#এই_মন_তোমাকে_দিলাম,পর্ব-০৫,০৬
#ঈপ্সিতা_মিত্র
পঞ্চম পর্ব
কিন্তু এরপর সাত দিন বাদে ছেলেটা হিয়ার দেখা পেয়েছিল হঠাৎ, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। শেষ বিকেলের গোধূলি আলো ছড়িয়ে ছিল সেই সময় চারিদিকে। স্পন্দন ল্যাব থেকে বেরিয়ে কিছু ডকুমেন্টস জেরক্স করাতে যাচ্ছিল বাইরে। তখনই করিডোর থেকে দেখেছিল হিয়াকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে। হিয়া সেই সময় ওর ক্লাসেরই দুজনের সাথে কথা বলছিল। কিন্তু ও নিজেও সেই মুহূর্তে হঠাৎ খেয়াল করেছিল স্পন্দনকে। ওকে দেখে যেন ওরই দিকে এগিয়ে আসছিল ছেলেটা জোর পায়ে! ব্যাপারটা দেখেই হিয়া আর দাঁড়ায়নি। তাড়াতাড়ি নিজের কথা শেষ করে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। তারপর বেশ তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে গেছিল ক্যাম্পাস থেকে। কিন্তু স্পন্দন সবটাই লক্ষ্য করেছিল সেদিন। হিয়া যে ওকে দেখেও অদেখা করে চলে গেল; এটা বুঝেছিল স্পন্দন। তার মানে কি হিয়া ওর সাথে কথা বলতে চায় না! এটা ভেবেই কেমন খারাপ লাগা তৈরি হয়েছিল মনে।
কিন্তু এরপরের দিনও একই ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন লাইব্রেরীতে স্পন্দনের মুখোমুখি হয়েছিল হিয়া। তবে স্পন্দন আজ ওকে যেতে না দিয়ে নিজেই ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল দেয়ালের মতন। তারপর খুব স্থির গলায় বলেছিল,
——-” তুই কেন করছিস এরকম! আমার ফোন ধরছিস না! আমার সাথে দেখা হলে কথা বলছিস না? কেন করছিস এইভাবে বিহেভ?”
এই কথায় হিয়া আজ খুব কম কথায় বলেছিল নিজের চোখটা নামিয়ে,
——” আমাদের আর কথা না বলাই উচিত। যাইহোক, ক্লাস আছে আমার। যেতে হবে।”
কথাটা কোন রকমে শেষ করে হিয়া নিজেই স্পন্দনের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল লাইব্রেরী থেকে।
তবে এবার যেন স্পন্দনের ধৈর্য্য শেষ হয়ে যাচ্ছিল কেমন। হিয়ার কাছ থেকে এই দূরত্বটা একসেপ্ট করতে পারছিল না ও কোনভাবেই। তাই পরেরদিন ও নিজে এসে হাজির হয়েছিল হিয়ার মাসির ফ্ল্যাটে। এখানে যদিও স্পন্দন আগে এক দুবার এসেছে; তাই সুকন্যার সাথে আলাপ আছে ওর। যাইহোক, সেদিন তবে সুকন্যা বেশ অবাক হয়ে গেছিল শান্ত স্বভাবের স্পন্দনকে এরকম অস্থির, এলোমেলো দেখে! তাই কথা না বাড়িয়ে হিয়াকে ডেকেছিল ড্রইং রুমে স্পন্দনের সাথে কথা বলার জন্য।
সেদিন হিয়া ড্রইং রুমে এসেই তবে কেমন থমকে গেছিল। স্পন্দন এখানে কি করছে! কথাটা ভাবতেই স্পন্দন বলেছিল বেশ কঠিন স্বরে,
——” কথা আছে তোর সাথে আমার। ছাদে যাবি?”
