একটি ভুল শেষ পর্ব

0
361

#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

তারপর শরীরটাকে টেনে রিমা দোতলা থেকে আস্তে আস্তে নীচে নেমে আসলো। সন্ধা ঘণিয়ে আসায় চারিদিক আলো আঁধারিতে ঢেকে গেল। রিমার দুচোখে নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের জল গড়িয়ে পড়ছে। এতো অপমান এতো অবহেলা তারপর রিমা বিশ্বাস করে ভয়াল অমাবশ্যার অন্ধকার পেরিয়ে ইনশাআল্লাহ ওর জীবনে আলোকিত চরাচরের আবির্ভাব হবে।

রিমা ক্ষীণ আশা নিয়ে মোবাইলটা খুলে দেখলো, শাহেদ কোনো মেসেজ পাঠিয়েছে কিনা। না শাহেদের কোনো মেসেজ আসেনি। ও যেন আর হাঁটতে পারছে না। পা দুটো মাটির সাথে গেঁথে রয়েছে। ও মাথা ঘুরে পড়ে যাবার ভয়ে মাটিতে বসে পড়লো। ওর দম আটকে আসছে। মনে হয় এক্ষুনি জ্ঞানটা হারিয়ে ফেলবে তখনি একটা পরিচিত স্পর্শ ওর কাঁধ ছুঁয়ে দিলো। ঝাপসা চোখে রিমা দেখতে পাচ্ছে অন্ধকারের অতল গহ্বর হতে শাহেদ ওকে টেনে আনছে। একসময় ও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

রিমার যখন জ্ঞান ফিরে আসলো ও দেখলো ওর বিছানায় ও শুয়ে আছে। শাহেদ ওর দিকে আপেলের জুসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
—–আমি যদি ঠিক সময়ে ওখানে না পৌঁছাতাম কি সর্বনাশ হতো বুঝতে পারছো।
রিমা মলিন হাসি হেসে বলে,
—–কি আর হতো?আমার মতো কুলটা নারীর হয়ত প্রাণটা যেতো। তারপর তুমি মার পছন্দ মতো বিয়ে করতে। সুখে শান্তিতে জীবনটাও কাটাতে পারতে।
—–আমি জানি তুমি মার ব্যবহারে কষ্ট পাও। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভর্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে তোমার তো ফোন দেওয়ার কথা ছিলো? তুমি তো ভার্সিটিতে গিয়ে আমাকে কিছু জানালে না। আমারও আজ অফিসে অনেক ব্যস্ততা ছিলো। আমাদের অফিসে এখন অডিট শুরু হয়েছে। এই কারণে কাজের চাপ বেশী।
—–আমাকে বাসায় আনলে কিভাবে?
—–তোমাদের ডিপার্টমেন্টের পিওনটাকে বললাম উবার ডেকে দিতে। তারপর তোমাকে কোলে নিয়ে উবারে বসিয়ে বাসায় নিয়ে আসলাম।
—–তোমার অনেক কষ্ট হলো।
—–আমার কষ্টটা বড় না। আল্লাহর রহমতে তোমার যে কোনো ক্ষতি হয়নি আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া জানাই।
রিমার মনে পড়লো। শাহেদ ওকে ফোন দিতে বলেছিলো।

রাত দশটা বাজে। রিমার শরীরটা খারাপ দেখে শাহেদের মা আর কোনো চিৎকার চেঁচামেঁচি করেনি। বাড়ির পরিবেশ মোটামুটি ঠাণ্ডা ছিলো। শাহেদ রুমেই রিমার রাতের খাবার নিয়ে আসলো। রিমা ডিনার করে আবার শুয়ে পড়লো। শাহেদ ওকে বললো,
——সারাদিন শরীরের উপর অনেক ধকল গিয়েছে। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি ডিনার করে আসছি।
শাহেদ লাইট অফ করে দিয়ে চলে গেল। ওর জন্য শাহেদের উৎকন্ঠা দেখে রিমার একটু হলেও ভাল লেগেছে। রিমা ভাবে যারা একবার হারতে শিখে তারা বারবার হেরে গিয়েও জেতার চেষ্টা করে। বারবার পড়ে গিয়েও তারা উঠে দাঁড়াতে জানে। রিমার বিশ্বাস ও একদিন শাহেদের ভালবাসা আদায় করে নিবে। মানুষটাকে ও এখনও বুঝতে পারে না। হয়ত আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তবে রিমা শাহেদকে ভালবাসতে শুরু করেছে এটা সত্যি।

