#একটুখানি_আশা,পর্ব ১১
#মেহরাফ_মুন(ছদ্মনাম)
সেদিন রাতেই মুনের প্রচুর জ্বর এলো। বোধহয় কান্নার ফলে মাথা ব্যথা উঠার কারণে জ্বর আসলো।
সকালে ফুফি মুনকে শেষ কয়েকদিন ভার্সিটি যাওয়ার জন্য ডাকতে এলো।
-‘মুন উঠ। ভার্সিটি যাওয়ার সময় হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নেয়।’ ফুফি রুমের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল।
-‘আজ শরীরটা ভালো লাগছে না, তাই ভার্সিটি যেতে ইচ্ছে করছে না ফুফি।’
-‘কী বলিস, অনেক জ্বর। শরীর তো পুড়ে যাচ্ছে। রাতে ডাক দিতি ফুফিকে।’ সুমাইয়া আহমেদ গায়ে হাত দিয়ে দেখতেই ভীষণ জ্বর দেখে বলল।
-‘ও ফুফি, তুমি এত উৎকণ্ঠা হয়ো না তো। সামান্য জ্বর।’
-‘চুপ একদম। এত্তো জ্বর নিয়ে বলছিস সামান্য? শুয়ে থাক, আমি নাস্তা আর মেডিসিন পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোর নিচে নামার প্রয়োজন নেই।’ এই বলে ফুফি রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
কিছুসময় পর মুনের ফুফি নাস্তা আর মেডিসিন পাঠিয়ে দিল। মুন কোনোমতে কিছু খেয়ে মেডিসিন খেয়ে আবারও শুয়ে পড়লো। এই সময় মা’কে বড্ড মনে পড়ছে। মুন অসুস্থ হলে মুনের মা একটুও নড়ে না মেয়ের পাশ থেকে। মুন অসুস্থ হলে খাবার খেতে চায় না তাই যতো দিন জ্বর থাকতো উনি নিজের হাতে জোর করে খাইয়ে দিতেন। আর তাতে মুন বিরক্তবোধ করতো তবুও উনি ছাড়তেন না। বাবা ঘন ঘন ডাক্তার আনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।
বাবা কিছুক্ষন পর পর এসে জ্বর চেক করতেন। পারে না যে দুই মিনিটের ভেতর জ্বরকে তাড়িয়ে দিতে। মেয়ের জ্বর হলে বাবা-মা দু’জনের দিকেই তাকানো যেত না। সবসময় মনমরা হয়ে মুনের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কখন মেয়েটা সুস্থ হবে সেই আশায় থাকতো দুজনেই।
আজ ভীষণ করে মনে পড়ছে বাবা-মা’কে। আজ অসুস্থ হলেও জোর করে খাইয়ে দেওয়ার কেউ নেই। এই প্রথমবারের মত মুন অসুস্থতারে সময় নিজের হাতে খেয়েছে তাও না পারতে মেডিসিন খাওয়ার জন্য। বাবার মত কেউ বারবার এসে জ্বর চেক করছে না। আজ কেউ ডাক্তার আনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন না। আসলেই বাবা-মা কী জিনিস সেটা দূরে গেলে-ই উপলব্ধি করা যায়। এখানেও ফুফি আর এই পরিবার থেকে মুন যথেষ্ট আদর পাচ্ছে কিন্তু তবুও বাবা-মা’র আদরটা ভিন্ন। বাবা-মার স্থানটা কেউ নিতে পারে না। কাছে থাকতে গুরুত্ব দেয় না কিন্তু দূরে গেলেই বাবা-মা আল্লাহ’রে তরফ থেকে কত্ত বড়ো নিয়ামত বোঝা যায়। ভালো থাকুক পৃথিবীর প্রতিটা সন্তানের বাবা-মা। যারা নিজের চেয়েও বেশি সন্তানের মঙ্গল কামনা করে।
এর মধ্যেই মা-বাবা’র সাথে ফোনে কথা বলল মুন। মা তো অসুখ শুনেই কান্না জুড়ে দিল, বাবার কণ্ঠেও অস্থিরতা। মেয়ের সাথে কথা শেষ করে মুনের মা-বাবা মুনের ফুফি সুমাইয়া আহমেদের সাথে কথা বলবে বলায় মুন মোবাইলটা অহনাকে দিয়ে নিচে ফুফির কাছে পাঠালো।
কিছুসময় বাদেই দেখল ফুফি হাসিমুখে খাবারের প্ল্যাট নিয়ে হাজির। প্ল্যাটটা পাশে রেখে মুনের পাশে বসে সুমাইয়া আহমেদ নিজেরে হাতে মুনকে খাইয়ে দিল এরপর মেডিসিন দিয়ে মুনকে ঘুমাতে বলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মুন যা বোঝার বুঝে গিয়েছে। ফুফি নিজ হাতে খাইয়ে দেয়া এই সব মায়ের কারসাজি। হয়তো বা মুন অসুস্থতারে সময় খেতে চায় না এটাই বলেছে মা। মুন মুচকি হাসলো।
এভাবেই কেটে গেল দু’দিন। এই দু’দিন মুন রুম ছেড়ে বের হয়নি একবারও। মুনের খাবার ঠিক টাইমে ফুফি অথবা অহনা নিয়ে আসতো।
বিকেলের দিকে মুন ঘুম থেকে উঠেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।
-‘আসতে পারি?’
