একটি ভুল পর্ব-তিন

0
232

#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

রিমা ভালবাসার পালে হাওয়া লাগিয়ে কোচিং এর ফাঁকে ফাঁকে জুনায়েদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। কখনও কার্জন হল কখনও টিএসসির চত্বর। রিমার মনে হতে লাগলো জুনায়েদের সাথে ওর প্রেমটা স্বর্গীয় প্রেম। আবেগ আর ইমোশনের মাঝে ওর অনুভূতীগুলো ভোঁতা হয়ে গেলো।
এর মাঝে একদিন জুনায়েদের সাথে রিমা বাইকে করে ঢাকা থেকে অনেকদূরে বেড়াতে বের হলো। জুনায়েদ অবশ্য আগে থেকে রিমাকে কিছু বলেনি। রিমাও জুনায়েদকে বিশ্বাস করে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। রিমার ঐ বয়সে মোহ আর মুগ্ধতা এতো বেশী ছিলো তখন বিশ্বাস আর অবিশ্বাস নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না।
যাই হোক ফার্মগেট থেকে রিমা বাইকে করে জুনায়েদের সাথে রওয়ানা হলো। ও জুনায়েদকে বলেছিল সন্ধার আগে ওকে বাসায় পৌছে দিতে হবে নয়ত অনেক ঝামেলা হবে।
ওরা ফার্মগেট থেকে মিরপুর একনাম্বার হয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে গাজীপুরের পথে রওয়ানা হলো। সময়টা ছিল অগাস্ট মাস। বৃষ্টির সময়। সেদিনও আকাশ কালো করে মেঘ করেছিল। হয়ত অলক্ষ্যে রিমার এভাবে জুনায়েদের সাথে যাওয়ায় প্রকৃতির সেদিন প্রচণ্ড অভিমান হয়েছিল। পরিবেশ দেখে মনে হলো ভয়ানক বৃষ্টি নামবে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘের ডমরু বাজচ্ছে। রিমাও বাইকে বসে ভয় পেয়ে জুনায়েদকে জড়িয়ে ধরছে। রিমার টিনএজার ক্রাশ জুনায়েদ ওকে অভয় দিয়ে বলছে,
—–ভয় কি রিমা? আমি তো তোমার পাশে আছি। তুমি পারবে না আমার হাত ধরে পুরো জীবনটা পাড়ি দিতে?
রিমাও আবেগের জোয়ারে ভেসে বলছে,
—-আমি তোমার সাথে আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারি।

অল্প বয়সের আবেগ ইমোশনগুলো মনে হয় অনেক সময় এমন হয়। কি বলছে আর কি করছে কোন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মানুষের কিছু বয়স থাকে। সে বয়সটা মনের অজান্তে অনেক ভুল কাজ করিয়ে নেয়। আর সারাজীবন ধরে মানুষকে সেই ভুলের মাশুল বয়ে বেড়াতে হয়।

