#একটুখানি_আশা,পর্ব ৩,৪
#মেহরাফ_মুন(ছদ্মনাম)
#পর্ব ৩
বিয়ে বাড়িটাতে মুহূর্তের মধ্যে হৈ চৈ উঠে গেল। বিয়ে করতে এসেই বর গ্রেপ্তার। বর পক্ষ আসার পর পর পুলিশ এসে আহানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। কোনো একটা মেয়ের রেপ ক্যাচে মেয়েটা স্বয়ং আহানের নামে মামলা করেছে, সে চায় না আর কোনো মেয়ের অবস্থা তাঁর মত হোক। আহান মনে করেছিল ক্ষমতার জোরে সবার মুখ বন্ধ করে রাখতে পারবে কিন্তু মেয়েটা চুপ থাকার নয়, সেও প্রতিবাদ করে উঠলো আর তারপর পর আহানের সমস্ত মুখোশ বেরিয়ে এলো। যে কাজগুলো এতদিন লোকচক্কুর আড়ালে ছিল সেই সবও বেরিয়ে এলো।এই খবর মুহূর্তের মধ্যেই বাতাসের ন্যয় চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো। আত্মীয়রা তো ইতিমধ্যে কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে যে শেষপর্যন্ত মেয়েকে কী না মাফিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে।
মুনের বাবা সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। তাঁর এখন ভীষণ আফসোস হচ্ছে যে তাঁর ফুলের মত মেয়েটার মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে এমন এক কুলাঙ্গারের সাথে বিয়ে দিচ্ছিলো? যদি আজ ওই মেয়েটা না আসতো? তাহলে তাঁর আদরের মেয়েটার জীবন এখানেই নষ্ট হয়ে যেত,ভাবতেই খারাপ লাগছে! মুনের চাচা সবাইকে সামাল দিচ্ছে। কোনো কোনো আত্মীয়, পাড়া-পড়শীরা তো বলেই উঠলো,’এই মেয়েকে আর কে বিয়ে করবে? আহারে ফুলের মত মেয়েটার জীবনে চুনকালী লেগে গেল। পরিবারের বড়ো মেয়ে, কই একটু খোঁজ-খবর ভালো করে নিয়ে বিয়ে দিবে তা না তাঁর উপর একটা মাফিয়া! কত মেয়ের জীবন শেষ করেছে কী জানি বাপু!’
ওই একজনের কথায় সবাই সম্মতি জানিয়ে হৈ হৈ করতে লাগলো।
মুনের পরিবারের কাছে এমন কথা ভালো লাগলো না। মুনের বাবা শফিক সাহেব উঠে দাড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘মেয়ে আমার। এত চিন্তা কেন আপনাদের? আমার মেয়ে এতোই ফেলনা না যে এই একটা কারণে আর বিয়ে হবে না ! এমন ধারণা আপনাদের কোথ থেকে আসলো? এখানে কী আমার মেয়ের কোনো দোষ আছে? আর আপনাদের এমন সান্ত্বনা আমার লাগবে না, যে সান্ত্বনাগুলো মানুষকে আরও ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।’
মুনের বাবা শফিক সাহেব এমন কথা শুনে কয়েকজন তো মুখ ভেংচি কেটে বলেই দিল যে অহংকারের শেষ নেই। সান্ত্বনা দিলেও হয় না। এই অহংকারের কারণেই আজকে মেয়ের এমন দশা।
শফিক সাহেবের ভাবতেই খারাপ লাগছে। সমাজের মানুষগুলো এত নিম্ন মন মানসিকতার! যে সমাজ তাঁর চোখের দিকে তাকাতে সাহস পেতো না সেই সমাজ আজ তাঁর চোখের উপর চোখ রেখে কথা বলার সাহস পাচ্ছে শুধুমাত্র এই একটিই কারণে! শফিক সাহেবের মেয়ের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। মেয়েটা এমনিও এই বিয়েতে রাজী ছিল না তাঁর ইচ্ছে ছিল ভিন্নদেশে গিয়ে পড়ালেখা করার অথচ মেয়েটার মতামতকে পাত্তা না দিয়ে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। না জানি মেয়েটার মনের অবস্থা কেমন! সমাজের অসভ্য মানুষের এমন কথাকে পাত্তা না দিয়ে মেয়েটা এগিয়ে যেতে পারবে তো?ছোট থেকেই এই পরিবারের সব ছেলেমেয়েরা শফিক সাহেবের আশে-পাশে খুব কম ঘেঁষতো, সবাই শফিক সাহেবকে ভয় পায়। সবসময় গম্ভীরভাবে থাকতো উনি। যার ফলে নিজের ছেলে-মেয়েগুলোর সাথেও তেমন বন্ধুসুলব সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। অথচ তাঁর ছোট ভাইয়ের সাথে সবাই কত হাসি-মেতে আড্ডা দিতো, শফিক সাহেব উপস্থিত হলেই সবাই ভয় পেয়ে যার যার রুমে চলে যেত। যার ফলে আজ মেয়েটার মনের অবস্থাটাও বুঝতে পারলো না, আফসোস হচ্ছে তাঁর!
