#একচিলতে_হাসি
#লেখিকা_আলিশা_আঞ্জুম
দৌড়ঝাঁপ করে নিজের অসুস্থ শরীর নিজের কাছেই বড্ড উটকো মনে হচ্ছে। তবুও মুখে আমার এক চিলতে হাসি ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। আমার অধরকে আমি হসপিটালে নিয়ে আসতে পেরেছি। ইরফান ভাইয়াকে অসংখ্য কেন কোনো প্রকার ভাষাতেই কৃতজ্ঞতা জানাতে পারবো না। উনি শুধু আমার প্রাণের মানুষটাকে নয়, আমার আত্নার সাথে সম্পর্কিত অধরকে নয় আমাকেও এই মুহূর্তে হসপিটালে ট্রিটমেন্ট করিয়েছেন। ঐ সময় অধরের রক্তাক্ত দেহ উনি নিজের গাড়িতে তোলেন। আমায় ও অধরকে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছাতে উনি এতটুকু গাফিলতি করেননি। অতি সতর্কতার সাথে উনি অধরকে ভর্তি করিয়ে আমার তদারক করেন। শরীর আমার বেজায় নিষ্প্রতিভ, অনুত্তেজক। ভাইয়া আমাকে একটা সেলাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি সেই স্যালাইন হাতে ধরে নিয়ে অধরের ও. টি. এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি। আমায় কেউ আটকে রাখতে পারেনি বেডে। আমার মন যে মানে না! আমার অধরকে ওরা এতক্ষণ ধরে কি করছে? আমার আত্না তো ধড়ফড় করছে। কেউ কোন সংবাদ আনছে না কেন? সে করুনাময়, আমি হতভাগা স্ত্রীর মিনতি তুমি ফিরিয়ে দিও না। নিশ্চয়ই তুমি মহান, আর আমি পাপিদের অন্তর্ভুক্ত।
মনে মনে এসবই বলে দোয়া করছিলাম। চোখের পানি বাঁধভাঙা হয়ে গলা ছাড়িয়ে গেছে। আমার অজ্ঞাতে হঠাৎই কেউ হাত রাখে আমার বাহুতে। আশ্চর্য হলাম সাথে কিছুটা চমকে উঠলাম। ঝটপট পেছন ফিরে দেখি ইরফান ভাইয়ার বউ। উনাকে দেখার সাথে সাথে ভেতর থেকে আটকে রাখা কান্না তীব্র বেগে কান্না ছুটে বাইরে আসতে চাইলো। এখনই কেঁদে দিতাম হাউমাউ করে। কিন্তু সচকিত হতেই দেখি আমার শশুর শাশুড়ি। হয়তো ইরফান ভাই জানিয়েছেন তাদের। আমার শাশুড়ি একাধারে চোখের অবাধ্য জল মুছেই চলেছে। শশুড়ের মুখে গাঢ় অসহায়ত্ব। আম্মার অবস্থা দেখে সত্যিই বুকটা কষ্টে কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার। আমি উত্তেজনায় পাশে বসা ভাবির হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম।
সময় যাচ্ছে আপন গতিতে। সেকেন্ড গিয়ে, মিনিট পেরিয়ে ঘন্টা হলো। প্রায় দুঘন্টা পরে ডাক্তার গুলো ঝুপ ঝুপ করে বেরিয়ে এলো ও. টি. থেকে। আমি লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু কিছু বলার সাহস হলো না আম্মা, আব্বার সামনে। উনারাই কথা বললেন ডাক্তারের সাথে। একটা মিষ্টি মুখী মেয়ে ডাক্তার। তার মিষ্টি হাসি দেখে বুঝলাম অবস্থা হাতের বাইরে যায়নি। মনে মনে লক্ষ কোটি শুকরিয়া আদায় করলাম। আমার স্বামী ভালো আছে।
.
