একটি_রূপকথার_গল্প,২,৩

0
590

#একটি_রূপকথার_গল্প,২,৩
#জেরিন_আক্তার_নিপা

অথৈর সরলতা দেখে আরমান বলতে বাধ্য হচ্ছে আশরাফ স্যারের মেয়ের মধ্যে এই গুণ না থাকলে চলতোই না। কীভাবে প্রথম দেখায় একজন অচেনা লোকের সামনে মনের কথা বলে ফেলতে পারছে। সবথেকে মজার যেটা সেটা হলো, তাকে যে অথৈর পছন্দ হয়নি সেটাও সরাসরিই বলে দিচ্ছে। আবার বিয়েটাও যে সে করতে চাচ্ছে না, বাবার চাপে এসে রাজি হতে হয়েছে এসবের কিছুই গোপন রাখল না।
অথৈ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল,

~আচ্ছা আপনি নেশা করেন? মদ গাঁজা টাইপ কিছু খান? জীবনে কখনও খেয়েছেন? সিগারেট তো খানই নাকি!”

আরমান জুসের গ্লাসটা মুখের কাছে তুলেছিল মাত্র। চুমুক দেওয়ার আগেই গ্লাস থেকে ছলকে খানিকটা জুস টেবিলের উপর পড়ল। একটুর জন্য তার সাদা শার্টটা নষ্ট হয়নি। তার এমন আচরণে অথৈ মুখ বাঁকিয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল। অথৈর প্রশ্নের ধরণে আরমানের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। খুব কষ্টে নিজেকে সামলালো সে। অথৈ আগের মত করেই বলল,

~কি খান না?”

~না।”

অথৈ কিছুটা আশাহত হলো। মন খারাপ করে বলল,

~খান না, না?”

~না।”

~কেন?”

~আমার কি ওসব জিনিস খাওয়া উচিত ছিল?”

~হুম খেলে অন্তত বাবাকে এটা বলতে পারতাম আপনি নেশাখোর। এখন তো বানিয়ে বললে দু’মিনিটে বাবা আমার মিথ্যা ধরে ফেলবে।”

আরমানের এই মুহূর্তে কেমন প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রয়োজন সে বুঝতে পারছে না। সে কি হাসবে নাকি কাঁদবে? আশরাফ স্যারের মেয়ে এরকম হবে সে ভাবতেই পারেনি। কোন রাখঢাক নেই। যা মনে আসছে বলে যাচ্ছে। তার কি বিয়েটা করা ঠিক হবে? আরেকবার ভেবে দেখা উচিত না!

~ আচ্ছা বাদ দেন ওসব। এখন তো আমাদের হাতে একটা অপশনই বাকি আছে।”

~আর সেই অপশনটা কী?”

~আপনি না করে দিবেন। বলবেন আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। আমার মত মেয়েকে আপনি বউ হিসেবে চান না।”

~স্যার যদি আমার থেকেও আপনাকে অপছন্দ করার তিনটা কারণ জানতে চান তখন?”

~তখন কিছু একটা বলে দিবেন। আপনাকে নিয়ে বাবার যে গর্ব তাতে আপনাকে পছন্দ না বললে হাজার প্রশ্ন করত। কিন্তু আমাকে পছন্দ না বললে সে প্রশ্ন গুলো আর করবে না।”

~আপনাকে কেন পছন্দ না এটা জিজ্ঞেস করলে কী বলব? বলব আপনি সুন্দর না। সেরা দশজন সুন্দরীর তালিকায় যাকে ফেলা যাবে সে সুন্দর না এই কথাটা শুনে স্যার নিশ্চয় রাগ করবেন। তার উপর আবার উনার একমাত্র মেয়ে। আমার এই কথায় কষ্টও পেতে পারেন। যদি বলি আপনার হাইট কম সেটাও তো টিকবে না। কারণ বাংলাদেশ ৫’২ মেয়েদের খাটো বলা চলে না। আপনি তো সেখানে ৫’৩/৪ হবেনই। শুনেছি আপনার পড়াশোনাও ভালো। ক্লাসে কোনদিন দ্বিতীয় আসেনি। রূপবতী, গুণবতী, কোটিপতি বাবার একমাত্র কন্যা। আপনাকে বিয়ে করা যেকোনো ছেলের স্বপ্ন। আপনার সম্পর্কে কোন খুঁতটা স্যারকে বলব আমি?”