শফিক সাহেব মেয়ের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,’ছোট, আত্মীয়দের খাবার ব্যবস্থা কর। তাঁদের এমন কথা শোনার সময় এখানে কারোর নেই। ‘
মুনের চাচা মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেল।
মেয়ের রুমের দরজার সামনে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো শফিক সাহেব। ঢুকবে কী ঢুকবে না ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই দরজায় টোকা দিল শফিক আহমেদ।
দরজার টোকার আওয়াজে মুন আর আরিফা দুজনেই তাকালো। মুন এতক্ষন আরিফার কাছ থেকে সব শুনছিলো। সে তো বেজায় খুশি অন্তত এমন লোক থেকে রেহায় পেলো। এবার বাবা, চাচা মেয়ের বিয়ের কথা আপাততর জন্য ভুলেই যাবে মনে হয়।
আরিফা উঠে দাঁড়িয়ে মুনের উদ্দেশ্যে হেসে বলল,
-‘আমি গিয়ে দেখে আসি কে আসছে। এবার সবাই তোমাকে সান্ত্বনা দিতে আসবে, হাহা। অথচ ওরা তো তোমার আসল মনের অবস্থা জানে না। তুমি তো আসলে আজকের ঘটনার জন্য অনেক খুশি।’
দরজা খুলেই বড়ো আব্বুকে দেখে আরিফা দাঁড়িয়ে পড়লো। কোনো অদৃশ্য কারণে এই বাড়ির সব ছেলে-মেয়েরা শফিক সাহেবেকে ভীষণ ভয় পায়। মুনও পায়, আরিফাও তেমন। সে বড়ো আব্বুকে ঢুকতে বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
শফিক সাহেব দরজা দিয়ে ঢুকতেই মুন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। শফিক সাহেব মুনের রুমের বিছানায় বসতে বসতে বলল,’এখানে বসো মা।’
মুন অবাক। ওর বাবা খুব অল্পই তাঁর রুমে আসতো। আর আসলেও হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা উপলক্ষেই আসতো। এসেই বসতো না, কথাটা বলেই বেরিয়ে যেত কিন্তু আজ তাঁর বাবা তাঁর রুমে এত শান্ত ভঙ্গিতে বসছে, এটা যেন মুনের বিশ্বাসই হচ্ছে না।
মুন ভয়ে ভয়ে তাঁর বাবার পাশে এগিয়ে গিয়ে বসলো। মুনের সাজ এখনো রয়ে গিয়েছে। বদলানোর সুযোগ হয়নি। শফিক সাহেব মেয়ের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিল,
-‘দেখতে দেখতে কত বড়ো হয়ে গেল আমার পরীটা। অথচ আমি ব্যাবসায়ের দিকে এতোই ঝুঁকে পড়লাম যে খেয়ালই করতে পারলাম না।’ মলিন হেসে বলল শফিক সাহেব।
মুন আজকে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। সে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো। সে বুঝতে পারলো তাঁর বাবার মনে মেয়ের জন্য অপরাধবোধ জাগ্রত হয়েছে। শফিক সাহেব মেয়েকে কতটা ভালোবাসে তা আজ তাঁর চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কিন্তু কোনো কারণে সেই দেয়ালটা টপকিয়ে মেয়ের কাছে আসতে পারছেন না। মুন তা বুঝতে পেরে এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো। সে এগিয়ে গিয়ে তাঁর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। শফিক সাহেব প্রথম কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। এরপর তিনিও মুচকি হেসে মেয়েকে বুকে আগলিয়ে নিলো।
মুনের মনে হলো মুহূর্তের মধ্যে তাঁর বাবার সাথে ভয়ের দেয়ালটা ভেঙে গেল। সে ওভাবেই তাঁর বাবার বুকে মুখ গুঁজে দিল।
-‘বাবার উপর রাগ করে আছো? মা।’শফিক সাহেবের কণ্ঠে স্পষ্ট অপরাধ জেগে উঠলো।
-‘তোমার উপর কীভাবে রাগ করে থাকতে পারি, বাবা?’
