#একটি_রূপকথার_গল্প
[পর্ব_১৬ এবং শেষ ]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
আরমান অথৈর চোখের দিকে চেয়ে আছে। অথৈ এই চোখ জোড়ায় পৃথিবীর সব ভালোবাসা নিজের জন্য দেখতে পেল।
~ আপনাকে আমার সব কথাই বলেছি। একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ছোট মা বাবা যাকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। তার মনে কেনই যেন এই ধারণাটা আটকে গিয়েছিল বাবা তাকে ভালোবাসেন না। বাসলেও উনার প্রথম স্ত্রীর মতো না। তিনি কখনও বাবার মনে আমার মায়ের মতো করে জায়গা নিতে পারবে না। ছোট মা’র এই ধারণাটা একেবারেই ভুল ছিল। বাবা ছোট মাকে যথেষ্ট ভালোবাসতো। প্রথম জনের জায়গা দ্বিতীয় জনকে না দিয়েও দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য আলাদা করে জায়গা বানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু ছোট মা’কে এটা কোনভাবেই বোঝাতে পারত না। ছোট মা যখন কাঁদত তখন আমি দেখতাম। তার জন্য মাঝে মাঝে বাবাকে দায়ী করতাম। কিন্তু যখন একটু বড় হলাম তখন বুঝতে পারতাম বাবার কোন দোষ নেই। ছোট মা আসলে ভালোবাসার মানুষটার সবকিছুতে নিজের অস্তিত্ব দেখতে চাইত। এটা দোষের কিছু না। পৃথিবীর সব মেয়েরাই এমনটা চায়। ছোট মা’কে দেখে দেখে আমার মাঝে এই ধারণাটা তৈরি হয়েছে, কাউকে ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয়। ছোট মা’র মতো কাঁদতে হয়। কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা মানে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা। আমি ছোট মা’র মতো দুর্বল না। তাই আমি ঠিক করলাম জীবনে কখনও কাউকে ভালোবাসবো না। ভালোবাসা নিজেকে ওই একটা মানুষের উপর নির্ভরশীল করে দেয়। দুর্বল করে দেয়। আমি ওরকম দুর্বল হতে রাজি নই।’
অথৈর এই উত্তর শুনে আরমানের চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। তার মানে অথৈ ওকে ভালোবাসে না! অথৈ আরমানকে দেখছে। কোথায় যেন সে পড়েছিল, কোন একটা বইয়ে। যে পুরুষটা তোমার জন্য কাঁদে সে সত্যিই তোমাকে ভালোবাসে।
~ আমার ধারণায় আমি অটুট ছিলাম। জীবনের অনেকগুলো বসন্ত একা একাই কাটিয়ে দিলাম। কাউকে মন দেওয়ার মতো ভুলটা করলাম না। কিন্তু তার পর আমার জীবনে এমন একজন আসে যে আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিল। আমাকে পুরোপুরি পাল্টে দিল। তাকে ভালোবাসতে আমাকে বাধ্য করলো। অপেক্ষা শব্দটা যা বরাবরই আমার কাছে অপছন্দের ছিল। সেই মানুষটার জন্য আমি জীবনের প্রথম বললাম, আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করব। এর এই অপেক্ষা জিনিসটা কতটা বেদনার এবং সেইসাথে মধুরও হতে পারে তা আমি মানুষটার জন্য জানতে পারলাম। আমি উনাকে আজও বলতে পারিনি উনাকে আমি কতটা ভালোবাসি। হয়তো কখনও পারব না। আচ্ছা ভালোবাসি কথাটা মুখে বলতে হবে কেন? উনি কি আমার চোখ দেখে পড়তে পারে না? প্রেয়সীর চোখের ভাষা যদি সে না-ই বুঝে তাহলে কেমন প্রেমিক পুরুষ সে! আমার অব্যক্ত কথা না বুঝলে তাকে আমি কেন বিয়ে করব?