না, হিয়া এটা শুনে আর না করেনি ওকে, কারণ স্পন্দনকে আজ সত্যিই ভীষণ অস্থির লাগছিল যেন।
তবে সেদিন ছাদে আসতেই স্পন্দন বেশ চেঁচিয়ে বলেছিল হিয়াকে,
——” তোর কি হয়েছে একটু বলবি আমাকে? প্লিজ! একদিন, শুধু একদিন আমি রাগ করেছি তোর ওপর। তার জন্য তুই এইভাবে কথা বন্ধ করে দিবি! আমাকে দেখলে এইভাবে এভয়েড করবি! এমনকি তুই আমার কল অব্দি রিসিভ করছিস না এতদিন ধরে! মানছি, সেদিন ভুল ছিল আমার। আমি জন্মদিনের দিন তোকে টাইম দিতে পারিনি! এন্ড এম সরি ফর দ্যাট.. আর সুচেতার ব্যাপারে তোর ওপর রাগ দেখানোর জন্যও সরি.. কিন্তু তার জন্য তুই এইভাবে শাস্তি দিবি আমাকে? একদম বন্ধুত্বটাই শেষ করে দিবি!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল স্পন্দন। কিন্তু হিয়া এই মুহূর্তে খুব কষ্ট থেকেই বলেছিল ওকে,
——” সরি বোলো না প্লিজ! তুমি কোন ভুল করোনি। আর আমি কোন শাস্তিও দিচ্ছি না কাউকে। আসলে প্রবলেমটা আমার! আমি ফিল করি তোমার জন্য, মোর দ্যান আ ফ্রেন্ড.. আজ থেকে না, অনেক বছর ধরে। সেই জন্য নিজের লিমিটটা ক্রস করে গেছিলাম সেইদিন। সেই জন্য সুচেতাদি কে নিয়ে এত ইন্সিকিউরিটি ছিল আমার! তবে তোমার জন্মদিনে আমি একটা কথা বুঝেছি, যে এই ফিলিংসগুলো এক তরফা। আর এতে কোন দোষ নেই তোমার! কেউ কারোর জন্য ফিল না ই করতে পারে। তবে, আমি আর পারবো না। তোমার সাথে কথা বললে, টাইম স্পেন্ড করলে আরো বেশি করে জড়িয়ে যাবো এই ফিলিংস গুলোর সাথে! আর একতরফা কষ্ট পাবো শুধু। কেউ সঙ্গে থেকেও দূরে থাকার কষ্ট। তাই আমাদের কথাবার্তা এখানেই শেষ করতে হবে। এন্ড এম রিয়ালি সরি ফর অল অফ দিজ.. ভালো থেকো খুব।”
কথাগুলো কিরকম নিজের মনে বলে গেছিল হিয়া। তবে এই মুহূর্তে স্পন্দনও যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল হঠাৎ! হিয়াকে দেওয়ার মতন কোন উত্তর নেই আসলে ওর কাছে। হিয়া যে ওর জন্য ফিল করে, এটাই জানা ছিল না এতদিন! আর নিজেও তো কখনো ভেবে দেখেনি এইভাবে। হিয়া ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু আলাদা করে তো ওকে নিয়ে ভাবেনি কখনো স্পন্দন! কথাগুলো ভাবতেই খেয়াল করলো হিয়া ছাদটা খালি করে দিয়ে চলে গেছে এই মুহূর্তে। তবে স্পন্দনও যেন কেমন কথাহীন হয়ে গেছে হঠাৎ! মনে হচ্ছে হিয়াকে না বুঝে ভীষণ হার্ট করে ফেলেছে ও। আর সত্যিই সব কিছু আর আগের মতন হবে না কখনো। দুজনের মধ্যে একটা নিঃস্তব্ধতার দেয়াল থাকবে হয়তো সারা জীবন!
