#একটি_রূপকথার_গল্প,৬,৭
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬
আরমান যে চলে গেছে এটা অথৈ জানতো না। সেদিন ফুপির বাড়িতেই রাতে থেকে গেছিল। লোকটা তার সব শর্ত মেনে তাকে বিয়ে করতে রাজি! কেন? বিয়েটা কি উনাকে করতেই হবে? কোন দায় আছে নাকি। বাবার ছাত্র বলে! অথৈর এলোমেলো ভাবনা গুলো ফুপি অনেকটা গুছিয়ে দিল।
~ ছেলেটার সাথে ওরকম ব্যবহার করা কি খুব দরকার ছিল?”
~ কোন রকম ব্যবহার! আমি আবার কী করেছি?”
~ আরমান আমাকে মা ডাকলে তোর তো কিছু কম পড়বে না। তোর জন্য আমার ভালোবাসা একইরকম থাকবে।”
~ তবুও ওই লোক কেন তোমাকে মা ডাকবে? ওর নিজের মা নেই। তুমি শুধু আমার ফুপি।”
মারজিয়া অথৈর পাশে বসল। অথৈর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে স্নেহের পরশ বোলাতে বোলাতে বলল,
~ তুই তো এখন বড় হয়েছিস। যা তোর তা তোরই থাকবে। কেউ চাইলেও তা এত সহজে তোর থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। আরমানের সম্পর্কে তুই কিছুই জানিস না। কেন রে? ছেলে হিসেবে ও কি কারো থেকে কম? সুদর্শন সুপুরুষ। আচার ব্যবহারে আভিজাত্যের ছাপ। একটা ভালো জবও আছে। তোর ওকে ভালো না লাগার কারণ কী?”
~ জানি না। কিন্তু উনি যেদিন থেকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলেছে ওইদিন থেকেই উনাকে আমার বিষের মত লাগে।”
মারজিয়া ভাইঝির কথা শুনে কিশোরীদের মত শব্দ করে হেসে ফেলল।
~ আচ্ছা, তোর ফুপাকে তোর কাছে কেমন লাগে?”
~ফুপা একজন চমৎকার মানুষ। আমার দেখা খুব কম সংখ্যক ভালো মানুষের মধ্যে ফুপাকে এক নাম্বারে ফেলা যায়।”
~ তোর এই চমৎকার মানুষটাকেও কিন্তু একসময় আমার একটুও ভালো লাগতো না। ও যখন আমার ভালোবাসার কাঙাল হয়ে দিনের পর দিন আমার পেছনে ঘুরত, তখন আমার মনে হতো ওকে আমি খুন করে ফেলি। একটা মানুষ এতটা বেহায়া কেন হবে? আমার তো ওকে ভালো লাগে না। ওর আমাকে ভালো লাগলেই এভাবে আমার পেছন পেছন ঘুরতে হবে। আমি যে ওকে এত অপমান করি তাতেও ওর লজ্জা হবে না কেন? আমার উপর জেদ কাজ করবে না কেন?”
~ মাই গড ফুপি! ফুপাকে তুমি এভাবে অবহেলা করেছ! কেন?”
~ কেন সেই কারণ তো আমিও জানতাম না। কিন্তু তোর যেমন আরমানকে কোন কারণ ছাড়াই পছন্দ না। তেমনি আমারও তোর মতই কোন কারণ ছাড়াই তোর ফুপাকে পছন্দ হতো না।”
~ তাহলে তোমাদের বিয়েটা কীভাবে হলো?”
~ ওই চালাক লোক তোর দাদুকে হাত করে নিয়েছিল।”
~ যেমনটা আরমান করেছে!”