অধরকে বেডে আনা হয়েছে। আম্মা, আব্বা ঘিরে রেখেছে তাকে। আমি তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। আম্মা আকুল হয়ে কাঁদছে। উনি চাপা স্বভাবের। আমি দেখেছি সব কথা, অনুভূতি প্রকাশ করার সক্ষমতা উনার নেই। এখনো সে বিশাল সমুদ্র ভরা কষ্ট বুকে চেপে ডুকরে কেঁদে চলেছে। চোখে, মুখে ছিটিয়ে রেখেছেন শাড়ির আঁচল। শশুর আব্বার চোখেও পানি টলমল করছে। অধর মুখ ফিরিয়ে রেখেছে তাদের থেকে। হয়তো তার চোখও শুষ্ক নয়। চলল কিছুক্ষণ মা, বাবা, ছেলের নীরবে দুঃখ নিবারণ। শুধু চোখে চোখে কথা হলো তাদের। মুখে কেউ কোন এক দ্বিধায় বাঁক ফুটাতে পারলো না। একসময় আমার শাশুড়ি হয়তো অভিমান করে চলে গেলেন ছেলের সম্মুখ থেকে। শশুর আব্বাও চলে গেল আম্মার পিছু পিছু। কিছু মুহূর্ত অধর মৌন হয়ে তাকিয়ে রইল তার মা বাবার দিকে। অতঃপর আমি তার চোখে ধরা পরতেই মিষ্টি হাসলো। ডেকে উঠলো আমায়।
— তিশু?
অধরের ডাক শুনে আমি আকুল হয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেলাম তার কাছে। জানি না কেন, কোন এক অদৃশ্য কারণে আমিও মৌন হয়ে গেলাম। কি বলবো, কি করবো কিছুই না বুঝে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম অধরের পাশে। অধরই কথা ব্যায় করে বলে উঠলো
— শরীর কেমন তোমার? আমি যখন এক্সিডেন্ট হই তখন তুমি ঠিক ছিলে?
বিশ্বাস হবে না হয়তো কারো। কিন্তু আমি অধরের আদর দেখে আবেগে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। এতো চিন্তা করে সে আমায় নিয়ে? চোখ ভরা জল নিয়ে বলে উঠলাম
— একদম ঠিক ছিলাম না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তোমার ওপর রাগ হচ্ছিল। তুমি কেন বেখেয়ালি ছিলে?
অধর হাসলো। চোখ চিকচিক করছে তার। ভীষণ কষ্ট যেন সে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। মুগে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে সে বলল
— তিশু আমি বেখেয়ালি ছিলাম না। আসলে আল্লাহ সয়নি আমার পাপ। তিশু জানো? আমার মন বলে আম্মাকে আমি বন…. বন্ধ্যা বলেছি বলে আমার শাস্তি হলো।
অধরের কথায় কেবলই আমি নির্বাক। বলার মতো কিছুই পেলাম না।
.
বাড়ি যাওয়ার সময় হয়েছে সবার। আমার শাশুড়ি এই সময় জেদ ধরলেন। তিনি থাকবেন ছেলের কাছে। প্রচুর ইচ্ছে ছিল অধরের পাশে থেকে ওর সেবা করবো। কিন্তু মায়ের আদরও তো তুচ্ছ নয়। অবশেষে শাশুড়ি কে রেখে আমায় নিয়ে আমার শশুর বাড়ি আসতে চাইলেন। ঠিক তখনই আম্মার নিষেধাজ্ঞা। উনি সটান বলে দিলেন আমাকে উনার প্রয়োজন। বুকটা আমার ধক করে উঠল। জানি না শাশুড়ি কি বলবে আমাকে। অধর ঘুমিয়ে গেছে। আমি ওর পাশে বসে অপেক্ষায় আছি। আম্মা কখন এসে আমায় কি বলবে। ঠিক এই সময় আবার আমার ছোট্ট হৃদপিন্ডে আগুন জ্বালাতে হাজির হলো সেই মিষ্টি মুখী ডাক্তারটা। এখন আর আমার তাকে মোটেও মিষ্টি মুখী বলতে ইচ্ছে করে না। সে হলো আমার