<৯>
এই মন খারাপের বিকেল পেরিয়ে আরো কটা মাস কেটে গেছে শহর থেকে। তবে স্পন্দন আর হিয়ার মাঝে আজও সেই নিঃস্তব্ধতার পাহাড়। আসলে স্পন্দন বুঝতে পারে না সেদিন বিকেলের পর কিভাবে আবার কথা শুরু করবে হিয়ার সাথে! আর সত্যিই তো এতদিন মিশেও ও বোঝেনি হিয়ার মন। বোঝেনি হিয়া ফিল করে ওর জন্য! আসলে স্পন্দন তো নিজের কেরিয়ার আর পড়াশুনা ছাড়া কখনো অন্য কিছু ভাবেনি জীবনে। আর হিয়া ওর খুব ভালো বন্ধু। নিজের ভীষণ সিরিয়াস একটা জীবনে কিছু হাসি মজার মুহূর্ত নিয়ে আসে যে; এমন একজন মানুষ। যার সাথে স্পন্দন একদম বেহিসেবী ভাবে কথা বলতো, সহজ ভাবে মিশতে পারতো।
কথাগুলো আজ ভীষণ ভাবে মনে হয় ওর। যখন একই ক্যাম্পাসে দেখা হলেও হিয়া নিঃশব্দে চলে যায় চোখ নামিয়ে, যখন আর হঠাৎ করে ওর ঘরে এসে বকবক শুরু করে দেয় না অকারণে, যখন নিজের বই খাতা নিয়ে পড়তে আসে না স্পন্দনের কাছে, এলোমেলো কথা বলে হেসে ওঠে না জোরে! এই সমস্ত কিছুই যেন ভীষণভাবে মিস করে স্পন্দন। আসলে এই বন্ধুত্বটার, হিয়ার বকবক শোনার, অভ্যেস হয়ে গেছে ওর; এতগুলো বছর ধরে। তাই হিয়ার না থাকাটা যেন মানতে পারে না ও! একটা ব্যাস্ত দিনের মাঝে সারাক্ষণই কিরকম খালি খালি লাগে রোজ। মনে হয় সমস্ত কিছুর মাঝেও কিছু একটা নেই! সবাই থেকেও খুব একলা স্পন্দন।
তবে এই ব্যাস্ত শহরে শুধু একলা স্পন্দনই না, হিয়াও একা ভীষণ। আসলে যখন নিজেকে জোর করে কারোর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়, যখন এতদিনের ফিলিংসগুলোকে বাক্স বন্দি করে বন্ধ করে রাখতে হয় সবার আড়ালে, তখন কষ্ট হয় ভীষণ! বার বার সেই চেনা নাম্বারে চোখ চলে যায়। বার বার ইচ্ছে হয়, একবার অন্তত গলার আওয়াজটা শোনার! কিছু কথা বলার! কিন্তু তারপর নিজেকেই বোঝাতে হয়, যে সম্ভব না। আর কথা বলা সম্ভব না। আর সেই মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব না। আসলে কেউ কাউকে ভালোবাসলে তো শুধু ভালোবাসাই ফেরৎ চায় সে! তাকে শুধু বন্ধু ভাবা, সম্ভব না।
যাইহোক, এই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার মাঝে হিয়া বদলে গেছে অনেক। আগের মতন হাসি, কথা আর আসে না কারোর সাথেই বিশেষ। তবে এই মন খারাপের ভিড়ে একজন নতুন বন্ধু হয়েছে ওর। উজান। ছেলেটা সুকন্যার কাছে ভ্যাওলিন শিখতে আসে। আসলে ছোট থেকেই ভ্যাওলিন বাজানোটা সুকন্যার হবি। কিন্তু চাকরি জীবনে সেই হবি নিয়ে চর্চা করার বেশি সময় পায়নি! তাই রিটায়ারমেন্ট এর পর হঠাৎই চর্চা শুরু করেছে। আর দু দিন ধরে মিষ্টি ভ্যাওলিন এর সুর শুনে পাশের ফ্ল্যাট থেকে উজান এসে হাজির। ভ্যাওলীন বাজানো শিখবে বলে! যাইহোক, ও আসাতে হিয়া আর সারাক্ষণ চুপ থাকতে পারে না। উজান এসে এলোমেলো বকবক করেই যায়। আসলে ছেলেটা কথা বলতে খুব ভালোবাসে। তাই নতুন কাউকে দেখলেই আলাপ জমিয়ে ফেলে! তারপর এই এক মাস আগে তো হঠাৎ এসে হিয়াকে বললো,
——-” ফেসবুকে দেখলাম সুকন্যা মাসির জন্মদিন আজ। চলো, একটা সারপ্রাইজ দিই। সব এরেঞ্জমেন্টস এ তোমার হেল্প কিন্তু দরকার আমার!”
