একটাই তুমি ??,সূচনা_পর্ব
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
তোকে যেন আর কোনোদিন আমার সামনে শাড়ি পড়ে আসতে না দেখি ইনায়াত!!’
সামনে থাকা ব্যক্তিটির এমন ঝাঁঝালো কন্ঠস্বরে রুহ কেঁপে উঠলো ইনায়াতের। এই একমাত্র ব্যক্তি যাকে কি না বাবার পরে যমের মতো ভয় পায় ইনায়াত। ব্যক্তিটি আর কেউ নয় ইনায়াতের কাজিন স্পন্দন। সম্পর্কে ফুফাতো ভাই হলেও ইনায়াতকে মনে হয় নিজের চোখের বিষ মনে করে যেটা ইনায়াতের ধারণা। যৌথ ফ্যামিলির কারণে ইনায়াতের ফ্যামিলি আর স্পন্দনের ফ্যামিলি এক সাথেই এক বাসায় ই থাকা হয়!
স্পন্দনের মুখে রাম ধমক শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নিজ ঘরের দিকে দৌড় দেয় ইনায়াত। রুমের দরজাটা বন্ধ করে খাটের উপর বসে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে সে।
ইনায়াত:’ লোকটা এমন কেন? যখনই কথা বলে তখনই ধমকের সুরে কথা বলে। জীবনে তো কোনদিন আমার সামনে হাসি মুখে কথা বলল না। জন্মের পর বোধহয় তার মুখে কেউ মধু দিতে ভুলে গিয়েছিল!’
আয়নার সামনে বসে বসে একমনে হাতের চুড়ি, কপালের টিপ এক এক করে খুলে নিল ইনায়াত। তার কথা একটাই আর কোনদিন শাড়ি পড়বে না সে! কত কষ্ট করে বান্ধবীদের কথায় আজ প্রথমবারের মতো শাড়ি পড়েছিল সে। তাও আজ ভার্সিটিতে নবীন বরণ উৎসব ছিল বলে!
‘কিন্তু তা আর হলো কই? এই শুধু এই স্পন্দন ভাইয়ের জন্য আজ সবটুকু পানিতে গেল। ব্যাটা, খবিশ কোথাকার!’
মনে মনে হাজারটা গালি স্পন্দনকে বিড়বিড় করে দিতে থাকে ইনায়াত।
এদিকে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে স্পন্দন। মাথার চুল গুলো পেছনের দিকে টেনে মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছু একটা বিড়বিড় করে বলছে সে।
স্পন্দন:’ কতদিন! আর কতদিন এভাবে নিজেকে ওর কাছ থেকে গুটিয়ে রাখবো? নিজেকে যে সামলানো বড় কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
ড্রয়ার থেকে একটা ছবির ফ্রেম বের করে স্পন্দন। ছবিটায় একটা মেয়ের ছবি যে কিনা আনমনে বসে আছে আকাশপানে চেয়ে। চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো। ছবিটায় হাত বোলাতে বোলাতে একসময় বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে সে। তারপর বাহিরের দিকে চেয়ে বলতে থাকে,
স্পন্দন:’ কবে বলবো তোমায় আমার মনের জমানো সেসব কথা? কবে বুঝবি আমায় ! কবে বড় হবি তুই ইনায়াত!!’
কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেয় ইনায়াতের মা মিসেস তানহা। বাহির থেকে একটি মেয়ে মুচকি হেসে সালাম দেয়। মিসেস তানহাও সালামের উত্তর দিয়ে বলে উঠে,
মিসেস তানহা: ‘ আরে নিধি, ভেতরে এসো মা!’
নিধি ভেতরে প্রবেশ করে। মিসেস তানহার সাথে টুকটাক আলাপের পর সে বলে,
নিধি: ‘ আন্টি ইনায়াত কোথায়? ও কি রুমে?’
মিসেস তানহা হ্যাঁ বলতেই নিধি পা বাড়ায় ইনায়াতের রুমের দিকে।
রুমের দরজায় টোকা পড়তেই টনক নড়ে ইনায়াতের। বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতেই কেউ মাথায় চাটি মারে তার। খেয়াল করতেই দেখে নিধি রাগান্বিত চোখে দাঁড়িয়ে আছে।
ইনায়াতকে দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় আপনাআপনি নিধির।
এবার সে একটু জোরেই ধমক দেয় ইনায়াতকে। বলে,
নিধি: ‘ কিরে তোর আর তোর রুমের এই অবস্থা কেন! খেয়াল আছে কটা বাজে? আজকে নবীন বরণ উৎসব আর তুই এখনো রেডিই হস নি! নবাবজাদী কোথাকার!’