অথৈ কতক্ষণ তব্দা খেয়ে আরমানের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আরমানও চোখ সরালো না। ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর অথৈর ফোন বাজছে। দ্রুত সময়ে অথৈ আবার নিজের রূপে ফিরেও এলো।

~তাহলে বাবাকে বলবেন আপনি বিবাহিত। অনেক আগে গোপনে বিয়ে করে ফেলেছেন। আপনাদের একটা ছেলেও আছে। ওর বয়স পাঁচ বছর। উম..এটাও বলবেন আপনার ওয়াইফ সেকেন্ড টাইম প্রেগন্যান্ট। ছয় মাস চলছে। অনাগত সন্তান, ছেলে, বউ নিয়ে আপনি ভীষণ ভীষণ ভীষণ খুশি আছেন। এখন প্রথম সংসার ফেলে আমাকে বিয়ে করা আপনার পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব না।”

বাবার সামনে কী কী বলতে হবে তা এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে বলে ফেলে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কানে নিল।

~ হ্যাঁ বল। বলেছিলাম এই সময়টাতে ফোন দিবি না। ইম্পর্ট্যান্ট কাজে আছি। তারপরও শুনলি না। আজরাইল কাকে নিতে এসেছে হ্যাঁ?”

অথৈর ধমক পেরে কার সাথে যেন কথা বলছে। এদিকে আরমান হতভম্ব, হতবিহ্বল, বাকরূদ্ধ। অথৈ কথা শেষ করে উঠতে উঠতে আরমানের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ব্যস্ততায় বলতে লাগল,

~ আমাকে এখন উঠতে হবে। তাহলে ওই কথাই রইল। আসি, আল্লাহ হাফেজ।”

আরমানকে ওই অবস্থায় রেখেই অথৈ রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আরমান বিস্মিত চোখে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। কতক্ষণ সে এভাবে বসে থাকল নিজেও বলতে পারবে না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে। অথৈ নামের মেয়েটা জীবনে প্রথম বারের মত তাকে গোড়া থেকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে। মাত্র কয়েক মিনিটে তার অস্তিত্ব ভুলিয়ে দিয়ে গেছে। এই মেয়েকে দুনিয়ায় এনে বড় করায় স্যারকে কী দিবে সে? না চাইতেও স্যার তাকে জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিসটা দিয়ে ফেলল। এই মূল্যবান জিনিসের অনাদর সে কখনও হতে দিবে না।
….
রেস্টুরেন্টের দরজায় চোখ রেখে অথৈর ফ্রেন্ডসরা ওর জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছিল। অথৈ গাড়িতে ওঠে বসতেই মিনহা জিজ্ঞেস করল,

~ এত দেরি হলো কেন? কী এত কথা বলেছিল লোকটার সাথে? বিয়েতে রাজি হয়ে এসেছিস নাকি আবার!”

~আরে না রে, রাজি টাজি কিছু না। আর আমার রাজি অরাজি দিয়ে কিছু যাবে আসবেও না। বাবা তার অতি প্রিয় এই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রকেই মেয়ের জামাই বানাবে।”

~ তাহলে তুই এতক্ষণ ভিতরে ঘোড়ার ঘাস কাটছিলি নাকি?”

~ লোকটাকে বোঝাচ্ছিলাম উনার আমাকে বিয়ে করা ঠিক হবে না। তাই উনিই যেন বাবাকে না করে দেন।”

দুই বান্ধবীকে চড়িয়ে প্রাপ্তি ওদের থামিয়ে দিল।

~ এই তোরা থাম, থাম তো।”

অথৈ দাঁত কামড়ে কাঁধ ডলতে ডলতে বলল,

~ মারিস না তুই। কথা বলবি ভাল কথা অন্যকে মারতে হবে কেন?”

