#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_১১
রেস্তোরাঁয় মুখোমুখি সোফায় বসে আছে কায়সার মাহমুদ আর কাহন মাহমুদ। একজনের চেহারা আকুতিতে পরিপূর্ণ হলেও অন্যজন ভাবলেশহীন। কাহন বিরক্ত গলায় বললো,
— “বলুন, কি বলতে চান!”
— “তার আগে বল কি খাবি। আমি অর্ডার করছি।”
জোর করে অ্যাপায়নের চেষ্টা করে হাসলেন কায়সার। কাহনের ভাবের পরিবর্তন হলো না। সে ত্যক্ত কণ্ঠে বললো,
— “আমি কিছু খাবো না। আপনি অর্ডার করুন।”
— “কেন? আমার কাছ থেকে কিছু খেতেও কি তোর কষ্ট?”
করুণ চোখে তাকালেন। মুখের হাসি বিলীন হয়েছে তার! ভেবেছিলেন, এতে অন্তত কাহন অপ্রস্তুত হবে। সায় দিবে খাওয়ার জন্য। কিন্তু না, আত্মপ্রত্যয়ী কাহন এতো অল্পতেই অপ্রস্তুত হয় না। শক্ত জবাব তার,
— “হ্যাঁ। আপনার দেয়া কোনোকিছু খেতেই আমার প্রবৃত্তি হয় না। আমি চাই না!”
— “অথচ একদিন, এই আমার জন্যই তুই মুখিয়ে থাকতি। আমি অফিস থেকে ফিরলে সর্বপ্রথম এসে জিজ্ঞেস করতি তোর জন্য কি এনেছি। তোর কাছে—”
— “এসব পুরোনো আলাপ ছেড়ে আসল কথায় আসুন। অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে। আমি কাজে যাবো।”
হঠাৎ ছেলের হাত আঁকড়ে ধরলেন কায়সার মাহমুদ। মিনতি করলেন,
— “তুই এমন করছিস কেন, বাপ! এমন অচেনা মানুষের মতো আচরণ কেন করছিস?”
— “কেন করবো না? আপনি আমার চেনা কেউ? চেনা তো ছিলেন বারো বছর আগে। যখন আমি আর আমার মা ছিল আপনার পৃথিবী। কিন্তু এখন তো তা আর নেই! আপনার পৃথিবী তো সেদিনই বদলে গেছে যেদিন আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করে এনেছেন!”
রাগে গা রি-রি করছে কাহনের। কোনো বিষয় নিয়ে তার রাগ নেই, ক্ষোভ নেই। অথচ এই একটি বিষয় নিয়েই তার যতো যন্ত্রণা। তার ক্ষোভ, বিদ্বেষ। কায়সার মাহমুদ বললেন,
— “আমি অস্বীকার করি না সেটা। দ্বিতীয় বিয়ে করেছি আমি। কিন্তু তার পেছনেও আমার কিছু কারণ ছিল! রেবুর সঙ্গে আমার বুনছিল না। রোজ-রোজ ঝগড়া-ঝাটি, কলহ-বিবাদ আমি আর নিতে পারছিলাম না। এমতাবস্থায় আমি কি নিজের সুখের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারি না?”
— “অবশ্যই পারেন। আপনি সেটা করেওছেন। কিন্তু আমার মায়ের অনুমতি ছাড়া। মার সঙ্গে আপনার কোনো ছাড়া-ছাড়িও হয় নি। তো, ওই অবস্থায় আমরা কি করে আপনার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সঙ্গে একই বাড়িতে থাকবো? আপনি তো তাকে নিয়ে ওই বাড়িতেই উঠবেন। আর তাই, মায়ের সাথে আমি চলে এসেছি। ছেড়ে দিয়ে এসেছি সমস্ত দাবি-দাওয়া। বারো বছর পেরিয়েছে মাঝে। এখন আবার কেন এসেছেন আপনি? আমাদের ছেড়ে দিয়ে—”
— “তোর মাকে ছেড়েছি সত্যি, তোকে তো ছাড়ি নি, কাহন? আমি নিজেই তোকে বলেছিলাম আমার কাছে থাকতে। বাপের কাছে থাকতে। তুই তো থাকিস নি!”
