#একটি_রূপকথার_গল্প,৪,৫
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪
~ কোথায় গাধাটা? ওই গরু কই? ওরে নাকি ভীমরতি ধেরেছে? ওর মাথায় তরমুজ ফাটিয়ে ওর ভীমরতি ছুটাবো আমি। কাকে জিজ্ঞেস করে এত বড় সিদ্ধান্ত নিল?”
ফুপির গলা শুনে অথৈ ঘর থেকে দৌড়ে এলো। এসেই ফুপির বুকে পড়ে কান্নার প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্তু চোখ ঢলে কচলেও একফোঁটা পানি বের করতে পারছে না। চোখে পানি না থাক গলায় কৃত্রিম কান্না এনে অথৈ বলল,
~ ফুপি এসেছ তুমি!”
~ তোর বাপটা কই? গাধাটার এত বড় সাহস! কাকে জিজ্ঞেস করে তোর বিয়ে ঠিক করেছে ও? আমি কি মরে গেছিলাম? ছেলে দেখা নেই, ছেলে করে কি জানা নেই, বংশ কেমন কোনকিছু না জেনেই মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে!”
~ বাবাকে তুমি বুঝাও ফুপি।”
~ ওই গাধাকে আর কী বুঝাব আমি? মরলেও তো ওইটা গাধাই থাকবে।”
আশরাফ হোসেন বোনের সামনে কোন কথা বলারই সুযোগ পাচ্ছে না। মারজিয়া উনাকে কিছু বলতে দিলে তো।
~ আরমান আমার ছাত্র বুবু। নিজের হাতে ওকে গড়ে তুলেছি। ছেলেটাকে আমি খুব ভালো করে চিনি।”
~ কচু চিনিস তুই। তোর কোন ছাত্রটা তোর কাছে খারাপ? তাই বলে কি সবার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবি?”
~ আরমানকে তুমি দেখোনি বলে আপত্তি করার সুযোগ পাচ্ছ। একবার ওকে দেখলে তুমিও এটাই চাইবে।”
~ চুপ কর তুই গাধা। তোর ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনলে গা জ্বলে আমার। করিস তো হাইস্কুলে ঠ্যাঙা মাস্টারি। ওই ছেলেকে ডাক। আমিও দেখি কত বড় সেয়ানা ওই ছেলে। তোকে হাত করে আমার ভাইঝিকে বিয়ে করার ফন্দি করছে!”
~ডাকব। কিন্তু তুমি তো আগে শান্ত হও। বিয়ে কি আমি দিয়ে দিয়েছি? তোমাকে ছাড়া…
~ আমাকে ছাড়াই তো বিয়ের কথা বলে ফেলতে পেরেছিস। দিতে বাকি আর কী রেখেছিস?”
…..
কাল মেয়ের সাথে দেখা করেছে। আজ মেয়ের ফুপু দেখা করতে চায়। পরশু কি চাচী বা খালা দেখা করার কথা বলবে? আরমানের নার্ভাস লাগছে। নার্ভাস লাগার কারণ স্যার নিজে জানিয়েছেন, “আরমান, আমার বড় বোন একটু কঠিন প্রকৃতির। ওর কোন কথায় কষ্ট পেও না তুমি। আসলে অথৈকে ও নিজের মেয়ের মত বড় করেছে তো।”
কথা ছিল আরমান উনার চেম্বারে যাবে। কিন্তু তিনি যে নিজে এসে তার বাসায় উপস্থিত হবে তা কে জানত? একলা মানুষ সে। রান্নাবান্না, ঘর গোছানোর জন্য একজন বোয়া ছিল। তিনিও কয়দিন হলো ছুটি নিয়েছেন। নিজেই রান্না করছে সে। ঘরটরও নিজেই গোছাচ্ছে। এই পরিবেশ অথৈর ফুপুর পছন্দ হবে না এটাই স্বাভাবিক। তবে অন্য দিনের তুলনায় আজকে তার বেডরুমটা ভালোই আছে। মারজিয়া ঘুরে ঘুরে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখছে। বেশ গুছালো ছিমছাম পরিবেশ। সে আসার আগে বলে আসেনি। না জানিয়ে হঠাৎ চলে এসেছে। যাতে ছেলেটা তাকে খুশি করার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে না রাখতে পারে।
~ তুমি এখানে একা থাকো?”
