একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_১৪

0
795

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_১৪

হিয়ার বিয়ে। বাড়িতে হৈ-চৈ। মনজুর আলম ছুটছেন কাজ নিয়ে, মৌসুমি আছেন মহিলা মহলকে নিয়ে। মেয়ের বিয়ে খুব ধুমধাম করেই দিচ্ছেন তারা।

বাড়ি ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। সকাল সকাল শুরু হয়েছে হলুদ খেলার ধুম! মেয়ের বিয়ে নিয়ে কোনোকিছুর কমতি না রাখলেও অন্যান্য বড়লোক বাড়ির মতো মেহেন্দি, সঙ্গীত, গায়ে হলুদ এগুলোর আয়োজন করেন নি মনজুর আলম। তিনি এসব পছন্দ করেন না। তাই বিয়ের দিন সকালেই কনের হলুদ গোসল সম্পন্ন করবেন মেয়েমহল। যেখানে আর কোনো পুরুষের যাবার নিয়ম নেই।

হিয়াকে হলুদ গোসল করিয়ে, সুতি একটা শাড়ি পরিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন মৌসুমি। মেয়েকে কষ্ট করে পার্লারে যেতে হবে না। পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান এসে সাজিয়ে দেবে। মূলত এই কথাটা মনজুর আলম নিজে বলেছেন। কারণ, মেয়েকে তিনি চেনেন। তার জেদ সম্পর্কেও যথেষ্ট অবগত। এখন যদিও বা বিয়ে করতে সম্মতি দিয়েছে কিন্তু কখন ঝোঁক বদলে যাবে কে জানে! তাই সাবধানে সব করছেন। এতো ব্যস্ততার মাঝেও ঠিকই কিছুক্ষণ পর পর এসে মৌসুমি দেখে যাচ্ছেন মেয়েকে। বাবা-মায়ের এই লুকোচুরি করে তাকে দেখে রাখার ছল দেখে হিয়া মনে মনে হাসে। তাচ্ছিল্যের হাসি। তখনই ফোনটা বেজে উঠে ওর। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে অর্পির নামটা। রিসিভ করে,

— “হিয়াপি!”
— “হ্যাঁ, বল।”
— “কেমন আছিস?”
— “ভালো। তুই?”

সেই কথার জবাব দেয় না অর্পি। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে,

— “সত্যিই ভালো তো?”

কণ্ঠে কি যেন ছিল! হিয়ার মন খারাপ হতে চায়। তবুও নিজেকে সামলায় সে। উত্তর দেয়,

— “হ্যাঁ।”
— “বিয়েতে তোর আপত্তি নেই?”
— “না।”
— “সত্যি বলছিস তো? দেখ, এখনো তোর মনের কথা বল আমাকে। কেউ তোর পাশে না থাকলেও আমি আছি। তুই নারাজ হলে জোর করে তোকে আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেব না আমি!”
— “তুই কি করবি? বিয়ে ভাঙবি?”

হাসে হিয়া। অর্পি ফুঁসে উঠে ফোনের ওপাশ থেকে,

— “দরকার হলে তাই! আর না পারলে তোকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেব। তবুও তোকে কষ্ট পেতে দেব না, বোন!”

বুকটা ভার হয়ে আসে। কেউ যখন ওর মনের খোঁজ নিচ্ছে না, জোর করছে বিয়ের জন্য, তখন একমাত্র অর্পিই ওর পাশে দাড়িয়েছে। বারবার নিষেধ করেছে বিয়ের জন্য! এভাবে হয় না। এভাবে তিন তিনটে জীবন নষ্ট করা যায় না!

আলতো হেসে জানায়,

— “আমি কষ্ট পাচ্ছি না, অর্পি। আমি ঠিক নিজের সুখ খুঁজে নেব!”