— “হ্যাঁ, থাকি নি। কারণ ওই মুহূর্তে আপনার জীবনে আমার প্রয়োজন ছিল না। আমি আপনার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। যেখানে প্রথম স্ত্রীই মূল্য পায় না, সেখানে তার সন্তান কি করে মূল্য পাবে? আপনার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আমার স্থান কি সেই নির্জীব আসবাবের মতোই হতো না?”
— “না হতো না। তুই আমার প্রথম সন্তান। আমার সমস্ত কিছুতেই তোর হক আছে। তুই কেন ছেড়ে এলি সেদিন!”
— “সেদিনের পর তো বহুবছর পেরিয়েছে। তাহলে এতদিন পর হঠাৎ আমার কাছে কেন এলেন আপনি? এতবছর তো ভুলেই ছিলেন।”
চোখের কোণায় জল চিকচিক করছে। তেজস্বী কণ্ঠটা নেতিয়ে পড়েছে কাহনের। সে আর পারছে না। ফেলা আসা অতীতের মুখোমুখি হতে তার বড় ভয় হয়। তবুও কেন তা সামনে এসে যায়?
— “আমি মিথ্যে বলবো না। সত্যি সত্যিই এতবছর আমি তোদের ভুলে ভালো ছিলাম। আমার স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে। কিন্তু বিশ্বাস কর, সেদিন তোকে আকার ফ্ল্যাটে দেখে প্রথমে চিনতেই পারি নি। পড়ে যখন চিনলাম, অবাক হয়ে গেলাম। আমার রাজপুত্রের মত সুন্দর ছেলেটা, যে কি-না আদরে-আহ্লাদে বড় হয়েছে, সে আজ অন্যের বাড়িতে থাকছে, নিজের খরচ চালানোর জন্য টিউশনি করছে—এই দৃশ্যটা আমি মানতে পারি নি। আমার ভেতরে অনুতাপের সৃষ্টি হলো। আমি অনুতপ্ত হয়ে তোর মামার বাড়িতে গেলাম। সেখানেই শুনলাম, রেবুর পাগল হওয়ার খবর। বিশ্বাস কর, আমি এসবের কিছুই জানতাম না। আমি ভেবেছিলাম, রেবু আবার বিয়ে করে সংসার করছে। তাই, তাই–”
— “সবাইকে নিজের মত স্বার্থপর ভাবা বন্ধ করুন! সবাই আপনার মত নয়!”
রুদ্র প্রতাপের উত্তরটা শুনে মলিন হাসলেন কায়সার,
— “তুই ঠিকই বলেছিস। সবাই আমার মতো নয়। কিন্তু কি করবি বল তো? আমি যে তোর বাপ! তুই কি আমাকে অস্বীকার করতে পারিস?”
— “না, সেটা পারি না। কিন্তু তাই বলে স্বীকারও করি না। আপনি আমার কেউ নন। আপনি আমার কাছে স্রেফ অপরিচিত মানুষ, চলার পথে যাদের সঙ্গে হুটহাট দেখা হয়ে যায়। একমুহূর্তের জন্য মুখচেনা হয় সবার পরক্ষণেই ভুলে যাওয়া যায়।”
— “তুই এরকম করিস না, কাহন। ফিরে চল আমার সাথে! প্লিজ ফিরে চল!”
ছেলের হাত ধরে কেঁদে ফেললেন কায়সার মাহমুদ। অতবড় একজন মানুষ, যার একটা সাইনে লাখ-লাখ টাকার চালান হয়, ঘুষ যার চাইতে হয় না, নিজে নিজে এসে টেবিল ভরে থাকে, সেই প্রবল-প্রতাপশালী, ‘টাকার পিশাচ’ নামে খ্যাত কায়সার মাহমুদ আজ একটা দীন-হীন ছেলের হাত ধরে কাঁদছে, দৃশ্যটা কি মেনে নেয়া যায়? কাহন পাথর হয়ে বসে রইলো। একটু পর কায়সার মাহমুদ ধাতস্থ হলে বললো,
— “আপনার সংসার আছে। সন্তানাদি আছে। তাদের মাঝে আমার কোনো স্থান নেই। আমি নিজের মত আছি। আমাকে তাই থাকতে দিন। বারবার পুরোনো ঘা খুঁচিয়ে রক্তাত্ত করবেন না আর। আই রিকোয়েস্ট!”