মারজিয়া হেসে বলল,
~ হ্যাঁ। কিছুটা এমনই। কিন্তু পুরোপুরি না। বিয়ের পর শুনেছি, তোর ফুপা নাকি আমার বাবার পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। ওর জীবনে আমাকেই লাগবে। যতক্ষণ আব্বা রাজি না হয়েছে ততক্ষণ পা ধরে বসেই ছিল। ওকে মেয়েমানুষের মত কাঁদতে দেখে তোর দাদার মন গলে গেল। সেদিন রাতেই মৌলবি এসে আমাদের বিয়ে পড়াল। আমার বাবার বাড়িতেই আমাদের বাসরঘর সাজানো হলো। বিয়ের রাতেই ভদ্রলোককে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আমি যে দরজা আটকে বসেছিলাম, তোর দাদুর উপর রাগ করে যাতে আর ওই লোকটাকেও দেখতে না হয়, টানা তিন দিন আর দরজা খুলিনি। এই তিনদিন তোর ফুপা এক সেকেন্ডের জন্য আমার ঘরের দরজার সামনে থেকে নড়েনি।”
অথৈ হতভম্ব হয়ে ফুপির কথা শুনছে। ওর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। ফুপির পক্ষে ও তো এখনও কিছুই করেনি। তারও তো তাহলে তিনদিন ঘরের দরজা আটকে রেখে বাবাকে শায়েস্তা করা উচিত। কিন্তু ফুপির তো বিয়ে হয়ে গেছিল। তার তো এখনও হয়নি। ঠিক আছে, ওই লোকের সাথে বিয়ে হলে অথৈও এমনই করবে।
~ যেই মানুষটাকে পছন্দ না বলে আমি এতকিছু করেছি, আজ ত্রিশটা বছর ধরে ওই লোকের সাথেই সংসার করছি। আর সবথেকে মজার কথা কী জানিস অথৈ? বিয়ের রাতে যাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম, এই ত্রিশ বছরে একটা রাতও তাকে ছাড়া দূরে কোথাও গিয়ে থাকিনি৷ এমনকি নিজের বাবার বাড়িতেও না।”
অথৈর ফুপা ফুপির গল্প শুনে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে। ফুপাকে দেখে বোঝা যায়, ফুপির জন্য কী পাগলামিই না করেছে তিনি! আর ফুপিও তো ফুপাকে কোন অংশে কম ভালোবাসে না।
~ আমাদের যাকে পছন্দ না একটা সময় সে-ই আমাদের খুব আপন হয়ে যায়। তাকে ছাড়া তখন থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে।”
~ ফুপা তোমার জন্য এতসব পাগলামি করেছে!”
~ ওর পাগলামি আরও কিছু নমুনা শুনলে তুই নিশ্চিত মানুষটাকে পাগল বলবি। কিন্তু আমার কাছে ওর এসব পাগলামিই আমার জন্য ওর ভালোবাসার প্রকাশ।”
~ ফুপাকে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না ফুপা এসব করতে পারে। বা করেছে।”
~ আরমানও তোর জন্য কী কী করে দেখতে পারবি। ওর চোখেও আমি ঠিক তোর ফুপার মতই পাগলামি দেখেছি। তোর ফুপা আমাকে যতটা ভালোবাসে ঠিক সেই একই রকম ভালোবাসা আমি আরমানের চোখে তোর জন্য দেখেছি।”
অথৈ কথাগুলো বিশ্বাস করতে চাইল না। ফুপি তাকে বিয়েতে রাজি করাতে এসব বলছে।
~ আরমানকে অবহেলা করে দূরে ঠেলে দিস না। ওর মত করে তোকে আর কেউ চাইবে না। ও তোর সব পাগলামি হাসি মুখে সহ্য করে নিবে।”
~ তুমি কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেলে!”
~ আরমানকে সারাজীবন আমি আমার ছেলে করে রাখতে চাই। ওর কেউ নাই রে অথৈ। বাবা মা ভাই বোন কেউ না। এই পৃথিবীতে ও সম্পূর্ণ একা। ওর জীবনে এমন একজন মানুষের প্রয়োজন যে ওর মুখে হাসি ফুটানোর কারণ হবে। আমি জানি তুই সেই ব্যক্তি হতে পারবি।”
….
ফুপির কথাগুলো পুরো একটা সপ্তাহ মাথা থেকে বেরোয় নি। অথৈ যা-ই করেছে সারাক্ষণ শুধু ফুপির বলা কথাগুলোই কানে বেজেছে। লোকটা তাকে ভালোবাসে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তাদের মাত্র দুই দিনই তো দেখা হয়েছে। এই একটু দেখাতে কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে? এক সপ্তাহ পর এক রাতে আরমানের কল আসে। নাম্বারটা সেভ করা ছিল না। তাই অথৈ চিনতে পারেনি। না চিনেই সে বলল,
~ কে?”