~ জি।”
~ কেন? মা বাবা তোমার সাথে থাকে না?”
~ আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমার বাবা মারা গেছেন। মাধ্যমিক দেওয়ার পর মা-ও চলে গেলেন। আর কোন ভাই বোন ছিল না। তাই আমাকে একাই থাকতে হয়।”
মারজিয়া ছেলেটার মুখের দিকে তাকাল। কথাটা শুনে একটু নরম হয়েছেন তিনি। এসব কথা বলার সময়ও ছেলেটার মুখে হাসি। কিন্তু এই হাসির পেছনের দুঃখটা দেখতে পারছেন তিনি। জীবনে অনেক মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। নানানরকম অভিজ্ঞতাও আছে। ছেলেটাকে বাইরে থেকে হাসিখুশি দেখা গেলেও ওর মনে অনেক কষ্ট লুকানো।
~ রান্নাবান্না কে করে?”
~ একজন খালা ছিলেন। উনি দেশের বাড়িতে গিয়েছেন।”
মারজিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখছেন তিনি৷ আসবাবপত্র দেখে ছেলের রুচি আন্দাজ করা যাচ্ছে। বেশ সৌখিন জিনিসপত্র। একা মানুষ। ভালো বেতনের জব করে। টাকাপয়সা কী করে? নেশা টেশা করে নাকি মেয়ে মানুষের পেছনে উড়ায়। না, এই ছেলে এরকম হতেই পারে না। এর সরলতা চোখে ভাসে।
~ চা খাবেন ম্যাম?”
মারজিয়া ভুরু কুঁচকে আরমানের দিকে তাকালেন। বেশ কঠিন গলায় বললেন,
~ কী বললে তুমি?”
আরমান হকচকিয়ে গেল। কিছুটা ভয়ে ভয়েই সে বলল,
~ চা খাবেন কি-না জিজ্ঞেস করেছি।”
~ কিন্তু তুমি ম্যাম কাকে বললে? ম্যাম কে?”
ম্যাম বলা অন্যায় নাকি? ফুপু বললে যদি রাগ করে এটা ভেবেই তো ম্যাম বলেছে।
~ আমি অথৈর ফুপু। ফুপু হলেও মায়ের থেকে কম না। অথৈ আমারই মেয়ে। তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও আর আমাকে ম্যাম বলো!”
আরমান হেসে ফেলল। মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
~ আপনাকে মা ডাকলে আপনি কি রাগ করবেন?”
~ বোকা ছেলে আবার প্রশ্ন করে! গাধাটা… আমার ভাইটা কী দেখে পছন্দ করেছে তোমায়? চা খাওয়ার কথা না বলছিলে। কে চা করবে?”
~ আমিই করব মা।”
আরমান খুব কষ্টে চোখের পানি আটকে রাখছে। আশরাফ স্যার যতটা ভালো উনার বোন তার থেকেও বেশি মমতাময়ী। পৃথিবীতে এতো ভালোও মানুষ আছে! আচ্ছা তার ভাগ্যে এমন ক’জন মানুষের ভালোবাসা পাওয়া লেখা ছিল যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তার থেকে বেশি আপন হবে এরকমটা কি সে কখনও ভেবেছিল! আরমান আজ কতটা খুশি তা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। কোন ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবে না। আজ সে মা পেয়েছে।
……
বাবা তো বাবাই, ফুপিও কি বাবার সাথে পাগল হয়েছে? ফুপির থেকে এরকমটা কোনমতেই আশা করেনি অথৈ। ভেবেছিল ফুপি লোকটাকে রাম টাইট দিয়ে আসবে। কিন্তু ফুপি তো ওখান থেকে ফিরে অন্য সুর ধরেছে। ফুপির কথা শুনে অথৈর কুয়ায় ঝাপ দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ঢাকা শহরে সে কুয়ো পাবে কোথায়? অথৈ চেঁচাচ্ছে।
~ ওই লোকটা কি জাদু জানে নাকি? মন্ত্রতন্ত্র পড়ে তোমাদের দু’জনকেই বশ করে ফেলেছে। বাবা নাহয় বোকা। কিন্তু তুমি তো একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। মানুষ চেনা তোমার কাজ। তুমি কীভাবে ওই লোকটার ধোঁকায় পড়লে ফুপু? কী পানি পড়া খাইয়েছে তোমাকে?”
