একগুচ্ছ_কালো_গোলাপ?পর্ব_২

0
7309

একগুচ্ছ_কালো_গোলাপ?পর্ব_২
#লাবিবা_তানহা_লিজা

?
ভোর সাড়ে পাচটায় সাবিনা এসে লাবিবাকে ডেকে গেছে নামায পড়ার জন্য । সাড়ে ছয়টায় এ এসে দেখে সেই অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে । কাথা টান দিয়ে বলে
– উঠ উঠ নয়টা বাজে স্কুলে কখন যাবি ?
– আর পাচ মিনিট ।
– হায়রে সাড়ে নয়টায় assembly . কখন কি করবি ? উঠ উঠ ।
চোখ ডলতে ডলতে ডুলতে ডুলতে বাথরুমে ডুকে লাবিবা । আধা ঘন্টা পরে সাবিনা খাবার এনে দেখে ঘরে নেই । বাথরুমের দরজা এখনো বন্ধ। এগিয়ে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে
– লাবিবা ..এই লাবিবা…এত্তোখন লাগে ফ্রেস হতে ? বাথরুমে কি রান্নাবারা করে খাইতে বসছিস ?
– আসতাছি ।
দরজা খুলে চোখ ডলতে ডলতে বের হলো লাবিবা । সাবিনা রেগে বলে
– বাথরুমে এতোক্ষন ঘুমালি তুই !! কাল থেকে সকালে উঠে ঘুম না ছাড়া পর্যন্ত তুই বাথরুমে ডুকবিনা । বাথরুম লক করে রাখবো আমি । চল তোকে ব্রাশ করাই ।
লাবিবাকে এক হাত ধরে টেনে নিয়ে বাথরুমে নিয়ে যায় । ফ্রেশ করিয়ে এনে মুখে ব্রেড পুরে পুরে দেয় ।
– খাওয়া শেষ হলে পড়তে বসবি ।
– আজকে তাহলে স্কুলে যাবো না !! বাসায় থাকবো.. Uff lovely?
– একঘন্টা পড়বি তারপর যাবি ।
-কয়টা বাজে ? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা পাচ বাজে । হাসিখুশি মুখটা চুপসে গিয়ে চোখ ছল ছল করে উঠে । খাবার ছেড়েই উঠে বলে – আরেকটু ঘুমোলে কি হতো ? একটু শান্তিতে ঘুমোতেও পারিনা । থাকবো না এখানে । কেউ ভালুপাসেনা । আব্বু কই ?
– কাজে গেছে । আসতে দেরি হবে আজ ।
– …uff lovely?.
এক দৌড়ে uniform পড়ে নিয়ে রেড়ি হয়ে ব্যাগ কাধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । পেছন থেকে সাবিনা চিল্লাচ্ছে – কোথায় যাচ্ছিস ? এতো সকালে স্কুলে গিয়ে কি করবি ? লাবিবার কোন উত্তরপায় না ।