কারো গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ শুনে মুন পিছনে ফিরেই চমকে উঠলো। তাঁর রুমের দরজায় আদ্রাফ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। এটা কী সত্যি! মুন নিজের হাতে জোরে চিমটি কাটলো। ব্যথা পাওয়ার কারণে চোখ-মুখ কুঁচকে দেখল না এটা তাঁর ভ্রম নয়। এই খাটাসটা স্বয়ং তাঁরই রুমে। প্রথমদিনের ওই ঘটনার পর থেকেই এই খাটাসকে দেখলেই মুনের ঠান্ডা মেজাজ সাথে সাথে গরম হয়ে যায়। এখনো তাই। মুনের এত্ত সুন্দর ফুরফুরে মেজাজটা বেড়ে গেল।
-‘এসেই তো গেছেন।’ মুন রাগী কণ্ঠে বলে উঠলো।
মুনের কথা শুনে আদ্রাফ হকচকিয়ে গেল। সে হালকা কেশে বলল,
-‘শুনেছি তুমি না-কি অসুস্থ।’
আদ্রাফের কথা শুনে মুন হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। একটা মানুষ দুইদিন অসুস্থ থেকে এখন সুস্থও হয়ে উঠছে আর উনি এতদিনে জানতে পারছে মুন অসুস্থ ছিল। এখানে আসার জন্য হয়তো কোনো কুমতলব আছে ব্যাটার। কিছু করতে আসলেই মাথা ফাটিয়ে দিব। মুন বিদ্রুপ করে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-‘ওহ্হো তাই? কোথায় শুনছেন আই মিন কোন চ্যানেল থেকে জানলেন আমি অসুস্থ ছিলাম এটা।’
মুনের কথা শুনে আদ্রাফের মুখের ভাব-ভঙ্গিমা পরিবর্তন হয়ে গেল। সে রক্তিম চোখে মুনের দিকে এগিয়ে এলো।
-‘এই মেয়ে! তোমার কিন্ত দিন দিন সাহস বেড়ে যাচ্ছে। তুমি জানো কার সাথে এভাবে কথা বলছো? আর এর পরিণতি কী হতে পারে ভাবতে পারবে?’