কথাগুলো শুনে হিয়ার ভালো লাগলো বেশ। আসলে এই হিসেবী পৃথিবীতে কজন পারে কাউকে এইভাবে আনন্দ দেয়ার কথা ভাবতে! তাই উজানের সাথে মিলেই হিয়া কেক কিনে আনা, রুম ডেকরেশন, সব করেছিল। ততক্ষণ সুকন্যা বাজারে ছিল। তবে বাড়ি ফিরেই কেমন থমকে গেছিল যেন! নিজের জন্মদিনে এরকম স্পেশ্যাল কিছু হবে ভাবেনি! যাইহোক, সেদিন মাসির হাসি মুখটা দেখে হিয়ার এত ভালো লেগেছিল যে উজানকে নিজের বন্ধুর জায়গাটা দিতে আর একবারও ভাবেনি ও। আসলে আজ এই আনন্দের মুহূর্ত গুলো তো উজানের জন্যই তৈরি হলো জীবনে!
যাইহোক, এইদিনের পর ও বাড়ি ফিরে এসেছিল নিজের। তবে উজানের সাথে বন্ধুত্বটা রয়েই গেছে। এর মধ্যে আবার ছেলেটা একদিন ওর কাছে এসে অদ্ভুত একটা হেল্প চেয়েছে। উজানের তৈরি শর্ট ফিল্মে অভিনয় করার জন্য খুব করে রিকুয়েস্ট করেছে হিয়াকে দুদিন ধরে। আসলে উজান গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে মাস কম নিয়ে পড়ছে। আর ওদের নতুন একটা প্রজেক্ট দিয়েছে পনেরো মিনিটের একটা শর্ট ফিল্ম বানানোর জন্য। তাই ও হিরোইনের খোঁজে হিয়ার স্মরণাপন্ন হয়েছে অবশেষে। আসলে সুকন্যার কাছে উজান গল্প শুনেছিল, যে হিয়া স্কুল কলেজের এনোয়াল প্রোগ্রামে নাটক করতো নিয়মিত। তাই হিয়াকে ছাড়া ওর গতি নেই! আর ছেলেটা এত বেশি সাধ্য সাধনা করেছে হিয়ার সামনে, যে ওকে শেষ অব্দি রাজি হতেই হয়েছে একটিং করার জন্য।
সেই শর্ট ফিল্মেরই শুটিং করতে এসেছিল আজ উজান। হিয়াদের বাড়ির ছাদেই হিয়ার সিঙ্গেল শট গুলো নেবে ও। সেই মতন ক্যামেরা হাতে বিকেলবেলা ছাদে গেছিল ছেলেটা হিয়ার সাথে! তারপর সিন বুঝিয়ে দেওয়া, বার বার টেক নেয়া, শটের মাঝে হিয়ার চুল ঠিক করে দেয়া, আর কাজের বাইরে অনেক সময়েই অকাজের কথা বলে ওঠা, এইসবই করছিল সারা বিকেল ধরে।
তবে আজ হঠাৎ পড়ার ঘর থেকে এই দৃশ্যটা দেখে কেমন থমকে গেছিল যেন স্পন্দন! বই নামিয়ে ও স্থির হয়ে গেছিল হিয়ার সাথে ওই ছেলেটাকে দেখে। ছেলেটা এত কি বকবক করছে হিয়ার সঙ্গে! তারপর ওর চুল ঠিক করে দিচ্ছে! ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে! এসব হচ্ছে টা কি! কিছুই যেন বুঝতে পারছিল না ঠিক। তবে এই মুহূর্তে কেমন ভিতরটা জ্বলতে শুরু করেছিল ওর। একটা অদ্ভুত রাগ এসে জমা হয়েছিল মনে। হিয়াকে এই ছেলেটার সাথে দেখে অসহ্য লাগছিল যেন সব কিছু।
চলবে
#এই_মন_তোমাকে_দিলাম ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
সেদিন সারাটা সন্ধ্যে স্পন্দন ছাদের ওই দৃশ্যগুলো নিয়েই ভেবে গেছিল। এই হালকা দাড়িওলা, রোগা করে ছেলেটাকে তো আগে দেখেনি কখনও পাড়াতে! আর হিয়ার সব বন্ধুকেই তো প্রায় ও চেনে। কিন্তু এই ছেলেটাকে তো আজ প্রথম দেখলো। তাও হিয়ার এত ক্লোজ! কথাটা ভেবেই মনে যেন একটা কাঁটা বিঁধলো খুব জোরে। স্পন্দন এবার কিছু না ভেবেই হিয়ার নাম্বারটা ডায়েল করলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর হিয়া ফোনটা ধরতেই স্পন্দন কেমন বেসামাল হয়ে বললো,
——-” এখন খুব নতুন বন্ধু বানাচ্ছিস মনে হয়! ছাদে কে ছিল ওটা বিকেলে?”
