একটি বিবাহত্তোর প্রেমের গল্প,পর্ব ৩

0
1009

একটি বিবাহত্তোর প্রেমের গল্প,পর্ব ৩
তামান্না জেনিফার

সকালে ঘুম থেকে উঠেই অপার ভীষণ মন খারাপ হয় ৷ ইশশ কেমন হুট করে ঘুমিয়ে গেলো ৷ এটা কোন কথা ! না জানি সুমন ভদ্রলোক কি ভাবছেন ৷ আসলে এমন ধকল গেছে বিয়ের , এতটা ক্লান্তি গেছে , কখন ঘুমিয়েছে নিজেই জানেনা ..ভদ্রলোক সোফায় ঘুমাচ্ছে ৷ তাকে আর ডাকে না অপা ৷ নিজে নিজে তাড়াতাড়ি পোশাক বদলিয়ে তৈরী হয়ে নেয় ৷ তারপর ঘরের বাইরে পা রাখে ৷ পুরো বাড়ির কেউ এখনো উঠেনি , অপার খুব চা তেস্টা পেয়েছে ৷ সে ভাবে নিজেই তৈরী করে নিবে ৷ রান্নাঘরে গিয়ে দেখে শ্বাশুড়ি উঠে পরেছে , নাস্তার যোগারযন্ত্র করতেছে .. অপা মৃদু পায়ে গিয়ে তার পাশে দাড়ায় ৷ এই অপরিচিত মানুষটি এখন থেকে তার মা , তার ছত্রছায়ায় থাকবে অপা ৷ অপাকে দেখে মৃদুহাসি দেন সুজলা রহমান , অপার শ্বাশুড়ি ৷

—এত সকালে উঠে পরেছো যে ? রাতে ঘুম হয়েছে ঠিক মতো ? খোকন বললো তোমার বালিশে অসুবিধা হচ্ছিলো ?

—তেমন সমস্যা হয়নি আন্টি , না মানে মা .,

—হা হা হা , প্রথম প্রথম মা ডাকতে একটু অসুবিধা হবে , সমস্যা নেই , ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে ৷

—মা , আপনাকে চা করে দেই ?

—না , না , তুমি বসো , আমরা বরং গল্প করি ..

অপার মনে হলো তার শ্বাশুড়ি মানুষটা বেশ ভালো ৷ কাজের খালা চোখ ডলতে ডলতে রান্নাঘরে এলো , ততক্ষনে নাস্তা বানানো প্রায় হয়ে গেছে ৷ শ্বাশুড়ি পরিচয় করিয়ে দিলো তার সাথে অপার “অপা ইনি আমাদের সাথে দীর্ঘদিন আছেন ৷ সুমন আর রিয়া ইনাকে মাজেদা খালা ডাকে , তুমিও তাই ডেকো ৷ ”

মাজেদা খালা থালা বাসন সব রেডী করে টেবিলে সাজাতে থাকে ৷ ততক্ষনে সুমন , ওর ছোট বোন রিয়া আর অপার শ্বশুড় রাশেদুর রহমান নাস্তা খেতে টেবিলে এসে গেছে ৷ অপা বুঝতে পারলো এরা সবাই একসাথে খায় , ওদের বাড়িতে এই নিয়ম নাই ৷ যার যখন ইচ্ছা খেয়ে নেয় ৷ নাস্তার টেবিলে সবার সাথে টুকটাক কথা হলো ৷ সুমনকে সে নিজে দাড়িয়ে থেকে খাওয়ালো , কাল রাত্রের কথাগুলো নিয়ে ও একটুও ভাবছে না , বরং সবাইকে কেমন যেন আপন মনে হচ্ছে ৷ এক রাতের মধ্যে এই মানুষগুলোকে কেন এত আপন লাগছে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা অপা ৷

সুমন অফিস যাবার পথে রিয়াকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দেয় , ওরা দুজন তাই সবার আগে বেরুলো ৷ তারও ঘন্টা খানেক বাদে অপার শ্বশুড় চলে গেলো অফিসে , তিনি ব্যাংকে চাকুরি করেন ৷ সবাই চলে যাবার পর অপার কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগতে থাকে ৷ বাড়িটা কেমন যেন নৈশব্দপুরী ৷ ওদের বাড়িতে এমন ছিলো না , সারাক্ষন আশে পাশের লোকজন যাতায়াত করতো , বাড়িটা ভরা থাকতো সবসময় ৷ অপা রুম থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে গিয়ে বসে ৷ মাজেদা খালা বসে রান্নার যোগারযন্ত্র করছে , সব রেডি হয়ে গেলে তার শ্বাশুড়ি এসে রান্না করবে ৷ মাজেদা খালা মজার মানুষ ৷ পান খেতে গুটগুট করে গল্প করছে , পানের রসে তার ঠোঁট পুরো লাল হয়ে গেছে ৷

—নয়া বউ , কিরাম লাগতাছে শ্বশুড়বাড়ি ?

—এইতো বেশ ভালোই ৷ অবশ্য এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না ৷

—বসেন , মোড়াডা লইয়া বসেন ৷ আপনের লগে গফসফ করি ৷ এই বাড়ি হিস্টোরি কই ৷ সব তো আপনের জানোন লাগবো , নাইলে বুজবেন ক্যামতে কে কিরাম !

—আচ্ছা বলেন ৷

—কার হিস্টোরি আগে কমু ! এই বাড়িত সব আছে , খালি কতা কওনের মানুষ নাই ..