ইনায়াত মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। ঐ স্পন্দন ভাইয়ের জন্যেই তো আমার সব রেডি হওয়া শেষ হয়ে গেল। ব্যাটা শয়তান!
ইনায়াতকে এভাবে বিড়বিড় করতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেল নিধি। কাঁধে ঝাঁকুনি দিতেই ধ্যান ভেঙ্গে যায় ইনায়াতের। সে খেয়াল করে নিধি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
এভাবে তাকাতে দেখে ইনায়াত কিছুক্ষণ পর দাঁত বের করে হেসে দেয়। যা দেখে নিধিও পাগলি বলে আলমারির কাছে চলে গেল।
আলমারি খুলে একটা গাঢ় সবুজ রঙের চুড়িদার বের করে ইনায়াতের সামনে ধরে। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে বলে,
নিধি: জাস্ট পাঁচ মিনিট দিলাম তোকে। যা রেডি হয়ে আয়। নাহলে তোর অবস্থা আরো খারাপ করে দিব আমি।
ইনায়াতও মুখ ভেংচি কেটে চলে যায়।
ভার্সিটি প্রাঙ্গণে সুবিশাল স্টেজ সাজানো হয়েছে। তাছাড়া চারপাশেও রয়েছে নানা ধরনের কারুকাজ। নবীন বরণ উৎসবের কারণে ভার্সিটির সব স্টুডেন্ট এক সাথে উপস্থিত হয়েছে।
ইনায়াত এবার অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর নিধি হলো ইনায়াতের একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। এককথায় বোনের মতো।
ভার্সিটি প্রাঙ্গণের থেকে ঠিক পশ্চিম প্রান্তে বিশাল এক কদম ফুলের গাছ। গাছটার নিচে বসার জন্য আসন ও রয়েছে গুটিকয়েক। প্রায় স্টুডেন্টদের আড্ডা কেন্দ্র হওয়ায় এ জায়গা কদমতলা নামেই বেশ পরিচিত।
ইনায়াত আর নিধিও বর্তমানে সেই জায়গাটাতেই আছে।
ইনায়াতের এবার বেশ রাগ লাগছে। নিধি ওকে দাড় করিয়ে আরামসে ফটোশুট শুরু করেছে। তাও গত একঘন্টা যাবৎ।
এবার ইনায়াত কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই নিধি একপ্রকার চিল্লিয়ে উঠে,
স্পন্দন!
নামটা শুনেই পেছনে ফিরে তাকায় ইনায়াত। বাইকের হেলমেট খুলে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিচ্ছে স্পন্দন। ব্লাক কালার পাঞ্জাবি, হোয়াইট পাজামা। হাতে ম্যাচিং ওয়াচ আর চোখে সানগ্লাস।
ব্যাস! সকল মেয়েদের হার্টবিট মিস করানোর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
স্পন্দন!পুরো নাম স্পন্দন চৌধুরী। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান। অনার্সের ফাইনাল ইয়ার অর্থাৎ চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সে।আর ভার্সিটির প্রায় সকল মেয়েদের ক্রাশ।
বাইক পার্কিং করে নিজের বন্ধুমহলের সাথে যোগ দেয় স্পন্দন। এদিকে ইনায়াতের অজান্তেই একজোড়া মায়া ভরা দৃষ্টি ছুঁয়ে গিয়েছে তাকে তা সে হয়তো জানেও না।
নিধির দিকে চোখ গরম করে তাকাতেই বেচারী ভয়ে মিইয়ে যায়।
মনে মনে বলতে থাকে,
ইনায়াত:’ এই লোকের সমস্যা কি! নিজে একদম ড্যাশিং হয়ে সেজে এসেছে আর আমাকে? আমাকে শাড়িটা পর্যন্ত পড়তে দিলো না। আর মেয়েগুলোও লুচু একেকটা! কিভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।
পরপর কয়েকবার গালি দিয়ে শান্ত হলো ইনায়াত।
রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে গিটারের টুংটাং শব্দ আর কারো গলার ঘোর লাগানো সুর ভেসে আসছে বারান্দা বরাবর। চোখের মধ্যে ঘুম ভাব থাকলেও মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে সেই প্রিয় চেনা সুরের। এক পর্যায়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় ইনায়াতের। ঢুলুঢুলু চোখে পা বাড়ায় ব্যালকনির দিকে। কাছে আসার পর যেন অজানা ঘোরের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ ইনায়াত।
স্বপ্নের বালুকায় কেউ কি পা লুকায়
যদি না আসে ভেজা দিন!!