অর্পির বিশ্বাস হয় না কথাটা। তবুও কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ কল কেটে দেয়!
____

নিজের ছোট্ট ঘরটায় চৌকির উপর বসে আছে কাহন। একটু আগেই কাঁচাবাজার থেকে ঘুরে এসেছে সে। মামীর ফরমাস অনুযায়ী কিনেছে আনাজ-সওদা। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও তার বাজার পছন্দ হয় নি মামী। রান্নাঘরে বসে তিনি একা একা বকবক করে চলেছেন। গাল দিচ্ছেন কাহনকে। সে উদাসীন, জিনিসপত্রের ঠিক-ঠাক দাম দিয়ে বাজার করতে জানে না, অপ্রয়োজনীয় সবজি কিনে আনে— ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘরে নিশ্চুপ বসে সেগুলো শুনছে কাহন। কিন্তু মন সেখানে নেই! মন অন্য কোথাও, অন্য কোনো রাজ্যে!

এমন সময় গুটিগুটি পায়ে ঘরের দরজায় এসে দাড়ালো কেউ। মুখ তুলে তাকালো কাহন। কান্তা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। হাতে একটা হলুদ খাম। বললো,

— “পোস্ট অফিস থেকে লোক এসেছিল, ভাইয়া! তোর চিঠি।”
— “আন্।”

হাত বাড়িয়ে দিলো কাহন। কান্তা এগিয়ে এসে খামটা ধরিয়ে দিলো। চোরা চোখে তাকালো আশপাশে। রাহেলা খানম রান্নাঘরে বসে আছেন। বেরিয়ে এসে যদি কান্তাকে এ-ঘরে দেখে তো ভারী রাগ করবেন!

অনাসক্ত চোখে খামটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলো কাহন। খুলবার আগ্রহ নেই তেমন। তারপরও কান্তা আগ্রহ নিয়ে ছেয়ে আছে বলে খুলবার সিদ্ধান্ত নিলো। আঠা লাগানো মুখটা ছিঁড়তেই বেরিয়ে এলো একটা ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটা কীসের সেটা দেখতেই গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ!

কাহন অবাক হয়ে চেয়ে আছে কাগজটার দিকে। মুখে রা’ নেই! কান্তার খটকা লাগলো। এগিয়ে এসে কাগজটায় উঁকি দিতেই তারও সেই একই দশা! চোখ কপালে উঠে গেছে যেন! অনেক্ষণ পর কান্তা মুখ খুললো,

— “তোর চাকরি হয়ে গেছে! তাও আবার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে! আল্লাহ্!”

মুহূর্তেই মধ্যে হৈচৈ শুরু হলো করে দিলো কান্তা। চেঁচিয়ে পুরো বাড়িতে জাহির করে দিলো, ‘তার ভাইয়ের চাকরী হয়েছে! চাকরী হয়েছে!’ পবন-পরাগ লাফাতে শুরু করলো খুশিতে। স্বয়ং রাহেলা খানম অবধি চমৎকৃত হলেন। কিন্তু ভাবলেশহীন কাহন। বিড়বিড় করে আওড়ালো,

— “সেই তো চাকরি হলিই, আগে কেন হলি না?”
___

কনে সাজানো শেষ। বিউটিশিয়ান দু’জন সাজানো পুতুল হিয়াকেদেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। উচ্ছসিত হয়ে বললো,

— “আপনাকে যা লাগছে, ম্যাম! আজ যেই আপনাকে দেখবে সেই অবাক হয়ে যাবে। কথাই বলতে পারবে না!”

হিয়া মাথা নাড়িয়ে মিষ্টি করে হাসলো সেই মন্তব্য শুনে। মনে মনে বললো, ‘ হ্যাঁ, আমি তো তাই চাই! আজ যেন আমাকে দেখে সবাই ভাষা হারিয়ে ফেলে!’ কিন্তু মুখে কিছু বললো না। শুধু উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নায় নিজেকে দেখলো। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। বাহ্, কি চমৎকার পুতুল বৌ! যে বৌ সাজবার স্বপ্ন হিয়ার আজীবনের। তবে ফুয়াদের জন্য নয়, তার ভালোবাসা ‘কাহন’ এর জন্য! নামটা ভাবতেই আনমনা হয়ে গেল হিয়া। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো!