—হুমম তাইতো দেখছি

—আপনের শাউরিরে দিয়া শুরু করি ৷ বিরাট ভালা মানুষ , তয় তার বিরাট একটা অসুখ আছে ৷ আল্লার লীলা বোঝন বড় দায় ৷ এই যে এই বাড়িত আছি দশ বছরের উপরে , কুনুদিন আমার লগে খারাপ ব্যবহার করেনি , কোনদিন রাগ হয়নাই .. অথচ আল্লা তারে দিলো কঠিন ব্যামো ৷ আহারে , যতবার মনে হয় কলিজাটা পুড়ে অঙ্গার হয়া যায় আমার প

—কি হয়েছে মায়ের ? দেখে তো সুস্থ মনে হলো ..

—সব আপনেরে দেখানের লাইগা ঢং ধরছে ৷ ক্যান্সার হইছে , দেখেননি , মাথাডা কিরাম ঢাইকা রাখে ! চিকিৎসা করতাছে , আর চুল পরতাছে … চোক্ষের নিমিষে মাথার চান্দি ফাঁকা হয়া গেলোগো নয়া বউ , খালি চাইয়া চাইয়া দেখলাম … কিছুই করতে পারলাম না .. তাও আমি আফারে কইছি , আমার রক্ত লন , চক্ষু লন , গুর্দা লন , তাও আপনে ঠিক হয়া যান .. আমার কি ! গরীবের আবার জীবন মরন .. আফায় আমার কতা শুইনা খালি হাসে ..

—আল্লাহ !

—এই হইলো গিয়া আপনের শাউরির হিস্টোরি ৷ এবার আপনের নন্দের হিস্টোরি শোনেন ৷ হ্যায় কইলাম আফার প্যাটের ছাওয়াল না .. এতীমখানা থেইকা হ্যারে টুকাই আনছে ৷ তয় হ্যায় হইলো এই বাড়ির আসল মালকিন ৷ হ্যায় যদি কইছে আমারে আসমানের চান্দখান আইনা দাও , কথাডা কওনের দেরী কিন্তু এর আগেই দুলাভাই আর সুমন বাবা মই বানাই সারবো চান্দ পারনের লাইগা .. এরার চোক্ষের মনি হইলো রিয়া আফা…

—কি অসম্ভব ব্যাপার ! আমিতো বুঝতেও পারিনি..

—বোঝনের কোন সিসটেম এরা রাখে নাই ৷ আপনের সোয়ামীর হিস্টোরি কইমু কি কইমু না এইডা ভাবতেছি..আমি সাদা মনে একখানা কথা হেইডা লইয়া আপনে যদি সুমন বাবার লগে প্যাচ খেলেন !

—হা হা হা , আরে না খালা , আমি কোন প্যাচ খেলবো না ৷ আপনি বলে ফেলেন ৷ না হলে আপনার পেট ব্যাথা করবে হা হা হা

—কথাডা মন্দ কননি ! আপনের সোয়ামী , পিরিত করছিলো এক পেত্তুনীর লগে ৷ এই বাড়িত যেদিন পরথম দিন আইলো হেই পেত্তুনী আমারে জিগায় ” বুয়া এদের জায়গা জমি কেমন ? এই বাড়ি কি নিজের ? ” আমারে কেউ বুয়া ডাকে না ৷ হ্যায় আইসাই আমারে কয় বুয়া ! আরে পেত্তুনী এরার জায়গা জমিনের খোজ তুই নেস ক্যান ? গেছে গা , সুমন বাবারে থুইয়া বৈদ্যাশ ! এরপর সুমন বাবা পাগল হয়া গেছিলো .. আহারে আমাহ মানিক ! আল্লার কাছে কত কাঁনছি .. যাক এই গুলান কইলাম এই কারনে , চেহারা সুরত আসলে সব ফাঁকি ! আসল হইলো অন্তরখান ৷ নয়া বউ ! আদর , সোহাগ , ভালোবাসা দিয়া সোয়ামীরে আঁচলের তলায় বাইন্ধা রাখো ৷ এরার মত ভালো মানুষ কুনুখানে পাইবা না , এরার জন্য জান দিয়া দিও তাও কারোর মনে কষ্ট দিওনা ..

— আচ্ছা খালা ৷ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো কথা দিলাম ৷ আচ্ছা আমার শ্বশুড় বাবার হিস্ট্রি বললেন না ?

—আপনার শ্বশুর মানুষ নাকি অন্য কিছু তাই বুঝিনা ৷ এই লোক অপিস যায় , বাড়িত আসে , খায় , ঘুমায় আর পেপার পড়ে .. এনার কুনো হিসটোরি নাই ৷ তয় এই লোকটা এক্কেরে একখান বউ পাগলা , বউ ছাড়া দুনিয়া আন্ধার ! নয়া বউ যাও তোমার শাউরিরে ডাইকা আনো , কোটা বাছা শ্যাষ ..

অপা শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে যায় ৷ মনে মনে করুনাময়কে ডেকে বলে ” ইয়া আল্লাহ , আমি জানিনা একদিনে আমি কেন বদলে গেলাম , এমন তো আমি ছিলাম না কখনোই ..এই বড্ড বেশী ভালো মানুষগুলোর সাথেই জীবন কাটাতে চাই.. তুমি কবুল করো মাবুদ ..”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here