স্পন্দনের প্রশ্নে হিয়া ঠিক কি বলবে বুঝতে না পেরে একটা শব্দেই বললো,
—– ” মানে?”
এটা শুনে স্পন্দন আরো অধৈর্য্য হয়ে বললো,
—–” মানে! মানে পড়াশোনাটা ঠিকঠাক চলছে, না কি বিকেলবেলা ফটোশুট করতেই বেশি ভালো লাগছে? কে ছিল ছেলেটা?”
কথাগুলো বেশ রুড লাগলো হিয়ার। স্পন্দন এইভাবে বলছে কেন ওকে! কথাটা ভেবেই ও বেশ দৃর গলায় বললো,
——” ছেলেটা আমার বন্ধু, উজান। আর পড়াশোনা আমার ঠিকঠাকই চলছে। আর ছাদে আমি কোন ফটোশুট করছিলাম না! উজান একটা শর্ট ফিল্ম বানাচ্ছে, তার কাজই করছিলাম। এটা উজানের একটা প্রজেক্ট। মাস কমের স্টুডেন্ট ও। নিজের কাজ করতেই এসেছিল আজ আমাদের বাড়ি। ”
কিন্তু এসব শুনে স্পন্দনের ভিতরটা আরো জ্বলে গেল যেন। হিয়া এত কিছু বলছে ওই ছেলেটার হয়ে! কথাটা ভেবেই স্পন্দন এবার বেশ রেগেই বললো,
——” শর্ট ফিল্ম! তুই একটিং করছিস! দেখিস, এসব করতে গিয়ে ওই উজানের চক্করে নিজের পড়াশোনাটার বারোটা বাজাস না আবার। ”
এই কথাটায় হিয়া এবার বেশ অধৈর্য্য হয়ে বললো,
——” প্লিজ, এইভাবে বোলো না। আর কারোর চক্করে পড়িনি আমি। উজান খুব ভালো একটা ছেলে। আমি শুধু ওর প্রজেক্টে হেল্প করছি, ব্যাস। যাইহোক, রাখলাম।”
কথাটা শেষ করেই হিয়া আর কিছু শোনার অপেক্ষা করলো না। ফোনটা কেটে দিল নিজে থেকে। কিন্তু স্পন্দনের যেন রাগটা আরো দশ গুণ বেড়ে গেল! হিয়ার মুখে ওই একটা সেন্টেন্স শুনে। উজান না কি খুব ভালো ছেলে! কদিন চেনে হিয়া ওই ছেলেটাকে; যে ওর ভালো খারাপ বুঝে গেল। বাড়াবাড়ির একটা লিমিট থাকা দরকার। যেইভাবে ছাদে আজ ছেলেটা হিয়ার চুল ঠিক করে দিচ্ছিল, কাছে আসার চেষ্টা করছিল, তাতে ছেলেটাকে খুব সুবিধার একেবারেই মনে হয়নি স্পন্দনের। কিন্তু এত কথা হিয়াকে বোঝাবে কে! আর এখন তো স্পন্দন এমনিও দূরের মানুষ। সেই পুরোনো কথা, পুরনো বন্ধুত্ব, সবই তো শেষ। কথাগুলো ভেবেই কেমন খারাপ লাগলো যেন মন থেকে।
<১০>