~ আমি আরমান।”
মানুষটার কন্ঠ শুনে অথৈর বুকের ভেতর কি কিছু হলো? কেমন একটা অনুভূতি। অথৈ ঠিক বুঝতে পারল না।
~ কেমন আছেন অথৈ?”
~ ভালো।” অথৈ এখনও ধাতস্থ হতে পারছে না। তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। ওপাশে আরমান অপেক্ষা করছে অথৈও তাকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু অথৈ করছে না দেখে সে-ই বলল,
~ কী করছিলেন?”
~ কিছু না। আপনি এখন কোথায় আছেন?” কথাটা জিজ্ঞেস করেও অথৈ ভাবল, দূর কী দরকার ছিল এটা জিজ্ঞেস করার। আরমান এপাশে নিঃশব্দে হাসল।
~ জাহাজে। সমুদ্রের বুকে। সমুদ্র আপনার কেমন লাগে অথৈ?”
~ সমুদ্র আমাকে তেমন টানে না। আমি পাহাড় প্রেমী। পাহাড় আমাকে সবসময় দু’হাত বাড়িয়ে ডাকে। আমার মাঝে মাঝে পাহাড়ের বুকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।”
আরমান ভেবেছিল আজও হয়তো অথৈ তার সাথে কথা বলবে না। কিন্তু না, অথৈ সেই প্রথম দেখার মত আজও বেশ সহজ ভাবে কথা বলছে তার সাথে। তাহলে কি অথৈ তার ব্যাপারে নিজের মতামত চেঞ্জ করেছে! বিয়েটা করবে ও!
অনেকটা সময় দু’জন নীরব থাকল। বলার মতো কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। আরমান অনেক কিছুই বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না।
~ রাখি অথৈ, পরে কথা হবে।”
…..
আরমান ঠিক তিন মাস পরে ফিরল। এই তিন মাসে অনেকবারই অথৈর সাথে তার কথা হয়েছে। কিন্তু অথৈ তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে। কোনদিনও কেমন আছেন, কী করছেন, খেয়েছেন? এর পরে আর কথা এগোয়নি। আরমান ফিরে এসে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে না গিয়ে সোজা অথৈদের বাসায় চলে এসেছে। এসে জানতে পারল অথৈ বাড়ি নেই। তার ফ্রেন্ড মিনহার বাসায় গেছে। আশরাফ হোসেন আরমানকে দেখে ঠিক বুঝতে পারলেন ছেলেটা এখনও বাড়ি যায়নি। ফ্রেশ হয়নি এমনকি কিছু খায়ওনি। এই পাগল ছেলে কি তার মেয়েকে দেখার জন্য ছুটে এসেছে!
~ আমি তোমার কাপড়ের ব্যবস্থা করছি। তুমি ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও।”
আরমান ফাঁসির আসামির মত অপরাধী মুখে স্যারের চোখের দিকে না তাকিয়ে বলল,
~ আমি বরং চলে যাই স্যার। পরে একদিন আসব।”
এখানে আসার আগে সে কিছুই ভাবেনি। কিন্তু এসে এখন লজ্জা লাগছে। স্যার তার সম্পর্কে কী ভাবছেন কে জানে! আশরাফ হোসেন প্রিয় ছাত্রের ক্লান্তিমাখা মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে বললেন,
~ আমার মেয়ের জন্য এরকম একটা পাগলই আমি চেয়েছিলাম। যা পেয়েও গেলাম। সৃষ্টিকর্তা আমার মেয়েটাকে সুবুদ্ধি দান করুক। অথৈ যেন এই হীরের টুকরোর মূল্য বুঝতে পারে।”
~ আমি আজ চলে যাই স্যার।”
আশরাফ হোসেন এবার খানিকটা শক্ত গলায় বললেন,
~ আমি তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি?”