কেউ কারো ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বলতে পারে না। মানুষ মন সবচেয়ে বেশী পরিবর্তশীল। তাই রিমা ভবিষ্যত নিয়ে না ভেবে বর্তমান নিয়েই ভাবতে চায়। কখনও মানুষ এক লহমায় বদলে যায়। সম্পর্কের প্যাটার্নগুলো তখন পাল্টে যায়। দরজা খোলার শব্দে রিমা ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে চুপটি করে ঘুমের ভাণ করে বিছানায় পড়ে রইল। শাহেদ খুব সাবধানে রিমার পাশে শুয়ে পড়লো। ওর একবার ইচ্ছে হলো রিমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। কিন্তু কেন যেন শাহেদ নিজেকে গুটিয়ে নিলো। সন্দেহের বীজ বড় ভয়ানক। তাই শাহেদ নিজের হৃদয়ে এই বীজের স্থান দিতে চায় না। তারপরও কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয় ওর মায়ের কথাই হয়ত ঠিক। মায়ের অভিজ্ঞ চোখ বলে কথা। আবার নিজেকে সামলে নেয়। কারণ মানুষের ভুল হয়। ওর মায়ের ধারণাও ভুল হতে পারে। একসময় শাহেদ ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।
রিমা পাশে শুয়ে বুঝতে পারে শাহেদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর মনটা চেয়েছিলো শাহেদ যেন ওকে একটু আদর করে দেয়। ছোটবেলা থেকে মনের মানুষকে নিয়ে রিমার অনেক স্বপ্ন ছিলো। ওই মানুষটার সাথে ও সুখের সংসার করবে। মানুষটা সব বিপদ আপদে ওকে আগলে রাখবে। অথচ জীবনের শুরুতে এমন একটা আঘাত পেল যা ওর জীবনের অংকটাকে বদলে দিলো। রিমা আস্তে করে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসে বসলো।

রাতের অন্ধকার পুরো পৃথিবীকে জড়িয়ে নিয়েছে। কল্যানপুরের নতুন বাজারের কাছে ২৪০০স্কয়ার ফিটের ফ্লাটে রিমার শ্বশুর বাড়ি। ওটা একটা অ্যাপার্টমেন্ট। সাত তলায় ওরা ভাড়া থাকে। রাস্তার লালনীল বাতিগুলো জ্বলছে। ইটপাথরের বিল্ডিংগুলো রঙিন আলোর ঝলকানিতে ভরে উঠেছে। রাতের প্রকৃতির নিরব আর নিস্তদ্ধতা রিমার খুব ভালো লাগে। মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো নিরব প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। একাকী রাতের নিঃসঙ্গ তারাগুলোর সাথে কথা বলে মনটাকে হালকা করে নেওয়া যায়।

অবশেষে রিমার ডেলিভারীর দিন চল আসলো। শাহেদের ভিতরে এক ধরণের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। অথচ শ্বশুর বাড়িতে সবাই রিমাকে দেখে অবাক হলো। এতো কষ্ট এতো অপমান সয়েও হাসিমুখে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা হলো। যাওয়ার সময় রিমাকে খুব দৃঢ়প্রতিঞ্জ লাগলো। অবশেষে সিজার করে রিমার পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। রিমার তখনও জ্ঞাণ ফিরেনি। কাঁপা কাঁপা হাতে তোয়ালেতে পেঁচিয়ে বাচ্চাটাকে শাহেদ কোলে তুলে নিলো। বাচ্চাটা খুব কাঁদছিলো। শাহেদের শরীরের স্পর্শ পেয়ে ওর কান্না থেমে গেল। দেখতে অনেকটা শাহেদের মতই হয়েছে। জ্ঞান ফিরে আসার পর শাহেদ বাচ্চাটাকে রিমার কোলে দিলো। রিমা বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে শাহেদকে বললো,
—–ওর ডিএনএ টেস্ট করিয়ে ফেলো।
শাহেদ বললো,
—–আমি তো তোমাকে বিশ্বাস করি রিমা। এসবের দরকার নেই।
—–না শাহেদ দরকার আছে। আমার সন্তানের ভবিষ্যত এর সাথে জড়িয়ে আছে। টেস্টের রেজাল্ট যাই হোক তুমি সবাইকে জানিয়ে দিও।
রিমার পিরাপিরিতে শাহেদ ডিএনএ টেস্ট করাতে বাধ্য হলো। রেজাল্ট হাতে আসতে কয়েকদিন সময় লাগলো। রেজাল্ট হাতে আসার পর শাহেদ রিমার ইচ্ছাতেই সবাইকে জানিয়ে দিলো।