জন্য বিষ মুখী। শাকচুন্নী, কচুর লতি, চুন পানি, অভদ্র, জঘন্য, লুচ্চা মহিলা। উফ! গলি মনে পর। এই ডাক্তার লারকি কে গালি না দিলে আমার আত্না শান্তি হবে না। মন তো চায় ওর চুল ধরে ঘূর্ণির মতো ঘুরানি দেই। লুচু মেয়ে খালি আমার অধরের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। এক ঘন্টা আগেই তো! সে কি সেবা শুরু করে দিয়েছিলো আমার অধরের। উঁহু! হুঁ! অধর শুধুই আমার। যদি আমি সুস্থ থাকতাম বা ও ডাক্তার না হতো তাহলে আমি কি ভয়ংকর চিজ ওকে বুঝিয়ে দিতাম।
অঝোরে মনে মনে ননস্টপ গালি বলছিলাম। হঠাৎ আম্মার ডাকে সচকিত হই। থতমত খেয়ে যাই। আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখি আম্মা ইয়া বড় চোখ বানিয়ে তাকিয়ে আছেন। বেশিক্ষণ না তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। আম্মা আচমকা বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। উপায়, দিশা না পেয়ে হতাশা নিয়ে আমিও তার পিছু নিলাম। হসপিটাল রুগি, লোকের আনাগোনা। আম্মা দেখি করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ভয়ে ভয়ে অজানা আশঙ্কা নিয়ে পা বাড়ালাম তার দিকে। কাছে গিয়ে নরম সুরে ডেকে উঠলাম
— আম্মা? কি যেন বলতে চেয়েছিলেন।
— হ্যাঁ। তিশু তুমি যথেষ্ট বুঝবান। শোন আমার কথা, মোটেও উত্তেজিত হবে না। দেখো তিশু আমার অঢেল সম্পদ। আমার যদি একটা বংশধর না থাকে তাহলে কেমন হয় এটা বলো? তুমি আমার জায়গায় থাকলে নিশ্চয়ই তুমিও একটা বংশধর চাইতে।
আম্মাকে আমি বরাবরই সম্মান করি। মুখে হাজার কথা এসে টোকা দিলেও কিচ্ছু বললাম না। আম্মা আবার বলে উঠলেন
— তুমি চলে যাও তিশু। আমি তোমার… প্রয়োজনে তোমার পায়ে পরি। আমার ছেলের জীবন নষ্ট করো না। দয়া করো এই মাকে। আমার ছেলেকে সুখী, সুন্দর একটা জীবন গড়ার সুযোগ দাও। মা হয়ে আমি এটা ভিক্ষা চাই তোমার কাছে। আমার সন্তানকে তুমি বাবা ডাক শোনার সুযোগ দাও।
আম্মার চোখে জল। কথাগুলো বলে উনি চোখ মুছে হনহন করে চলে গেলেন। আমার মন প্রশ্ন ডুবে আছে। চোখ ডুবে আছে জলে। সত্যিই কি আমার জন্য অধর সুখী, সয়ংসম্পূর্ণ জীবন পাচ্ছে না? আমি চলে গেলেই সব হবে? মন ভীষণ দূর্বল হয়ে গেল। আম্মার অনুরোধ কি তবে বৃথা যাচ্ছে না? মন আমার বশ করে নিল? মন তো তাই বলছে। আমার জন্য অধর বাবা ডাক শুনতে পারবে না। আমি চলে গেলেই সব হবে। আমার পেটে যখন আমাদের বেবি ছিল তখন অধর বারংবার বারো কথা বলেছে
” তিশু, বেবি কবে আসবে? আমি কবে কোলে নেবো? আচ্ছা বেবি কি জন্ম নেওয়ার পরেই আমাকে বাবা ডাকবে? ও কতটুকু হবে? আচ্ছা এতো ছোট বাচ্চা কি খাবে তিশু? ওর পোশাক বাজারে সুন্দর, নরম সাইজের পাওয়া যাবে? তিশু ছোট বাচ্চা আমরা কিভাবে সামলাবো? উফ! আমি ভীষণ এক্সাইটেড।”
এমনও অসংখ্য কথায় সারাদিন কান ঝালাপালা করে দিয়েছে আমার। সত্যিই সে একটা বাচ্চার জন্য অনেক এক্সসাইটেড।
.
