। সে বড্ড ঘুমকাতুরে। ছুটির দিনগুলোতে দশটার আগে হুশ থাকে না।

আমি নেমে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে হাতভর্তি শিউলি ফুল নিয়ে। আমি কাছে যেতেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “শুভ জন্মদিন শিউলিকন্যা।”

আমি কেঁদে ফেললাম। আমার জন্মদিন সে মনে রেখেছে! এই ঢাকা শহর থেকে দুষ্প্রাপ্য শিউলি কোথা থেকে খুঁজে নিয়ে এলো এত সকালে? আমার কি তবে সুখের দিন শুরু?

সেদিন আমরা প্রায় পুরোটা দিন একসাথে কাটালাম। ঘুরলাম, খেলাম, বিকেলে একগাদা পথশিশুদের নিয়ে আমার জন্মদিনের কেক কাটলাম।

কেক কাটতে গিয়ে আমি পুরোটা সময় শুধু কাঁদলাম। সে জিজ্ঞেস করায় সত্যিটাই বললাম, “আমার জন্মদিনে কখনো কেক কাটা হয়নি।”

সে মমতা নিয়ে হাসল। হাতটা আমার মাথার ওপর রেখে আলতো করে সান্ত্বনা দিতে থাকল। আমার চোখ বুজে এলো।

সেদিন পথশিশুদের নিয়ে শুধু কেক নয়, পেটপুরে ভাত খাওয়া হলো। তার পথশিশুদের খুব পছন্দ। বিশেষ করে যারা অনাথ। তার মতে সে তাদেরই একজন।

আমার সবসময় ভয় হয়, সুখের দিন না এক ঝটকায় শেষ হয়ে যায়৷ ভয়ের অংশবিশেষ সত্য হলো। সুখের দিন শেষ হলো না, তবে একটা শনির দৃষ্টিতে পথটা জটিল হয়ে গেল।

আমার কোনো এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় নাকি ঢাকা এসেছিলেন কাজে। আমাকে দেখেছেন এক ছেলের সাথে ঘোরাঘুরি করতে। সেসব রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছেন বাড়িতে। তার ভাষ্যমতে ঢাকা শহরে পড়তে আসা সব মেয়েরা নাকি একটা করে প্রেমিক জোটায়, তারপর তাদের সাথে বাসা ভাড়া করে থাকে। মানে আধুনিক ভাষায় ‘লিভ টুগেদার’। আমারও নাকি সেই দশা। নিজের ওপর এরকম একটা আরোপ মানা যায় না। আমি ফোনে মায়ের সাথে খুব চেঁচামেচি করলাম৷ মিথ্যাবাদী এক লোককে বিশ্বাস করার জন্য ভর্ৎসনা করলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারা স্বচক্ষে দেখে আসা সেই কুটিল লোকটিকে বিশ্বাস করে আমাকে দোষী করে দিল।

বাবা ফোনে বললেন, “আমাদের মান সম্মান নষ্ট না করলেই চলত না? এখন পুরো এলাকার মানুষ জেনে যাবে সবকিছু।”

গ্রামের মানুষ তিলকে তাল বানায়। এখানে বানাচ্ছে হাতি! আমি খুব কান্নাকাটি করতে শুরু করলাম। এমন একটা দিন আমার কখনো পাওনা ছিল না। আমি কী এমন খারাপ কাজ করেছি? না জেনে না বুঝে কেউ এমন অপবাদ দেয়?

সেদিন সারাদিন তার ফোন ধরলাম না। কাঠ হয়ে বসে রইলাম শুধু। সন্ধ্যার দিকে খুব জ্বালাতন করতে লাগল ফোনে। অবশেষে নিজেই থাকতে না পেরে তাকে বলে দিলাম পুরোটা। সে অনেকক্ষণ ভাবল। শেষে বলল, “তুমি বাড়ি যাও।”

আমি শক্ত গলায় বললাম, “আমি কোনোদিন আর বাড়ি যাব না।”

সে আরও শক্ত হয়ে বলল, “অবশ্যই যাবে। আমি টিকিট কেটে দিচ্ছি, কালই যাবে।”

“মানে কী? আমি বাড়ি যাব কেন?”

সে একটু নরম হয়ে বলল, “শোনো, আমি বাবা মা হারিয়ে এখন বুঝছি তারা জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ। তুমি বেঁচে থাকা বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখবে না এটা আমি হতে দেব না। তোমার বাবা মা আমারও বাবা মা। আমি একটা রেডিমেড পেতে যাওয়া বাবা মা আরও হারাতে পারব না। তুমি কালই যাবে।”

“গিয়ে কী করব?”

“সত্যিটা বলবে।”

“ওরা বিশ্বাস করবে না। তখন কী করব?”

“সেটা আগে যাও, তারপর আমি বলে দেব।”

“তুমি ভেবে বলছ?”

“হ্যাঁ। ভেবেই বলছি।”

“তারচেয়ে চলো না আমরা বিয়ে করে ফেলি।”

“বিয়ে করলে তোমার বাড়ির লোক তোমাকে মেনে নেবে?”

“জানি না।”

“নেবে না। তুমি বলেছিলে তোমার মেজো বোনের সাথে এখনো তাদের সম্পর্ক ভালো না।”

“হ্যাঁ।”

“তুমি কি চাও তোমার সাথেও তেমন হোক?”

“না।”

“তাহলে যা বলছি শোনো। বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত বাবা মাকে না জানিয়ে নেয়া উচিত না।”

“ঠিক আছে যাব। তবে ওরা অন্যায় কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে আমি কিন্তু চলে আসব।”

“তুমি আমার ওপর ভরসা রাখো। কিচ্ছু হবে না।”

আমি তার ওপর ভরসা করে পরদিন বাড়ির পথ ধরলাম। জানি না কী অপেক্ষা করে আছে সামনের দিনগুলোতে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here