……
সেই রাতেই আরমান অথৈর বিয়ে হয়েছে। অথৈ বাবাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে আরমানের সাথে তার বিয়ে না হলে সে জীবনে আর কাউকে বিয়েই করবে না। এখন বাবা কী করবে ভেবে দেখুক। আশরাফ হোসেনের মন গলাতে আরমান মেয়েদের মতো কেঁদেকেটে বলেছে, অথৈকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না স্যার৷ ওকে ছাড়া আমার জীবন চলবে না। আমার বেঁচে থাকার জন্য অথৈকেই লাগবে।
মারজিয়ার কিলগুঁতো ধমক খেয়ে আশরাফ হোসেনের মাথা থেকে ভূত নেমে গেল। তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে আরমানের হাত ধরে বললেন,
~ বুড়ো হয়েছি তো। মাথা ঠিক নেই বুঝলে। তোমাকে আমার কতটা পছন্দ তুমি জানো না। এই প্রথম স্যার একটা ভুল করেছে। এখন তো আর ছাত্রের কাছে ক্ষমা চাওয়া সম্ভব না। তারপরও তুমি যদি বলো…’ আরমান তার স্যারকে এর পরে আর কিছু বলতে দিল না।
কাজি এলো। রাত এগারোটার মধ্যে বিয়ে পড়ানো শেষ। উকিল বাবা দেওয়া হলো ফুপাকে। অথৈদের বাড়িতেই বাসরঘর সাজানো হলো। অথৈর বিয়ে পড়ানো শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টিয়া মরা কান্না শুরু করে দিয়েছে। যেন এই মাত্র অথৈ কবুল বলে দুনিয়া থেকে বিদায় নিল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলছে,
~ ও আপা গো, আপনি চলে গেলে আমারে কে শাস্তি দিব গো। আমারে কে ধমকাইব গো। কে দিনে চৌদ্দ বার কইব, তোর চাকরিটা কিন্তু এবার খেতেই হবে টিয়া।’
সমস্ত আচার অনুষ্ঠান শেষ করে বারোটার পর ওরা ঘরে এলো। অথৈ আসলে ভাবেনি এভাবে তাদের বিয়েটা হয়ে যাবে। সব দোষ বাবার। বাবার যে কেন আদর্শ শ্বশুর থেকে মাঝখানে ভিলেন সাজার ইচ্ছে হলো। আরমান নিজেও কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। এই ঝুটঝামেলায় অথৈর জন্য কিছুই কেনা হয়নি। বন্ধুদের কাছে শুনেছে বাসর রাতে নতুন বউয়ের মুখ দেখে তাকে কিছু দিতে হয়। তাই অথৈর মুখ থেকে ঘোমটা তুলতে আরমান ইতস্তত করছে। সে হাত বাড়িয়ে ঘোমটা ধরতে যাবে আর আগেই অথৈ ঝট করে মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে বলে উঠল,
~ শুনুন বাবার প্রিয় ছাত্র, আমি আবেগের চোটে তখন সব কথা বলে ফেলেছি ঠিক আছে। কিন্তু আমার আপনার থেকেও একটা কথা নেওয়ার আছে।’
আরমান হতভম্ব হয়ে তার সদ্য বিবাহিতা বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হতভম্ব গলায়ই জিজ্ঞেস করল,
~কী কথা বলে ফেলেছ!’
~ওইযে আপনাকে যে আমি ভালোবাসি।’
~ হুম। কিন্তু আমার থেকে কী কথা নেওয়ার আছে?’
~ আমি আপনার জন্য আর অপেক্ষা করে থাকব না। অপেক্ষা জিনিস আমার চোখের বিষ। জানের শত্রু। আপনি চলে যান ঠিকই সাথে আমার সুখ শান্তি ঘুমও নিয়ে যান। এরকম হলে চলবে না।’
~ এখন তুমি কী চাও?’
