একটি_রূপকথার_গল্প,১০,১১

0
486

#একটি_রূপকথার_গল্প,১০,১১
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১০

বাড়িতে ডাক্তার এসেছে। অথৈর জ্বর মেপে ওর জ্বর কমানোর জন্য ঔষধ দেওয়া হয়েছে। অথৈর জ্ঞান ফিরলেও জ্বরের ঘোরে কাউকে চিনল না সে৷ চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে রইল। আশরাফ হোসেন মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনেই স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন। মারজিয়া বুঝতে পারছে না হঠাৎ মেয়েটার এত জ্বর আসার কারণ কী! আরমান নিজেও অথৈর মাথার কাছে বসে আছে। সবকিছুর জন্য সে নিজেকেই দায়ী করছে। সারাটা দিন আরমান অথৈদের বাড়িতে কাটাল। ঔষধের প্রভাবে বিকেলের দিকে অথৈর জ্বর কিছুটা কমেছে। সে দুর্বল শরীরে উঠতে চাইলে আরমান বারণ করল। অথৈ মানুষটাকে দেখল। এক দুপুরে কী হাল করেছে নিজের! সব সময় পরিপাটি থাকা লোকটাকে এখন কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অথৈ দুর্বল ঠোঁটে হাসল। জিজ্ঞেস করল,

~ বাবা কোথায়?’

~ এই ঘর থেকে মাত্র গেল।’

~ ফুপি?’

~ তিনি স্যারকে নিয়ে গেছেন। আপনার চিন্তায় স্যার নিজেও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন।’

~ আপনি এখনও যাননি কেন?’

আরমান অথৈর চোখের দিকে চেয়ে দ্বিধাজড়িত গলায় বলল,

~ আপনার জাগার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন চলে যাব।’

~ হ্যাঁ যান।’ অথৈর মনে মনে ভীষণ হাসি পাচ্ছে। মানুষ কাউকে ভালোবাসলে তার সামনে এসে এতটা অসহায় হয়ে যায় কেন?

~ যাব।’ আরমান মুখে যাব বললেও যাওয়ার কোন আগ্রহই দেখা গেল না তার মাঝে। সে আগের মতই বসে রইল। অথৈ বলল,

~ আপনাকে না নিষেধ করেছিলাম আমাদের বাড়িতে আসতে। তবুও আপনি এলেন যে!’

~ আমি না এলে আপনাকে কে নিয়ে আসত! আপনার যে জ্বর তা আমাকে জানাননি কেন অথৈ?’

~ জ্বর যে বুঝতে পারিনি। সামান্য গা গরম মনে হয়েছে।’

~ সামান্য গা গরম! সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন। নিজেকে নিয়ে এতটা উদাসীনতা কেন অথৈ? আপনি জানেন যতক্ষন আপনার জ্ঞান ছিল না আপনার ফুপি কেমন ছটফট করেছে। আপনার বাবা নিজেও অসুস্থ হবার পথে। এই মানুষ গুলোকে কেন দুঃশ্চিন্তায় ফেলেন? এদের জন্য হলেও আপনার নিজের খেয়াল রাখা উচিত।’

অথৈ আরমানের দিকে চেয়ে মনে মনে বলল,

~ এখন থেকে আমার খেয়াল রাখার জন্য আপনি আছেন তো।’