পিচডালা রাস্তার পাশ দিয়ে লাফাতে লাফাতে হেটে যাচ্ছে লাবিবা । প্রত্যকটি পায়ের আঘাতে আঘাতে পাথর গুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হচ্ছে । মাঝারি পাথর গুলো বল বানিয়ে খেলতে খেলতে হাটছে । লম্বা কোমড় পর্যন্ত ঝুটি দুটোও লাফানোর সময় লাফিয়ে উঠছে । সকালের শিরশির করা বাতাস এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মুড়িয়ে নিচ্ছে । হাটতে হাটতে লাবিবা চলে এসেছে অন্য পথে । স্কুলে আসার দুটো পথ । রেগুলার যে পথে যাতায়াত করা হয় সেই পথে হেটে স্কুলে পৌছতে সময় লাগে মিনিমাম পনের মিনিট । আরেক পথে সময় লাগে চল্লিশ মিনিটের মতো । এই লম্বা পথেই আজ এসেছে লাবিবা সময় পেয়েছে জন্যে । অবশেষে সে দাড়িয়ে পড়ে এক বিশাল বাড়ির সামনে যার জন্য কষ্ট করে এতোটা পথ তার হেটে আসা । মুগ্ধ চোখে রাস্তায় দাড়িয়ে নজর রাখে সেই বাড়ির দিকে । এই রাস্তায় যে কেউ এলেই কিছুক্ষনের জন্য এই বাড়ির দিকে তাকাবেই । বিশাল দুতলা বাড়ি , বাড়ির বাইরের পরিবেশ দেখেই লোকজন মুগ্ধ হয়ে যায় । সুন্দর ফুল ফলের বাগানে ঘেরা বাড়িটি । বাড়ির ডিজাইনিং গেইট , বাউন্ডারি ওয়ালগুলোর উপর হারিকেন লাইট , বাড়ির সামনের রাস্তার দু পাশে ফুলের বাগান , বসার জন্য বেঞ্চি সব মিলিয়ে অপরুপ সৌন্দর্যে ঘেরা । কিন্তু লাবিবা কে এগুলোর কিছুই মুগ্ধ করে না । তাকে মুগ্ধতার আবেশে ছেয়ে নেয় বাড়িটির এক কর্নারে দু তলা সহ জুড়ে থাকা বিশাল সেই কালো গোলাপের গাছটি । যার প্রত্যেকটা আনাচে কানাচে ফুটে রয়েছে অজস্র কালো গোলাপ । যার সৌন্দর্য শুভ্রতা আজ টেনে এনেছে লাবিবা নামের ছোট মেয়েটিকে। অতি চঞ্চল মেয়েটি ও এই সৌন্দর্যে অবিভূত হয়ে ভুলে যায় তার সত্বাকে । শান্ত হয়ে যায় তার পৃথিবী । নিস্পলক চোখে শুষে নেয় #একগুচ্ছ_কালো_গোলাপের স্নিগতাপূর্ন সৌন্দর্যকে । সুযোগ পেলেই চলে আসে এই বাড়ির সামনে কালো গোলাপ বিলাস করার জন্যে। তার খুব ইচ্ছা সে এই ফুল গুলো নিবে । কিন্তু কখনো এই বাড়ির ভিতরে যেতে পারে না । কারন এটি এমপি ফিরোজ খানের বাড়ি । কড়া সিকিউরিটি । লাবিবার আব্বুর সাথে ফিরোজ খানের খুব ভালো সম্পর্ক তাই এই বাড়িতে তার ভালোই যাতায়াত আছে । কিন্তু লাবিবাকে নিয়ে আসা হয়নি কখনো । গেইটের সামনে দারোয়ান বসে ছিলো । লাবিবাকে হাতের ইশারায় ডাক দিলে লাবিবা এগিয়ে আসে সামনে । দারোয়ান আকবর মিয়া এক গাল হেসে বলে
– কি মা জননী ? কেমন আছো ? অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম গো ।
– আলহামদুলিল্লাহ কাকা । আসবো কিভাবে বলো ..তুমি যেমন এই বাড়ি পাহারা দাও আমাকেও আব্বু পাহারা দেয় । আর এতোটুকু রাস্তা হেটে আসা যায় নাকি ?? পা ব্যথা করবে আমার ।
– তা কিভাবে এলে ? আব্বু কোথায় ?
– সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আব্বু নেই । কোথায় নাকি গিয়েছে । আসতে দেড়ি হবে । সেই সুযোগে বেরিয়ে এলাম ।
– হা হা হা তাই নাকি ? গোলাপ দেখা হয়ে গেছে ? বাড়িতে গাছ লাগাতে পারোতো ।
– লাগিয়েছিলাম । অক্কা খাইছে । জিন্দা হইলেও কি এর মতো এত সুন্দর হবে ? শুধু দেখেই গেলাম । নিতে আর পারলাম না ।
– সে ঠিক বলেছো । এই গাছ অনেক বছরের । এই বাড়ির ছোট সাহেব যখন হাটতে শিখেছিলো তখন নাকি গাছ লাগানোর সময় ছোট ছোট হাতে এই গাছ লাগিয়েছিলো সেই দেড় বছর বয়সে । ছোট সাহেবের খুব প্রিয় যত্মের এই গাছ । ছোট সাহেব ছাড়া কেউই এই গাছ ফুল ছোয়ার সাহস পায় না ।
– ওওওওওও তাই নাকি ? । খুবি ডেন্ডেরাজ বিশয় আশয় । তোমাদের ছোট সাহেব বুঝি তেলাপোকা চচ্চরি , টিকটিকির কাবাব, মাকডসার রেজালা , ব্যঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ খেয়ে ডেন্ডেরাজ হয়েছে ?
– yackk.. কি বলো এসব ?
– তুমি বুঝবেনা । বুঝার বয়স হয় নাই এখনো । আমি গেলাম । আর শোন আব্বুকে ভুলেও বলোনা কিন্তু আমি এসেছিলাম কেমন ?
– আচ্ছা আচ্ছা ।

