#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী
তাড়াতাড়ি রিমাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। ডক্টর চেকআপ করে ওষুধ দিয়ে গেছে। হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। কিছুটা সময় এভাবে পার হয়ে গেল। আস্তে আস্তে রিমার জ্ঞান ফিরে আসলো। রিমা ওর মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—–মা আমাকে ক্ষমা করে দাও। বাবাকে বলে দিও আমাকে ক্ষমা করে দিতে। আমি তোমাদের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমরা যদি আমাকে ক্ষমা না করো তা হলে মরে গিয়েও আমি শান্তি পাবো না। এই কথাগুলো বলে ও আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। রিমার বাবা হন্ত দন্ত হয়ে ডক্টরের কাছে গিয়ে বললো,
—–প্লিজ ডক্টর দেখুন না, ওর কি হয়েছে। এক্ষুনি কথা বলতে বলতে সেন্সলেজ হয়ে গেল।
ডক্টর পালস চেক করে বললো,
—–চিন্তা করার কিছু নাই। সব ঠিক আছে। শরীর দুর্বল আর তার সাথে মানসিক চাপ সামলাতে পারছে না বলে এমন হচ্ছে।
ডক্টর ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলো। এর মাঝে দুদিন সময় কেটে গেল। ধীরে ধীরে রিমা আজ
চোখ খুললো। অতিরিক্ত ঘুমের কারণে চোখদুটো ভারী হয়ে আছে। বামহাত তুলতে গিয়ে রিমা দেখলো চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। তাকিয়ে দেখে হাতে স্যালাইনের চ্যানেল করা হয়েছে। উচ্ছল মেয়েটি এখন পুরোপুরি অন্তর্মুখী হয়ে গেছে। সুস্থ হওয়ার পর রিমা ওর বাবা মায়ের সাথে বাসায় ফিরে গেল। এরমাঝে রিমার বাবা জুনায়েদের সাথে রিমার ডিভোর্সের বিষয়টা ফয়সালা করে ফেললো।
রিমা আস্তে আস্তে নিজেকে সবার কাজ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। নিজের ভালবাসার মানুষের কাজ থেকে অসম্মান আর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে রিমা অনেক কষ্ট পেয়েছে। আবার ওর কারণে ওর বাবা মা আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবার কাছে অসম্মানিত হয়েছে। এই বিষয়গুলো ওর ভিতরটাকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। জীবনটার উপর ওর বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। এখন কারো কোনো কথায় রিমার এখন আর কিছু আসে যায় না। কারো সাথে ওর সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছা হয় না। এমনকি তানভীর আর তাশদীদের সাথেও রিমা ভালো করে কথা বলে না। চোখের সামনে বোনটার এই অবস্থা দেখে ওদেরও মনটা বিমর্ষ থাকে। এতো হাসিখুশী পরিবারটা মূহুর্তে বিপর্যস্ত হয়ে গেল।
সন্ধা ঘণিয়ে আসছে। তাশদীদ আর তানভীর ওর বাবার সাথে স্কুল থেকে বাসায় ফিরলো। রিমার মা এখন ছুটিতে আছে। রিমা এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। রিমার ফুফুটাকে রাগ করে ওর মা দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে তো রিমার বিষয়ে সব জানত তারপরও কেন উনাদের জানায়নি?
তাশদীদ যদিও বোনের উপর খুব বিরক্ত কিন্তু তানভীরের রিমার জন্য খুব মায়া হলো। ও রিমার কাছে গিয়ে বসলো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—–আপু তুই এভাবে মন খারাপ করে থাকলে আমার খুব কষ্ট হয়। তুই তাড়তাড়ি নিজেকে সামলে নে। সব আবার নতুন করে শুরু কর।
রিমা কাষ্ঠ হাসি হেসে বললো,
—–তুই কবে এতো বড় হয়ে গেলি ভাই? কেবল তো ক্লাস নাইনে উঠেছিস। অথচ কত সুন্দর করে আমাকে অনেক দামি কথা বললি। আমার মতো কুলাঙ্গার হস না। বাবা মায়ের মনে কখনও কষ্ট দিস না। আমি তো পারলাম না। তোরা দু,ভাই অন্তত বাবা মায়ের স্বপ্নটা পূরণ করিস।
—–আপু এভাবে বলো না। তোমার সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। তুমি ঘুরে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখিয়ে দাও তুমি শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়াতে জানো।
মাগরিবের আযান শোনা যায়। তানভীর ওজু করতে চলে গেল। রিমাও ওজু করে নামাজ পড়ে লাইট অফ করে শুয়ে আছে। এই মূহুর্তে রিমা আর কোনো স্বপ্ন দেখতে চায় না। ডিপ্রেশন ওকে এতটাই গ্রাস করেছে ও ভবিষ্যত নিয়ে আর ভাবতে চায় না। ওর সমস্ত স্বপ্নগুলো নিষ্ঠুর বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে। এখন ওর মনে হচ্ছে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। তবুও যে বাঁচতে হবে। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। আর কার জন্যই বা সে মরতে যাবে আর কেনই বা মরবে যিনি তার জীবন দান করেছেন তারজন্য ইবাদত করে না হয় জীবনটা পার করে দিবে।