অথৈকে রেখে আরমানের যেতে ইচ্ছে না করলেও কোন উপায় নেই৷ এখনও তাদের বিয়ে হয়নি। এটা এখনও তার শ্বশুরবাড়ি হয়নি যে আজ সে এখানে থেকে যেতে পারবে।
…..
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অথৈ ভালোই ছিল। কিন্তু রাতে আবার তার গা কাঁপানো জ্বর উঠল। জ্বরের তোপে অথৈ অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। দাঁতে দাঁত ঠকঠক করে বারি খাচ্ছে ওর। আশরাফ হোসেন, মারজিয়া দিশাহীন হয়ে পড়লেন। রাতেই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আরমানও খবর পেয়ে চলে এসেছে।
বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে কিন্তু অথৈর সুস্থ হবার নাম নেই। ওর জ্বর কোনভাবেই ভালো হচ্ছে না। আজ পঞ্চম দিন সে হাসপাতালে ভর্তি আছে। আশরাফ হোসেন মেয়েকে কষ্ট পেতে দেখে এতটাই ভেঙে পড়েছেন তারও প্রেশার, ডায়াবেটিস কমে গিয়ে মেয়ের থেকে করুণ দশা। অথৈর যখন জ্বর ছাড়ে তখন তাকে দেখে সুস্থ মনে হয়। সে নিজেই সবাইকে বলে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পরেই আবার জ্বরে অচেতন হয়ে কাউকেই চিনে না। আরমান এই পাঁচ দিন হাসপাতালেই অথৈর পাশে কাটিয়েছে। অথৈর প্রতি ছেলেটার টান দেখে মারজিয়া আশ্চর্য হয়।
আরমান না ঘুমিয়ে পুরো রাত অথৈর খেয়াল রাখে। কখন ওর ঘুম ভেঙে যায়। মারজিয়া ছেলেটার মাথায় হাত রেখে স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন,

~ এবার তুমি রেস্ট নাও বাবা। নইলে তোমারও অসুস্থ হয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। তুমিও রোগী হয়ে গেলে আমি একা কীভাবে সবাইকে সামলাবো বলো।’

~ আমি ঠিক আছি মা।’

~ ঠিক আছো! এই কয়দিনে নিজের মুখটা আয়নায় দেখেছ একবার? দেখলে বুঝতে কী হাল করেছ নিজের। ঠিকমতো খাওয়া নেই। ঘুম নেই। বাড়ি যাও না। মাথার চুল, দাঁড়ি গোঁফে মুখের অবস্থা বেহাল অবস্থা হয়েছে। আজকের রাতটা আমি অথৈর কাছে থাকি৷ তুমি বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হও। ভালো করে খাওয়াদাওয়া করে ঘুম দাও৷ কোন কিছুর দরকার হলে আমি তোমাকে ডেকে নেব।’

আরমান অথৈকে রেখে যেতে নারাজ। নিজে যথেষ্ট শক্ত আছে সে৷ কয়টা দিন খাওয়া ঘুম বাদ দিলেও কিছু হবে না ওর। আরমান অনুরোধে গলায় বলল,

~ আজকের দিনটা আমি অথৈর কাছে থাকি মা, প্লিজ।’

~ না। তোমাকে আমি যা বলেছি তা করো। মায়ের অবাধ্য হতে নেই। শরীরটার একটু রেস্ট দরকার।’

না চাইতেও মারজিয়ার কথা রাখতে আরমান নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলো। সেই রাতে অথৈ একদম সুস্থ মানুষের মত উঠে ফুপিকে তার পাশে বসে ঘুমোতে দেখে ডাকল।

~ ফুপি। ফুপি।’

ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল মারজিয়া। অথৈকে বসে থাকতে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলল।

~ তুই আমাকে চিনতে পারছিস বুলবুলি! আমাকে ডাকছিস!’

অথৈ দুর্বল ভাবে হেসে বলল,

~ তোমাকে চিনব না কেন? আমার কি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে?’

~ কয়টা দিন কী ভীষণ জ্বরে ভুগেছিস তুই জানিস না রে মা। আমাদের জান বের করে দিয়েছিলি। এরকম ভাবে কেন ভয় দেখালি আমাদের। তোর বাবা কান্নাকাটি করে আমার মেজাজ খারাপ করে দিত।’

~ আমি তোমাদের খুব কষ্ট দিয়েছি তাই না ফুপি?’