ইচ্ছের হিমালয় হয়না কভু ক্ষয়
হৃদয়ে থাকে অমলিন!
কিছু স্বপ্ন কিছু ইচ্ছে
এই আমায় টেনে নিচ্ছে
তোমার কাছে বারবার…
কেউ না জানুক আমি তো জানো
আমি আমার
ওওও.. কেউ না জানুক তুমি তো জানো
তুমি আমার…
স্পন্দনের ঘোর লাগানো কন্ঠে গানটা শুনে ইনায়াতের চোখে যেন পূর্বের থেকেও এক প্রশান্তির ঘুম এসে তাড়া দিচ্ছে। স্পন্দন প্রায়শই গভীর রাতে গিটার নিয়ে ব্যালকনিতে বসে পড়ে আর সুর তোলে। আর সেটারই সুযোগ নিয়ে ইনায়াতও সবসময় চুপি চুপি ব্যালকনিতে এসে স্পন্দনের গিটারের টুংটাং শব্দ আর গান শোনে। উপর আর নিচতলা বরাবর একই রুম হওয়ায় ব্যালকনিও পাশাপাশি। গান শোনার এক পর্যায়ে ব্যালকনিতে বসেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় ইনায়াত। আর এদিকে স্পন্দনও তার গিটার রেখে রুমে চলে যায়। মাঝরাতে হুটহাট সুর তুললে কেন জানি তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি মেলে।
সকালের মিষ্টি রোদ চোখে পড়তেই ভ্রু দুটি আপনাআপনি কুঁচকে যায় ইনায়াতের। চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করে বারান্দায়। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই আনমনে হেসে দেয় সে। দেয়াল ঘড়ির দিকে খেয়াল করতেই দেখে ঘড়িতে সকাল ৮:০০ টা বাজে। রাতে দেরী করে ঘুমানোর জন্য বেশ দেরি করেই ঘুম ভেঙ্গেছে ইনায়াতের।
ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে নেয় ইনায়াত। ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং রুমে যেতেই দেখে টেবিলে বসে আয়েশ করে ব্রেকফাস্ট করছে স্পন্দন। আর ইনায়াতের মা মিসেস তানহাও সাদরে খাবার বেড়ে দিচ্ছে স্পন্দনের পাতে। মাঝে মাঝে ভেবে পায় না ইনায়াত নিজের ঘর থাকতে এ বাসায় এসে পড়ে থাকার কারণ।
এদিকে ইনায়াতের দিকে চোখ যেতেই বারবার তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে স্পন্দন। পরনে পার্পেল রঙের লং কুর্তি, স্বচ্ছ সাদা রঙের হিজাব পেঁচানো, চোখে কালো কাজল আর ঠোঁটের কোণে কালচে একটা তিল! ব্যাস স্পন্দনকে ঘায়েল করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
চেয়ার টেনে টেবিলে বসতেই মিসেস তানহা বলে উঠে,
মিসেস তানহা: ‘ ঘুম থেকে উঠেছিস তাহলে! নে তারাতাড়ি খেয়ে নে। আর শোন আজকে এক কাজ কর, তুই স্পন্দনের সাথে ভার্সিটি চলে যা।’
এতক্ষণ আনমনে বসে পাউরুটি চিবুচ্ছিলো ইনায়াত। মায়ের কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলে সে। মনে মনে বলে,
ইনায়াত: ‘ এই স্পন্দন ভাইয়ের সাথে যাওয়া আর যমের সাথে যাওয়া এক কথা। ব্যাটা খবিশ কোথাকার!’
কিছুটা আমতা আমতা করতেই স্পন্দন বলে উঠে,
স্পন্দন: ‘ তারাতাড়ি খেয়ে নেও। আমি বাহিরে আছি।’
স্পন্দনের বলা গম্ভীর কন্ঠ শুনে মনে মনে দোয়া দূরুদ পড়তে থাকে আর নাস্তা করে নেয় ইনায়াত।
বাহিরে আসতেই দেখে স্পন্দন বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ইনায়াতকে দেখে চোখের ইশারায় ডাকতেই সেও চলে যায়। বাইকের হেলমেট পরে স্টার্ট দিতেই ছুটে চলে দুজন ভার্সিটির উদ্দেশ্যে!
চলবে?