~ মাথা ঠান্ডা কর তো সোনা। কেউ আমাকে পানি পড়া খাওয়ায়নি। হ্যাঁ একটা কথা তুই ঠিক বলেছিস। ছেলেটা জাদু জানে। কিন্তু এই জাদু মন্ত্রতন্ত্রের জাদু না। ভালোবাসার জাদু আছে ওর কাছে। এই বাড়ির জামাই হলে আরমানই হবে।”
আশরাফ হোসেন বোনের কথা শুনে হাসছেন।
~ দেখেছ তো বুবু! আমি তোমায় বলেছিলাম। তুমি তো সকালে আমাকে শুধু শুধু বকলে।”
~ সরি রে বাবু। আমি বুঝতে পারিনি। শুধু শুধু তোকে কত কিছু বলেছি। আ’ম রেইলি ভেরি সরি।”
~ ইট’স ওকে বুবু। তুমি আমাকে কারণ ছাড়াই বকতে পারো।”
অথৈ দুই ভাই বোনের গদগদ ভালোবাসা দেখে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আজ সকালেও ইঁদুর বিড়ালে ঝগড়া করে গেছে। এখন ভালোবাসা দেখো! অথৈ রাগ করে হাতের কাছে থাকা ফুলের টবটা তুলে আছাড় মেরে কয়েক টুকরোয় ভেঙে ফেলল। সেদিকে বাবা বা ফুপু কেউ নজরই দিল না। ফুপু গদগদ গলায় বলছে,
~ ছেলেটাকে একদিন বাড়িতে আসতে বলতে হবে। বোয়া দেশে গেছে। কী রাঁধে কী খায় কে জানে! তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেল। ওর তো গুরুজন কেউ নেই। বিয়ের কথা ওর সাথেই বলতে হবে।”
অথৈ আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়াল না। ঘরে গিয়ে ধড়াস শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল। ফুপিও পাগল হয়ে গেছে। এখন শুধু তার পাগল হওয়া বাকি। তাহলেই ষোল কলা পূর্ণ। পুরো গোষ্ঠী পাগল হয়ে ওই লোকের ঘাড়ে ঝুলে পড়বে। দুঃখে কষ্টে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। শেষে কি-না ফুপিও! ফুপি তার সাথে এমনটা করতে পারল। এখন তো এই বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না। কারো সাধ্য নেই এই বিয়ে আটকানোর। অথৈ নাকিকান্না করতে করতে বলল,
~ আল্লাহ তুমি আমাকে এ কোন ঝামেলায় ফেললে বলো তো। ওই লোকটাকে আমি বিয়ে করতে চাই না। তুমি কি ওকেই আমার কপালে লিখে রেখেছ?”
অথৈ বালিশ টালিশ ছুঁড়ে ফেলে ফোন খুঁজে হাতে নিল। লম্বা করে দম নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল। এখন বাবা বা ফুপিকে কিছু বলে লাভ নেই। যা বলার লোকটাকেই বলতে হবে। গতরাতের মত আজও রিং হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোকটা কল তুলছে না। অথৈ বিরক্তি নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল,
~ ফোন ধর ব্যাটা তুই। ফোন ধর। কোন দেশের রাজারে তুই! ফোন কল ধরার জন্য চামচা রেখে দিতে হবে তোরে? তুই খালি একবার কল তুলে দেখ। ফোনের ভেতর দিয়ে গিয়ে তোর চুল ছিড়ব আমি। আমাকে বিয়ে করবি? তোর বিয়ে করার শখ যদি আমি জন্মের মত ঘুচিয়ে না দিয়েছি , তাহলে আমার নামও অথৈ আশরাফ না। আমার নাম হবে কথা রাখতে না পারা বাদুড়নী আশরাফ।
…..