মারজিয়া অথৈর মাথায় চুমু খেয়ে ওকে বুকে টেনে নিল।

~ তুই আমাদের জান। তোর কিছু হলে আমরা কীভাবে বাঁচতাম বল তো!’

~ সরি ফুপি।’ অথৈর চোখ একজনকে খুঁজছে। মানুষটাকে দেখার জন্য তার চোখজোড়া তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। পুরো ঘর খুঁজে আরমানকে দেখতে পেল না সে। ক্ষীণ গলায় অথৈ জিজ্ঞেস করল,

~ আরমান কোথায় ফুপি?’

~ ওই পাগলের কথা জিজ্ঞেস করছিস! আরমান তো তোর বাবার থেকেও বেশি পাগল রে অথৈ। ও তোর ফুপাকেও পেছনে ফেলেছে। তোর কি কিছু মনে নেই? পাঁচ দিন ধরে এখানে আসিস তুই। এই পাঁচ দিনে পাঁচ মিনিটের জন্য আরমান তোকে ছেড়ে নড়েনি। রাতে যদি ওর চোখ লেগেছেও তুই কুঁই শব্দ করলেই হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠেছে। আজ আমি জোর করে ওকে বাড়ি পাঠিয়েছি। না ঘুমিয়ে, না খেয়ে থেকে নিজেও অসুস্থ হয়ে যেত। তুই ভীষণ ভাগ্যবতী রে বুলবুলি। আরমানের মত লাইফ পার্টনার যার হবে তার দুনিয়াই জান্নাত। তোর গাধা বাপটা মেয়ের জামাই বাছতে ভুল করেনি৷ ছেলেটা হীরের টুকরা। তোকে নিয়ে আমাদের আর কোন চিন্তা রইল না। তুই সঠিক মানুষের হাতেই পড়েছিস।’
….
আরও দু’দিন পর অথৈ বাড়ি ফিরল। পুরো সাতটা দিন হাসপাতালে কাটিয়েছে সে। অথৈর শরীর এখনও যথেষ্ট দুর্বল। একা একা হাঁটতে পারে না সে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না মাথা ঘুরে যায়। অথৈকে কখনো ডায়েট করতে হয়নি। সে আগে থেকেই রোগা ছিল। এই জ্বরে তাকে আরও রোগা করে দিয়ে গেছে। সব গুলো জামা কেমন ঢোলা লাগছে। তার উজ্জ্বল গায়ের রঙ মলিন হয়ে গেছে। সদ্য ফোটা গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁটজোড়া নেতিয়ে গেছে যেন। এবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সময় লাগবে অনেক।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অথৈর মাথাটা চক্কর দিয়ে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। আরমান তার পাশেই ছিল। ক্ষীণ গলায় অথৈ বলল,

~ বাবার প্রিয় ছাত্র, আমার হাতটা ধরবেন একটু?’

যে মেয়ে নিজের পায়ে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না দু’দিন পর সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে কীভাবে?
অথচ নির্ধারিত ডেট অনুযায়ী দু’দিন পর অথৈর বিয়ে হবার কথা। সে অনুযায়ীই সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আজ কাল মেহেন্দি, হলুদ হবার কথা ছিল। কিন্তু অথৈর অসুস্থতায় সেসবের কিছুই হলো না। আশরাফ হোসেন ভাবছেন বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দিবেন। কার্ড বিলি করা হয়ে গেছে তাতে কী হয়েছে? আগে মেয়ের সুস্থতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার জন্য। জীবনে একবারই বিয়ে হবে। এই বিয়েও কি অথৈ শুয়ে শুয়ে করবে নাকি! আরমানের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
আরমান প্রতিদিন নিয়ম করে অথৈকে দেখতে এলে অথৈ উপরে উপরে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলেও আরমান একদিন না এলে মনে মনে সে কতটা অস্থির হয় তা শুধু সে-ই জানে।

~ এইযে ভালো ছাত্র, বাবা আপনার খোঁজ করছিলেন। আজ আসতে এত দেরি হলো কেন?’

