এই_মন_তোমাকে_দিলাম পর্বঃ১৯ এবং সমাপ্ত

0
4177

এই_মন_তোমাকে_দিলাম
পর্বঃ১৯ এবং সমাপ্ত
#Arshi_Ayat

তিন বছর পর…………..

একদিন রাস্তায় রুহি আর ওর তিন বছরের বাচ্চা রাহিন একসাথে হাটছিলো।ছোট্টো বাচ্চাটা রুহির হাত ধরে ছোট ছোট পা ফেলে হাটছিলো।হঠাৎ পিছন থেকে কারো গলার আওয়াজ শুনে রুহি পেছনে তাকাতেই দেখলো আকাশ দাড়িয়ে আছে।আকাশকে দেখে রুহি অবাক হলো।আকাশ ধীরে ধীরে রুহির সামনে এসে দাড়ালো।তারপর বলল”কেমন আছো,রুহি?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি?”

“ভালো নেই।”

“দেখতেই পাচ্ছি।কিন্তুু ভালো না থাকার কারণ কি?ভালো থাকতেই তো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে।”

“হ্যাঁ সেটাই আমার জীবনের বড় ভূল ছিলো।তোমাকে ডিবোর্স দেওয়ার পর নাতাশা অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছিলো।সেই সময়টায় আমি বুঝেছিলাম তুমি আমার কতোখানি জুড়ে ছিলে।ভেবেছিলাম তোমার কাছে মাফ চাইবো।কিন্তুু পারি নি।প্রত্যেকটা মুহুর্ত মৃত্যুসম লাগতো।কয়েকবার আত্নহত্যাও করতে চেয়েছিলাম কিন্তুু তাও পারি নি।এক পর্যায়ে চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলাম।বাবা মা এ অবস্থা দেখে বলেছিলে আবার বিয়ে করতে কিন্তুু করি নি।ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সৌদি আরবে চলে গিয়েছিলাম।কিছুদিন হলো দেশে ফিরেছি।”

“আর বিয়ে করো নি কেন?”

“ইচ্ছে করে নি।”

“আর নাতাশা?তারপর কি আর যোগাযোগ হয় নি?”

“না তবে শুনেছি সংসারে কলহের কারণে কয়েকদিন আগে আত্মহত্যা করেছে।”

“ওহ!”

“হ্যাঁ,তারপর বলো তোমার কি খবর?”

“যাচ্ছে ভালোই।”

হঠাৎ আকাশ রাহিনের সামনে বসে পড়লো।তারপর রুহির দিকে তাকিয়ে বলল”আমাদের ছেলে?”

“নাহ!শুধু আমার ছেলে।তোমার না।”

“কিন্তুু…….”

আকাশকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রুহি বলল”কোনো কিন্তুু নেই।তিনবছর আগের কথা মনে পড়ে?এই বাচ্চার জন্য তুমি আমাকে কম অত্যাচার করো নি।একে মেরেও ফেলতে চেয়েছিলে।তাহলে এখন কোন মুখে বলতে এসেছে তোমার ছেলে?যদি শুধু তুমি আমাকে কষ্ট দিতে আমি তোমাকে তোমার ছেলে দিয়ে দিতাম কিন্তুু না তুমি ওকে ও কষ্ট দিয়েছো।গর্ভাবস্থায় একটা মেয়ে সবসময় তার ভালোবাসার মানুষটা তার স্বামীকে চায়।চোখে থাকে হাজারো স্বপ্ন।কিন্তুু আমার ক্ষেত্রে এমন হলো কেনো আকাশ?আমি কি তোমাকে কম ভালোবেসেছিলাম?আমার ভালোবাসার কি এই প্রতিদান? তারপর বাচ্চা প্রসবের সময় একটা মেয়ে বাচা মরার মাঝখানে থাকে।সে নিজেও জানে না সে বাঁচবে কি না!সেই সময়টা একটা মেয়ে তার ভালোবাসার মানুষটাকে খুব করে চায় কারণ তার কিছু হয়ে গেলে যেনো বাচ্চাটা নিরাপদ থাকে।কিন্তুু আমি!আমি পাই নি তোমাকে আকাশ!তারপর যখন বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখলো তখনও তুমি ছিলে না।ওকে তিনটা বছর আমি একা লালন পালন করেছি।ওর বাবা, মা সব আমি।কই তখন তো তুমি ছিলে না।ওর কাছে তুমি মৃত।আর সারাজীবনই থাকবে।এটাই তোমার শাস্তি!”