আরমান বেচারা লজ্জায় এবার কেঁদে ফেলবে মনে হয়। স্যার হয়তো ভাবছে, এ কেমন নির্লজ্জ ছেলে! এখনও বিয়ে ঠিক হয়নি আর এই ছেলে আমার বাড়িকে অলরেডি শ্বশুরবাড়ি ভেবে বসে আছে। বিয়ের কথা উঠেছিল, সে রাজি হলেও অথৈ অমত জানিয়েছে। এই তিন মাসে স্যার কিন্তু একবার বলেনি, তুমি এলে বিয়ের ডেট ঠিক করব। স্যার হয়তো মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে চাচ্ছে না। না, আজ এখানে আসাটা তার উচিত হয়নি। আশরাফ হোসেন ফোনে অথৈকে বাড়ি ফিরতে বললে অথৈ রেগেমেগে আগুন হয়ে গেল।
~ বাড়ি ফিরব মানে কী? আমি তোমাকে বলে আসিনি আজ মিনহাদের বাড়িতে থাকব! ওর জন্মদিন আজ। বাড়িতে কী এমন জরুরি কাজ পড়েছে যে আমাকে আমার বন্ধুর জন্মদিনের পার্টি ফেলে যেতে হবে।”
~ আরমান এসেছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
~ হ্যাঁ! কে এসেছে?”
চলবে…
#একটি_রূপকথার_গল্প’৭’
#জেরিন_আক্তার_নিপা
আরমান তার জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করছে জেনেও অথৈ রাতে বাড়ি ফিরেনি। লোকটার কি আক্কেল জ্ঞান কিচ্ছু নেই? কোন আক্কেলে তাদের বাড়িতে এসেছে? বিয়েটা কি হয়ে গেছে? এটা কি উনার শ্বশুরবাড়ি? আরমান রাতে আশরাফ হোসেনের সাথে খাওয়াদাওয়া করে আরও কতক্ষণ অথৈর জন্য অপেক্ষা করে চলে গেল। সে মনে মনে লজ্জায় কুঁকড়ে ছিল। বেচারা স্যারের সামনে মাথা তুলে কিছু বলতে পারল না। অথৈর না ফেরায় আশরাফ হোসেন মেয়ের উপর রাগ করে বসে থাকলেন। পরের দিন সকালে অথৈ বাড়ি ফিরেই তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল,
~ তোমার ছাত্রের মাথায় কি ঘিলু নেই? গোবর দিয়ে ভরা নাকি! মাঝরাতে কেউ কেন আরেকজনের বাড়িতে আসবে?”
~ অথৈ কথা বলার ধরন ঠিক করো।”
~ উনি তোমার ছাত্র। তোমার কাছে এসেছে। তুমি আমাকে বাড়ি আসতে বলো কেন? আমাদের কি বিয়ে হয়েছে? ওই লোক আমার কিছু হয়?”
অথৈ তো কথাগুলো রাগের মাথায় বলেছে কিন্তু আশরাফ হোসেন মেয়ের কথা শুনে ভাবল, সত্যিই তো। এবার তো ওদের বিয়েটা ঠিক করে ফেলতে হবে। আরমানের ছুটি কয়দিন আছে কে জানে।
….
ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের নিয়ে অথৈ একটা কফিশপে এসে বসল। প্রাপ্তি যখন থেকে শুনেছে কাল রাতে আরমান অথৈদের বাড়িতে এসেছিল তখন থেকেই ওকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে।
~ এখনও তো বিয়ে হয়নি। বিয়ের কথা হচ্ছে মাত্র। এই লোক এখনই এত পাগল না জানি বিয়ের পর কেমন পাগলামি করবে। তোকে রেখে সমুদ্রে ভাসতে পারবে তো?”