~ কিছু কাজ ছিল।’

~ আপনি ব্যস্ত মানুষ। কাজ তো থাকবেই। আমিই শুধু বেকার। বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছি।’

~ স্যার কেন খোঁজ করছিলেন?’

~ দেখুন গিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিতে চাচ্ছে নাকি। বাবা ফুপিকে ওরকমই কিছু আলাপ করতে শুনলাম।’

আরমান ফ্যালফ্যাল চোখে অথৈর দিকে তাকাল। কথাগুলো কত সহজ ভাবে বলছে অথৈ। আরমান কি এখনও ওর মনে জায়গা করে নিতে পারেনি? আরমান বেশ গম্ভীর হয়ে অথৈর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,

~ এই বিয়েটা নিয়ে আপনার মতামত কি অথৈ? আমি স্যার বা মা’র কথা জানতে চাচ্ছি না। আমি আপনার সিদ্ধান্ত জানতে চাচ্ছি। আপনি যদি এখনও বিয়েটা করতে না করেন তাহলে এই মুহূর্তে আমি বিয়ে ভেঙে দেব। এবং এজন্য আপনার উপর মোটেও রাগ করব না। স্যারকেও যা বলার আমিই বলব। কারো কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে না। আমার কথা বা কারো কথা ভাববেন না। আপনি শুধু এটা ভেবে উত্তর দিন, আমার সাথে কি বাকিটা জীবন কাটাতে চান আপনি? প্লিজ অথৈ, আপনার উত্তরের উপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে।’

চলবে_

#একটি_রূপকথার_গল্প’১১’
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আরমান খোলা সমুদ্রের দিক মুখ করে জাহাজের ডেক-এ দাঁড়িয়ে আছে। যতদূর চোখ যায় বিশাল নীল জলরাশি। একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। আরমান প্রায় সমুদ্রে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটি দেখে। সমুদ্র জীবনে এই একটা জিনিসই তার ভীষণ প্রিয়। সমুদ্রের বুকে সন্ধ্যা নামতে দেখে তার মন শান্ত হয়। আজ তার মনট বিশেষ ভালো নেই। প্রিয় একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। আরমান ভাবে, আগেই তো ভালো ছিল। কোন পিছুটান ছিল না। বাড়ির কথা মনে পড়ে মন খারাপ হতো না। তখন পুরো বছরটাও সমুদ্রে কাটিয়ে দিতে পারত সে। কারণ তীরে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই এটা জানত সে। এখন গল্পটা একটু ভিন্ন। সারাদিন এই কয়েকটা চেনা মুখ দেখেও মনের পর্দায় আরও কয়েকটা প্রিয় মুখ ভেসে উঠে। দিন শেষে ওই মানুষ গুলোর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সামনে থেকে দু’টি চোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করে। আরমানের খুব শখ অথৈকে একদিন সমুদ্রে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটা দেখাবে। নিজের ভালোলাগা গুলো প্রিয়জনের সাথে ভাগ করে নিলে সেই ভালো লাগা দ্বিগুণ হয়ে যায়। আরমান অথৈকে পাশে নিয়ে সমুদ্রে দীর্ঘ একটা পথ পারি দিবে। কিন্তু তার প্রিয়তমা তো পাহাড় প্রেমী। সমুদ্র নাকি তাকে টানে না। আরমান হাসল। এইবার ফেরার পর তার মধ্যে বিশাল পরিবর্তনটা সবার চোখে পড়েছে। ইতোমধ্যে বন্ধুরা মজা করতে শুরু করে দিয়েছে। উত্তাল সমুদ্রের বুকে ভেসে চলছে আজ চার দিন। চার দিন আগেই ফিরেছে সে। সেই রাতে তার করা প্রশ্নে অথৈর উত্তর শুনে আর কোন সংশয় রইল না তার মনে। আরমান এখন জানে অথৈও তাকে ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটা ভালোবাসার কথা মুখে বলতে চায় না কেন? আরমান মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল অথৈ যদি সত্যিই তাকে পছন্দ না করে তাহলে বিয়েটা ভেঙে দিবে সে। অথৈকে জোর করে কোন সম্পর্কে বাঁধবে না। কিন্তু অথৈ সেদিন উত্তর দিয়েছিল,