বিউটিশিয়ান দু’ জন ওকে বিছানায় বসিয়ে, শাড়ির কুচি গুছিয়ে, মাথায় ঘোমটা পরিয়ে দিয়ে চলে গেল। হিয়া একপলক তার ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নিলো। তার ঘর, তার প্রিয় আসবাব! রিদিন টেবিলের উপর একটা ফটোফ্রেম। সুখী পরিবারের হাস্যোজ্বল ছবি। কি সুন্দর সবটা! আহা!

চোখে জল এলো ওর। সেটা এক হাতে মুছে নিলো দ্রুতই। কাঁদলে যে সাজ নষ্ট হয়ে যাবে! তার সাজ তো নষ্ট হওয়া যাবে না কিছুতেই! সবার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে হবে না, তাকে দেখে? এভাবে কি সেই সুযোগ নষ্ট করা চলে?

মুখ ঘুরিয়ে নিজের ছোট্ট শয্যা খানার দিকে তাকালো। সুন্দর রাজকীয় বিছানা, নরম দুটি বালিশ পাশাপাশি রাখা। তারই একটা বালিশের নীচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে আনলো একটা শিশি। ছোট্ট কাচের বোতল, রংটা খয়েরী। দেখলে হোমিওপ্যাথিক ঔষুধের বোতল বলে মনে হয়। হিয়া ভাবলো। হ্যাঁ, ঔষধই তো। মরণ ঘুমের ঔষুধ! যেটা একবার খেয়ে ফেললে সব জ্বালা মিটে যায় মানুষের! ভেবেই হাসলো একটু। তারপর শিশিটা ঠোঁটের সঙ্গে লাগিয়ে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা গিলে ফেললো!
___

মুজাহিদ সাহেব মিষ্টি কিনে এনেছেন। সবাই মিষ্টি মুখ করছে। কান্তা ছুটছে এ-বাড়ি ও-বাড়ি মিষ্টি বিলোতে। রাহেলা খানমও হাসি হাসি মুখ করে আছেন। বেকার ভাগ্নের একটা কর্ম সংস্থান হয়েছে। তাও যে-সে নয়। শহরের নামী-দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক হিসাবে!

কিন্তু যাকে নিয়ে এতো খুশি, সেই কাহনই এখন চুপচাপ। কেউ সেটা লক্ষ্য না করলেও চোখ এড়ায় নি কান্তার। সে অনেক্ষণ থেকেই দেখছে কাহন কেমন উদাস হয়ে বসে আছে! কারণটা আন্দাজ করতেও তার কষ্ট হয় নি। হিয়ার আজ বিয়ে। দুপুরেই বরযাত্রী আসবার কথা। বিকেলে বিয়ে পরানো হবে। খুব কাছের বন্ধু হলেও কান্তা দাওয়াত পায় নি। কি জানি কি ভেবে, মনজুর আলম তার মেয়ের বিয়েতে বান্ধবীদের ডাকেন নি! হিয়াও বলে নি কিছুই। কান্তা যা শুনেছে, সবই লোকমুখে!

বড় ভাইয়ার কাছে এসে দাড়ালো কান্তা। আশে-পাশে এখন কেউ নেই। রাহেলা খানম পাশের বাড়িতে গেছেন মিষ্টি নিয়ে। পবন-পরাগ খেলছে। কাহন একা-একা বসে আছে বারান্দায়।

— “মন খারাপ?”

বোনের চোখের দিকে তাকালো কাহন। মাথা নাড়লো,

— “নাহ্।”
— “তাহলে?”
— “কিছু না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কান্তা। ফুপাতো ভাইটির সাথে তার কোনদিন ভালো করে কথা হয় না। সেই সুযোগটাই হয় নি কখনো! তাই তো আজ কথা বলতে এতো সংকোচ, এতো দ্বিধা!

