একটি ভুল পর্ব-আট

0
227

#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী

শাহেদ দরজা খুলে ওর মাকে বললো,
—–কিছু বলবে মা?
—–সকালে তো লাঞ্চ নিয়ে যাসনি। টেবিলে ভাত বেড়েছি খেতে আয়।
—–ঠিক আছে তুমি যাও আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে আসছি।
ওর মা চলে যাওয়ার পর রিমা আর শাহেদ নামাজ পড়ে নিলো। এরপর শাহেদ রিমাকে বললো,
—–তোমারও তো দুপুরে খাওয়া হয়নি। চল একসাথে খেয়ে নেই।
—-আমাকে দেখলে মা রেগে যাবে। তুমি বরং খেয়ে নাও আমি পরে খাবো।
—-মা রাগলে রাগবে। একসময় মা তোমাকে সয়ে নিবে। তাই বলে তোমার এই শরীরে অভুক্ত থেকো না।
আসলে ক্ষুধায় রিমার মাথাটা চক্কর দিলো। তাই অনিচ্ছা সত্বেও শাহেদের সাথে রিমা খাবার টেবিলে এসে বসলো। রিমাকে দেখে শাহেদের মা শাহেদকে বললো,
—-শাহেদ তুই ওকে বলেছিস ওকে কি করতে হবে?
—-মা এই বিষয়টাতো আমার। এটা আমার উপরেই ছেড়ে দাও।
—–আমি আমার সংসারে আপদ পুষতে পারবো না।
—-তোমাকে তো কেউ আপদ পুষতে বলছে না। আর আপদ প্রমানিত হলে আমিও পুষবো না।
—–কথাটা যেন তোর মনে থাকে। মায়াবিনীর মায়ায় যেন আটকে পরিসনা আবার?
এই কথা বলে ওর মা ওখান থেকে চলে গেল। শাহেদের মা নিজের রুমে গিয়ে সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।

সন্ধার চা বানাতে রিমা কিচেনের দিকে যাচ্ছিলো। ওকে দেখে মর্জিনা বললো,
—–মা তোমাকে কিচেনে ঢুকতে নিষেধ করেছে।
—–কেন? আমি চা বানালে কিসের সমস্যা?
—–মা বলেছে তোমার হাতের কোনো কিছু উনি গ্রহন করবেন না।
রিমা আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে আসলো। মর্জিনা চা বানিয়ে শুধু শাহেদের চা টা ওদের ঘরে দিয়ে গেল। শাহেদ রিমাকে বললো,
—–তোমার চা টা নিয়ে আসো। দুজনে মিলে একসাথে চা খাই।
—–তুমি খেয়ে নাও। আমার এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে না।
মর্জিনা শাশুড়ির রুমে চা আর টোস্ট বিস্কিট পিরিচে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে গেল। এরপর শাশুড়িকে বললো,
—-মা বাচ্চাটা এবরশন করতে শাহেদ ভাই রাজি হয়েছে?
—–আমি তো আমার মত জানিয়ে দিয়েছি। দেখি শাহেদ কি করে? আয়েশা ঘুম থেকে উঠেছে?
—–না,মা উঠেনি।
—–যাও ওকে উঠিয়ে দাও। এরপর উঠলে আবার রাত জাগবে। রাতে আর ঘুমাতে চাইবে না। তোমার মেয়ের জন্য আমার ছেলের রাতের ঘুম হারাম হবে।

মর্জিনা শাশুড়ির রুম থেকে বের হয়ে গেল। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, এতদিন আমাকে আপনারা জ্বালিয়েছেন। এখন আমি আপনাদের কি করে পেইন দেই সেটাই এখন দেখার পালা। মর্জিনার বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে। ও এসএসসি পাশ। ওর ভাইরা মধ্যেপ্রাচ্যে শ্রমিকের কাজ করে। প্রচুর টাকা পয়সা পাঠায়। ওর বাবার ওষুধের ডিসপেন্সারি আছে। এদিকে রাশেদ ঢাকাভার্সিটি থেকে মার্কেটিং এ মাস্টার্স করেছে। ছেলেমেয়েরা যেহেতু শিক্ষিত লেখাপড়ায় ভাল ছিলো সেই অহম রাশেদের মা তার আচার আচরণে ভালোয় বুঝায়। মর্জিনাকে বউ করে আনার রাশেদের মায়ের একটু অপছন্দ ছিলো। কারণ ওর গায়ের রংটা একটু চাপা। তারপরও রাশেদের ইচ্ছাতেই উনি রাজি হয়েছেন। আর রাশেদের একটা সংসারি মেয়ে দরকার। ওর মায়ের সাথে যেন মানিয়ে নিতে পারে। মর্জিনা অবশ্য মানিয়ে নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিন শাশুড়ির মুখে শুনতে হতো গায়ের রং কালো। আবার লেখাপড়া কম জানে। ওর বাবা মায়ের অনেক কপাল সাত পুরুষের ভাগ্যে যে রাশেদের মতো জামাই পেয়েছে। এসব কথা মুখ বুঝে সয়ে সংসার করে যাচ্ছে। শাহেদের রিমার সাথে বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার পর থেকে রাশেদের মা মর্জিনার সাথে ভাল ব্যবহার করে। সেদিন রাশেদ অফিস থেকে আসার পর মর্জিনা রাশেদকে বললো,
—–একটা খবর শোনো রিমা কনসিভ করেছে।
রাশেদ ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেস হয়ে টাওয়েলে মুখ মুছতে মুছতে মর্জিনাকে বলে,
—–এতে অবাক হওয়ার কি আছে। বিয়ে যখন হয়েছে। বাচ্চা তো কনসিভ করবে।
—–মা বলেছে ঐ বাচ্চা শাহেদ ভাইয়ের নয়।
—–শোনো কারো সম্পর্কে না জেনে এরকম কথা বলা শুধু অন্যায় না বরং পাপ হয়। তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে মায়ের সন্দেহের আগুনে তুমি মনে হয় ঘি ঢালছো। এসব নোংরা কথায় সময় নষ্ট না করে আমাকে চা দাও। আমি মায়ের ঘরে আছি।