আজ রিমা ওর দোষে কঠিন পথের একাকী যাত্রী। ওর মনে হচ্ছে সামনে এগিয়ে যাবার রাস্তা ও হারিয়ে ফেলেছে আর পিছনে ফেরার রাস্তাও বন্ধ। রিমার মা অর্জিত ছুটি নিয়ে সার্বক্ষণিক রিমাকে আগলিয়ে রাখছে। আসলে বয়সন্ধি কালের ভুলের কারণে অনেকে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে চায়। এই সময় বাবা মা ভাই বোনের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশী দরকার হয়। ডাক্তারের পরামর্শে ঐ বছর রিমা কোথাও ভর্তি হয়নি। ওর পরিবারের সবাই সেদিন ওকে আগলে রেখেছিলো। ওর বাবা মানুষের টিটকারী আর টিপ্পনির কারনে কোয়ার্টার ছেড়ে ওদের নিয়ে মিরপুরের বাসায় শিফট করেছিলো।
তানভীরের সেদিনের কথাগুলো ওর ভিতরে অনেক আলোড়িত হয়েছিলো। আসলেই তো হার মেনে জীবনে বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই। অথচ লড়াই করে পৃথিবীতে টিকে থাকার মধ্যে আনন্দ লুকিয়ে আছে। একবছর পর রিমা রাজশাহী ভার্সিটিতে ইংরেজী সাহিত্য ভর্তি হয়। ও আসলে ঢাকাতে থাকতে চাচ্ছিল না। ওর বন্ধু বান্ধবীরা মেডিকেল, বুয়েটে, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। এর ফলে ওর মনের উপর প্রচণ্ড প্রেসার যায়। তাই নিজের ইচ্ছাতেই রাজশাহীতে পড়তে গেল। এর মাঝে ওর বাবাও স্ট্রোক করলো। এতো আদরের মেয়ের এই অবস্থা উনি মনের দিক থেকে মেনে নিতে পারেননি। রিমাও আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বাবার অসুস্থায় বাবার পাশে থেকেছে। নিজেও ভার্সিটিতে ওর সাবজেক্টে সর্ব্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে অনার্স কমপ্লিট করেছে।
দরজায় কে যেন নক করছে। নক করার শব্দে অতীতের খেরোখাতা থেকে রিমা বর্তমানে ফিরে আসলো। ও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বিকাল পাঁচটা বাজে। মনে হয় শাহেদ অফিস থেকে ফিরেছে। দরজা খুলে দেখে শাহেদের মুখ খুব গম্ভীর। রিমা ওর দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে আসলো। একটু পরেই মাগরিবের আযান দিবে। শাহেদ ড্রেস করতে করতে রিমাকে বলে,
—–মা বললো তুমি নাকি বমি করেছো। বাচ্চাও নাকি কনসিভ করেছো। আমাদের তো এখনও বিয়ের একমাস হয়নি। এতো তাড়াতাড়ি কেউ বাচ্চা কনসিভ করে?
—-তার আগে আমি জানতে চাই তুমি আমাকে বিশ্বাস করো কিনা। হ্যা আমি মানছি অসাবধানবশত আমার জীবনে এক বিশাল ভুল বলো, অন্যায় বলো, পাপ বলো আমি করেছি। কিন্তু আমি তো সেজায়গা থেকে ফিরেও এসেছি। তোমাকে কমপ্লিন করছি না কিন্তু মা আমাকে মেনে নিতেও পারছে না। ওই বিষয়টা নিয়ে মা আমাকে প্রতিদিন খোঁটা দেয়।
এসব খোঁটা শোনা এখন আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে তুমি যদি আমায় বিশ্বাস করো জীবনের সব কিছুই আমি জয় করে নিতে পারবো।
—-রিমা আমি তো তোমাকে বিশ্বাস করেছি বলে তােমার সবটা জেনেও আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। কিন্তু মা বলছে এই বাচ্চাটাকে এবরশন করে ফেলতে। আর আমাদের তো কেবল বিয়ে হলো। বাচ্চা নেওয়ার অনেক সময় পাওয়া যাবে।
—–দেখো আমার পক্ষে এবরশন করা সম্ভব নয়। মা যেহেতু আমাকে এতো বড় অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাই আমার যত কষ্টই হোক যত অপমানিত হই না কেন আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে আমি আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবো। আর আমি নিজে ডিএনএ টেস্ট করে প্রমান দিবো এই সন্তান তোমার।
শাহেদ রিমাকে আর কিছু বললো না। যদিও রিমার সাথে ওর প্রেমের বিয়ে না তবুও এই কয়দিনে মেয়েটাকে অনেক আপন মনে হয়। ও খুব লড়াকু একটা মেয়ে। শাহেদ জানে,ও বাসায় না থাকলে মা ওর ভাবি রিমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। কারণ রিমার ঐ বিষয়টা মা মেনে নিতে পারে নাই। মার কথা হচ্ছে পৃথিবীতে কি এতই মেয়ের আকাল ছিলো যে তোকে ওকেই বিয়ে করতে হবে। এমন সময় শাহেদের মা এসে দরজায় নক করলো।
চলবে