— “একটা কথা বলি? তুই শুধু আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিবি?”
— “বল।”
— “হিয়া তোকে ভালোবাসে। কিন্তু তুই কি ওকে ভালোবাসিস না?”

কাহন অবাক হলো না। হিয়া কান্তার বান্ধবী। ওর সব কথা তো কান্তারই জানবার কথা! অস্বীকার করলো,

— “না। বাসি না!”

— “কিন্তু তোর মুখ তো অন্য কথা বলে! সেই সকাল থেকেই দেখছি, তুই কেমন মন খারাপ করে বসে আছিস। চাকরী পাওয়ার মতো একটা ভালো খবরও তোর মন ভালো করতে পারে নি!”

কান্তা আরও কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই স্বগোক্তি করলো কাহন,

— “সবই যখন বুঝিস তখন এটাও নিশ্চয় বুঝিস, হিয়াকে আমি কেন মানতে পারি না?”

— “বুঝি। কিন্তু ভাইয়া, এখন তো সেই সমস্যাটা নেই। এতদিন তোর চাকরী ছিল না, ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত। কিন্তু এখন সেটা নেই! তোর চাকরী হয়েছে। তুই তো চাইলেই—”

— “মেয়েটার আজ বিয়ে, কান্তা! জীবনটা কোনো নাটক নয়, যে শেষ মুহূর্তে গিয়ে নায়ক নায়িকাকে পেয়ে যাবে!”

— “জীবন নাটক নয়, কিন্তু নাটকের চেয়েও নাটকীয়!”

— “তবুও— এ হয় না। বাড়িতে বিয়ের আয়োজন। পাত্র-পাত্রী সব ঠিক। সেখানে আমি উটকো ঝামেলা হয়ে গিয়ে— তাছাড়া হিয়া নিজেই তো বিয়েতে রাজী হয়েছে। এখন আমি ওর কাছে গেলে সে আমাকে গ্রহণ করবে কেন?”

কাহন যুক্তি দেখায়। কান্তাও ছেড়ে দেয় না,

— “কেন গ্রহণ করবে না? ও বেচারী তোর জন্য কি-না-কি করেছে। কতো পাগলামি করেছে। তোর পিছে পিছে ঘুরেছে। শেষ অবধি তুই যখন ওকে পাত্তা দিলি না, তখন নিরাশ হয়ে মেয়েটা বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। কিন্তু একবার ভাব তো, যাকে মন দেয়া হয়েছে সে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ওই মেয়েটা সুখী হবে কেন? হিয়া তোকে অসম্ভব ভালোবাসে, ভাই!”

— “আমি জানি। আমি খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু পরিস্থিতি আমার হাতে নেই! এই নিয়োগপত্রটা যদি গতকালও আমার হাতে এসে পৌঁছত তাহলেও হতো। আমি হিয়ার বাবার কাছে যেতাম। তার একমাত্র মেয়েকে ভিক্ষে চাইতাম! কিন্তু আজ, যখন মণ্ডপে বর-বৌ বসেছে কাজীর অপেক্ষায়—”

কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে ওর। কথা বলতে পারে না কিছুতেই। ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে কান্তা। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে সে, তার এই ভাইটি কোনদিন সুখ পায় নি। চোদ্দ বছর বয়সে বাপ-মায়ের ছাড়াছাড়ি; বাবাকে ছেড়ে মার সঙ্গে বসবাস; সেই মাও পাগল হলেন দু’ বছরের মধ্যেই; মামার আনি-টুনি সংসারের বোঝা হয়ে বাঁচতে হলো; পদে পদে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা; লেখাপড়া করে চাকরী নামক সোনার হরিণের পিছনে ছোটা; কারো ভালোবাসা না পাওয়া জীবনে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির মত এক অষ্টাদশী বালিকার আগমন; একটুখানি প্রেমের জন্য মেয়েটির আকুলতা; তবুও নিজের অপারগতার কারণে মেয়েটিকে ভালোবেসেও গ্রহণ করতে না পারা— কোনোদিন সুখ পেল না!