~ আমি চাই আমার বর আমাদের বিবাহবার্ষিকীকে, আমার জন্মদিনে, আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনে, আরও যে বিশেষ বিশেষ দিনগুলো থাকে সেসব দিনে যেন আমার কাছে থাকে।’
~ ব্যস! এইটুকুই? তুমি চাইলে আমি চাকরি ছেড়ে এসে তোমাদের বাড়িতে ঘর জামাই থাকব। তুমি চাইলে জীবনও দিয়ে দেব। চাকরিবাকরি তো অনেক ছোট ব্যাপার। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো। সারাজীবন আমাকে এভাবেই ভালোবেসে যেও। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।’
……….
অথৈর ডায়েরি কথন…
পৃষ্ঠ –
মানুষটা যে কী ভীষণ চালাক আর বদ! মিষ্টি কথা দিয়ে কাজ হাসিল করে নিতে খুব ভালো পারে। বলেছিল, তুমি বললে জীবন দিয়ে দেব। তার জীবন আমার চাই না। সেই জীবন থেকে শুধু একটু সময় চাই। বদ লোক সেটাও দিতে পারছে না। পারবিই যখন না তখন এত বড় বড় কথা বলেছিলি কেন?
আমরা হানিমুনে গিয়েছিলাম কাশ্মীর। পৃথিবীর বুকে এক টুকরো জান্নাত। আমার জীবনের প্রথম ইচ্ছেটাই তাকে নিয়ে পূরণ করেছি আমি। সেখান থেকে ফিরেই লোকটা তার দ্বিতীয় বউয়ের কাছে চলে গেল। সমুদ্র তার দ্বিতীয় বউ। তুমি বললে চাকরিবাকরি ছেড়ে ঘরজামাই থাকব। হাহ্! কী মিষ্টি কথা। তিনি গেছেন আজ ছয় মাস। প্রতি দিনই আমি তাকে মিস করি। কিন্তু আজ একটু বেশিই করছি।
পৃষ্ঠ –
তিনি এসেছেন। এবার মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজেনি। তাই হাতে-পায়ে ধরে অভিমানের পাহাড় গলিয়েছেন। এবারও একগাদা মিথ্যে বলে আমার রাগ ভাঙিয়েছে। আমি জানি মানুষটা চাইলেও সমুদ্রকে আর ছাড়তে পারবে না। সমুদ্রের মায়ায় জড়িয়ে গেছেন তিনি। তাই বলে কি আমার মায়া কম পড়ে গেল?
পৃষ্ঠ –
আজ জানতে পারলাম আমি মা হতে যাচ্ছি। খুশিতে আমার চোখে পানি এসে গেল। প্রথম বার মা হওয়ার অনুভূতি কোন শব্দে ব্যক্ত করার মতো না। জীবনের সব খুশি যেন আমি পেয়ে গেছি। কিন্তু এই সময়টাতেও সে আমার পাশে নেই। তাকে ফোনে জানাব না ভাবলাম। পরের বার এলে মশাইকে সামনাসামনি বাবা হবার খবর দেব। জীবনের সবথেকে বড় খুশির সংবাদ শুনে তার কেমন প্রতিক্রিয়া হয় নিজের চোখে দেখব। কিন্তু আমার পাগল পরিবার সেটা আর হতে দিল না। আমার বাবা বাচ্চাদের মত কতক্ষণ কেঁদেকেটে জামাইকে কল করে নিজের নানা হবার কথা জানিয়ে দিলেন। আমার শরীর ভারী হচ্ছে। সাথে আমার পুরো পরিবারের ঘুম চলে যাচ্ছে। ফুপি তো আগে থেকেই পাগল ছিল। এখন মাথাটা পুরোপুরি গেছে। তিনি আমার সব কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলেন। সময় যাচ্ছে আরমান এর মাঝেও একবার এসেছিল। তখন আমার পাঁচ মাস। আরমান যে এরকম বাচ্চামি করবে আমি সত্যিই ভাবিনি। এসেই সবার সামনে আমার পেটে ধরে তার কী কান্না! বাবা, ফুপির সামনে আমার তখন লজ্জায় মরিমরি দশা।
পৃষ্ঠ –