অথৈর কথায় পাত্তা দিল না প্রাপ্তি। উৎসাহ নিয়ে সে বলতে লাগল,

~ লোকটা দেখতে কেমন রে? হ্যান্ডসাম? তুর্কি নাকি কোরিয়ান? পাকিস্তানি ছেলেদের মত দেখতে হলেও চলবে অবশ্য।”

মিনহা ফোঁড়ন কেটে বলল,

~ লে আমরা আছি বিয়ে ভাঙার মিশনে আর চরিত্রহীন নারী আছে ওই লোকের লুক নিয়ে।”

মিনহার কথায় প্রাপ্তি রেগেমেগে আগুন হয়ে বলল,

~ তুই চরিত্রহীন। তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী চরিত্রহীন।”

অথৈ চেঁচিয়ে উঠে বলল,

~ উফ থাম তো তোরা। ওই লোক তুর্কি, কোরিয়ান কোনটাই না বাঙালিদের মতই দেখতে। আমার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে ঠিকঠাক চলে যেত। কিন্তু আমি এখন কাউকেই বিয়ে করতে চাচ্ছি না। তাই ওই লোকটাকে আমার পছন্দ না।”

কথাগুলো প্রাপ্তির তেমন পছন্দ হলো না। মুখ বাঁকাল সে। বলল,

~ কাউকেই তোমার পছন্দ না। কেউ প্রপোজ করলেও রাজি হবি না। বাবার পছন্দের ছেলেকেও রিজেক্ট করবি। তুই আসলে চাসটা কী? এই ছেলের সমস্যা কী? মেরিন ইঞ্জিনিয়ার! তোর বাবার ছাত্র। আঙ্কেল যা বলবে তা-ই শুনবে। বিয়ের পর তুই তোর বাবার কাছেই থাকতে পারবি। শ্বশুরবাড়িতে না থাকলে শ্বশুর শাশুড়ী ননদ অত্যাচার করতে পারবে না। এর বেশি বেটার তুই আর কী চাস?”

অথৈর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখে মিনহা ধমক দিয়ে প্রাপ্তিকে চুপ করিয়ে দিল।

~ তুই থাম তো প্রাপ্তি। বেশি বকরবকর করিস তুই। শুধু অথৈ কেন, আমরা তিনজনই জীবনে বিয়ে করব না। আজীবন চিরকুমারী থাকব। তুই যদি বিয়ে করতে চাসও তাহলে আমি নিজে তোর বিয়ে ভেঙে দিব। বলব তুই লেসবিয়ান। এতদিন আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করে আমাকে ঠকিয়েছিস।”

প্রাপ্তি ঘৃণায় চোখ মুখ বাঁকিয়ে বলল,

~ এহহ ছি! এসব কথা বলতে তোর লজ্জা করে না!”

মিনহা হাসছে। অন্য সময় হলে অথৈও এই কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খেত। কিন্তু আজ বিষন্ন মুখে বান্ধবীদের দিকে তাকাল। বলল,

~ বিয়ে করতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি শুধু আরও কয়েকটা বছর সময় চাই। তোরা তো জানিসই আমি ছাড়া আমার বাবার আর কেউ নেই। বিয়ে করে আমি শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে বাবা একদম একা হয়ে যাবে।”

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে অথৈর দিকে ফিরে মিনহা বলল,

~ তাহলে আঙ্কেলকে এই কথাগুলো খুলে বল।”

~ বললেও লাভ হবে না৷ বাবার মাথায় আমার বিয়ের ভূত চেপেছে। তার উপর আবার উনার আদরের ছাত্রকে পেয়েছে। কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি না।”

মিনহাও এবার সিরিয়াস হয়ে কথা বলছে,

~ তাহলে তুই বরং সরাসরি ওই লোকটার সাথে কথা বল। বল বিয়ে করতে তোর কোন অসুবিধা নেই। শুধু উনার তোকে কয়েকটা বছর সময় দিতে হবে।”

~সেটাই করতে গিয়েছিলাম।” অথৈ অন্যমনস্ক হয়ে মনে করতে লাগল আসার আগে সে লোকটাকে কী কী বলে এসেছে। বিড়বিড় করে নিজেকেই ধমকাচ্ছে অথৈ, ” ছ্যাহ! কী বলার ছিল আর কী বলে এসেছি!”
….
আরমান রেস্টুরেন্টে বসেই স্যারকে কল করলো। দু’বার রিং হবার পরেও তুললো না। স্যার হয়তো ব্যস্ত আছে। আরমান উঠতে যাচ্ছিল, ওর ফোন বাজলে আবার বসে পড়ল। স্যারের কল। তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করল সে।

~ হ্যাঁ আরমান, অথৈ গিয়েছিল? তোমার সাথে দেখা করেছে ও?”