আল্লাহ্ সব মানুষের ভাগ্য একরকম করে বানান না। কেউ কেউ জীবনে শুরু থেকেই আনন্দ-আহ্লাদ করে বাঁচে; কেউ সারাজীবন কষ্ট পেয়ে শেষ পরিণতিতে সুখের দেখা পায়; কেউ বা দুঃখের সাগরে হাবু-ডুবু খেতে খেতেই অন্তিমে পৌঁছায়!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর কাহন নিজেই জানালো,

— “এখন ওখানে গিয়েও কোনো লাভ নেই জানিস? হিয়ার বাবা আমাকে মানবেন না কখনো। তিনি আমার পরিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড জানেন। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কারণে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই, মা পাগল ছিলেন— এরকম ছেলের কথা জেনে কোন বাবা তার আদরের মেয়েকে বিয়ে দিবে বল তো? বিয়েতে যেন আমরা কোনো ঝামেলা না করতে পারি সেজন্য দেখ, উনি তোকে অবধি ডাকেন নি বিয়েতে!”

— “আমাদের কোনো বান্ধবীই যায় নি বিয়েতে। দাওয়াত পায় নি।”

— “তাহলেই বোঝ। উনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন তার মেয়েকে সু-পাত্রের কাছে পাত্রস্থ করতে। আমি সেখানে—”

— “আমি তোর যুক্তি বুঝতে পারছি। কিন্তু তুই আমার কথাটা একবার শোন? হিয়াকে আমি চিনি। ও কোনোদিন এই বিয়েতে সুখী হতে পারবে না। ও মরে যাবে ভাইয়া! প্লিজ, ওকে তুই মরতে দিস না!”

হাহাকার করে উঠলো কান্তা। বলে চললো,

— “আজ যদি ওই মেয়েটা নিজের কোনো ক্ষতি বসে, তুই পারবি, পারবি নিজেকে ক্ষমা করতে? বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পাবি কোনদিন?”

আঁতকে উঠলো কাহন। প্রমাদ গুনলো,

— “হিয়া এমন কিছু করবে না!”

— “করবে না? কে বলেছে করবে না? তুই চিনিস ওকে? ও কতো জেদি, একরোখা, বেপরোয়া—”

ক্ষেপে উঠলো। অপরাধবোধে মাথা নুইয়ে ফেললো কাহন। কি করবে সে? তার যে কিছুই করবার নেই! কান্তার হঠাৎ মায়া হলো খুব। জীবন এতো নিষ্ঠুর কেন? ওই ভঙ্গুর মানসিকতার ছেলেটির দিকে চেয়ে প্রবল অনুরোধ করলো,

— “যা না ভাইয়া। একবার যা? শেষ চেষ্টাটা তো করে দেখ?”

বোনের মুখের দিকে তাকালো কাহন। কান্তা ছলছলে নয়নে চেয়ে আছে। সে নয়নে শুধু একটিই আকুতি, ‘ তুই হিয়াকে নিয়ে আয় ভাই! ওকে শেষ হয়ে যেতে দিস না! তুই যা। তুই গেলে হিয়া ঠিক আসবে। তুই পারবি!’

