একটি ভুল পর্ব-পাঁচ

0
293

#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

রিমার বাবা কোচিং সেন্টারে এসে রিমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। সকালে যে উচ্ছল মেয়েটাকে এখানে রেখে গিয়েছিল সেই মেয়েটা এতো বিমর্ষ হয়ে গেল কিভাবে? আরেফিন সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-রিমা তোর শরীর ভাল আছে তো?
—–হ্যা বাবা আমি ঠিক আছি।
মেয়েটাকে নিয়ে আরেফিন সাহেব বাড়ির পথে রওয়ানা হলেন। আরিফিন সাহেব মেয়েটাকে দেখে ভাবছেন, ছোটোবেলায় ওর সব আব্দার ছিলো উনার কাছে অথচ আজ মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ও অনেক দূরের কেউ। সহজে কোন কথা শেয়ার করতে চায় না। কবে মেয়েটা এতো দূরে চলে গেল উনি টের পেলেন না। মাঝে মাঝে মনে হয় উনারা স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। সেই সকালে দুজনে অফিসে চলে যান আবার রাতে বাসায় ফিরেন। তারপর ছেলেমেয়েদের সাথে দু একটা কথা বলে টিভিতে খবর টকশো এতে ব্যস্ত হয়ে যান। ছেলেমেয়েদের রেজাল্ট ভাল হয় বলে উনার ধারণা সন্তানেরা সঠিক ট্রাকে আছে। আজ মনে হয় ধারণাটা ভুল। শুধু লেখাপড়া দিয়ে নয় আরো অনেক কিছুর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। সন্তানেরা কোথায় যাচ্ছে কাদের সাথে মিশছে ওদের বন্ধুবান্ধবদের সার্কেলটা কেমন এসবের দিকেও নজর রাখতে হয়। নিজের সন্তানদের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে হয়। আজ আরেফিন সাহেবের মনে হচ্ছে প্যারেন্টিং এ অনেক ভুল হয়েছে। এমন সময় মোবাইলে মেসেজের শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখে সেই অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।”আর চব্বিশ ঘন্টা পরে আপনার মেয়ে আপনার সামনে দিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। আপনার কিছুই করার নেই। ভালোয় ভালোয় মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন। নয়ত আপনার মান সম্মানের বারোটা বাজিয়ে দিবো”। আরেফিন সাহেব বাড়িতে এসে মেয়েকে কাছে ডেকে বললেন,
—–তোর কি কারো সাথে সম্পর্ক হয়েছে। আমাকে বলতে পারিস। আমাকে বলতে ইচ্ছে না হলে তোর মাকে বলতে পারিস।
রিমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
—–না, বাবা সে রকম কেউ নেই।
আরেফিন সাহেব ফোনটা বের করে রিমাকে দেখিয়ে বললো,
—-এই নাম্বারটা কি তোর পরিচিত?
রিমা তাকিয়ে দেখলো ওটা জুনায়েদের নাম্বার। ওর আরোও অবাক হওয়ার পালা। জুনায়েদ কয়েক মাস ধরে ওর বাবাকে ব্লাকমেইল করে চলেছে। ও আবারও জুনায়েদের ব্যাপারটা গোপন করে গেল।