আরমান ফোন রুমে ফেলে রেখে বাইরে গিয়েছিল। যার কারণে অথৈর কল সে ধরতে পারেনি। রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে এতগুলো মিসড কল দেখে ভাবনায় পড়ে গেল। এটা কে হতে পারে? কার নাম্বার এটা? কাল রাতেও এই নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল এসেছে। সে কল ব্যাক করলো।
ফোন রিং হতেই অথৈ বেডের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ফোন হাতে নিল। ব্যাটা নবাবজাদা কল ব্যাক করেছে। রিসিভ করেই অথৈ বলতে লাগল,
~ অসভ্য। অভদ্র। ইতর। বদ লোক। আপনার সাহস কী করে হয় আমার ফুপিকে…
কানের পর্দা হয়তো ফেটেই গেছে আরমনাের। অথৈ এরকম ভাবে চেঁচিয়ে কথা বলছে। ফোন ধরা হাতটা কান থেকে দূরে সরিয়ে নিল। অন্য হাতে কান ডলতে ডলতে বলল,
~ফোনের ভেতর এত চোটপাট! সামনে থাকলে কী করত কে জানে!”
~ এই ব্যাটা উত্তর দিচ্ছেন না কেন? এখন বোবা লেগে আছেন কেন? আমার ফুপিকে কী খাইয়েছেন আপনি? আপনি কি ভেবেছেন এসব করে আপনি পার পেয়ে যাবেন! কত বড় বদ লোক হলে…
আরমান কট করে কল কেটে দিল। অথৈ এখন রেগে আছে। ওর রাগ কমার অপেক্ষায় রইল সে। রাগের মাথায় মানুষ যা খুশি বলে ফেলতে পারে। পরে রাগ কমলে সেই কথার জন্য অনুতপ্ত হলেও তা আর ফেরত নেওয়া যায় না। আরমান চায় না অথৈও এখম এমন কিছু করে পরে অনুতপ্ত হোক।
চলবে_
#একটি_রূপকথার_গল্প’৫’
#জেরিন_আক্তার_নিপা
অথৈ হড়বড় করে বলেই যাচ্ছিল। কল কেটে গেছে এটা সে লক্ষ করেনি। ফোনের ওপাশে আরমান নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখে রেগে বলল,
~বোবায় ধরছে নাকি? আল্লাহর দেওয়া জবান কাজে লাগাবেন না তাহলে কেটে ফেলে দিন।”
টুট টুট শব্দে ফোনের স্ক্রিনের দিকে দেখল অথৈ। ফোন হাতে নিয়ে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল। কত্ত বড় সাহস! তার কথার মাঝখানে কল কেটে দিয়েছে! অথৈ ফোন ছুড়ে চিৎকার করে উঠল,
~ আমি কিছুতেই এই লোককে বিয়ে করব না।”
…..
অথৈ ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ছে। তার ছোটবেলার শখ এটা বলা যায়। তার এই সিদ্ধান্তে বাবা ফুপি কেউই খুশি হয়নি। একমাত্র ফুপা ছাড়া। শুধু ফুপাই বলেছিল,
” ওর যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়েই পড়ুক না।”
ফুপার এই কথা শুনে ফুপি ফুপাকে এমন এক ধমক দিয়েছিল,
” তুমি চুপ করো। এমনিতেই ও নাচুনি বুড়ী তুমি আবার তার উপর ঢোলের বারি দিচ্ছ। ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ে ও কী করবে? মিডিয়ার জগতে আমি ওকে কদম রাখতে দিচ্ছি না।”
জীবনে প্রথম বার বাবা ফুপির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের শখকে প্রধান্য দিয়েছিল অথৈ। নিজের স্বপ্নটাকে পরিবারের স্বপ্নের থেকে বড় করে দেখেছিল। বাবা অবশ্য তাকে কিছুই বলেনি। ফুপিও না। তবে ফুপি শুধু বলেছিল, দেশের একজন টপ ফ্যাশন ডিজাইনার না হতে পারলে আমার সামনে কখনও দাঁড়াস না।’ চার বছরের কোর্সে এবার তৃতীয় বর্ষে আছে সে। তার লক্ষে পৌঁছাতে আর মাত্র একটা বছর। তারপর সে তার স্বপ্নকে ছুঁতে পারবে। কেউ যখন তার ডিজাইন করা কাপড় পরবে তখন তার কেমন লাগবে? ক্লাস টেস্টের প্যারায় দু’টা দিন বিয়ের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেদিনের পর ফুপিও বাসায় আসেনি। বাবাও কিছু বলেনি তাকে৷ আজ বাড়ি ফেরার সময় ফুপির কল আসল।
~ হ্যাঁ ফুপি বলো।”
~ কই তুই?”