সাতদিন পর আজ রিমা হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছে। বাসায় পৌঁছাতে বেলা বারোটা বেজে গেল। শাহেদ দেখলো দরজাটা ভেজানো রয়েছে। আলতো করে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ঘরের ভিতরে চোখ পড়তেই ওরা অবাক হয়ে গেল। শাহেদের বোন মুন্নি বিশাল এক ফুলের বোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিমার শ্বাশুড়িও মিষ্টির প্লেট হাতে হাসিমুখে রিমাকে বললো,
—-ঘরে আসো ছোটো বউমা।
শাশুড়ির আদুরে ডাকে রিমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল। ঘরে ঢুকার সময় মুন্নির দশ বছরের মেয়ে লিজা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে ওদের অভিনন্দন জানালো। মর্জিনা দৌড়ে এসে শাহেদের কোল থেকে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো। শাহেদের মা রিমাকে মিষ্টিমুখ করালো। আয়েশা রেনুর কোলে বসে ভাইয়ের গৃহ প্রবেশের আনন্দ অনুভব করতে লাগলো। আর রাশেদ পুরো দৃশ্য মোবাইলে ক্যামেরা বন্দী করলো। এসব দেখে রিমার চোখদুটো জলে ভরে উঠলো। এমন দিন ওর জীবনে আসবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। ঘরে এসে রিমা আরোও অবাক হলো। ওর বাবা মা সোফায় বসে আছে। রিমা ওদের দেখে খুশী হয়ে বললো,
—–তোমরা কখন এলে?
রিমার মা বললো,
—–সকালে বেয়াইন ফোন দিয়ে বললো আপনাদের নাতি হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসেন। তুই তো আমাদের কিছুই জানাসনি।
—-আব্বুকে নিয়ে তুমি এমনিতেই অনেক
ব্যস্ত থাকো। তাই তোমাকে জানানো হয়নি। তবে আমি যে কনসিভ করেছি এটা তোমাকে জানিয়েছিলাম।
—-আমি ভাবছিলাম তোর ডেলিভারী ডেট মনে হয়
সামনের মাসে।
—–মা তানভীর আর তাশদীদ আসলো না?
—–ওরা টাঙ্গাইল থেকে রওয়ানা দিয়েছে।
মুন্নি এসে রিমাকে বললো,
—-তোমার লড়াইয়ে জিতে ফেরার জন্য আমার তরফ থেকে এই উপহারটা গ্রহন করো।
মুন্নির বর মুন্নিকে বললো,
—-তুমি চেইনটা রিমার গলায় পড়িয়ে দাও।
মুন্নি চেইনটা রিমার গলায় পড়িয়ে দিলো। রিমা তখন থেকে কেঁদেই চলেছে। ওর শাশুড়ি রিমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—–অনেক কেঁদেছো। আর কাঁদতে হবে না। পারলে তোমার বুড়ো মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিও। আসো আমার বুকে আসো মা।
রিমা শাশুড়ির বুকে পরম স্নেহে মাথা এলিয়ে দিলো। রিমার যদিও শাশুড়ির উপর অনেক কষ্ট অনেক অভিমান জমা ছিলো তারপরও শাহেদের মা হিসাবে শাশুড়িকে ক্ষমা করে দিলো। বিয়ের পর থেকে শাহেদ সবসময় ওর পাশে ছিলো। জীবনের সাথে দীর্ঘ লড়াই করে ও আজ বড্ড ক্লান্ত। একটা সুন্দর স্বাভাবিক পেতে ওরও মন চায়। তাই ওর প্রতি হওয়া সব অন্যায়কে ক্ষমা করে দিয়ে সুখ ও শান্তিতে ভরা জীবনকে আহ্বান জানালো। মেয়ের সংসারের উপচে পড়া সুখ দেখে রিমার বাবা মার চোখদুটোতে আনন্দের সাগর বয়ে গেল। শাহেদ ওর মাকে বললো,
—–মা রিমা ঘরে গিয়ে ফ্রেস হোক। বাবু এখানে তোমাদের কাছে থাক।
—-ঠিক আছে তুই রিমাকে ঘরে নিয়ে যা।
রিমার শাশুড়ি মর্জিনাকে বললো,
—–দাও নাতিটারে আমার কোলে দাও। মুন্নি আর তুমি রান্নাঘরে গিয়ে সবার খাবারের ব্যবস্থা করো।
শাহেদ রিমাকে ঘরে নিয়ে বুকের কাছে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
—–পরম বিশ্বাসে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে এই হাত আমি ধরেছি। আমৃত্যু আমার বুকের মাঝে তোমায় জড়িয়ে রাখবো।
রিমা অনুভব করলো ওর আর শাহেদের মাঝখানের অবিশ্বাসের দেয়ালটা শাহেদের ভালবাসায় ভেঙ্গে চৌচির হলো।

পাঁচ বছর পর——

রিমা ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স কমপ্লিট করে হলিক্রসে জয়েন করেছে। চার বছর ধরে শিক্ষকতা করছে। রিমা এখন শ্বশুর বাড়ির লক্ষী বউ আর বাবার বাড়িতে লক্ষী মেয়ে হয়ে উঠেছে। কর্মস্থলে সবার আদর্শ শিক্ষক। কিন্তু রিমার জন্য এই জার্নি এতো সহজ ছিলো না। অনেক চড়াই উৎড়াই পার হয়ে সুখ নামক পাখিটার সন্ধান পেয়েছে। অনেকে হয়ত অল্প বয়সের অনাকাঙ্খিত ভুল থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। কিন্তু রিমা ওর ভুলটাকে শুধরে নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here