সন্ধা হয়ে আসছে। মাগরিবের আযান শোনা যায়। রিমার মা রিমা আর ওর দুভাইকে ওজু করে নামাজ পড়তে বললো। রিমার মা ওর বাবাকে বললো,
—–মাগরিবের আযান দিচ্ছে। ওজু করে এসে ছেলেদের সাথে জামাত করে নামাজ পড়ে নাও।
রিমার মার মনে হলো ওর বাবা যেন উনার কথা শুনতে পেলেন না। অন্য জগতে বিরাজ করছেন। উনি যেন টেনশনে অস্থির হয়ে আছেন। তাই রিমার বাবাকে ওর মা বললো,
—–তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে টেনশনে আছো?
—–তুমি কি আমাকে কিছু বলছো?
—-হ্যা এখানে তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই।
রিমার বাবা মোবাইলের মেসেজগুলো বের করে রিমার মাকে দেখালো। রিমার মা মেসেজগুলো সব পড়ে ওর বাবাকে বললো,
—–তুমি এতোদিন এগুলো আমাকে দেখাওনি কেন?
—–আমার মনে হয়েছে কেউ হয়ত আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছে? আমাদের মেয়ের পিছনে শত্রু লেগেছে।
——তুমি ভুল ভাবছো। এর সাথে তোমার মেয়েও জড়িত আছে। তা,নাহলে ঐ ছেলের এতো বড় সাহস হয় কি করে? মাগরিবের নামাজ আগে পড়ে নেই। তারপর আমি এই ছেলের পরিচয় বের করছি।
—–তুমি আবার রিমাকে মারধর করো না।
এই বিষয়টা এখন তুমি আমার উপরে ছেড়ে দাও।
—–ওকে মারধর করো না। যদি আবার কিছু করে বসে?আজকাল দেখো না কত অঘটন ঘটে?
—–এতো চিন্তা করো না। তোমার মেয়ের ভালোর জন্যই ওর পেট থেকে আমাদের কথা বের করে নিতে হবে। তা নাহলে আমাদের মেয়ের অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে।
রিমার মা মাগরিবের নামাজ পড়ে আল্লাহপাকের কাছে সন্তানের জন্য চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে মোনাজাত করলো। সন্তানের জন্য পিতামাতা দোয়া করলে আল্লাহপাক কবুল করে নেন।
রিমার মা রিমার রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
——এই ছেলের সাথে তোর সম্পর্ক কত দিনের?
রিমা ওর মায়ের কাছে এই সম্পর্কের কথা গোপন করলো না। বিয়ের কথাটা চেপে গেল। তাই ওর মায়ের কথার উত্তরে ও বললো,
—–ওর সাথে দুবছরের সম্পর্ক।
——ও কি করে? ওর বাবা কি করে?
—–ও ঢাকা কলেজে অনার্স পড়ে। আর ওর বাবা গ্রামে থাকে।
—–তুই আমাদের বড় সন্তান। তোকে বিশ্বাস করা আমাদের ভুল হয়েছে। কি করে পারলি এরকম একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করতে। তোর বাবাকে একটানা ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে। দুধ কলা দিয়ে আমি এতোদিন কাল সাপ পুষেছি। তুই কোনদিন এই ছেলের সাথে মানিয়ে নিতে পারবি না। তুই ঐ ছেলের সাথে ব্রেক আপ করে ফেল। একটা ভাল শিক্ষিত ছেলে হলেও নিজেকে সান্তনা দিতে পারতাম। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর না হয় ছেলের সাথে বিয়ে দিতাম। আর এই ছেলে তো দুনিয়ার বদ। একটা আস্ত ছোটো লোক।
রিমা ওর মাকে হ্যা না কিছু বললো না। ওর মা রেগে গিয়ে ওকে কষে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
—–তোর জন্মের সময় যদি জানতাম তুই এভাবে আমাদের বুকে ছুড়ি মারবি আঁতুরঘরে মুখে লবন দিয়ে তোকে মেরে ফেলতাম।
এই কথা বলে ওর মা দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
রিমার আজ আবারও মনে হলো বাবা ওর মায়ের কাছে এই ছেলের সাথে সম্পর্কের কথা শুনে মুষড়ে পড়েছিলো। আর মনে অনেক আঘাত পেয়েছিলো। রিমাকে তো উনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। রিমা উনার কাছে পুরো বিষয়টা লুকিয়েছিলো। আসলে রিমাও আজ বুঝে পায় না মা বাবার সাথে কবে থেকে ওর দুরত্ব তৈরী হয়েছিলো। অথচ ছোটোবেলায় বাবার কাছে সবকিছু শেয়ার করতো।

এসব শুনে তখন ওর বাবার প্রেসার বেড়ে যায়। তাশদীদ সেদিন রিমার ঘরে এসে ঘৃণা ভরে ওকে বলেছিলো,
—–আপু তুমি কিভাবে পারলে বাবা মার মুখে চুনকালি মাখাতে?
মূহুর্তে রিমাদের বাসার পরিবেশ পাল্টে গেল। নিজেকে বড় অপাংঙতেয় মনে হলো। রাতে বাসার কেউ আর ডিনার করেনি। বাড়িটাকে সেদিন শোকের বাড়ি মনে হয়েছিল। জুনায়েদ সেইরাতে রিমার মোবাইলে আবারও মেসেজ পাঠিয়েছে।”তুমি আমার বিয়ে করা বউ। কাল আমি তোমাকে আনতে যাবো। সুড় সুড় করে আমার সাথে চলে আসবে। কোন বাহানা করবে না। তাহলে তোমার বাবার সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিবো”।

জুনায়েদ মনের আনন্দে গোঁফে তা দিতে থাকলো। চিবিয়ে চিবিয়ে আপন মনে বললো,
——আরেফিন সাহেব আমাকে বস্তির ছেলে বলেছেন। পঁচা শামুক বলেছেন। কাল টের পাবেন কত ধানে কত চাল।
জুনায়েদের বোন এসে ওকে বললো,
——বিড় বিড় করে কার সাথে কথা বলছিস।
—–আনন্দের উল্লাস প্রকাশ করছি।
——মেয়েটার সাথে তোর এরকম করা উচিত না। ও লেখাপড়া করতে চাচ্ছে করুক। তুইও লেখাপড়াটা শেষ কর। ও তো এখন তোর বউ। সুতরাং হাতছাড়া হবার কোনো ভয় নেই।
—–লেখাপড়া শিখে কি হবে? এদেশে মামা খালা ছাড়া চাকরি হয় না। তুমি বাঁধা দিও না। অনেক কায়দা করে এই রাজকন্যাকে ফাঁদে ফেলেছি। ভালোয় ভালোয় কালকে খাঁচায় বন্ধি করতে পারলে আমার বাকি জীবন নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।

এর মাঝে চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে গেল। রিমা খুব টেনশনে আছে। কিভাবে পুরো ঘটনাটা সামাল দিবে। বিকালের দিকে জুনায়েদ ওর সাঙ্গ পাঙ্গ সহ দুজন পুলিশ নিয়ে রিমাদের বাসায় হাজির হলো। দরজা নক করলো। রিমার বাবা দরজা খুলে বললো,
—–কাকে চাই।
—–কেন শ্বশুর আব্বা?আমি তো মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে বলেছি আপনার মেয়েকে আজ নিয়ে যাবো।
——কি আবোল তাবোল কথা বলছো? কে তোমার শ্বশুর আব্বা?
—–এই দেখেন আপনার মেয়ের সাথে আমার বিয়ের কাবিননামা।
রিমার বাবা মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যেতে লাগলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here