“আপনার জন্য অপেক্ষা করব আমি।”

তার প্রশ্নের এটা তো উত্তর হতে পারে না। আরমান তখন না বুঝলেও পরে স্যারের কথা শুনে অথৈর উত্তরটা ঠিকই বুঝেছিল। স্যার চাইছে না বিয়েটা এইবার হোক। অথৈও অসুস্থ। আরমানের ছুটির বেশি দিন নেই। তাই তারা বিয়ে পিছিয়ে দেওয়াই ঠিক মনে করল। অথৈ এইজন্যই বলেছে, ‘আপনার জন্য অপেক্ষা করব আমি।’
…..
আরমানকে কি সে ভালোবাসে? এটাকে ভালোবাসা বলে? কে জানে। সে তো কখনও কাউকে ভালোবাসেনি। তাহলে কীভাবে বুঝবে এটাই যে ভালোবাসা। অথৈ না বুঝলেও বাকি সবাই বুঝতে পারছে অথৈ আগের মত নেই। মারজিয়া তো সেদিন বলেই ফেলল,

~ তোর কী হয়েছে আমাকে বল তো বুলবুলি।’

অথৈ ফুপির কথায় অবাক হয়ে বলেছে,

~ আমার আবার কী হবে!’

~ সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।’

~ কিছুই হয়নি।’

~ কাকে বোকা বানাচ্ছিস? নিজেকে নাকি আমাদেরকে?’

~ দূর ফুপি, কথা পেঁচিও না তো।’

~ বিয়েটা তো আমরা ভেঙে দিইনি। শুধু সময়টা পিছিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে তা করেও ভুল করেছি। তুই তো বিরহে বেদনায় দেবদাসের ফিমেল ভার্সন দেবদাসী, দেবদাসী হবে নাকি দেবদাসনী শিওর না অবশ্য। তবুও সেটাই হয়ে গেছিস।’

ফুপির কথায় অথৈ ঘোর প্রতিবাদ জানাল। বলল,

~ ইশ! কী ধারণা তোমার! ওই লোককে বিয়ে করার জন্য যেন আমি মরে যাচ্ছি! তোমার পাতানো ছেলে এতটাও রসগোল্লা না। ওকে কে বিয়ে করবে? বিয়েটা না পিছিয়ে একেবারে ভেঙে দিলেই ভালো হতো। ওরকম হ্যাংলা ছেলেকে আমার বর হিসেবে লাগবে না। এখানে থাকতে সারাদিন আমাদের বাড়িতেই পড়ে থাকত। ঘর জামাই হওয়ার মনে হয় অনেক শখ।’

মারজিয়া অথৈর কথা শুনে হাসে। কিছু বলে না। মেয়েটা এমন কেন? ভাঙবে তবুও মচকাবে না টাইপ। মেয়েরা হবে সহজসরল তুলোর মত নরম। এই মেয়ে সবার থেকে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার জন্য যত উদ্ভট কাণ্ড করে। আরমানকে যে ও মনে মনে কতটা চায় তা কেউ না বুঝলেও মারজিয়া ঠিকই বুঝে।

