একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_০১ #মৌরিন_আহমেদ

0
1610

ব্যাগটা পাশে রেখে দুম করে সিটে বসে হিয়া বললো,
— “তোর ভাইয়ের সমস্যা কি রে? আমাকে একটু ভালোবাসলে কি তার জাত চলে যাবে?”

কলেজে আজ ফার্স্ট পিরিয়ডে ইংরেজী পরীক্ষা। পড়াকু কান্তা তাই পড়ায় মন দিয়েছিল। হিয়ার কথা শুনে বই থেকে চোখ না তুলে ছোট্ট করে বললো,
— “কি হয়েছে?”

কিন্তু ওই বলা পর্যন্তই। মন তার পুরোটাই ইংরেজী রাইটিংয়ের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। সেসব কিছু খেয়াল না করে হিয়া নিজের মতো বকে যাচ্ছে,

— “কি হয় নাই, সেইটা বল! তোর ভাইয়ের এতো ভাব কেন! আজব, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে তাকায়ও না।”

রাগে ফুঁসতে লাগলো হিয়া। কান্তার মন তখনো পড়ায়। হিয়ার কথা শুনছে না মোটেও। কোনমতে মাথা নাড়লো,
— “হুঁ।”
— “সালাম দিলে জবাব অবধি দেয় না!”
— “হুঁ।”
— “কিছু জিজ্ঞেস করলে এমন ভাব করে যেন শুনতেই পায় নি।”
— “হুঁ।”

এবার ক্ষেপে গেল হিয়া,
— “কি তখন থেকে ‘হুঁ হুঁ’ করছিস? আমার কথা শুনেছিস কিছু?”

কান্তা এতোটাই ডুবে আছে যে ওর কথা যেন শুনতেই পেল না। রাগে খিটমিট করতে করতে ওকে ঠ্যালা মারলো হিয়া,
— “কান্তা!”

হাত থেকে বই পড়ে গেল কান্তার। চটকা ভেঙে তাকাতেই দেখলো হিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। চিৎকার জুড়ে দিলো,

— “তোরা দুই ভাইবোন এরকম করিস কেন আমার সাথে? আমাকে একটু পাত্তা দিলে তোদের কি জাত চলে যায়? এমন কেন তোরা?”

— “কি করেছি আমি? তুই তো ভাইয়ার কথা বলছিলি, সবই তো শুনেছি।ভাইয়া তোর দিকে তাকায়—”

— “শুনে একেবারে উদ্ধার করে ফেলেছিস যেন! সর, সামন থেকে। আমি বেরোব।”

তেজ দেখিয়ে বললো হিয়া। কান্তা তখনো বোকা চোখে তাকাচ্ছে। আজব মেয়ে তো! ওর সব কথা শোনবার পরও রাগ করলো কেন? ও তো শুনলোই, কাহন ভাই হিয়াকে পাত্তা দেয়। দেখা হলে তাকায়। মিষ্টি করে কথা বলে। আর–আর কি বলেছে হিয়া? ঠিক মনে আসলো না। তাতে কি? নিশ্চয় ভালো কিছুই বলেছে?

তবে হিয়া এতো রাগলো কেন? বোকার মত তাকালো,

— “এতো ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন তুই? আমি তো–”
— “তুই সরবি? না মাlর খাবি?”

চোখ পাকিয়ে তাকালো। বিপন্ন হয়ে ওর যাবার জন্য জায়গা করে দিতে বাধ্য হলো কান্তা। ফাঁক পেয়েই হনহন করে ছুটলো হিয়া। একটু রাগ আর একটু উদাস হয়ে!
___

বেলা এগারোটা। মুজাহিদ সাহেবের বাড়ির অবস্থা এখন থমথমে। বাড়ির গিন্নি রাহেলা খানম চেঁচিয়ে যাচ্ছেন এক নাগাড়ে। তার চেঁচামেচির কারণ একটি নয়, বেশ কয়েকটি। প্রথমত, ছোট পুত্র পবন বেশ দামী একখানা গ্লাস ভেঙে পগারপার হয়ে গেছে!

গ্লাস ভাঙা তেমন ব্যাপার না। মেনে নেয়া যায়। কিন্তু রাহেলা খানম মানতে পারছেন না। কারণ, পবন শুধু গ্লাস ভাঙে নি। সেই ভাঙার কথা কাউকে না জানিয়ে চেপেও গিয়েছিল। আর তাই না জেনে রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়ে ভাঙা কাচে পা পড়ে তার বারোটা বেজেছে। একেবারে রlক্তারlক্তি কান্ড! পা ধরে মাটিতে বসে যখন তিনি ‘পবন পবন’ বলে চেঁচাচ্ছেন, তখন পবন গেছে পালিয়ে!