রাশেদ মায়ের ঘরে গিয়ে বসলো। মাকে বললো,
—-কি ব্যাপার মা এই সময় শুয়ে আছো? তোমার শরীর ভালোতো?
—–মনে শান্তি না থাকলে শরীর কিভাবে ভাল থাকে। এদিকে বিয়ের আগে শাহেদকে কতবার বললাম ঐ মেয়েকে বিয়ে করিস না। তা ওতো আমার কথা শুনলো না। ওর নাকি ঋণ শোধ করতে হবে। তাই বিয়ে করে ও পিতৃঋণ শোধ করবে। এখন দেখ বিয়ের একমাস না হতেই বাচ্চা পেটে নিয়ে বসে আছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে ঐ বাচ্চা আমার শাহেদের নয়।
—–তুমি শাহেদকে জানিয়েছো?
—–জানিয়েছি।
—–ও কি বলছে?
—–ও বলছে ওর ব্যাপারটা ওর উপর ছেড়ে দিতে।
——তাহলে তো হয়েই গেল। তুমি আর এসব নিয়ে কোনো চাপ নিও না। এছাড়া কাউকে সন্দেহ করে কিছু বলা উচিত না। এটাতো অন্যায় আর গুনাহ র কাজও বটে।
—–শোন বিয়ের পরে ও মেরুদন্ডহীন হয়ে গেছে।
রাশেদ একটু বিরক্ত হয়ে ওর মাকে বললো,
—-তুমি সব বিষয়ে মাথা ঘামিও না। যার সমস্যা তাকে ফয়সালা করতে দাও। তোমার ছেলে তো মুখ দিয়ে ভাত খায়। নাক দিয়ে তো খায় না যে ওকে সব হাতে ধরে বুঝাতে হবে।
রাশেদের মা আর কথা বাড়ালো না। মর্জিনা চা এনে রাশেদের হাতে দিয়ে বললো,
—–মা রাতে কি রান্না হবে?
রাশেদের মা একটু ঝাঁঝ দেখিয়ে বললো,
—–এতো দিন বিয়ে হয়েছে কোনো কাজ তো একা করতে পারো না। রাতে রান্না কি হবে সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে।

নানাবিধ টানাপোড়েনে রিমার সংসারের দিনকাল পার হতে লাগলো। অযত্ন অবহেলায় রিমার শরীরটা খারাপ হতে লাগলো। শাহেদের মা রিমাকে দিয়ে উনার ঘরের কোনো কাজ করান না। উনার বদ্ধমূল ধারণা রিমার চরিত্র ভালো না। এই সন্তান উনার ছেলের নয়। আর রিমার সহ্য করে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ওর সংসারের অশান্তি ওর বাবার কানে গেলে ওর বাবা এই ধকল নিতে পারবে না। আর রিমাও এই বাচ্চা এবরশন করবে না তাহলে ওর শাশুড়ি ওর বিরুদ্ধে যে অ্যালিগেশন এনেছে সেটা প্রতিষ্টিত হবে। তাই যত কষ্টই হোক আল্লাহর উপর ভরসা করে এই সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে। তবে রিমার এটুকু সান্তনা শাহেদ মুখে কিছু বলে না তবে রিমাকে বিশ্বাস করে। শাহেদের আচরণে রিমা বুঝতে পারে।