~ জি স্যার।”

~ তা কী ঠিক করলে তোমরা?”

~ আমার কোন আপত্তি নেই স্যার। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি।”

~ আলহামদুলিল্লাহ। যাক খুশি হলাম। তোমার থেকে এই উত্তরেরই প্রত্যাশা করছিলাম। তাহলে কাল একবার বাসায় এসো। আজ আমার একটু কাজ আছে।”

~ ঠিক আছে স্যার।”

কল কেটে আরমান অজান্তেই হেসে ফেলল। অথৈ যখন তার বাবার মুখে শুনবে সে বিয়েতে রাজি হয়েছে তখন অথৈর চেহারা কেমন হবে ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। অথৈ হয়তো বিশ্বাসই করতে পারবে না। আরমানের উপর প্রচন্ড রাগ হবে তার। পরের বার দেখা হলে নিশ্চয় হাতের সামনে যা পাবে তা-ই দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিবে।

~ কিন্তু আমার যে কিছু করার নেই মিস অথৈ। আপনার ভালোবাসায় আমি এমন ভাবে পা পিছলে পড়েছি এখন যে বিয়ে না করা পর্যন্ত ওই অবস্থা থেকে উঠতে পারব না।”
…..
অথৈ মনে মনে নিশ্চিত ছিল লোকটা বিয়েতে না করে দিবে। লোকটাকে এমনভাবে বুঝিয়েছে যে, উনি কিছুতেই হ্যাঁ বলবেই না। বিয়ে ভেঙে দিতে পারার খুশিতে গুনগুন করতে করতে হেলতে দুলতে ড্রয়িংরুম দিয়ে যাচ্ছিল সে। বাবা মনে হয় এখনও ফিরেনি।

~ অথৈ।”

বাবার ডাক শুনে থেমে গেল সে। হাসিখুশি মুখেই বলল,

~ আজ জলদি চলে এলে?”

~ হ্যাঁ। কারণটাই কিছুটা এমন সামনাসামনি না বললে হতো না। আরমান তার উত্তর জানিয়ে দিয়েছে। বিয়েতে রাজি ও। তোমাকে বিয়ে করতে কোন আপত্তি নেই ওর।”

~ভালো।” অথৈ প্রথমে মনোযোগ দিয়ে শুনেনি। বাবা কী বলল? চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাস্য গলায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল,

~ হ্যাঁ! কী বললে? কে রাজি?”

চলবে….

#একটি_রূপকথার_গল্প’৩’
#জেরিন_আক্তার_নিপা

অথৈকে কেউ যেন আসমানের উপর থেকে জমিনে ছেড়ে দিল। সে টপ করে জমিনে পড়ে তব্দা খেয়ে আছে। বাবা কী খেয়ে এসে এমন আবোলতাবোল বলছে! লোকটা কী করে বিয়েতে রাজি হবে? আশরাফ হোসেন মেয়েকে লক্ষ করে দেখলেন। কোন একজন অচেনা মানুষকেও প্রথম বার দেখে মনের কথা বলে দিতে পারেন তিনি। আর অথৈ তো তার নিজের মেয়ে। বাইশটা বছর ধরে চোখের সামনে দেখে আসছেন। ওকে রগে রগে চেনা আছে। নিশ্চয় আরমানোর সাথে দেখা করতে গিয়ে এমন কিছু করে এসেছে যাতে আরমান নিজেই বিয়েতে না করে দেয়। কিন্তু আরমান না করার বদলে হ্যাঁ করেছে বলেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

~ মনে হচ্ছে তুমি ওর থেকে অন্য কোন উত্তর আশা করছিলে। ওর এই উত্তরে তুমি খুশি হতে পারছ না।”

~ তুমি চাও আমি এখন খুশিতে ধেইধেই করে নাচি?”