এটা বলেই রুহি রাহিনের হাত ধরে আবার হাটা শুরু করলো কালো অতীতকে পিছনে রেখে।চাইলেই তাদের সুন্দর একটা সংসার,হাসিখুশি সব থাকতো কিন্তু নিয়তি যেনো মেনে নিতে পারে নি।

রাহিন হাটতে হাটতে রুহিকে জিগ্যেস করলো”মাম্মাম,প্রিয় আঙ্কেল আজ আসবে না?”

“আসবে তো বাবা।তোমার আঙ্কেল সন্ধ্যায় আসবে।”

রাহিন খুশী হয়ে গেলো প্রিয়মের আসার খবর শুনে।রুহি মুচকি হাসলো রাহিনের খুশী দেখে।ছেলেটা কতো অল্পতেই খুশী হয়!রুহি একটু হাটাহাটি করে বাসায় ফিরলো।রুহি প্রতিবারই বাসায় এসে একটা আনন্দ পায়।হয়তো নিজের বাসা বলে।তিনবছরের পরিশ্রম এই বাড়িটা।এখন কিছুরই কমতি নেই।বাব মা আর রাহিনের সাথে এখানেই থাকে এখন।নিজের দুটো শোরুম আছে।আরেকটা কয়েকদিনের মধ্যেই প্রস্তুত হবে।আর কি লাগে!পর্যাপ্ত টাকা পয়সা সব আছে কিন্তু ভালোবাসা নেই!রুহি এটা নিয়ে আফসোস করে না।কিন্তুু মাঝেমধ্যেই খুব একাকীত্ব অনুভব করে।আর প্রিয়ম!সে তো তিনবছর ধরে কতোবার রুহিকে “ভালোবাসি” বলেছে তার হিসেব নেই।কিন্তু রুহি স্পষ্টভাবে বলেছে”আমার ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে।অবশিষ্ট বলতে কিছু নেই যে আপনাকে দিবো।একজীবনে যতোটুকু ভালোবাসা আছে সব তাকেই দিয়েছি।এখনো তাকেই ভালোবাসি।আপনি যদি বন্ধু হয়ে থাকতে চান তাহলে আমার আপত্তি নেই।কিন্তুু প্লিজ আমাকে ওসব বলবেন না।

এর পরও প্রিয়ম হাল ছাড়ে নি কিন্তু রুহির উত্তর একই।তাই এখন আর বলে না।কিন্তুু ভালোবাসা ঠিকই আছে।

ঘড়িতে সময় ৮.৩০………..

প্রিয়ম রুহির বাসায় এসেছে।হাতে কয়েক প্যাকেট চকলেট এনেছে রাহিনের জন্য।রাহিন খুশীতে আত্নহারা হারা হয়ে চকলেট গুলো নিয়ে বলল”প্রিয় আঙ্কেল তুমি খুব ভালো।”

প্রিয়ম মুচকি হেসে বলল”তুমিও।”

তারপর গাল এগিয়ে বলল”একটা চুমু দাও তো।”রাহিন চট করে প্রিয়মের গালে চুমু খেয়ে দৌড়ে চলে গেলো।রাহিন যেতেই রুহি আসলো চা নিয়ে।প্রিয়মের হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে নিজেও নিলো।তারপর বলল”কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ।তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি।তো কি খবর?”

প্রিয়ম একটা বিয়ের কার্ড হাতে দিয়ে বলল”মা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।বিয়েটা করতেই হবে।”

“করে ফেলুন।”

“আরেকবার ভাবো রুহি।সত্যি কি করে ফেলবে।”

“ভাবাভাবির কিছু নেই।করে ফেলুন।”

প্রিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল”আচ্ছা,আজ তাহলে উঠি।শুক্রবারে বিয়ে।আসবে কিন্তু!”

“অবশ্যই।”
এরপর প্রিয়ম চলে গেলো।প্রিয়ম যাওয়ার পর রুহি ঘরে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল”আকাশ তুমি আমাকে শেষ করে দিয়েছো!!!”

—————————-

অরুণী বিষন্ন চেহারায় জানালা দিয়ে দাড়িয়ে আছে।কয়েকদিন ধরে দেখছে প্রণয় কেমন যেনো পাল্টে গেছে!আগের মতো কথা বলে না।ভালোও বাসে না।ফিরতেও দেরি করে।কেমন যেনো হয়ে গেছে।এই প্রণয় আর আগের প্রণয়ের কোনো মিল নেই।হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ পড়তেই অরুণী গিয়ে দরজা খুলে দিলো।প্রণয় দাড়িয়ে আছে।অরুণী দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই প্রণয় ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে বলল”অরুণী খাবার দাও।আজকে অনেক টায়ার্ড।”

“আচ্ছা বসো।”

অরুণী প্রণয়কে খাবার বেড়ে দিলো।প্রণয় চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে গেলো।একবারও জিগ্যেস করলো না ‘তুমি খেয়েছো কি না?’অরুণী অভুক্ত পেট আর অভিমানী মন নিয়ে ঘরে গিয়ে বলল”শোনো।কাল একটু বাসায় আসবে।”

“কেনো?”