মিনহাও জিজ্ঞেস করল,
~ সত্যিই আরমানের সাথে তোর বিয়ে হবে অথৈ? হলে একটা কথা আগে থেকে জেনে নে। তোর বিবাহিত জীবন সিঙ্গেলদের মতই কাটাতে হবে। আরমান ছয় মাসও দেশে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ। ওর জবটাই তো এমন। সারা বছর জাহাজে কাটাবে। তোর স্পেশাল দিন গুলোতেও ওকে আশা করতে পারবি না। বউ বাচ্চাকে সময় দেওয়া এদের কর্ম না।”
এদের বকরবকর শুনে অথৈর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। অন্য একটা টেবিলে প্রাপ্তি যেন কাকে দেখে গলা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
~ ওই দেখ আবির। তোর দিকেই তাকিয়ে আছে।”
মিনহা আশেপাশের টেবিল খুঁজতে খুঁজতে বলল,
~কই? আবিরটাও কিন্তু তোকে অনেক পছন্দ করে অথৈ। তুই-ই ওকে পাত্তা দিস না।”
অথৈ আবিরকে দেখে বিরক্ত হলো। মিনহা প্রাপ্তি ওদের ওদিকে না তাকাতে বলল। মিনহা বলল,
~ তোর কাছে কিন্তু আবিরও একটা অপশন। আরমানকে বিয়ে করতে না চাইলে আবিরকে হ্যাঁ বলে দে।”
~ ওরে দেখলেই তো আমার বিরক্ত লাগে।”
প্রাপ্তি অথৈর উপর রাগ দেখিয়ে বলল,
~ একটা ছেলে তিন বছর ধরে আদাজল খেয়ে তোর পেছনে পড়ে আছে আর তুই ওকে ঘাস ঢালছিল না। ওরে পছন্দ না হওয়ার কারণ কী?”
~ আরে ওই প্রতিবন্ধী টিকটিক করে। তোরা চাস একটা টিকটকারের সাথে আমি রিলেশন করি!”
…..
অথৈদের বাড়ি থেকে এসেছে আজ দুই দিন হলো। আরমান এর মাঝে অথৈদের বাড়িতে যাওয়ার নামও মনে আনেনি। ওইদিন জীবনের সবথেকে বড় ভুল করে ফেলেছে। স্যার নিশ্চয় তাকে ভুল বুঝেছে। কেন যে নিজের ফ্ল্যাটে না ফিরে ওখানে চলে গিয়েছিল! স্যার আজ তাকে বাসায় ডেকেছেন। কিন্তু আরমান কাজের বাহানা দিয়ে যেতে মানা করে দিয়েছে।
বিকেলে আরমান শুয়েছিল। ঘুমোতে ঘুমোতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। বাসায় কেউ নেই বলে ডেকে দেয়নি। কলিংবেলের শব্দে আরমানের ঘুম ভাঙে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এই সময় কে আসতে পারে ভেবে পেল না। বেড থেকে নেমে টিশার্ট হাতে নিয়ে হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে দিতে গেল আরমান। দরজা পর্যন্ত আসতে আসতে টিশার্ট পরা শেষ। দরজা খুলে সামনে অথৈর বাবা ফুপিকে একসাথে দেখে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। আশরাফ হোসেন ওকে দেখে মৃদু হাসলেন। মারজিয়া বলল,
~ ঘুমোচ্ছিলে নাকি?”
আরমান সজোরে মাথা নাড়িয়ে না জানাল। মারজিয়া বলল,
~ দেখে মনে হচ্ছে মাত্র ঘুম থেকে উঠে দরজা খুললে।”
~ দুপুরে একটু শুয়েছিলাম। স্যার ভেতরে আসুন। মা আপনিও… আরমান কথা শেষ করার আগেই মারজিয়া ভেতরে চলে এলো। আরমান সরে আশরাফ হোসেনকে ভেতরে যাওয়ার জায়গা দিল। উনাদের পেছনেই একজন অনেকগুলো মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আরমান ভাবনায় পড়ে গেল। আশরাফ হোসেন ছেলেটাকে বললেন,
~এগুলো ভেতরে নিয়ে রেখে আসো শফিক।”
মিষ্টির প্যাকেট রেখে ছেলেটা চলে গেলে মারজিয়া বলল,
~ তুমি একা মানুষ ভেবেই অল্প এনেছি।”
আরমান প্যাকেট গুলোর দিকে দেখে মনে মনে বলল,
“এখানে যদি অল্প মিষ্টি হয় তাহলে অনেকগুলো আনলে নিশ্চয় আমার ঘরে জায়গা নিত না।”