পুরোনো কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে কোনোমতে পা’টা টেনে নিয়ে বাইরে বেরোতে না বেরোতেই দেখলেন আরেক কাণ্ড। পবনের জমজ ভাই পরাগ, পাগলীর ঘরের জানালায় দাড়িয়ে প্রাণপনে চিৎকার করছে। পাগলী পরাগের চুল ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে আর জানালার গ্রিলের সাথে বাড়ি লাগাচ্ছে ক্রমাগত। পরাগ নিজেকে ছুটানোর চেষ্টা করেও পারছে না। তাই চিৎকার করে মাকে ডাকছে!

ছেলের অবস্থা দেখে কাটা পা নিয়েই ছুটে এলো রাহেলা। কোনোমতে পাগলীর হাত থেকে ছেলেকে ছুটিয়ে নিয়ে কষিয়ে চড় লাগালেন পুত্রের গালে,

— “বারবার! বারবার নিষেধ করেছি এ দিকে আসবি না। তবুও আসতে হবে? আরেকটু হলেই তো তোর ঘাড়টা মটকে দিচ্ছিল ডাlইlনিটা!”

গ্রিলের ওপাশ থেকে পাগলী তখন চেঁচাচ্ছে,
— “এই! এই ডাইনি বলছিস কাকে?”

সেদিকে একপলক চেয়ে ছেলের হাত ধরে টেনে আনলেন রাহেলা। অপর গালে সপাটে আরেকটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,

— “বল কেন গিয়েছিলি ওখানে? তোকে বারণ করি নি আমি?”

পরপর দুটি শক্ত চড় খেয়ে কাঁদতে শুরু করেছে পরাগ। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করতে করতে জবাব দিলো,

— “আমার কি দোষ? ফুপি যে ডেকেছিল?”

— “এহহ! ফুপি ডেকেছিল! এই তুই জানিস না, ও পাগল? কাছে গেলেই মারে? তবু যাস কেন?”

ভেঙালেন ছেলেকে। পরাগ কেঁদে চলেছে নিজের মতো। ধমক দিলেন একটা,

— “খবরদার! আর যদি পাগলীর ঘরের আশপাশে গিয়েছিস তো–”

কাঁদতে কাঁদতেই পরাগ ছুটে পালিয়ে গেল। আর ঠিক মুহূর্তেই পায়ের চিনচিনে ব্যথাটা ফিরে এলো রাহেলার। চোখ নামাতেই দেখতে পেলেন ব্যান্ডেজ ভিজে রlক্ত পড়ছে। কাটা পায়ে কি আর এতো দৌড়-ঝাঁপ সয়?

পুনরায় ব্যান্ডেজ পাকাতে পাকাতে তার কাহনের কথা মনে পড়লো। এতো বেলা হয়ে গেল অথচ নবাবপুত্রের পাত্তা নেই? এখনো ঘুমোচ্ছে? আগুন জ্বলে উঠলো মাথায়। উফ্, এতো যন্ত্রণা! এই একটা বাড়ি যার কোনোকিছুই ঠিক নেই। সবকিছু এলোমেলো, অগোছালো!

রাগে চিড়বিড় করতে করতে বাড়ির উত্তর দিকের ছোট্ট ঘরটার সামনে দাড়ালেন। যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। দরজা বন্ধ, কাহন ভেতরে ঘুমাচ্ছে। জানালা সংলগ্ন বারান্দায় দাড়িয়ে ডাকলেন,

— “এ্যাই, কাহন! কাহন! আর কতো ঘুমাবি? উঠতে পারিস না?”