কাহন উঠে দাড়ালো। উদ্যত হলো ফিরে যাবার। কায়সার মাহমুদ পিছু ডাকলেন,
— “কাহন! আমার কথাটা তো শোন, কাহন?”
কিন্তু লাভ হলো না। কাহন চলে গেল তাকে ফেলে। নিজের বাপকে উপেক্ষা করে। ভাঙা একটা সম্পর্ক ভেঙে গেল পুনর্বার। এর পেছনে দায়ী কে? কাহন, না কায়সার? না পাগলিনী রেবেকা? নাকি কারোরই কোনো দোষ নেই। পরিস্থিতিই দায়ী?
___
উদাস বিকেল। ড্রয়িং রুমে টিভির সামনে বসে কার্টুন দেখছিল হিয়া। পাশে এসে বসলেন মৌসুমি। হিয়া উচ্ছসিত হলো নাপ্রস্তাব করলো,
— “কার্টুন দেখবে মা? আসো টম অ্যান্ড জেরি দেখি!”
— “দূর! আমার কি ওসবের বয়স আছে নাকি?”
হাসলেন মৌসুমিও। হিয়া মুখ লটকালো,
— “কেন থাকবে না? কার্টুন দেখার আসলে কোনো বয়স নেই। যে যেকোনো বয়সেই দেখতে পারে। এটা তো মনের ব্যাপার। বুঝেছ?”
— “আচ্ছা। বুঝলাম।”
মাথা হেলিয়ে টিভি স্ক্রীনে দৃষ্টি মেললো হিয়া। ছোট বেলা থেকেই ‘টম অ্যান্ড জেরি’ তার পছন্দ। এই কার্টুনের একটা এপিসোডও তার মিস হয় না কখনো!
— “একটা কথা বলি, মা?”
ইতস্তত করলেন মৌসুমি। হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
— “একটা কেন একশোটা বলো। কিন্তু তারজন্যে পারমিশন নিচ্ছো কেন?”
— “না, এমনই। আচ্ছা, তুই টিভি দেখ। আমি পড়ে বলবো।”
উঠে যেতে প্রবৃত্ত হলেন। কিন্তু হাত ধরে আটকে দিলো হিয়া। সন্দিহান হয়ে বললো,
— “এখন বলতে চেয়ে পড়ে।
উদ্বিগ্ন হলো হিয়া। কি এমন কথা থাকতে পারে যার জন্য মার এমন ইতস্ততা? এমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব? বললো,
— “এখন বলো।”
— “বললাম তো পড়ে!”
— “যদি এখন না বলো,তাহলে সে প্রসঙ্গ তুললে কেন তুমি?”
ভারী রাগ করলো হিয়া। মৌসুমি পড়লেন বিপাকে,
— “কথাটা যে কী করে বলি— আসলে—”
— “মা বলবে তুমি?”
— “তোমার জন্য তোমার বাবা পাত্র ঠিক করেছেন, মা। তোমার বিয়ের জন্য!”
মায়ের কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো হিয়া। বললো,
— “মানে?”
— “তোমার বিয়ে!”
— “আমার বিয়ে? কার সাথে?”
অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো। মৌসুমি মাথা নাড়লেন,
— “হুঁ। ফুয়াদের সঙ্গে। তোমার খালাতো ভাই। তোমার এইচ এসসির আগেই ওরা প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি তখন রাজি হই নি, এখনও খুব রাজি নই। কিন্তু তোমার বাবা চাইছেন, বিয়েটা হয়ে যাক!”
হিয়া অনেক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না। থমকে গেল ওর দুনিয়া, ওর ভাবনাচিন্তা। সাজানো স্বপ্নগুলো তছনছ হয়ে যেতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
— “এ হয় না মা! এ কিছুতেই হতে পারে না।”
— “কেন? ফুয়াদকে তোর পছন্দ নয়?”
— “ফুয়াদ আমার ভাইয়া হয় মা! সে আমার খালাতো ভাই।”
— “কিন্তু নিজের নয়!”