ছাদে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলো তানভীর । হটাৎ নিচের দিকে চোখ পড়তেই দেখে দারোয়ানের সাথে একটা uniform পড়া মেয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলছে । চেনা চেনা লাগে ভাবতে ভাবতেই চিনে ফেলে মেয়েটাকে । এতো সেই মেয়ে যার সাথে car accident হতে হতে বেচে গেছে । কিন্তু এখানে কি করে ? ভাবতে ভাবতে নিচেই চলে আসে তানভীর । দারোয়ানের কাছে গিয়ে দেখে লাবিবা নেই চলে গেছে। দারোয়ানকে বলে
– এখানে একটা মেয়ে দাড়িয়ে ছিলো uniform পরা ।
– লাবি মনি মা । ইসমাইল চ্যায়ারমেনের মেয়ে ।
– হুম । এখানে কি করছিলো ?
– আর বলবেন না ছোট সাহেব ..আপনার ঐ গোলাপ ফুলের গাছ দেখার জন্য আসে মাঝে মাঝে । ওর খুব প্রিয় কালো গোলাপ । লুকিয়ে আসে । চ্যায়ারম্যান সাহেব যেন না জানে ।
– ওহ আচ্ছা ।
– ও আচ্ছা ।

টেবিলে খেতে বসেছে সবাই । সোহানা ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে । তানভীর খেতে খেতে বলে – পাপা আমি কাল চলে যাচ্ছি । এই দুই দিনেও যেহেতু গন্ডগোল করেনি মনে হয়না আর করবে ।
ফিরোজ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে – তোমার কোন কাজ নেই ঢাকায় আপাদত । যে কয়টা দিন দেশে আছো এখানেই থাকো ।
– ওকে ভেবে দেখবো । বাট কাল যেতে হবে ।
– ঠিক আছে ।