পাঁচটা দিন পার করলাম অধরকে ছাড়া। এক মুহুর্তও ভুলে থাকতে পারিনি। প্রত্যেক রাতে চোখের পানিতে তাকে স্মরণ করেছি অনন্যভাবে। আম্মার কথাগুলো শুনে সেদিন সোজা বাবার বাড়ি চলে এসেছি। মা বাবা আমার সবকিছু জানে। কিচ্ছু করার নেই কারো। ভাগ্যের লিখন অখন্ডনীয়। বেলকনিতে বসে বসে এসবই ভাবছি। ভাবনারাও আজকাল জ্বালাপোড়ায় দগ্ধ হয়ে দেয় হৃদয়। উফ! ভাববো না। কয়েকটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পরবো। এই অধরের চিন্তা করলে চলবে না। সে তো একবারও খোঁজ নেয়নি আমার। নিশ্চয়ই সুখে আছে ভালো আছে। মনে মনে সেও হয়তো চেয়েছিল আমি ভালো……
ভাবনা আমার এখানেই স্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। আমি শূন্য অনুভূতির কোঠায়। কোনো এক আকস্মিক থাপ্পড়ে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেছে। ভীষণ অবাক আমি। কে থাপ্পর দিল? আমার তো কোন এইরকম বদমাইশ টাইপ ভাই বোন নেই! পেছন ঘুরে চাইলাম। প্রচন্ড রেগে গেছি। অজ্ঞাত ব্যক্তির মুখ দর্শন করার সথে সাথে আমি বাকরুদ্ধ! অধর? অধর দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। চোখে মুখে অশ্ব গতিতে রাগ ছলকে ছলকে পরছে। আমার চাহনি গাঢ় হওয়ার মুহূর্তে সে আবারও থাপ্পর দিল আমার গালে। ভয়ঙ্কর রাগ মিশ্রিত তার সুর
— বেশি বুঝিস তাই না? কে বলছে তোকে চলে আসতে? আমি বলছি? এসে যেখানে সেখানে লুকিয়ে পরো তাই না? অন্যের কথা মাথায় থাকে না? তোরা নারী জাত আসলেই বেশি বুঝিস। আম্মা তোকে কি না কি বোঝালো আর তুই চলে আসলি? আমার কথা ভাবলি না?
ঝুপ ঝুপ করে চোখের জল ফেলছি। সেই সাথে গিলছি আদরের ধমকাধমকির। অকল্পনীয়! অধর আসবে আমি কখনো ভাবিনি। তার কথায় বুঝতে পারছি আম্মা তাকে সব বলেছে হয়তো। আমি মুখ তুলে অধরের দিকে চাইলাম। মুখ খুলবো ঠিক সেই মুহূর্তে সে আবারও ধমকে উঠল
— একটাও কথা বলবি না। তোকে আমার গলা চেপে মারার ইচ্ছে হয়েছে। কেন চলে আসলি? আমার উপর তোর ভরসা নেই?
আমি জানি না কেন খিলখিল করে হেসে উঠলাম। হয়তো আনন্দে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছি। ভীষণ আনন্দ লাগছে। অধর বকেই চলেছে আমাকে। নিজেও নিজেকে বকছি। আসলেই পাগল আমি। যুদ্ধ এবং ভালোবাসার কাছে সব হার মানে। এখানে একটু অপরাধ করে বেহায়া হয়ে থাকা মহা পাপ নয়। মনে মনে ঠিক করলাম, আর কখনো কোন কিছুতেই প্রিয় মানুষের মুখ থেকে ছাড়ার কথা না শুনে এক পাও নড়বো না তার থেকে। অধর তুই তোকারির ঝড় তুলেছে। সে কখনো আমায় তুই সম্বোধন করেনি। জানতাম না! এই তুই শব্দের মধ্যেও এত্তো মধু আছে। আমার শুধু চোখ ভরা জল নিয়ে মুখ ভরে হেসে যেতে ইচ্ছে করছে। অধরের উড়াধুড়া বকার মধ্যেই খপ করে তার হাতটা মুঠোয় পুরলাম। আকস্মিক কাজে অধর হতভম্ব হয়ে একদম স্তব্ধ। আমি পরম ভালোবাসা নিয়ে বললাম
— প্রিয়, তুমি বিশ্বাস দিয়ে বাঁধন দিও
এইভাবেই আজীবন আগলে রেখো
আমি সব দুঃখ হাসিমুখে মেনে নেবো
তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।
আমার কথার প্রত্যুত্তরে দূরকল্পনীয় ভাবে দেখি অধরও সুর মেলালো। রাগী চোখে দুম দুম করে আমার উপর রাগ ঝাড়ু দিয়ে বলল
— প্রিয়া, এরপর তুমি শুধু বেশি বুঝে দেখো?
তোমার পা ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেবো।
আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম অধরের বাণীতে।
সত্যিই! প্রিয় মানুষ শক্ত করে হাত ধরতে শিখলে বাঁধন কেউ খুলতে পারে না। এতোই সহজ! ভালোবাসার বাঁধ ডিঙিয়ে দুঃখের বন্যায় প্লাবিত করা? মোটেও না। এক চিলতে হাসি কেউ কাড়তে পারবে না সত্যি ভালোবাসায় আসক্ত জুটিদের।
সমাপ্ত
[ অন্নেক বড় হওয়ার জন্য দুঃখিত। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। হ্যাপি রিডিং ]