দিনদিন রিমার শরীরটা ভারী হয়ে যাচ্ছে। নিজের একান্ত কাজগুলো করতে রিমার কষ্ট হয়। তাই শাহেদ রিমাকে সহযোগিতা করার জন্য ওর অফিসের পিয়নের দ্বারা একটা বারো বছরের মেয়েকে নিয়ে আসলো। এতে শাহেদের মা মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গেল। শাহেদ অফিসে চলে গেলে রেনুকে ডেকে বলে,
—–আমি তোর স্যারের মা। এখানে থাকতে গেলে আমার হুকুম মেনে চলতে হবে। তুই এখন যা আয়েশার সাথে খেলা কর।
এদিকে রিমা রেনুকে ডেকে পায় না। গোসল করার পর বাথরুমে ওর আর শাহেদের ভিজা কাপড় পড়ে আছে। ওগুলো ধুয়ে ছাদে মেলে দিতে হবে। যদিও এবাড়িতে ছুটা লোক আছে তারপরও শাহেদ বাসায় না থাকলে শাহেদের মা আর মর্জিনা রেনুকে ডেকে ওদের কাজগুলো করিয়ে নেয়। এর মাঝে একদিন রিমা দুপুরে ভাত খেতে বসেছে। গ্লাসের পানি ফুরিয়ে গেলে রেনুকে ডেকে বলে,
—–রেনু জগে একটু পানি দিয়ে যা
রেনু বললো,
—-আপনি নিজে পানি নিয়ে নেন। আমি আয়েশা আপুকে ঘুম পাড়াচ্ছি।
রিমা আবার বলে,
—–তুই ভাবির কাছে আয়েশাকে দিয়ে আমার কাছে আয়।
—–চাচী ঘুমিয়ে আছে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে চাচীর মাথা ব্যথা করবে। আমি আয়েশাকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর আসবো।
রিমা খুব আহত হলো। বাচ্চাটা কনসিভ করার পর ওর শাশুড়ি এক টেবিলে বসে ওর সাথে খায় না। বাড়ির সবাই খাওয়ার পর রিমা খেতে বসে। ওযে একজন প্রসুতি মা এটা এ বাড়ির মানুষগুলো ভুলেই গেছে। আজ দুপুরের খাবার খেতে বেলা চারটা বেজে গেল।। এমনিতেই দিন দিন শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তারপর রেনুকেও ডেকে সবসময় কাছে পায় না। কোনো না কোনো কাজে ওকে ব্যস্ত রাখা হয়।

রিমার প্রেগনেন্সি সময়ের ছয় মাস পার হয়ে গেল।
রিমা জগন্নাথে মাস্টার্সে ভর্তি হবে। এদিকে শরীরটাও বেশ অসুস্থ। সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করতে করতে সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছে। কাল ওর ভর্তির লাস্ট ডেট। শাহেদ অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসার পর রিমা শাহেদকে বলে,
—–কাল আমি একটু জগন্নাথ ভার্সিটিতে যাবো। মাস্টার্সে ভর্তি হবো। ফর্মফিলাপ করে অনলাইনে জমা দিয়েছিলাম। ওরা ভর্তি হওয়ার জন্য মেইল পাঠিয়েছে।
——এই অসুস্থ শরীরে যেতে পারবে?
—–তুমি অফিসে যাওয়ার সময় নামিয়ে দিও। আর আমার কাজ হয়ে গেলে তোমাকে ফোন দিলে তুমি ভার্সিটিতে এসে আমাকে নিয়ে এসো।
—–ঠিক আছে তুমি সামলে নিতে পারলে আমার সমস্যা নেই।
রাতে খাবার টেবিলে শাহেদ ওর মাকে বলে,
——কাল রিমা আমার সাথে অফিসে যাওয়ার সময় বের হবে।
——কেন?
——কাল ওর মাস্টার্সে ভর্তির লাস্ট ডেট। জগন্নাথ ভার্সিটিতে ভর্তি হবে।
—-কিরে আমি কি পাঠশালা খুলে বসেছি? নাকি আমার বাড়িটা এতিমখানা। শোন বিয়ের পর থেকে তোর অনেক সাহস বেড়ে গেছে। ওর আর পড়াশোনা করার দরকার নেই। মন দিয়ে সংসার করুক।

রিমা সবটা শুনে রুম থেকে বের হয়ে এসে বলে,
——মা,আমি মাস্টার্সে ভর্তি হবো।
শাহেদের মা রেগে গিয়ে বলে,
——তুই যদি ওকে মাস্টার্সে ভর্তি করতে ওর সাথে যাস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি।
রাশেদ রেগে গিয়ে বললো,
——সারাদিনপর বাসায় এসে তোমাদের অশান্তির জন্য শান্তি করে একটু ভাতটাও খেতে পারি না। রাশেদ খাওয়া রেখে হাত ধুয়ে রুমে চলে গেল।
শাহেদও না খেয়ে উঠে চলে গেল।

পরদিন রিমা সকালে উঠে রেডি হয়ে ভার্সিটিতে চলে গেল। ভর্তির কাজ শেষ করতে সন্ধা হয়ে গেল। এর মাঝে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। শাহেদ ওকে নিতে আসবে কিনা ও জানে না। কারণ ওর মায়ের কসম উপেক্ষা করে কিভাবে আসবে? চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। ডিপার্টমেন্টের পিয়ন রমিজ বলছে,
—–আপু সন্ধা হয়ে আসছে। বাড়ি যাবেন না?
—–হ্যা যাবো।
রিমা এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। চোখ দুটো কাউকে দেখার আশায় ব্যর্থ হলো। শরীরটারও উঠার শক্তি যেন ফুরিয়ে গেল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here