যুক্তি দেখালেন মৌসুমি। মেয়ের হাবভাব তার ভালো লাগছে না। কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে হিয়া, চোখের দৃষ্টি ঘোলা, কণ্ঠও কেমন যেন। একটু আগেও ঠিক ছিল। এখন হঠাৎ কি হলো? উদ্বেগের সহিত বললেন,
— “তোর কি হয়েছে বল তো?”
হিয়া তাকালো, সেই ঘোলা চোখেই। বিড়বিড় করে বললো,
— “আমি ফুয়াদ ভাইকে বিয়ে করবো না। কিছুতেই না। আমি– আমি–”
— “তুই কি? কথা শেষ কর? এরকম করছিস কেন? তোর শরীর খারাপ করছে? আমাকে বল? এ্যাই, হিয়া?”
কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন মৌসুমি। চেহারায় চিন্তার ছাপ। একমাত্র মেয়ে তার! সে এরকম করছে কেন? হঠাৎ হিয়া বলে উঠলো,
— “আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি!”
— “কীহ্!”
আঁতকে উঠলেন তিনি।
— “হ্যাঁ, মা। আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। কিছুতেই না!”
কাঁদো-কাঁদো গলায় বললো হিয়া। মৌসুমি কি বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়ের কথা তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। থমকে আসা গলায় উচ্চারণ করলেন,
— “ছেলেটা কে?”
— ” কাহন। কাহন মাহমুদ। এখনো চাকরি করে না, খুঁজছে। ইংরেজিতে মাস্টার্স শেষ করেছে। রেজাল্ট ভালো। সম্পর্কে কান্তার ফুপাতো ভাই হয়।”
— “সে তোকে ভালোবাসে? বিয়ে করতে চেয়েছে?”
— “না!”
— “তবে?”
— “তবে আমি তাকে ভালোবাসি। পাগলের মতো ভালোবাসি। তাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। একদিনও বাঁচতে পারব না। আমি তাকে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে শোনে নি। আমাকে সে একটুও পাত্তা দেয় না। কিন্তু আমি তার অবহেলা নিতে পারি না। আমার অসহ্য লাগে সবকিছু। ইচ্ছে করে, মরে যাই! মা, তুমি বাবাকে বলে দিও আমি ফুয়াদ ভাইকে বিয়ে করবো না। আমি কাহনকে চাই! প্লিজ, মা!”
মায়ের কোলে আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো হিয়া। এলোমেলো অনেক কথা বললো। কোনোটা বোঝা গেল, কোনোটা না। শুধু একটা কথাই স্পষ্ট হলো, ‘ কাহনকে চাই!’ পাগলের মতো এই প্রলাপ বকে গেল একনাগাড়ে!
হতবাক, হতবিহ্বল মৌসুমি ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকালেন মেয়ের দিকে। কিচ্ছুটি বলতে পারলেন না। না কোনো রাগ, না কোনো করুণা কিছুই প্রকাশ করলেন না। নির্বাক হয়ে বসে রইলেন কেবল!
___
অন্ধকার পথ। ল্যাম্প পোস্টের বাতি জ্বলছে না। বোধ হয় লোড শেডিং হয়েছে। আকাশেও চাঁদ নেই। অমাবস্যার ঘোর অমানিশা লেগেছে।পথের ধারের গাছগুলোতে বসে থাকা নিশাচরেরা ডেকে চলেছে নিজস্বরে, একটানা। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চাপলো কাহন। দেশলাই বের করে কাঠি ঠুকলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জ্বলে উঠলো সেটা। দক্ষ হাতে জ্বলন্ত কাঠিটা দিয়ে সিগারেটের ডগায় আগুন ছোঁয়ালো। লালচে অlগ্নিশিখা জ্বলে উঠতেই কাঠিটা ছুঁড়ে দিলো আঁধারে। সেটা নিজের দিশা হারিয়ে পড়ে গেল কোথাও। কাহন নিজের কাজে ব্যস্ত। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে গলা হাঁকালো,
— “আমার জন্যে আলো জ্বেলো না কেউ!
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি,
শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরবো না, না, না, না, না, না~”
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ
[আমার প্রথম ই-বই ‘বাতাসে বহিছে প্রেম’ পাওয়া যাচ্ছে বইটই অ্যাপে। পড়তে চাইলে ঝটপট কিনে ফেলুন মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে! লিংক কমেন্টে… ❤️]