অসহনীয় প্রসব যন্ত্রণায় আমি যখন কাতরাচ্ছি তখনও আরমান আমার পাশে নেই। সেবার প্রথম বারের জন্য মনে হচ্ছিল আমি বুঝি ওকে আর দেখতে পারব না। শেষ বারের জন্য ওর কানে বলতে পারব না ভালোবাসি। এত কষ্ট এত যন্ত্রণা
আমার ফুটফুটে দু’টি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সব কষ্ট ফিকে হয়ে গেল। দুই মেয়ের জননী হয়েছি আমি। বাবা, ফুপি নাতনিদের পেয়ে আমাকে ভুলেই গেল যেন। উনাদের সব আনন্দ এখন ওদের নিয়ে। আরমান আসতে পারল না। মেয়েদের বয়স তিনমাস তখন ওরা প্রথম বার বাবার কোলে উঠেছে। প্রথমবার মেয়েদেরকে কোলে নিয়ে আরমানের হাসি, ওর কান্না, খুশি আমি দু-চোখ ভরে দেখেছি। মানুষটাকে যত দেখি যতই মুগ্ধ হই। আমার এই মুগ্ধতা কমে না। বরং বেড়েই যাচ্ছে।
পৃষ্ঠ –
আমার মেয়েদের নাম এখনও আপনাদের বলিনি তাই না! আমার বড় মেয়ের নাম আরহা। ছোট মেয়ে বড় মেয়ের থেকে দুই মিনিটের ছোট। ওর নাম আনহা। মেয়েদের নাম ওর বাবা রেখেছে। আজ ওদের জন্মদিন। এইতো দেখতে দেখতে পাঁচ বছরে পা দিল। আজও ওদের বাবা ওদের কাছে নেই। এইজন্য মেয়েরা মন খারাপ করে বসে আছে। নতুন জামাও পরবে না। কেকও কাটবে না। ওদের অভিযোগ পাপা সবসময় এমন করে। পাপা একটুও ভালো না। পাপা ওদের দুই বোনকে ভালোবাসে না। এই অভিমানী দুই পরীকে কে বোঝাবে পাপা ওদের কতটা ভালোবাসে।
পৃষ্ঠ –
মেয়েদের জন্মদিনে আসেনি বলে মেয়েরা ওদের বাবাকে পানিশমেন্ট দিয়েছে। সাহেব এখন অপরাধী মুখে মা জননীদের সামনে কান ধরে উঠবস করছে। ওরা দু’জন বিছানায় বসে পা নাচাতে নাচাতে গুনছে। বাবা থেমে গেলেই দুই বোন সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলছে,
~ খবরদার পাপা থামবে না । তাহলে কিন্তু আবার প্রথম থেকে গুনব।’
~ ফিফটি বার তো হয়েছে মা। আর কত? পাপার কিন্তু কষ্ট হচ্ছে।’
~ তোমার জন্য আমরা কেক কাটিনি। নতুন জামাও পরিনি। তোমাকে আজ পুরো দিন কান ধরে উঠবস করতে হবে। নইলে আমরা দু’জনেই রাগ করব। কথা বলব না তোমার সাথে।’
আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাবা মেয়েদের খুনসুটি দেখছি। ওরা যখন আমার চোখের সামনে থাকে তখন মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার থেকে সুখী মানুষ আর কেউ নেই। সৃষ্টিকর্তা আমার কোলে নিষ্পাপ দু’টি ফুল দিয়েছেন। সেই ফুলদের বাবা আমার মাথার প্রশান্তির ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাছ। যে আমাকে পৃথিবীর সব দুঃখ কষ্ট থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। যার মাঝে আমি নিজেকে বিলীন করেছি অনেক আগেই।
শেষ কথা…
আমার জীবনটা যেন একটি রূপকথার গল্প। যে গল্পে দুঃখ নামের শব্দটা থাকলেও সুখের সংখ্যা এত বেশি যা অগণনীয়। যে গল্পে কোন অপূর্ণতা নেই। যে গল্পে অথৈ নামের মেয়েটা সুখপুরীর রাজকন্যার ভূমিকা পালন করছে।
সমাপ্ত