কাহনের তবুও হেল-দোল নেই। রাহেলা ডাকলেন কয়েকবার। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হলো না। আগে থেকেই রেগে আছেন তার উপর কাহনের ঘুম। মেজাজ তিরিক্ষি হতে সময় লাগলো না। একটু পরেই শুরু করলেন তার গজরানি,

— “সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমানো। আর কোনো কাজ আছে? বাজারে যাবে কে শুনি? বেলা এগারোটা বাজে– এরপরে বাজারে গেলে আর কিছু পাবি? সব বেচা হয়ে যাবে না? অথচ নবাবজাদার কোনো খেয়াল নেই। সে তো আপন খেয়ালে মত্ত–”

মামীর কণ্ঠ শুনে ঘুম ভাঙলো কাহনের। চোখের পাতা অসম্ভব ভারী। টেনে তাকানো যাচ্ছে না। বহুত কষ্টে চোখ মেলতেই মনে হলো পৃথিবীটা যেন দুলছে। আশেপাশের সবকিছু নড়ছে এলোমেলো হয়ে। যেন ধপাস করে পড়ে যাবে। বাম হাত কপালে নিতেই টের পেল তার জ্বর এসেছে। প্রচণ্ড উত্তাপ লাগছে হাতে। চট করে হাত সরিয়ে নিলো কাহন।

জ্বর যে হুট করে এসেছে তা নয়। গতকাল রাত থেকেই তার জ্বর জ্বর ভাব। সাথে ঝিম ধরানো মাথা ব্যথা। সারারাতে ঘুমোতে পারে নি তাই। ছটফট করে করে রাত পার করেছে। হাতের কাছে সিগারেটও ছিল না। ফলে আরও যন্ত্রণায় কেটেছে সময়। যারা সবসময় ধূমপান করেন তাদের ভাষ্যমতে অস্থিরতা কমাতে সিগারেট নামক বস্তুটি নাকি কাজ করে খুব। অথচ অসুস্থ অবস্থায় পাশে কেউ নেই যাকে একগ্লাস পানি দিতে বলবে, সেখানে ওর জন্য সিগারেট এনে দেবে কে?

মন আনচান করছিল খুব। তাই এই অসুস্থ শরীরটাকে টেনে নিয়ে একটা প্যাকেট কিনবার জন্যই মোড়ের দোকানে গিয়েছিল সকালে। ফিরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে তবেই মিলেছিল শান্তি। অতঃপর নিঃশেষ হয়ে আসা সিগারেটখানা ছুঁড়ে ফেলে ডুবে গিয়েছিল অতল ঘুমে।

মাথাটা ভারভার লাগছে। বিছানায় উঠে বসতে বসতে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলো কাহন,

— “মামী, জ্বর এসেছে আমার!”

— “জ্বর এসেছে তো আমি কি করবো? নিজে নিয়মকানুন মানবে না, আবার জ্বর হলে সেবাযত্ন করবো আমি? ওটি হচ্ছে না।–”

ঝামটা মারলেন তিনি। বাহির থেকে ঝাড়ুর খড়খড়ে আওয়াজ কানে বাজলো ওর। মামী বারান্দার সামনের উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। কাহন স্বর তুললো একটু,

— “আজ বাজারে না গেলে হয় না?”

চট করে জানালার কাছে এসে দাড়ালেন রাহেলা। হাতে ঝাড়ু উঁচানো,

— “হ্যাঁ। সেই জন্যই তো জ্বরের বাহানা। বাজারে যেতে হবে যে! কি ভেবেছো আমি বুঝি না? সব বুঝি। তোমাদের এসব ঢং– পরের বাড়িতে থাকছো, খাচ্ছো। দুটো কাজ করে দিতে বললেই যতো বাহানা—”

নিজেকে হঠাৎ খুব ছোট মনে হলো কাহনের। আচ্ছা, জীবনটা এতো জটিলতায় ভরপুর কেন? অন্যের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে বলেই কি দিনরাত এই খোঁটা, এই লাঞ্ছনা? যে জ্বর হলেও কোনো মূল্য নেই? আজ নিজের বাড়িতে নিজের মায়ের কাছে থাকলে কি হতো তার? জীবনটা কি অন্যরকম হতে পারতো না?

বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না একটুও। তবুও উঠতে হবে। জোর করে উঠলো সে। মেঝেতে পা ফেলতেই সারা গায়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল! ইসস, কি ঠাণ্ডা! একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নেমে পড়লো বিছানা থেকে। আলনা থেকে শার্ট নিয়ে গায়ে পরতে পরতে বেরিয়ে এলো। রাহেলা খানম তখন পরাগের সাথে কি একটা নিয়ে খিটিমিটি করছেন,

— “আর পারি না, বাপু! এই সংসারের ঘানি টানতে টানতে জীবন গেল। তবুও তোদের এতো জব্দ সইতে পারি না আর—”

চলবে___

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০১
#মৌরিন_আহমেদ

[শুরুটা কেমন লাগলো? আরও এগোবো? না এখানেই থামিয়ে দেব?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here