~ নাচবে কেন? কিন্তু মুখটাকে এমন করে রেখেছ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি খুব খারাপ একটা সংবাদ শুনলে।”

~ তোমার জন্য এটা সুসংবাদ হলেও আমার জন্য দুঃসংবাদই।”

অথৈ রেগে বোম হয়ে গটগট করে রুমে চলে গেল। আশরাফ হোসেন হেসে ফেললেন। অথৈর চাল তার উপরই ভারী পড়ে গেছে। ভেবেছিল নিজে কিছু না করে আরমানকে দিয়ে কাজ আদায় করে নিবে। কিন্তু ছেলেটার বুদ্ধি আছে।

~ আমার মেয়ের ফাঁদে পা না দিয়ে প্রথম পরীক্ষায় তুমি ফুল মার্কে পাস করে গেছ।”

রুমে এসে অথৈর ইচ্ছে করছে বাথটাব ভর্তি বরফ কুচি দিয়ে পুরো এক ঘন্টা শুয়ে থাকতে। সর্বাঙ্গে আগুন জ্বলছে তার। লোকটা কী পরিমাণে অসভ্য! এত করে বলে আসার পরেও এরকম একটা বদমায়েশি করতে পারল! অথৈ পায়ে জোরে জোরে শব্দ করে ঘরময় পায়চারি করে যাচ্ছে।

~ লোকটা একটা ফাজিল। একটা অসভ্য। মানুষকে বাইরে দিয়ে দেখে ভেতরটা বোঝা যায় না। দেখতে সভ্য হলেও কাজকর্মে মীরজাফরের বংশধর। শালা হারামি করলোটা কী হ্যাঁ!”

বাবার স্টাডিতে এসে থমথমে মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। আশরাফ হোসেন মেয়েকে দেখে ডাকলেন। অথৈ ভেতরে এলো।

~ ওই লোকের ফোন নাম্বার দাও।”

আশরাফ হোসেন ঠিক বুঝতে পারলেন না অথৈ কোন লোকের কথা বলছে। কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে তিনি বললেন,

~কোন লোকের কথা বলছ?”

~নাটক কোরো না। তুমি জানো না কোন লোকের কথা বলছি? তোমার আদরের ছাত্রের।”

আশরাফ হোসেন তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে দেখলেন। আরমানের ফোন নাম্বার চাইছে কেন ও! কী করতে চাচ্ছে অথৈ? অথৈ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আশরাফ হোসেন মেয়েকে কোন প্রশ্ন করলেন না। আরমানের নাম্বার দিয়ে দিলেন। মনে মনে ভাবলেন, ছেলেটাকে কল করে জানিয়ে দেওয়া উচিত। পরক্ষণে ভাবলেন, না থাক। অথৈকে ওর নিজেরই হ্যান্ডেল করতে দেওয়া উচিত। বাবার হাত থেকে ছোট্ট কাগজের টুকরোটা নিয়ে ওতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখল অথৈ। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

~ ধন্যবাদ।”

সাথে সাথে ফিরে দাঁড়িয়ে যেতে লাগল অথৈ। আশরাফ হোসেন কিছুটা বিস্ময় নিয়ে মেয়ের যাওয়ার দিকে দেখছেন। অথৈর ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ছিল! আরমানের সাথে কী করতে চাচ্ছে ও। এবার সত্যি সত্যিই চিন্তিত হলেন তিনি। মেয়েকে তিনি যতটা চিনেন তাতে অথৈ নিজের কথা মানানোর জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। আর পাগল মেয়ে ওসব উল্টাপাল্টা কাজ করার আগে একবার ভাববেও না।

রুমে এসে অথৈ থুতনি চুলকাতে চুলকাতে ভাবছে আগে কার সাথে কথা বলবে। ওই লোকটাকে আগে টাইট করবে? নাকি ফুপির সাথে কথা বলবে। ফুপিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে একবার হাত করতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। ফুপিই ব্যাটাকে দিনে তারা দেখিয়ে দিবে।
অথৈ প্রথমে আরমানের নাম্বারে ট্রাই করল। ফোন বিজি বলছে। চোখ মুখ কুঁচকে ফোনের দিকে দেখল সে।

~ কার সাথে কথা বলছে লোকটা!”