তবে সেদিনের পর আরো একটা দৃশ্য দেখে স্পন্দনের খারাপ লাগাটা যেন বেড়ে গেছিল দ্বিগুণ। আসলে সেদিন সোমবার ছিল। আর কদিন বাদেই শহরে দুর্গা পুজো। চারিদিকটা তাই সেজে উঠছে ধীরে ধীরে। কোথাও মণ্ডপ তৈরির কাজ জোর কদমে চলছে, তো কোথাও লাগছে আলো। এর মধ্যেই ক্যান্টিনে আজ আলোচনা হচ্ছিল সবার, যে দুর্গা পুজোর প্ল্যান কি! এই কথায় ল্যাবের সবাই নিজেদের কিছু না কিছু ঠাকুর দেখার প্ল্যানের কথা বলছিল। কিন্তু স্পন্দন একদম চুপ ছিল। আসলে প্রত্যেকবার দুর্গা পুজোটা তো ও হিয়ার সাথেই কাটায়! ষষ্ঠী থেকে দশমী ওই মেয়েটার সাথে ঠাকুর দেখা, ফুচকা খাওয়া, মণ্ডপে আড্ডা, অঞ্জলী এইসবের মধ্যে কিভাবে সময়টা কেটে যেত বুঝতেই পারতো না! কিন্তু এইবার পুজোয় হিয়াকে ছাড়া কিভাবে কাটাবে দিনগুলো! এমনিই তো প্রত্যেকটা দিন ওই মেয়েটাকে ছাড়া কিরকম ফাঁকা লাগে। সত্যিই, হিয়া যতদিন সাথে ছিল, এইভাবে কখনো ভাবেনি স্পন্দন। কিন্তু আজকাল ভীষণ মনে হয় কথাগুলো। কেউ না থাকলেই হয়তো তার থাকাটা ফিল হয় বেশি করে! এইসবই ভাবছিল, তখনই পাশ থেকে সুচেতা বলে উঠলো,
——–” আমি কলকাতার পুজো দেখেনি খুব একটা। স্পন্দন, আমাকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে এইবার?”
এই কথায় স্পন্দনের চিন্তার ঘোরটা কাটলো। কিন্তু সেদিন ক্যান্টিনের ইনসিডেন্টটার পর থেকে স্পন্দন সুচেতার সাথে আর আগের মতন সহজ হয়ে মেশে না। আসলে হিয়াকে ওইভাবে সবার সামনে ইনসাল্ট করার পর এই মেয়েটাকে কেমন খারাপ মানুষ মনে হয় ওর! যাইহোক, এই কথায় স্পন্দন খুব অল্প কথায় বললো,
——-” না, আমার হবে না। অন্য প্ল্যান আছে পুজোতে।”
কথাটা সবার সামনে বলেই স্পন্দন উঠে পড়লো চেয়ার থেকে। আর ঠিক ক্যান্টিনে থাকতে ভালো লাগছে না ওর। সবার এত কথা, এত ভিরে কিরকম অস্বস্তি হচ্ছে যেন! কিন্তু এই সময়ে সুচেতারও খারাপ লাগলো কেমন। এতদিন ধরে ও অনেক চেষ্টা করছে স্পন্দনের সাথে কথা বলার, আগের মতন সহজ হওয়ার। কিন্তু স্পন্দন প্রত্যেকবারই কেমন মুখের ওপর বুঝিয়ে দিচ্ছে ওকে দূরত্বটা। আসলে সবই ওই হিয়ার জন্য। মেয়েটার সাথে রুডলি কথা বলেছে বলেই স্পন্দনের মনে এত রাগ। কিন্তু কি করে যে ওরকম সিম্পল একটা মেয়ে স্পন্দনের কাছে এতটা ইম্পর্টেন্ট হলো কে জানে! ভেবেই সুচেতার কেমন পারদ চড়লো হঠাৎ। তাই ও স্পন্দনকে একা না ছেড়ে ওর রাস্তার মাঝে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
——-” কেন? পুজোতে তোমার টাইম নেই কেন? হিয়ার সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছে বুঝি?”