আরমানের সাথে অথৈর খুব কম কথা হয়৷ মাঝে মধ্যে এক দু’দিন। সেটাও তিন চার মিনিটের বেশি না। লোকটার সাথে কথা বলার পর তার আর কোনকিছু ভালো লাগে না। কোন কিছুতেই মন বসতে চায় না। কারণ ছাড়া মনটা কেমন বিষণ্ণ লাগে। তখন তার সবথেকে প্রিয় কাজ যেটা সেটাও করতে ইচ্ছে করে না। তাই অথৈ ঠিক করেছে এই দু-একদিন তিন চার মিনিটের কথা বলাও বন্ধ করে দিবে। একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। একটা মানুষ যে তার থেকে কতশত মাইল দূরে বসে আছে তার কথা মনে পড়ে নাকি অথৈর দিনটা বিষন্ন যায়৷ রোজকার রুটিন পাল্টে যায়৷ কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার!
….
ক’দিন বাদে অথৈর পরীক্ষা। তৃতীয় বছর শেষ করে চতুর্থ বর্ষে উঠবে৷ এটাই ফাইনাল ইয়ার৷ তারপর ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যাবে। এই কয়দিন পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। আরমানের ভাবনা মাথায় এলেও জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে পড়াশোনার কথা ভাবতে লাগল। আরমান নিয়ম করে তাকে কল দেয়। অথৈ মাঝে মাঝে তুলে মাঝে মাঝে দেখেও এড়িয়ে যায়। লোকটা সত্যিই জাদু জানে। প্রথমে তার বাবা পরে তার ফুপি৷ আর এখন তার উপরও লোকটার জাদুর প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে।

~ আপনি যত বড় জাদুকরই হোন না কেন, অথৈ আশরাফও কঠিন চিজ।’

অথৈর পরীক্ষা বেশ ভালো হলো। শেষ পরীক্ষার দিন বন্ধুদের সাথে খেতে গেল। সেখানে গিয়েও শান্তি নেই ওর। সবার মুখে আরমানের কথা। সে যে লোকটাকে ভুলে থাকতে চায় তাকেই সবাই তার কথা মনে করিয়ে দেয়।

~ কিরে অথৈ, আমাদের জামাই বাবা জীবনের খবর কী?’

~ নাম্বার নিয়ে নিজেই জেনে নে।’

~ এরকম চেতে উঠছিস কেন? ঝগড়া টগড়া হয়েছে নাকি?’

প্রাপ্তি ফোনে মনোযোগ রেখে অথৈকে বলল,

~ এই তোর জামাইয়ের ফেসবুক আইডি দে তো। ফ্রেন্ড রিকু পাঠাই।’

প্রাপ্তির গালে ঠাস করে এক চড় দিতে ইচ্ছে হলো অথৈর। ওদের বিয়ে কবে হয়েছিল সে যে মানুষটাকে তার জামাই বানিয়ে ফেলেছে৷ কিন্তু অথৈ কিছু বলার আগেই মিনহা বলল,

~ জামাই আর হলো কই! বিয়েটাই তো পিছিয়ে গেল। তোর জ্বর হওয়ার আর সময় পেল না। আমাদের সব প্ল্যান বরবাদ হলো। কই ভেবেছিলাম সেজেগুজে তোর বিয়েতে গিয়ে ছেলে পটাব। সেখানে কী হলো? ফল-ফলান্তি নিয়ে রোজ রোগী দেখতে হাসপাতালে গেছি।’

~ আরমান কবে আসবে রে অথৈ? আর তো অপেক্ষা সহ্য হয় না। তোর বিয়ের জন্য যে শপিং গুলো করেছিলাম তা আলমারিতে ইঁদুরে খাচ্ছে হয়তো।’

অপেক্ষা! অথৈ সে রাতে আরমানের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। কিন্তু তার অপেক্ষা যে এতটা দীর্ঘ হবে তা কে জানতো। ছয় মাস কেটে গেছে। এখনও তার অপেক্ষা শেষ হওয়ার নাম নিচ্ছে না। লোকটা কি ইচ্ছে করে তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে? নিক। সে-ও তো কম যাচ্ছে না। মাসে একদিন কল তুলে। তবুও কত ব্যস্ততা দেখায়। শোধ তো সে-ও নিচ্ছে।
প্রাপ্তি বিরক্তি মাখা গলায় বলে যাচ্ছে,