পরপর কয়েকবার কল দিতেই থাকল। যতক্ষণ না ধরবে ততক্ষণ দিতে থাকবে। আজ ফোনেই একটা দফারফা করে ছাড়বে। অসভ্য বদমাশ লোক তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে! কত বড় সাহস।

~ আমাকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছিস, না? আমি তোকে এমন শাদীকা লাড্ডু খাওয়াব, ডায়েবিটিস হয়ে মরবি তুই শালা হারামি।”
……
আরমনা তার বন্ধু রাশেদের সাথে কথা বলছিল। অননোন নাম্বার থেকে কল আসছে দেখেও সে তেমন একটা পাত্তা দিল না। আজকের দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোই রাশেদকে বলছে। রাশেদ ফোনের ওপাশে আগ্রহে ফেটে পড়ছে।

~ তারপর কী করলি তুই?”

আরমান ফোঁস করে দম ফেলল। বলল,

~ কী আর করব! অথৈকে পছন্দ না হলেও আমি স্যারকে মানা করতে পারতাম না।”

~ কিন্তু মেয়েটা তোকে মুখের উপর বলেছে তোকে ও বিয়ে করবে না।”

~ তা বলেছে। কিন্তু আমাকে অপছন্দ করার মত কোন কারণ নেই ওর কাছে। অথৈ আমাকে না, ও এই মুহূর্তে কাউকেই বিয়ে করবে না।”

~ যাক দোস্ত শেষ পর্যন্ত তাহলে তোরও একটা গতি হয়ে গেল।”

আরমান বাম হাতের উপর মাথা রেখে সিলিঙের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। আজ সকালে স্যার জানিয়েছে বিয়ের আগে অথৈর সাথে যেন একবার দেখা করে নেয়। বিয়েটা সারা জীবনের ব্যাপার। বিয়ে দু’জন মানুষকে এক সুতায় গেঁথে ফেলে। অথৈকে তার জেনে নেওয়া প্রয়োজন। দু’জনের মতের মিল হলে তবেই রাজি হওয়া উচিত। আরমান স্যারের কথা মতই দুপুরে অথৈর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সে নির্ধারিত সময়েই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু অথৈর আসার নামগন্ধ নেই। দশ মিনিট থেকে বিশ মিনিট তারপর আধা ঘণ্টা কেটে গেল। তবুও অথৈ আসছে না দেখে আরমান উঠে পড়ার কথা ভাবছিল। অথৈ হয়তো আসবে না। কিন্তু তখনই সে একটা মেয়েকে রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে। সে এতক্ষণ যার জন্য অপেক্ষা করছে এই মেয়েই সেই মেয়ে কিনা তার জানা নেই। কিন্তু মেয়েটার দিকে সে তাকিয়েই রইল। চোখ সরাতে পারল না। অথৈর হাত থেকে পার্স পড়ে গেলে সে ঝুঁকে তুলে নেওয়ার সময় একগোছা চুল অবাধ্য হয়ে মুখের উপর এসে পড়ে। সোজা হতে হতে ডান হাতের আঙুল গুলো চিরুনীর মত চালিয়ে চুলগুলোকে পিছনে নিয়ে যায়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে সবগুলো টেবিলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজছে মেয়েটা। আরমান ভাবল এটাই হয়তো সে মেয়ে যার জন্য অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু শিওর হতে পারল না সে। অথৈ ঠোঁট কামড়ে লোকটাকে খুঁজছে। এখানে আসবে শুনে বাবা তাকে লোকটার ছবি সেন্ড করেছিল। হ্যাঁ ওই তো লোকটা। কোনার একটা টেবিলে বসে আছে। লোকটাও তাকেই দেখছে। অথৈ সোজা এই টেবিলে চলে এলো। আরমানের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল,

~ আপনিই কি মিস্টার আরমান আবরার?”