-‘আজকে তোমার সিদ্ধান্ত জানিও। তোমার যেটা ইচ্ছে সেটাই পূরণ হবে মা। রাতে ডিনারের সময় থেকো।’ মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল শফিক সাহেব।
দরজা দিয়ে মুনের মা আর আরিফা এমন দৃশ্য দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ওই সময় মুনের বাবা রুমে ঢুকার পর পরই আরিফা দৌড়ে বড়ো মার কাছে গিয়েছিল। সে মনে করেছিল বড়ো আব্বু হয়তো বা মুন আপুকে বকা দেওয়ার জন্য রুমে ঢুকেছে আর মুনের মা এটা শুনে তাড়াতাড়ি করে রুমে ঢুকতেই এমন দৃশ্য দেখে মনটা মুহূর্তের মধ্যে ভালো হয়ে গেল। আরিফাও ভীষণ খুশি হলো।
মুনকে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিতে বলে শফিক সাহেব বের হতে নিলেই স্ত্রীকে দেখতে পেলো দরজার সামনে। স্ত্রী এক নজরে তাকিয়ে রইল শফিক সাহেবের দিকে। শফিক সাহেব তা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
যাক অন্তত এই বিয়েটা উপলক্ষে মুনের বাবার গম্ভীরতা ভাবটা একটু হলেও কেটেছে আর মেয়ের সাথেও এমন ভালোভাবে মিশেছে ভাবতেই ভীষণ খুশি লাগলো মুনের মার। আর অন্যেদিকে মুনেরও আজকে ভীষণ খুশির দিন মনে হচ্ছে।
———————
রাতে খাবার টেবিলে পরিবারের সবাই খাওয়া শেষে মুনের বাবা মুনের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘কী করার ইচ্ছে আমার পরীটার এখন?’
মুন এক নজর সবার দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বলে উঠলো,
-‘বাবা আমার ইচ্ছে এখনো আগের মতোই। আমি জাপানে গিয়ে পড়তে চায়।’
মুনের কথা শুনে সবাই স্তব্ধ।
#চলবে ইনশাআল্লাহ।
(ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন দয়া করে,)
#একটুখানি_আশা
#মেহরাফ_মুন(ছদ্মনাম)
#পর্ব ৪
মুনের এমন ইচ্ছের কথা শুনে শফিক সাহেব কিছুক্ষন মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবলেন। বাকি সবাই এখনো মুনের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিফা আগে থেকেই জানতো তাঁর আপু এমন অদ্ভুত ইচ্ছের কথা বলবে তাই সে স্বাভাবিক। মুনের মাথা তুলে মুনের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘কিন্তু তুমি একা ওই ভীনদেশে কীভাবে থাকবে মা?’
শফিক সাহেবের কথা শুনে মুনের মনে হলো তাঁর মন থেকে একটা পাথর সমান বোঝা নামল। তাঁর মানে তাঁর বাবা রাজী হবে।
মুনের মা শফিক সাহেবের কথা শুনে রেগে গিয়ে বলল,
-‘মেয়ে যেতে চাইছে বলে তুমিও যেতে দিবে? একা এমন একটি দেশে কেমনে থাকবে এই মেয়ে? পড়াশোনা কী এখান থেকে করা যায় না? এত দূর দেশে পাঠাতে হবে না।’
-‘বাবা তুমি আমার মতামত জানতে চাইছিলে তাই বললাম। আমার এই একটাই ইচ্ছে।’মুন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল।
শফিক সাহেব মুনের উদ্দেশ্যে নরম স্বরে বলল,
-‘তুমি রুমে যাও মা। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমাকে কাল সকালে বলবো।’
মুন চেয়ার ছেড়ে উঠে মাথা হেলিয়ে তাঁর রুমে চলে গেল।
মুন যাওয়ার পর পর শফিক সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘মেয়েটা এখনো একটা ট্রমার মধ্যে আছে। এই বিয়েটা আমরাই ওকে জোর করে দিতে চেয়েছিলাম মনে করেছি এমন পরিবার আর পাবো না কিন্তু ভাগ্য…। মেয়েটার অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ভীনদেশে গিয়ে পড়ার। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর ইচ্ছেটাকে দামা-চাপা দিয়ে সে বিয়েতে রাজী হয়েছিল কিন্তু বিয়ের দিন কনের জন্য এমন একটি ঘটনা একদম অপ্রত্যাশীত আর মন তো ভাঙ্গেই, আর তাঁর উপরে সমাজের এমন কুরুচিপূর্ণ কথাগুলো মেয়েটা সয্য করতে পারবে না। দেখা যাবে মেয়েটি আরও মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। একে একবার অন্যায় করে ফেলেছি ওর সাথে। অপরাধবোধে আমাকে ঘিরে ধরে। মেয়েটা সবেমাত্র এইচএসসি দিল, তাঁর জীবন এখনো অনেক বাকি রয়ে গেছে। তাঁর উপর এই ইচ্ছেটাকেও যদি মাটি-চাপা দিই তাহলে আমরা মা বাবা হওয়ার যোগ্য নয়। আমরা ওর মতামতকে প্রাধান্য দিব। আমি চায় ও এই কালো অধ্যায়টা ভুলে গিয়ে আবারও সুন্দর করে জীবনে এগিয়ে যেতে পারে। তাই আমার মতামত হচ্ছে ওর এই ইচ্ছেটাকে পূরণ করা।’
মুনের বাবা এটুকু বলে থেমে মুনের মা রাশিদা আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমি সব ভেবেচিন্তে বলছি রাশু। এবার তুমি কী চাও এটা বলো।’
রাশিদা আহমেদ মাথা নেড়ে বলল,’আমিও চায় আমার মেয়ে এসব ভুলে গিয়ে জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিক। কিন্তু অত দূর দেশে..।’
-‘আহা ভাবি এত চিন্তা কীসের? ওখানে তো আমার আফা আছে। আফা জানলে তোমাদের একদম চিন্তা করতে দিবে না।’মুনের চাচা বলল।
শফিক সাহেব আর রাশিদা আহমেদের এতক্ষনে হুশে আসলো। সত্যিই তো, ওখানে মুনের বড়ো ফুফি আছে তাহলে এত চিন্তা কীসের! এতকিছুর চাপে ভুলেই গেছিল জাপানে এই পরিবারের বড়ো মেয়ে থাকে। ওখানে ওর হাসব্যান্ড বিসনেস করে এরপর থেকে আর আসা হয়নি এই দেশে। মুনের বিয়ে উপলক্ষেও আসা হয়নি কিন্তু এই বিয়ে ভাঙার জন্য উনার মনও ভীষণ খারাপ। বড়ো ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে বলে কথা। মুনদেরও ভীষণ আদর করে। তবে সরাসরি একবারও দেখা হয়নি। ভিডিও কলেই পরিচয়। শফিক সাহেব আর রাশিদা আহমেদের মনে হলো এতক্ষনে বোঝা কমছে, এতক্ষন তো চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে ওদের। শফিক সাহেব নিশ্চিন্ত মনে তাঁর ছোট ভাইকে সব ব্যবস্থা করতে বলে রুমে চলে গেল।
———————-
সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মি চোখের উপর পড়তেই মুন বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে চোখ খুলে দেখল কেউ একজন তাঁর জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। মুনের ঘুম থেকে আপাতত উঠার ইচ্ছে নেই তাই সে আবারও লেপ টেনে নিয়ে ঘুমানোর জন্য পাশ ফিরলো। মাথার উপর কারো হাত বুলিয়ে দেওয়ার অস্তিত্ব অনুভব করে মুন আবারও চোখ খুললো। চোখ খুলেই দেখতে পেলো বাবা হাসিমুখে মুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
-‘শুভ সকাল মামনি।’
-‘বাবাই!’ মুন অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল শফিক সাহেবের দিকে। কারণ তাঁর মনে পড়ছে না শেষ কবে তাঁর বাবা এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম থেকে তুলেছিল। ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়িয়ে খুঁজে পেলো জিরো। না, মনে পড়ছে না। আর কাল থেকে হঠাৎ এত ভালোভাবে মিশতে চাচ্ছে। যায় হোক, মুনের অনেক খুশি লাগছে এখন কারণ তাঁর গম্ভীর বাবাটাও হয়তো আবার সবার মতোই হাসিমুখে থাকবে।
-‘উঠে পড়ো মামনি। অনেক বেলা হলো।’ মুনের ভাবনার মাঝেই শফিক সাহেব বলে উঠলো।
মুন তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠে বসলো।