এই কথায় স্পন্দন বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,
——” যদি এপয়েন্টমেন্ট থাকেও, তাহলে তোমাকে বলতে যাবো কেন! এটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার।”
এটা শুনে সুচেতা ঠিক আর সহ্য করতে পারলো না। এইভাবে কথা বললো স্পন্দন ওর সাথে! না, এর একটা উত্তর দিতেই হবে এবার। কথাটা ভেবে সুচেতা বেশ তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
——-” পার্সোনাল! কিসের পার্সোনাল? হিয়া তো এখন ক্যাম্পাসে দেখা হলেও তোমার সাথে কথা বলে না। আর আগের সপ্তাহেই তো দেখলাম, বাস স্ট্যান্ডে একটা ছেলের বাইকে বসে চলে গেল। আই ডোন্ট থিঙ্ক তুমি আর ওর লাইফে এগজিস্ট করো! আর ওদের মতন মেয়েরা এরকমই হয়। টাইম পাস করার জন্য আরেকটা ছেলে পেয়ে গেছে, তাই!”
না, কথাটাকে সুচেতার শেষ হতে না দিয়েই স্পন্দন এবার বললো ভীষণ রেগে,
——-” শাট আপ.. জাস্ট স্টপ নাও.. হিয়ার ব্যাপারে আর একটা উল্টো পাল্টা কথা শুনবো না আমি তোমার কাছ থেকে। কতটুকু জানো হিয়া কে তুমি! সি লাভ’স মি.. সি অনলি লাভ’স মি.. এন্ড আই লাভ হার টু.. যাইহোক, এরপর কখনো আর আমার সাথে কথা বলতে আসবে না। মনে থাকে যেন।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই স্পন্দন আর দাঁড়ায়নি। সুচেতা কে অদেখা করেই প্রায় এগিয়ে গিয়েছিল করিডোর থেকে। কিন্তু এই সময় এত অস্থির লাগছে যে ল্যাবেও আর ফেরেনি ও। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ইউনিভার্সিটি থেকে। তারপর সামনে একটা বাস দেখতে পেয়ে উঠে বসেছিল কিছু না ভেবে। কিন্তু বাসটা চলতে শুরু করলে, জানলার ধারের চলন্ত রাস্তা, হালকা বৃষ্টিতে ভেজা শহরটাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে পড়ে গেছিল নিজের বলা কথাগুলো। ও ভালোবাসে হিয়াকে! এই কথাটা ও নিজের মুখেই তো বললো আজ। তার মানে কি এই এতদিনের বন্ধুত্ব, মুহূর্তগুলো আলাদা জায়গা তৈরি করেছে মনে! সেই জন্যই হিয়ার না থাকাটা এত বেশি কষ্ট দেয় রোজ! একটা শুণ্যতা তৈরি হয়ে থাকে সব সময় চারিদিকে। কারণ হিয়াকে ভালবেসে ফেলেছে স্পন্দন, নিজের অজান্তেই! কবে, কোন দিন, কোন সময় এই ফিলিংস গুলো তৈরি হয়েছে মনে, ও নিজেও জানে না। কিন্তু ভালোবাসে, এটা আজ বুঝেছে।
কথাগুলো ভেবেই যেন মনের মধ্যে চলতে থাকা এতদিনের অস্থিরতাটা কমলো কিছুটা। নিজের কাছেই নিজের ভাবনাগুলো পরিষ্কার হলো আজ। কিন্তু তারপরেই মনে পরে গেল সুচেতার কথাটা। ও হিয়াকে একটা ছেলের বাইকে করে যেতে দেখেছে! নিশ্চয়ই ছেলেটা আর কেউ না, ওই উজান। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো পাবলিকটা কে জানে! কথাটা ভেবেই কেমন মনটা তিতো হয়ে গেল আবার, আর একটা অদ্ভুত বিরক্তি এসে জমা হলো মনে।
তবে বিরক্তিটা চারগুণ বেশি বেড়ে গেল যখন পাড়ার মোড়ে নেমেছিল বাস থেকে। রাস্তার উল্টোদিকের ফুচকাওলার দিকে চোখটা যেতেই আসলে থমকে গেল স্পন্দন। হিয়া আর উজান বেশ গল্প করতে করতে ফুচকা খাচ্ছে এই মুহূর্তে একসাথে। দৃশ্যটা দেখেই কেমন পা থেকে মাথা অব্দি জ্বলে গেল ওর। ও আর নিজের রাগটাকে সামলাতে না পেরে এবার হিয়ার সামনে হঠাৎ এসে বলে উঠলো,
——” এখন কি চব্বিশ ঘণ্টা এই ছেলেটার সাথে থাকিস?”