~ জি।”

~ আমি অথৈ আশরাফ।” বলতে বলতে চেয়ার টেনে বসে পড়ল অথৈ। পার্স থেকে ছোট্ট একটা ক্লিপ বের করে সামনের ছোট চুলগুলোকে পেছনে নিয়ে আলগা করে আটকে দিল। ওই মুহূর্তেই আরমান কাত হয়ে গেল। এই বিয়েতে না করার কোন প্রশ্নই আসে না। যে মেয়েকে সে প্রথম দেখায় মন দিয়েছে সারাজীবন তাকেই পাশে পেতে চায়। অথৈ যখন বলছিল, আপনাকে আমার পছন্দ না। তখন তার ভেতরে কেমন যেন একটা খারাপ লাগা শুরু হয়েছিল। কিন্তু যখন বুঝল, অথৈ তাকে কেন কাউকেই বিয়ে করবে না। বিয়েতে না করার একটাই কারণ পড়াশোনা শেষ না করে এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। তখন খারাপ লাগাটা কিছুটা কমলেও মনটা পুরোপুরি শান্ত হয়নি।

চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরমান।

~আপনাকে আমি প্রথম দেখাতেই মন দিয়েছি। আপনি কি আমাকে ভালোবাসার চেষ্টাটুকুও করবেন না অথৈ? আপনার কি সেরকম পছন্দের মানুষ কেউ আছে?”
……
অথৈর বড় ফুপি মারজিয়া ইসলাম। পেশায় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। ফুপি বাবার বড় হওয়ায় ফুপির কথার উপর আজ পর্যন্ত কোন কথা বলতে পারেনি বাবা। আর বললেও ফুপি তা শুনবে কেন? ফুপি এমন একজন মানুষ যে সব কাজে নিজের মতামতকে উপরে রাখে। নিজের যা ঠিক মনে হবে সেটাই করবে। এতে কেউ সঙ্গ দেক বা না দেক। ফুপা ব্যবসায়ী মানুষ। বলা যায় ফুপা যে জিনিসে হাত লাগায় তা-ই সোনা হয়ে যায়। বিজনেসে ফুপার লাক ভীষণ ভালো। ঠিক দাদুর মতন। অথৈর দাদু ছিলেন হাড় কিপ্টে মানুষ। জীবনে শুধু দু’হাতে অর্জন করে গেছেন। কোনকিছুই ভোগ করে যেতে পারেননি। বাবা শিক্ষক মানুষ বিজনেসের ‘ব’ও বুঝে না। দাদুর এত বড় ব্যবসা আর কয়দিনে বাবা হয়তো উড়িয়েই দিত। ফুপা যদি সাহায্য না করত। বাবা নিশ্চিন্তে নিজের অংশের ব্যবসাটুকুও ফুপার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দিব্যি আছেন। এতদিনে ফুপা নিজের ব্যবসা সহ বাবার ব্যবসাও তিনগুণ বাড়িয়েছে। কত জায়গায় যে ফুপার ব্যবস্থা জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা হয়তো ফুপা নিজেও জানে না। এত টাকাপয়সা দিয়ে ফুপা কী করবে তা নিয়ে ফুপাও দুশ্চিন্তায় আছে। তবে এই দম্পতির কোন সন্তান সন্তানাদি নেই৷ তবুও ওরা সুখী। বিয়ে ষোল বছর পরেও ফুপির কোন সন্তান না হলে একটি মেয়েকে এডপ্ট করেছিল। কিন্তু সেই মেয়েটাও সাত বছর বয়সে সামান্য জ্বরে মারা যায়। তারপর আর ফুপি সন্তানের ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। ফুপাও জোর দেননি। সমস্যাটা ফুপির। ফুপি কখনও মা হতে পারবে না। ফুপা এই নিয়ে কোনোদিনও একটা কথাও বলেনি। অনেক পুরুষই আছে যারা সন্তান না হলে দ্বিতীয় বিয়ে করে। ফুপা তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফুপা অথৈর দেখা আদর্শ একজন স্বামী। সে সবসময় এটাই চায় ফুপার মত কেউ একজন তার জীবনে আসুক। ফুপিকে ফুপা যতটা ভালোবাসে ঠিক ততটাই যেন সেই মানুষটাও তাকে ভালোবাসে। আজ সকালে অথৈদের বাড়িতে বিনা মেঘে বজ্রপাত হচ্ছে। বাবার ভীমরতি ছুটাতে ফুপি সকাল সকাল হাজির। বাড়িতে পা রেখেই ফুপি বাবাকে যা-তা বলে গালাগাল দিচ্ছে। অবশ্য আগুনে ঘি ঢালার কাজ অথৈ রাতেই করে রেখেছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here