~ ক্লাস শেষ করে বাড়ি যাচ্ছি।”
~শোন, শোন আমার এখানে চলে আয়।”
~ তোমার চেম্বারে? ওখানে গিয়ে আমি কী করব?”
~ আরে আমার বাসায় আয়।”
~ কেন বলো তো।”
~কেন কী আবার? শেষ কবে এসেছিলি মনে আছে।”
~ অনেকদিন হয়েছে। আচ্ছা আসছি। আমি কিন্তু বিরিয়ানি খাব।”
~ বিরিয়ানির পাগল রে! হেলদি কোন খাবার তোর গলা দিয়ে নামে না।”
অথৈ বাবাকে জানিয়ে দিল সে আজ ফুপির ওখানে যাচ্ছে। ফুপি রান্নাঘরে বিরিয়ানি রাঁধছে। ভেতর থেকে কী সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। গন্ধেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অথৈ বসার ঘরে সোফায় পা তুলে বসে টিভি দেখতে দেখতে কমলা খাচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের মত কিছু কমলার খোসা ফ্লোরে এদিক ওদিক ছিটিয়ে ফেলেছে। কিছু সামনের ছোট টেবিলে জমিয়েছে। টিভিতে টম এন্ড জেরি কার্টুন চলছে। তা দেখেই অথৈ মাঝে মাঝে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। কে যেন এসেছে। কলিংবেল বাজছে। কিন্তু অথৈ শুনেও উঠছে না। কিচেন থেকে মারজিয়া গলা উঁচিয়ে বলল,
~ বুলবুলি দেখ তো কে এসেছে।”
~ আমি এখন টিভি দেখছি।”
~ টিভি দেখলে দরজা খোলা যায়। যা দরজা খোল গিয়ে।”
~ আমি পারব না। তুমি দেখো কে এসেছে।”
~ আমাকে আসতে হলে আগে তোর কান গরম করব তারপর দরজা খোলব।”
~দূর!” না চাইতেও উঠতে হলো অথৈকে। ফুপি যে কী! শুধু তাকে দিয়ে কাজ করাতে চায়। এরা কেন বুঝে না কাজ করতে অথৈর কতটা কষ্ট লাগে। হেলেদুলে দরজার সামনে গেল। বাম হাতে কমলার একটা কোয়া মুখে দিয়ে ডান হাতে দরজা টেনে খুলেছে মাত্র, সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে নিল। দরজা খুলেও মুখের উপর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা অবাক হলো আরমান। অথৈ যে দরজা খুলেছে তা সে দেখেনি। এদিকে অথৈ এক দৌড়ে বসার ঘরে চলে এলো। এই ছিল তাহলে ফুপির মনে! লোকটা আজ এখানে আসবে বলেই ফুপি তাকেও আসতে বলেছে। সে বোকার মতন বিরিয়ানির লোভে পড়ে কিছু না ভেবেই নেচে নেচে চলে এসেছে। অথৈ চিৎকার করে বলল,
~ ফুপি, তুমি অনেক খারাপ। আমি আর কোনোদিনও তোমার বাসায় আসব না। তুমি কান্নাকাটি করে বন্যা বইয়ে ফেললেও না।”
এক দৌড়ে দোতলায় চলে গেল অথৈ। রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল।
আরমান ভাবছে আবার বেল টিপবে কি-না। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হলো না। মারজিয়া এসে দরজা খুলে দিল। আরমানকে দেখে হাসি মুখে বলল,
~ এসো।”
~ আপনি কেমন আছেন?”