কথাটায় হিয়া কেমন আকাশ থেকে পড়লো যেন। তবে কিছু বলার আগেই এবার স্পন্দন উজানের দিকে তাকিয়ে বললো,
——-” আর তোমারও কি কোন কাজকর্ম নেই। কখনো ছাদে ফটো শুট করো, কখনো ইউনিভার্সিটির সামনে বাইক নিয়ে চলে আসো লিফ্ট দেয়ার জন্য, আবার এইসব ফুচকা খাচ্ছো রাস্তায় দাঁড়িয়ে! নিজের কোন পড়াশোনা নেই! না কি মেয়ে পটিয়ে বেড়ানোই একমাত্র কাজ?”
কথাগুলো ভীষণ রাগের সাথে বললো স্পন্দন। কিন্তু হিয়া এই মুহূর্তে আর চুপ না থেকে বললো,
——-” এইসব কি বলছো কি তুমি এইভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে! আর উজান আমার খুব ভালো বন্ধু। ওকে এইভাবে ইনসাল্ট করার কোন রাইট নেই তোমার। যাকে যা ইচ্ছে তাই বলে দিতে পারো না তুমি!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো হিয়া। তারপর স্পন্দনের সামনেই উজানের হাতটা ধরে আস্তে গলায় বলে উঠলো,
——” চলো এখান থেকে। এন্ড এম রিয়ালি সরি ফর অল দিজ..”
কথাটা বলেই ও এগোনোর জন্য পা বাড়ালো, কিন্তু স্পন্দন এইসব দেখে শুনে এই মুহূর্তে হিয়াকে আটকে দিল হঠাৎ। তারপর এই রাস্তার মাঝেই ওর হাতটা ধরে বললো,
——” তুই ওর সাথে যাবি না। এইভাবে যার তার সাথে ঘুরতে পারিস না তুই। এন্ড ইউ লাভ মি.. কি হলো সেই সব ফিলিং এর? সব ভুলে গেলি না কি?”
এই প্রশ্নে হিয়া যেন থমকে গেল কেমন। স্পন্দন আবার এইসব পুরনো কথা কেন তুললো! কি প্রমাণ করতে চায় ও এইসব বলে! হিয়া তো নিজে থেকেই দূরে সরে গেছে। তাহলে এইভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলার কি মানে! কথাটা ভাবতেই এবার উজান খুব শান্ত স্বরে নিঃস্তব্ধতা কাটিয়ে বললো,
——” দ্যাখো, তুমি কে আমি জানি না! কিন্তু আমি হিয়ার কাছে কোন বাইরের লোক নই। আমরা খুব ভালো বন্ধু। আর একটা মেয়ের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এইভাবে সিন ক্রিয়েট কোরো না। তোমার পার্সোনাল কোন কথা থাকলে আলাদা করে এসে বলো। এইভাবে রাস্তায় চিৎকার করে কোন লাভ নেই।”
কথাগুলো ভীষণ দৃর গলায় বললো উজান। তবে এইসব শুনে স্পন্দনের রাগের ঘোরটা কাটলো হঠাৎ। ও সেই মুহূর্তে খেয়াল করলো হিয়ার অন্ধকার মুখটা। সত্যিই কি খুব বেশি রিয়্যাক্ট করে ফেলেছে ও! খুব বাজে ভাবে কথা বলে ফেলেছে হিয়ার সামনে! কথাগুলো ভাবতেই হিয়া এবার জোর করে স্পন্দনের কাছ থেকে ওর হাতটা ছাড়িয়ে আর দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগিয়ে গেল নিজের বাড়ির গলির দিকে। উজানও এরপর হিয়ার সাথেই পা বাড়ালো একই রাস্তায়।
চলবে