~ ছাতা এজন্যই আমি ঠিক করেছি বিয়ে করলে বেকার একটা ছেলেকেই করব। কালেভদ্রে জামাইকেই যদি কাছে না পাই তাইলে টাকা দিয়ে কী করব! বাবা সেদিন বলছিল, কেমন ছেলে আমার পছন্দ। আমিও বলে দিয়েছি, আমার জন্য কোন বেকার ছেলে খোঁজ। যার কোন কাজকর্ম থাকবে না। সারাদিন বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরবে।’

প্রাপ্তির কথা শুনে মিনহা হো হো করে হাসছে। ওকে হাসতে দেখে প্রাপ্তি রেগে বলল,

~ ছাগলের মত হাসছিস কেন? ভুল কিছু বলেছি নাকি আমি! আরমানকেই দেখ না। বেচারা সেই যে গেল, মাঝে অথৈর জন্মদিন গেল আসতে পেরেছে সে?’

অথৈ অন্যমনস্ক ছিল। প্রাপ্তির শেষের কথাগুলো শুনে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
প্রাপ্তির কথাগুলো এখনও কানে বাজছে অথৈর। বাবা তাকে অনেকবার খাওয়ার জন্য ডেকেছে। অথৈ ডাইনিংয়ে যায়নি। বাবাকে আজ একাই খেয়ে নিতে বলেছে। তার মাথা ব্যথা করছে শুনে বাবা ঘরে এসে দেখে গেছে। ঘরটর অন্ধকার করে বসে আছে সে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। অনেকক্ষণ বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু আগে শুতে গেল। কাজের মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দরজার কপাটে বারি খেল।

~ অথৈ আপা! ও আপা…

বিরক্ত হলো অথৈ। এই মেয়েটাকে কোনদিন যেন ঘাড় ধরে বিদায় করে দেয় অথৈ। মেয়েটা তার সব কথাই শুনে। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে! এইযে ঘোড়ার মত এসে দরজায় বারি খেলি ব্যথাটা কে পেয়েছে?

~ তোর সমস্যা কি টিয়া! জানের উপর থেকে মায়া উঠে গেছে তোর?’

~ আপা ভাইজান আইছে।’

ভাইজান! অথৈর বুকটা চিনচিন করে উঠল। এই মেয়ের ভাইজান মানেই তো আরমান। তাহলে কি আরমান এসেছে! কিন্তু এত রাতে, আর ও যে আসবে এটাও তো অথৈকে বলেনি। অথৈ খুব করে চাচ্ছে মানুষটা যেন আরমানই হয়। তবুও টিয়ার কাছে জানতে চাইল,

~ কোন ভাইজান?’

~ দুলা ভাইজান। নিচে গিয়া দেহেন। আমার মনে হয় ভাইজান আপনারেই দেখতে আইছে। তাড়াতাড়ি যান।’

অথৈর ইচ্ছে করছিল এক ছুটে আরমানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু মনের সব আগ্রহ কৌতূহল খুশি চেপে রেখে টিয়ার সামনে এমন একটা ভাব করল যেন এত রাতে আরমানের এখানে আসাতে ভারি বিরক্ত হয়েছে সে। অথৈ শোয়া থেকে উঠে ওড়নাটা টেনে নিয়ে কোনরকম চঞ্চলতা না দেখিয়ে টিয়ার আগে আগে হাঁটছে। তার মনের ভেতর যে খুশির জোয়ার কী ভীষণ বেগে বইছে তা শুধু সে আর তার আল্লাহই জানেন। কতগুলো মাস পর মানুষটাকে চোখের সামনে দেখবে অথৈ!

চলবে_

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here