-‘গুড, এবার ফ্রেশ হয়ে এসো মা। বাবাই নিচে টেবিলে অপেক্ষা করছি।’ এই বলে শফিক সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মুন এখনো ঘোরের মাঝে আছে। এটা তাঁর বাবাই তো? এত ফ্রি? মুনের এখন আহানকে গিয়ে একটা টাইট করে জড়িয়ে হাগ্ দিতে ইচ্ছে করছে। এই আহানের জন্যই তাঁর বাবার সাথে সবারই আবার মিল হবে আর তাঁর সাথে তো হয়েছেই। মুনের বুঝ হওয়ার পর কোনোদিনও তাঁর বাবা শফিক সাহেব কারো সাথেই অপ্রয়োজনীয় কথা বলতো না। সবকিছুই নিয়মের ভেতর চলতো। এমনকি তাঁর চাচা, কাজিন সবাই মিলে আড্ডা দিলে ঐদিক দিয়ে শফিক সাহেব আসার ইঙ্গিত পেলেই সবাই আড্ডা ফেলে সবাই নিজ নিজ রুমে চলে যেত। সকালে কোনোদিন একসাথে নাস্তা করেনি শফিক সাহেব। সে আগে আগে করে চলে যেত। আর আজ! মুনের ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে। মুন এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রেশ হতে চলে যায়।
ফ্রেশ হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখল পরিবারের সবাই আজ একসাথে টেবিলে বসেছে তাঁর বাবাই সহ। গল্পও করছে। মুন গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসতেই তাঁর চাচী নাস্তা এগিয়ে দিল।
শফিক সাহেব মুনের দিকে তাকিয়ে বলল,’মামনি লাস্টেবারের মত বলো, তুমি কী দেশের বাইরে যেতে চাও?’
মুন শান্তস্বরে তাঁর বাবার দিকে তাকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
-‘আচ্ছা তাহলে। তোমার সবকিছু ঠিকঠাক করতে কিছুদিনের মত লাগবে। এই কয়দিন পরিবারের সাথে সময় কাটাও। আর ওখানে গেলে তোমার ফুফির কাছেই থাকবে। ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি আশা রাখি ঠিকঠাকভাবে থাকবে আমার মেয়েটা।’
মুন তো খুশিতে বাকরুদ্ধ। সে ভাবেওনি এত তাড়াতাড়ি তাঁর আশাটা পূরণ হবে। এত সহজে তাঁর বাবা মেনে নিবে।
মুন রুমে গিয়ে বসতেই আরিফা আসলো। বোঝায় যাচ্ছে মেয়েটার আজ মন খারাপ। মুন মুচকি হেসে বলল,’কী হয়েছে আমার বোনটার? আজ মুখটা এমন ক্যান?’
আরিফা কিছু না বলে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,’আপু তুমি চলে যাবে?’
মুন আরিফাকে কাছে ডাকলো। আরিফা এসে মুনের পাশে বসলো।
-‘সবসময় তো কথা হবেই। মনে হবে আমি এভাবেই তোমার পাশে আছি।’
আরিফা কিছু না বলে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। কোনোদিন চাচাতো বোনের মত ভাবেনি। নিজে কিছু কিনলে তাঁর জন্যও একটা কিনতো। একসাথেই সব করতো। তাঁর এই বোনকে ছাড়া বাড়িটাই খালি খালি লাগবে। কেমনে থাকবে সে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল আরিফার।
মুন আরিফার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’আর বফ তো আছেই। মন খারাপ হলেই ওকে কল দিবি দেখবি দুইমিনিটের ভেতর মন ভালো করে দিবে। যায় হোক আজকাল কার নিব্বা-নিব্বি বলে কথা। নিব্বা-নিব্বিদের মধ্যে একজনের জ্বর উঠলে মেসেঞ্জারে মাথায় হাত বুলানোর ইমোজি দিলেই জ্বর উধাও। একজনের জ্বর অপর পাশ থেকে আরেকজন সারানোর অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মে এরা। মেসেঞ্জারে কী সুন্দর সংসারও হয়ে যায়। হাহা, আর সামান্য তোর মন খারাপটাই উধাও হবে না?’ এসব বলেই আরিফার দিকে তাকিয়ে হাসি চেপে রাখলো।
-‘দুরু আপু। আমরা নিব্বা-নিব্বি না। যথেষ্ট ম্যচিউর্ড আমরা।’ আরিফা মুখ গোমড়া করে বলল।
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ। টেনে পড়েই ম্যচিউর্ড। হাহা।’
আরিফা মুনের কথায় হেসে উঠলো।
———————
দেখতে দেখতেই হেসে-মেতে কেটে গেল এই কয়দিন। আজকে মুনের ফ্ল্যাট। তাঁর ভীষণ খারাপ লাগছে এখন। অত দূর দেশে কীভাবে থাকবে সে? এই আপনজনগুলোকে ছেড়ে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ।
(ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন দয়া করে)