মারজিয়া বাঁকা চোখ তাকালে আরমান হেসে ফেলে বলল,
~ মা।”
ভেতরে এসে বসার ঘরের অবস্থা দেখে মারজিয়ার চক্ষু চড়কগাছ। অথৈটা এ কী হাল করে রেখেছে! এই মেয়েটা এত নোংরা কেন? যেখানে বসবে ওই জায়গাকে ডাস্টবিন করে ছাড়বে। আরমানের সামনে কী বলবে ভেবে পেল না মারজিয়া। তাড়াহুড়ো করে টেবিলের উপর থেকে কমলার খোসা হাতে নিয়ে আরমানের দিকে ফিরে কৈফিয়তের সুরে বলল,
~ আমার বাড়িতে ভীষণ পাঁজি একটা বেড়াল এসেছে। এসব ওরই কাজ।”
আরমানের বুঝতে বাকি রইল না ফুপি কার কথা বলছে। আর কে প্রথমে দরজা খুলেছিল। অথৈ তাহলে এখানেই আছে। কোথায় সে? অথৈকে দেখার জন্য আরমানের দু’চোখ আকুল হয়ে উঠছে। তার অশান্ত চোখ দু’টো অথৈকে দেখতে পারলেই যেন শান্ত হবে। অথৈ কি তাকে দেখে লুকিয়ে আছে? তার সামনে আসবে না? একটা বার দেখা দিবে না? আর কত অপেক্ষা করবে সে? সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে যাওয়ার পর দেখে অথৈকে আর দেখিনি সে। পরের দিন রাতে কল করেও অথৈ ঠিকঠাক মতো কথা বলল না। রাগের মাথায় কী সব বলল সে নিজেও জানে না।
~ তুমি বসো বাবা।”
….
আসার পর থেকে একাই বসে আছে আরমান। অথৈর দেখা সে এখনও পায়নি। বসে বসে পা নাচাচ্ছে। নখ খুঁটছে। ঘরের আসবাবপত্র দেখছে। বসার ঘরে অনেকগুলো পেইন্টিং আছে। একটা জল রঙে আঁকা গ্রামের ছবি। ছবিতে প্রকৃতি বৃষ্টি নামার আয়োজন করছে। বাতাসে ধানের ক্ষেত দুলছে তা যেন আরমান চোখের সামনে দেখতে পারছে। আরেকটা পেইন্টিং অনেকগুলো কদম ফুল একসাথে। বাকি যেগুলো আছে তা কোন বাচ্চার হাতে করা। আরমান মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। মারজিয়া কখন এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। মারজিয়াও আরমানের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেয়ালে ঝুলানো ছবি গুলোর দিকে তাকাল। হেসে বলল,
~ এখানে যা যা দেখছ সব অথৈর হাতে আঁকা।”
আরমান অবাক হলো। অথৈ এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে! এই মেয়ের তো দেখা যাচ্ছে গুণের শেষ নেই। মারজিয়া বলতে থাকল।
~ ছোট বেলা থেকেই ওর আঁকাআঁকির দিকে ভীষণ ঝুঁক ছিল। কিন্তু ওর মা আবার এসব পছন্দ করত না। তবুও অথৈ জেদ করেই আঁকত। আমি অনেকবার ওকে আর্ট ক্লাসে দিতে চেয়েছি কিন্তু অথৈ রাজি হয়নি। তারপর ওর মা মারা যাবার পর অথৈ আঁকাআঁকি ছেড়েই দিয়েছিল। ওর বাবা আমি বললেও তেমন আঁকত না। এখন তো ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ছে। তাই টুকটাক আঁকতেই হয়। ওর করা ডিজাইন দেখলে তুমি মুগ্ধ হবে। এখনই ওর কাজ প্রফেশনালদের মতন।”
….
অথৈ ঘরে আসার পর থেকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। মারজিয়া এসে কয়েকবার ডেকে গেছে ওকে। এবারও ডাকতে এসে অথৈর সাড়াশব্দ না পেয়ে রাগ হলো। ছেলেটা কখন থেকে একা বসে আছে। দুইদিন পর ওর সাথে বিয়ে হবে। না, আরমানের প্রতি অথৈর এই আচরণ কোনভাবেই মানা যাচ্ছে না। মারজিয়া দরজা ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। বিকট শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠল অথৈ। কখন ঘুমিয়েছিল সে খেয়ালই নেই। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দিয়ে হাই তুললো অথৈ।
~ তুই এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলি!”
~ কেন কী হয়েছে? বাড়িতে ডাকাত পড়েছে?”