পরদিন দুপুর বেলা স্কুল মাঠে দুই দলে কোন্দল শুরু হয় । ফিরোজ সাহেব শুনে দলের ছেলেদের কাছে খবর পাঠায় গন্ডগোল না করতে । শান্তি বিরাজ করতে । অযথা মারামারি না করে সরে আসতে সেখান থেকে । কিন্তু দলের ছেলেরা সরে আসতে চেয়েও সরে আসতে পারে না । উল্টো রিরোধীদলের প্রতিনিধী হাসান এর দল ফিরোজ দলের ছেলেদের আটকিয়ে উস্কিয়ে দেয় । শুরু হয় মারামারি । হটাৎ স্কুল খুলা টাইমে এইভাবে মারামারি শুরু হওয়াতে ছাত্ররা ভয় পেয়ে যায় । টিচার রা ছাত্রছাত্রীদের হল রুমে নিয়ে আসে তারাতাড়ি করে । হেডটিচার মুক্তার খেয়াল হয় তার শালিকা তো স্কুলে এসেছে । কোথায় ও ? খুজে খুজে বের করে দেখে বেস্ট ফ্রেন্ড নুপুরকে চেপে ধরে ভয়ে শুকনো মুখ করে দাড়িয়ে আছে । কাছে যেতেই লাবিবা এসে কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে
– ভাইয়া কোন দল কোন দল মারামারী করছে ?
– ফিরোজ আর হাসানের দল ।
– আব্বু কি আসছে এখানে ? আমি সিউর আব্বু আসছে । আব্বু পরিষধেই ছিলো ।
– আরে না আসে নাই । তুই ভয় পাস না ।
বাইরের প্রত্যেকটি আওয়াজে লাবিবার বুক ধরফর করতে থাকে । ভয়ে কান্না চলে আসে । মুক্তাকে ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাড়ায় । বাইরের লোকগুলো লাঠি দিয়ে মারামারি করছে । হটাৎ দেখে একটা গাড়ি এসে থামলো । গাড়ি থেকে তানভীর কে নামতে দেখেই চিনে ফেলে এইতো সেই ডলফিন । তানভীর নেমেই হাতা ফোল্ড করতে করতে এগিয়ে এসে সামনের লোক গুলো কে ধোলাই করতে শুরু করে । কুস্তিগিরী বডির সাথে কেউ পেরে উঠে না । পুরো দলের অর্ধেকের বেশী লোক গুলোকে ধোলাই করার পর হটাৎ করে সব এক জোড় হয়ে তানভীরের উপর ঝাপিয়ে পড়ে নিজেদের শরীরের জ্বালা মিটাতে । কারন বিগত কয়েক বছর থেকে প্রত্যেক গোলোযোগের সময় তানভীরের হাতে সবাইকে ন্যাস্ত হতে হচ্ছে । ঘটনা বেগতিক দেখে দুই ইউনিয়নের দুই চেয়ারম্যান আর তিন মেম্বার ভিড়ে ঢুকে তানভীর কে সেফ করতে । এর মধ্যে ইসমাইল ও ছিলো । তানভীরকে আনতে গিয়ে তাদের শরীরেও কয়েক ঘা পড়েছে । এদিকে তানভীরের এমন ফাইট দেখে লাবিবা ভয়ে কাপতে থাকে । যখন ইসমাইলকে দেখতে পায় তখন তার প্রানটা হাতে । এতোক্ষনে কোন্দল প্রায় থেমে গেছে । ছাত্রছাত্রীরা বাইরে বের হতে শুরু করেছে । লাবিবা বের হতে নিলে মুক্তা আটকাতে নিলেও লাবিবা দৌড়ে বেরিয়ে আসে । আব্বু আব্বু করে কাদতে কাদতে চিল্লাতে চিল্লাতে দৌড়ে আসতে থাকে । ইসমাইল ডাক শুনে দেখে লাবিবা । কাছে আসতেই নিজের সাথে চেপে ধরে বলে
– ভয় পাইছো আব্বু ? কিচ্ছু হয় নাই তো । কাদে কেনো ? ভয় পাইও না । তুমি তো আমার সাহসী বাচ্চা ।মুক্তা কই ? ধরে নাই তোমারে ?
– আব্বু তোমাকে মারছে । কই মারছে ? কই ব্যথা করতেছে তোমার ?
– আমায় মারে নাই তো ।
– আমি দেখছি তোমার কাধে লাঠি লাগছে ।
তখনি মুক্তা এসে দাড়ায় । ইসমাইল মুক্তাকে বলে
– ধরবানা তুমি ওকে ? দেখতে দিছো কেন ? ভয় পাইছে তো ।
মুক্রা কিছু বলে না । ইসমাইল লাবিবার চোখ মুছে চেপে ধরে কান্না থামায় । আব্বুকে জড়িয়ে ধরে চুপ চাপ তানভীরের দিকে তাকিয়ে থাকে । তানভীর ও অনেকক্ষন থেকে এক দৃষ্টিতে লাবিবাকে দেখছিলো । দুজনার চোখ দুজনের দিকে । লাবিবা শান্ত চোখে চোখ পিট পিট করে । বড় বড় পাপড়িতে নোনা পানির ছলছল খেলা গভীর নয়নে দেখতে থাকে তানভীর । ইসমাইলের কথায় হুস ফিরে ।
– বাসায় যাও তানভীর । তোমার পাপা ফোন করেছিলো ।
– শালারা আমি চলে গিয়েছি ভেবে গোলযোগ শুরু করে দিয়েছে । অর্ধেক রাস্তাও যেতে দিলো না । শালা গুলার জন্য ফিরে আসতে হলো ।
– ইলেকশন হলো কয়েকদিন আগে । এখন একটু করবেই । জিততে পারে নাই তেজ দেখাবোই । দুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবো । তোমার হাতে লাগছে । চলো বাসায় যাও ।
– গাড়িতে উঠেন কাকা । পৌছে দিতেছি । আর এইযে , আম্মুনিকা হরলিক্স খাওয়াকা বাচ্চিকা । এতো ভয় কিসের ? আব্বুর মতো হও । অনেক সাহসী অনেক শক্তিশালী ।
লাবিবা কোন উত্তর না দিয়ে আব্বুকে আরো শক্ত করে ধরে তানভীরের দিকে তাকিয়েই চোখ পিট পিট করে ।
ভেজা চোখের পিটপিটানি যে এতো ভালোলাগা ছড়িয়ে দেয় তা এই প্রথম দেখছে তানভীর । তানভীর এসে গাড়ির গেইট খুলে দেয় । ইসমাইল লাবিবাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে ।

To be continue _________

®লাবিবা____?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here