“ভুলে গেলে?”

“মনে পড়ছে না।”

“আচ্ছা থাক।তুমি কাল তাড়াতাড়ি চলে এসে এতেই হবে।”

“না, না অরুণী।কাল কোনোভাবেই তাড়াতাড়ি আসা যাবে না।বসের সাথে জরুরি মিটিং আছে।”

“প্লিজ,চেষ্টা করো তাড়াতাড়ি আসার।”

“আচ্ছা দেখবো।তুমি এখন যাও আমি কাজ করবো।”

অরুণী চলে গেলো।
——————
অনেক্ক্ষণ ধরে প্রণয়ের আশায় বসে আছে অরুণী।আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী!কিন্তু এখনো প্রণয়ের আসার নাম নেই।এক সময় অরুণী রাগে দুঃখে কেক,পায়েস সব ফেলে দিলো।ঘরে এসে নিজের সাজগোজ মুছে আগের মতো হয়ে গেলো।

প্রণয় রাত ১০ টা বাজে ফিরেছে।অরুণী প্রণয়ের সাথে একটা কথাও বলে নি।শুধু খাবার বেড়ে দিয়েছে।প্রণয় খাবার খেয়ে ঘরে চলে গেলো।সেও কোনো কথা বলে নি।

এভাবেই দিন কাটছে ওদের।অভিমান,অভিযোগের পাল্লা বড়ো থেকেও বড়ো হচ্ছে!সেদিকে কোনো খেয়াল নেই প্রণয়ের।

হঠাৎ একদিন প্রণয়ের কাছে ফোন এলো।ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল”মিসেস অরুণী রহমানের অবস্থা ভালো না!আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।”

প্রণয় খবরটা শুনেই বাসায় চলে এলো।বাসার সামনে আসতেই দেখলো অ্যাম্বুলেন্সে তরুণীকে নেওয়া হচ্ছে।প্রণয়ও সাথে গেলো।চিন্তায় ঘাম ছুটে যাচ্ছে।হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বলল”অবস্থা খারাপ।পাকস্থলীতে ক্যান্সার হয়েছে!প্রচুর রক্তবমন হচ্ছে।”

প্রণয় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল”ডাক্তার প্লিজ ওকে বাচান।”

“আমরা চেষ্টা করবো।আমার মনে হয় আপনার স্ত্রী খাওয়া দাওয়ার প্রতি অনেক অনিয়ম করতো!”

“আমিতো জানি না।আমিতো ব্যাস্ত থাকি কাজে।আপনি প্লিজ কিছু করুন।”

‘আচ্ছা ঠিকাছে আপনি শান্ত হোন আমি দেখছি।”

ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে চলে যাওয়ার পর প্রণয় কান্নায় ভেঙে পড়ালো।সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করছে সে! কিন্তুু সব তো অরুণীর জন্য করতো।অরুণী যেনো ভালো থাকে কিন্তুু এসব করতে করতে যার জন্য করছিলো সব তারই খেয়াল রাখতে পারলো না।

ডাক্তার তিন ঘন্টা পর বাইরে এসে বলল”দুঃখীত,আমারা পারি নি।”

প্রণয় দৌড়ে অরুণীর কাছে গিয়ে দাড়ালো।অবিরাম ধারায় চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।অরুণী বেডের সামনে বসে ওর হাত ধরে কাঁদতে লাগলো।

একসপ্তাহ পর………
একদিন প্রণয় অরুণী শাড়িগুলো দেখছিলো হঠাৎ একটা শাড়ির ভাঁজে একটা চিরকুট পেলো।প্রণয় খুলতেই দেখতে পেলো ওতে লিখা ছিলো”আপনাকে কতোটা ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না।কিন্তুু কখনো বলতে পারি নি।যাওয়ার আগে একবার বলতে চেয়েছিলাম কিন্তুু হলো না।ভালো থাকবেন।”

প্রণয় চিরকুট টা হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কাদতে লাগলো।

সমাপ্ত।

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।এতোদিন ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য।এর পরের গল্প নিয়ে ফিরে দেরি হবে।ততোদিন ভালো থাকুন,সুস্থ থাকুন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here