আদ্রাফের রাগী চেহারা দেখে মুন ভয় পেয়ে গেল কিন্তু ভয়টা দেখালে চলবে না।
-‘আমি ভালো করে-ই জানি কার সাথে কথা বলছি। এই মুহূর্তে একজন ইরেসপনসিবল মানুষের সাথে কথা বলছি।’
আদ্রাফ আরও রেগে গেল মুনের কথা শুনে।
-‘আরেকবার যদি আজেবাজে বকো তাহলে এক্ষুনি ছাদে নিয়ে গিয়ে আছাড় মেরে নিচে ফেলে দিব। এমনিতেও পিচ্চি। একবার আছাড় মারলে-ই শেষ।’ আদ্রাফ বাঁকা হেসে বিদ্রুপ করে বলে উঠলো।
মুনের রাগ চরম পর্যায়ে উঠে গেল আদ্রাফের কথা শুনে। রাগের মাঝেও মুনকে হেনস্থা ঠিকই করছে। মুনের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি আসলো, এই তো সুযোগ খাটাসটাকে জব্দ করার। মুনও আদ্রাফের দিকে তেড়ে আসলো।
-‘তুই তো এক বালের কাজ এটাই জানিস। শুধু হুমকি দিয়ে মানুষকে ভয় লাগাতে জানিস। তুই রামছাগল, মাথামোটা হনুমান। তুই জন্মের সময় তোর মুখে মধুর বদলে ভুম্বা মরিচ দিয়েছিলো ভুলে ফুফি। ভুম্বা মরিচ চিনিস? না-কি ঐটাও চিনিস না, বাংলার আঘা-গোড়া কিছুইতো জানিস না। ভুম্বা মরিচ মুখে দেওয়ার সাথে সাথে যেমন জ্বাল বেরোই ঠিক তুইও তেমন। মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় এটা তো কোনোদিন পারবিও না মনে হয়। তুই একটা খাটাস।’ মুন এতটুকু বলে একটু থামলো।
আদ্রাফ মুনের কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে মুনের দিকে তাকিয়ে রইল। তাঁর মুখের ভঙ্গিমা দেখে মুনের হাসি পাচ্ছে কিন্তু এখন হাসলে চলবে না।
ইট’স হাই টাইম ফর গালাগালি। আদ্রাফের মুখে রাগের পরিবর্তে এখন অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা। মুন তো ভারী মজা পাচ্ছে। এখানে আসার পর থেকে ইংরেজি বলতে বলতে মাথা শেষ। সবগুলো ইংরেজের দল। আজকে বাংলায় গালি দিতে পেরে শান্তি শান্তি লাগছে। তাঁর উপর পছন্দের মানুষটাকে দিতে পেরে স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। মুন আবারও বলে উঠলো,
-‘এই মেয়ে কী সব আজেবাজে বকছো। তুমি কী জ্বরের কারণে পাগল-টাগল হয়ে গেছো না-কি?’
-‘কী বললি আমি পাগল? তুই এক নাম্বারের পাগল তাই আমাকেও পাগল বলছিস। অভিশাপ দিলাম তুই এমন একটা উন্মাদ বউ পাবি যে সবসময় তোরে কামড়াবে, তোর চুল ছিঁড়ে ফেলবে। তোরে যেন শান্তিতে থাকতে না দেয়। একটু গিয়ে মধু খেয়ে আয় তারপর তোর মুখ দিয়ে ভালো কথা বের হবে। এক নাম্বারের খাটাস তুই।’
মুনের ভঙ্গিমা দেখে আদ্রাফ একটু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে ওকে মুন বাজে কিছু বলছে। আদ্রাফ চোখ রাঙিয়ে বলে উঠলো,
-‘যা কিছু বলছো সবকিছুই আবার ইংলিশে ট্রান্সলেট করো। কুইক। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে বাজে কিছু বলছো।’
-‘এহহ, আমার খায়-দায় কাজ নেই যে। এগুলো ট্রান্সলেট করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতাম।শিখিস নাই ক্যান বাংলা? এবার বুঝ ঠেলা। এগুলো ট্রান্সলেট করলে তুই আমারে শুধু ছাদ থেকে না পৃথিবী থেকে পৃথিবীর বাইরে ছুঁড়ে মারবি। এখানে এসে ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে হাফিয়ে গেছি তাই আজ আমি বাংলায় মন খুলে কথা বলবো আর তাও একমাত্র তোর সাথে। দেখি কতক্ষন সয্য করতে পারিস তুই।’
-‘স্টপ ইট!’ মুনের বকবকানি শুনে আদ্রাফ চিৎকার করে ধমক দিল।
-‘এই জানিস। তোকে এখন কেমন লাগছে? ষাঁড় চিনিস? ষাঁড় এর সাথে তোর একটা অদ্ভুত মিল আছে। ষাঁড় যেমন লাল কাপড় দেখলে পাগলের মত করে তুইও ঠিক তেমন আমাকে দেখলে করিস। আমার মনে হয় কী জানিস? তুই আগের জন্মে ষাঁড় ছিলিস।’ আদ্রাফের রাগী রাগী চেহারা দেখে মুন ভয় না পেয়ে আরও বেশি করে বলতে লাগলো।
-‘জাস্ট স্যাট আপ। তোমাকে আমি দেখে নিব।’ এই বলে আদ্রাফ রেগে হনহন পায়ে মুনের রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মুন তো বেজায় খুশি। এতদিনে খাটাসটাকে জব্দ করতে পেরেছে ভেবে মনে মনে পৈচাশিক হাসি দিল মুন।
#চলবে ইনশাআল্লাহ।