আশরাফ হোসেন মারজিয়া বসে আছে। আরমান দাঁড়িয়ে আছে। মারজিয়া বলল,
~ তোমার বাড়ি তুমিই বসছো না। আমাদের লজ্জা পাচ্ছ নাকি? মা’র কাছে ছেলের কিসের লজ্জা? তুমি কি তোমার স্যারকে লজ্জা পাচ্ছ! বাবু তুই ওকে বসতে বল। তোর কথা ছাড়া মনে হচ্ছে বসবে না।”
সোফায় বসেও আরমান ভাবছে, সে কি সত্যিই জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখছে। দুই ভাই বোনের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আজই বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে যাবে। মিষ্টি হাতে এইজন্যই এসেছে নিশ্চয়। কিন্তু আরমানের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে এটা হয়তো তার স্বপ্ন। এক্ষুনি ঘুম ভেঙে গেলে সামনে আর কাউকে পাবে না। মারজিয়াই কথা শুরু করল।
~ দেখো বাবা, তোমার গুরুজন তেমন কেউ নেই যার সাথে কথা বলে আমরা বিয়ের দিন তারিখ পাকা করব। যেহেতু তোমার দিক থেকে তুমিই একা তাই বিয়ের কথাও সরাসরি তোমার সাথেই বলতে হবে। তুমি হয়তো জানো না আমরা তোমাকে কতটা পছন্দ করি। আমি তোমাকে ছেলে বানিয়েছি। আমি চাই সারাজীবন তুমি আমার ছেলে হয়েই থাকো। তাই এই সম্পর্কে আরও পাকা করতে আমি আমার মেয়ের মত ভাইঝিকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে চাই। তোমার যদি কোন আপত্তি থাকে তাহলে এখনই জানাতে পারো।”
ফুপু যতক্ষণ কথাগুলো বলছিল আরমানের দম আটকে ছিল। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিল সে। যাকে প্রথম দেখায় মন প্রাণ জান সব দিয়ে বসে আছে তাকে বিয়ে করতে আপত্তি থাকবে ওর!
মারজিয়া আশরাফ হোসেন দু’জনই আরমানের মুখের দিকে চেয়ে আছেন। আরমান না করবে না এই বিশ্বাস আশরাফ হোসেনের আছে। মনে মনে খুশিতে একচোট নাচতে ইচ্ছে করলেও মুখে তার কোন প্রভাব পড়তে না দিয়ে যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে আরমান। সে বলল,
~ অথৈ কি এই বিয়েতে মতামত দিয়েছে? ওর হয়তো আপত্তি থাকতে পারে।”
~ অথৈকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। অথৈ এমন একটি মেয়ে ও নিজের জন্য সামান্য এক জোড়া জুতো, একসেট কাপড় পছন্দ করতে পারে না। ছোট থেকে ওর সব শপিং আমাকে করতে হয়। কোন খাবারটা ওর পছন্দ তা ও বলতে পারবে? ক্লাস নাইনে কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়বে তা নিয়ে মিটিং বসতে হয়েছে। কলেজেও সেই একই সমস্যা। যে মেয়ে এই ছোট ছোট বিষয়ে একা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে কি জীবনের এই সবথেকে বড় বরং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত একা নিতে পারবে! আর ওকে এতবড় সিদ্ধান্ত একা নিতে দেওয়ার ঝুঁকি আমরা নেব!”
কথাগুলো বলে মারজিয়া হাসতে লাগলেন। আরমান তবুও সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মারজিয়া ওর মুখ দেখে ভাবনার কারণ বুঝতে পেরে ওকে আশ্বস্ত করে বলল,
~ ওর কী পছন্দ, কী অপছন্দ ও নিজেই জানে না। একটা মজার কথা বলি, ওর ফুপাকে অথৈ কোন কারণ ছাড়াই ভীষণ পছন্দ করে। ও মনে মনে এটাই আশা করে ওর ফুপার মতই কেউ একজন ওর জীবনে আসুক। আর মজার কথাটা কি জানো, তুমি ঠিক ওই মানুষটার মতন।”
…..