~ ছেলেটাকে একা বসিয়ে রেখে এসে তুই ঘরে ঘুমোচ্ছিস!”
~ উনাকে কি আমি ডেকেছি? আমার মেহমান উনি? তোমার মেহমানের সাথে তুমি বসে গল্প করো। আমার তো কোন কাজ নেই।”
~ ওর সাথে তোর বিয়ে হবে বজ্জাত মেয়ে। দু’দিন পর ও তোর স্বামী হবে।”
অথৈ আবার হাই তুলল। বলল,
~ তোমরা চাচ্ছ বলে হচ্ছে। আমি তো ওই লোককে বর বানাতে চাই না।”
~ এক্ষুনি চোখে মুখে পানি দিয়ে আরমানের কাছে যা। ওর সাথে গল্প কর। ওর চাকরির ব্যাপারে, বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে কথা বল। ত্যাড়িং বেড়িং করলে আমি তোর ঠ্যাং ভেবে দেব অথৈ। ছেলেটা অসহায়ের মত একা বসে আছে।”
~ তোমার কাছে দুনিয়ার সবাই অসহায়। অথচ আসল অসহায় তো আমি।”
~ যা এখন।”
…..
খাবার টেবিলে বসে অথৈ আরমানের সাথে কথা বলবে তো দূর একবার ওর দিকে দেখলও না। এদিকে আরমান বারবার আড়চোখে ওকেই দেখছে। অথৈ কি তার সাথে কথা বলবে না? অথৈর যে আচরণে ওকে ভালো লেগেছিল, ওর তোতাপাখির মত বলে যাওয়া। আজ তো কোন কথাই বলছে না। আরমান খুব করে চাইছে অথৈ কিছু বলুক। কিন্তু অথৈ বোবা হয়ে খেয়েই যাচ্ছে। মারজিয়া আরমানকে জোর করে সবকিছুই একটু একটু করে খাওয়াচ্ছে। আরমান মারজিয়াকে মা বলে ডাকলে অথৈ বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। বড় বড় চোখে আরমানের দিকে তাকাল। মারজিয়া ব্যস্ত হয়ে বলল,
~ কীভাবে খাচ্ছিস? এত বড় হয়ে গেছিস এখনও খাওয়া শিখলি না! পানি খা, পানিটা খা বুলবুলি।”
আরমান পানির গ্লাস অথৈর হাতে তুলে দিল। অথৈ কোনরকমে পানি খেয়ে সরাসরি আরমানকে প্রশ্ন করল,
~ কে আপনার মা!”
যাক অথৈ তাহলে মৌনব্রত ভেঙেছে। আরমান উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল।
~ ফুপিকে আপনি মা ডাকছেন! কেন? আমার ফুপি আপনার মা হবে কেন? আশ্চর্য! আপনি আমার ফুপিকে মা ডাকবেন না বুঝেছেন।”
মারজিয়া অথৈকে ধমক লাগাল।
~ এসব কেমন কথা অথৈ! আমি তোর ফুপু হয়েছি বলে আর কারো মা হতে পারব না।”
~ না। তুমি শুধু আমার ফুপি।”
অথৈর রাগ লাগছে। লোকটা সবাইকে হাত করে রেখেছে। অথৈর ফুপা অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছে। তাই আরমানের সাথে উনার দেখা হলো না। আরমান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যাওয়ার জন্য উঠল। মারজিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে সে৷ মারজিয়া অথৈকে শাসিয়ে আরমানকে এগিয়ে দিতে পাঠাল। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এলেও অথৈ কিছু বলছে না। গাড়ির কাছে এসে আরমানই বলল,
~ কিছু বলবেন না অথৈ?”
~ আমার কিছু বলার নেই।”
~ আমাকে এতটা অপছন্দ করার কারণটা জানতে পারি কি?”
~ আপনি বিয়েতে রাজি কেন হলেন?”
~ আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান না?”
~ না।”
~ আপনি যে শর্ত গুলো দিয়েছিলেন সেগুলো মেনে নিলেও না?”
অথৈ চোখ কুঁচকালো। আরমান বলল,
~ আমি আপনার সব শর্ত মেনে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি।”
চলবে..