মুষলধারে বৃষ্টি নামল। রিমা বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে। মাথার চুলগুলো সুন্দর করে ভিজে মুখের আশে পাশে লেপ্টে রয়েছে। ফর্সা রঙের রিমাকে জুঁই ফুলের মতো শুভ্র লাগছে। জামা কাপড়ের অবস্থাও বেশ বাজে। শরীরের সাথে এমনভাবে লেগে আছে ভাঁজগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রিমার লজ্জা এবং অস্বস্তি একটা অনুভূতি পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরতে লাগলো। জুনায়েদের বাইক যখন গাজীপুর বোর্ড বাজারের কাছে পৌঁছে গেল রিমা তখন জুনায়েদকে বললো,
—–জুনায়েদ আমার এজমার সমস্যা আছে। এভাবে একটানা বৃষ্টিতে ভিজে ভেজা কাপড়ে জড়িয়ে থাকলে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। তখন আবার আব্বু আম্মুর কাছে ধরা পড়ার ভয় আছে। আমার মনে হয় ফিরে গেলে ভাল হয়। আমরা আর একদিন আসবো।
——Don’t worry baby ম্যায় হুনা।
জুনায়েদ এই কথা বলে বোর্ড বাজারের কাছে একটা শোরুম থেকে রিমার জন্য থ্রীপিচ কিনে নিয়ে আবার গন্তব্যে রওয়ানা হয়। পনেরো মিনিটের মধ্যে জুনায়েদ রিমাকে নিয়ে রিসোর্টে পৌঁছে যায়। তখন দুপুর একটা বাজে। রিমার কেমন যেন ভয় ভয় হতে লাগলো। রুমে ও খাটের এক কোনায় আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলো। জুনায়েদ ওর কাছে এসে বললো,
—–যাও ড্রেসটা চেঞ্জ করে ফেলো। তোমার ভেজা কাপড়গুলো এই ফ্যানের নীচে মেলে দাও। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে সব শুকিয়ে যাবে। রিমা বাথরুমে ঢুকে কাপড় চেঞ্জ করার সময় সেমিজ পড়া অবস্থায় চিৎকার দিয়ে বের হয়ে এসে জুনায়েদকে জড়িয়ে ধরে।জুনায়েদ রিমাকে বলে,
—–তুমি ভয় পেলে কেন?বাথরুমে কি সমস্যা?
——বাথরুমে তেলাপোাকা।
ততক্ষণে রিমাকে এভাবে পেয়ে জুনায়েদ ওর ঠোঁটে শক্ত করে চুম্বন দিলো। রিমাকে পাগলের মতো আদর করতে লাগলো। একসময় জুনায়েদ রিমাকে পুরোপুরিভাবে চাইলো। রিমা জুনায়েদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
—–বিয়ের আগে এসব করা গুনাহ্ র কাজ। আমি পারবো না।
জুনায়েদ বলে,
—–আমরা আজ বিয়ে করবো। তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো তাই না।
—-হ্যা বিশ্বাস করি। বিয়ের জন্য স্বাক্ষী লাগে। স্বাক্ষী কোথায় পাবে?
—-টাকা দিলে বাঘের চোখ মেলে। স্বাক্ষীর ব্যবস্থা কাজী অফিসের মানুষই যোগাড় করে দিবে। তাহলে আর বাঁধা কিসের। আমরা এখান থেকে বের হয়ে আজ বিয়ে করে বাসায় ফিরবো। বিয়ের পরে যে বাসর হতো সেটা না হয় একটু আগেই হলো।
সেদিন জুনায়েদের চাওয়ার কাছে রিমাকে হার মানতে হলো। আজ রিমার মনে হয় সেদিন জুনায়েদ সবটা প্লান করেই করেছে। পাশাপাশি এটাও মনে হয় ওর বাবা মা দুজনেই একটু কড়া প্রকৃতির মানুষ ছিল। মা একটু বেশীই কড়া ছিল। যার কারণে রিমা অনেক কিছু ওর মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারেনি তাই জীবনের এই জটিল দিকগুলো ওর জানা হয়ে উঠেনি। জুনায়েদ ওর কথা রেখেছিল। কারণ রাজকন্যা যাতে হাতছাড়া না হয় সেজন্য রিমার সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এই রাস্তা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা তখন জুনায়েদের জন্য খোলা ছিল না। জুনায়েদের সাথে সেদিন রিমার বিয়ে হয়ে যায়। রিমা ভিতরে ভিতরে অনুশোচনার আগুনে পুড়তে লাগলো। ও কিভাবে বাবা মার সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলো? ওর মনে লাগলো জুনায়েদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে গিয়ে বাবা মাকে অনেক বড় কষ্ট দিয়ে ফেললো।
বাসায় আসতে সেদিন রিমার সন্ধা হয়ে গিয়েছিল। ঢাকাতেও প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। ওর বাবা মা তখনও বাসায় ফেরেনি। রিমা নিশ্চিন্ত বোধ করলো। ঘরে আসার পর তাশদীদ ওর গালে হাত দিয়ে বললো,
—–আপু তোমার গালে এটা কিসের স্পট?
রিমা আয়নায় তাকিয়ে দেখে চমকে উঠে তাশদীদকে বললো,
—-একটা পোকা কামড়িয়েছে।
তাশদীদ চলে যাবার পর ওর ফুফু বললো,
—-পোাকাটার আকৃতি কি মানুষের মতো?
—-ফুফু তুমিতো সব জানো তাহলে আমাকে খোঁচা দিচ্ছো কেন?
—–শোন তোমার বাবা জানতে পারলে কেটে টুকরো টুকরো করে গাঙ্গের জলে ভাসিয়ে দিবেন। কথাটা মনে রেখো।
সেদিন রিমাকে দেখে ওর ফুফুরও ওর মা বাবার উপর রাগ হয়েছিল। বিশেষকরে ওর মায়ের উপর। কারণ মেয়ে শুধু লেখাপড়ায় ভাল হলে হয় না মেয়ের স্বভাবচরিত্রের দিকে মায়ের তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়। রিমার মা চাকরি করে বলে সংসারের পুরোটা দায় রিমার এই দূরসম্পর্কের ফুফুটার উপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চায়। বিনিময়ে কিছু টাকা রিমার ফুফু রাহেলা বেগমের হাতে ধরিয়ে দেয়।উনি ভূলে জান দিনশেষে রিমারা ওদের ব্যক্তিগত বিষয়ে ওর ফুফুর হস্তক্ষেপ মেনে নিবে না। যে শাসন রিমার মা রিমাকে করতে পারবে সেই শাসনটা উনি করতে পারবে না আবার রিমাও মেনে নিবে না। এর থেকে চুপ থাকাই ভাল।

রিমা ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়ে এতো ভয়ে ছিল যে ও খেয়াল করতে পারেনি। ওর গালে একটা লালটকটকে দাগ হয়েছিল। ফর্সা হওয়াতে খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝা যাচ্ছিল। তারপর থেকে কয়েকদিন রিমা ওর মা বাবার মুখোমুখি হয়নি।
এদিকে কয়েকদিন পর রিমার বাবার মোবাইলে অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ আসে। সেখানে রিমার বাবাকে অপরচিত ব্যাক্তিটি বলে,
—-আপনি বলেছিলেন মনে আছে আপনার। পঁচাশামুকে নাকি আপনি আপনার মেয়ের পা কাটতে দিবেন না। কিন্তু পঁচা শামুকেই আপনার মেয়ের পা কেটেছে।
তখন রাত বারোটা বাজে। রিমার বাবা দৌড়ে গিয়ে রিমার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে, রিমা পড়াশোনায় ভীষণ ব্যস্ত। তখন ভেবে নেয় কেউ হয়ত শয়তানি করছে। রিমার বাবা ওর মাকে এই বিষয়টা জানায়নি। কারণ জানতে পারলে মেয়েটার সাথে চিৎকার চেঁচামেঁচি করবে। সামনে ভর্তি পরীক্ষা। পরে পরীক্ষাগুলো খারাপ হয়ে যাবে। প্রথমে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলো। সবাই ভেবেছিল রিমার মতো টপার গার্লের ঢাকাতেই হয়ে যাবে। কিন্তু ওর ঢাকায় না হয়ে কক্সবাজার মেডিকেলে হয়ে গেল। রিমার বাবা মায়ের মন খারাপ হলো। তারপরও রিমার বাবা মা চাইল রিমা যেন কক্সবাজারে ডাক্তারি পড়তে চলে যায়। রিমাও রাজি। কিন্তু বাঁধা দিলো জুনায়েদ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here