বাবা, ফুপি অথৈকে কিছু না জানিয়ে বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেলেছে শুনে অথৈ এটা নিয়ে চেঁচামেচি করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। এমনিতে সারাদিন ওর কিছু খাওয়া হয়নি গরমে শরীরটাও ক্লান্ত ছিল। অথৈকো নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেলে ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটা দিশাহারা হয়ে আরমানকে কল করে বসল। আরমান এই কথা শুনে দশ মিনিটের ভেতরে অথৈদের বাড়িতে হাজির। ততক্ষণে অথৈর জ্ঞান ফিরে এসেছে। আরমান বুঝতে পারছে না তার এখন কি চলে যাওয়া উচিত নাকি আরও কিছুক্ষণ থাকা উচিত। অথৈ চোখ দিয়ে আগুন ঝরাতে ঝরাতে ফুপির দিকে দেখছে। মারজিয়া অথৈর ভয়ে আগেই বলে দিল,
~ আরমানকে আমি ডাকি নি। বিশ্বাস কর। এই তোকে ছুঁয়ে বলছি।”
আরমান অস্বস্তি নিয়ে অথৈর ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। অথৈর দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না ও। অথৈ বেচারি কয়েক মুহূর্তে ঘটে যাওয়া এই তুলকালাম ঘটনায় যথেষ্ট হতবাক। এই বাড়িতে এখন থেকে যা কিছুই হবে সব কি এই লোকটাকে জানাতে হবে? স্টোর রুমে থাকা মোটা ইঁদুরটা বাচ্চা তুললেও কি এই লোকটাকে খবর দিতে হবে! একে তো তাকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। তার উপর এই লোকটা আঠার মত তার পেছনে লেগে আছে। কঠিন গলায় অথৈ ফুপিকে বলল,
~ ফুপি তুমি একটু এখন বাইরে যাও। উনার সাথে আমার একা কিছু কথা আছে।”
মারজিয়া কিছু বলতে পারল না। তিনি চলে গেলে আরমানের মনে হতে লাগল অথৈ হয়তো এক্ষুনি তার উপর ঝাপিয়ে পড়বে। ফুলদানি দিয়ে বারি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিবে নয়তো গলা চেপে ধরবে।
~ আপনার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে আমি জ্ঞান হারিয়েছি এ থেকে নিশ্চয় ধারণা হয়েছে আমি আপনাকে কতটা অপছন্দ করি?”
~ জি হয়েছে।”
~ আমাদের বাড়ির হুলোবেড়ালটা বায়ুদূষণ করলেও কি আপনি আমাদের বাড়িতে ছুটে আসবেন?”
আরমান ঝট করে একবার অথৈর চোখের দিকে দেখল। অপরাধী মুখে সে বলল,
~ জি না।”
~ তাহলে এলেন যে!”
~ আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়েটা ফোনে জানাল আপনি হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাই…
~ আপনি কি ডাক্তার?”
~ না।”
~ তাহলে আমি অসুস্থ শুনে আপনার এখানে এসে কাজ কি? আপনি তো আমাকে সুস্থ করতে পারবেন না।”
আরমান অথৈর দিকে চোখ না রেখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। অথৈ জেলারের মত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।
~ ওইদিন কেন এসেছিলেন? সেদিনও কি আমার অসুস্থতার খবর পেয়েছিলেন?”
~ জি না।”
~ আজকের পর থেকে আপনি আর কখনও আমাদের বাড়িতে আসবেন না। বিয়ের পরেও না। আমি অসুস্থ শুনলেও না। ঝড়তুফানে আমাদের বাড়ি উড়ে গেছে শুনলেও না। আমাদের ছাদে বজ্রপাত হয়েছে শুনলেও না। যে পুরুষ ঘনঘন শ্বশুরবাড়ি আসে আমি ওদের দুচোখে দেখতে পারি না। আমার ফুপা জীবনেরও আমাদের বাড়িতে এসে থাকে না। এলেও চলে যায়।”
আরমান অথৈর কথা শুনে ঠিক বুঝতে পারল না অথৈ বিয়েটা এখনও করবে কি-না।
আরমান চলে যাবার পর যে কাজের মেয়েটা আরমানকে খবর দিয়েছে তাকে অথৈ শাস্তি দিল, আজ রাত থেকে অথৈর বিয়ের দিন সকাল পর্যন্ত এই মেয়েটার ফোনে কথা বলে যেতে হবে। কার সাথে বলবে এবং কী বলবে তা ওর ব্যাপার। কিন্তু এক মিনিটের জন্য বিরতি নেওয়া যাবে না। দরকার পড়ে টেলিফোন বিল দিয়ে তার বাবা ফতুর হয়ে যাবে।
চলবে_