উঠে দাড়ালো কাহন। কান্তার আত্মবিশ্বাস তাকে এসে ছুঁয়ে দিলো। বুকের ভেতর জেগে উঠলো শেষ আশা! হ্যাঁ, এখনো সময় আছে! এখনো তো যাওয়া যায় হিয়ার কাছে!
___

বাড়িতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। বরযাত্রী এসে গেছে এরমধ্যেই। কিন্তু তাদের বরণের কোনো আয়োজন নেই। লোকজন ফিসফাস শুরু করেছে। কনে নাকি বিষ খেয়েছে! মুখ দিয়ে ফ্যানা বেরোচ্ছে! বসছে কিনা ঠিক নেই! মনজুর আলমের দিশেহারা অবস্থা। মেয়েকে নিয়ে তিনি ছুটলেন হাসপাতালে। সঙ্গে ছুটলো হবু বর ফুয়াদ, আর তার বাবা। বিয়ের আসর ঘেঁটে গেল মুহূর্তেই। মহিলা মহল মৌসুমীর সেবায় নিয়োজিত। মেয়ের অবস্থা দেখে তার যাই-যাই দশা! ঘন ঘন জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। অবস্থা বেগতিক দেখে অবিলম্বে তাকেও নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে!
___

দৌড়াতে দৌড়াতে হিয়াদের বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো কাহন। কখনো আসা হয় নি, তবুও সে জানে এই বাড়িটিতেই তার প্রেয়সী থাকে। তার হিয়া, তার ভালোবাসা! যার বিয়ে উপলক্ষ্যে সাজানো এই বাড়িটি!

কিন্তু ভেতরে ঢুকে কাঙ্খিত পরিবেশ দেখতে পায় না কাহন। সব কেমন ছন্নছাড়া, এলোমেলো। লোকজন আছে তবে কেউ হৈচৈ করছে না। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত ভাব! কাহন এগিয়ে এলো একটু। একজন বৃদ্ধা এদিকে আসছিলেন, ওকে দেখে বললেন,

— “আপনে? আপনে কেডায়?”
— “আমি— আমি— আচ্ছা, হিয়া কোথায়? বিয়ের অনুষ্ঠান—”

কাহনকে অপ্রস্তুত লাগলো। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে ছেলেটা। এতোটা পথ ছুটতে ছুটতে এসেছে! কপাল দিয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে। মহিলাটি মুখ বেঁকিয়ে বললেন,

— “বিয়ার আসর তো ভাইঙা গেছে! কি অবস্থা দেখেন! বিয়ের দিনে এমুন একডা কান্ড!”

ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি লম্বা বক্তৃতা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু কাহনের হাতে সময় নেই। উত্তেজনায়-দুশ্চিন্তায় ছেলেটা ছটফট করছে। তারমধ্যে মহিলার হেয়ালি কথা। কিছু বুঝে আসছে না ওর। কোনোমতে বললো,

— “কি হয়েছে সেটা একটু বলবেন? আমার হিয়ার সাথে দেখা করা দরকার—”

মহিলাটি এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সন্দিগ্ন কণ্ঠে বললেন,

— “ওর লগে দেখা করবেন ক্যান? আপনি কেডারে?”

কাহন মরিয়া হয়ে উঠলো,

— “আমি যেই হই। আপনি বলুন না, সে কোথায়?”
— “ছেরি বিষ খাইছে! সক্কলে তারে নিয়া হাসপাতালে গেছে!”

কাহনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো! হিয়া বিষ খেয়েছে? তার উপর অভিমান করে? আর কিছু ভাবার সময় হলো না তার। মহিলাটি কিন্তু তখনো থেমে নেই। তার কথার ফুলঝুড়ি ছুটেছে। নিজের সারাজীবনের অভিজ্ঞতার গল্প টেনে এনে তিনি বলে চলেছেন,

— “বুঝি না বাপু! কি এমুন হইলো যে ছেরি তুই বিষ খাইলি? মাও-বাপের মনে কষ্ট দিলি? কারো লগে চক্কর থাকলে কইতি। বাপ-মায় কি তোর খারাপ চায়—”

এতো কথা, এতো আওয়াজ কিছুই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। মস্তিষ্কে তখন সেই এক চিন্তা। হিয়া কি করে এমনটা করলো? কেন করলো? কেন সে কারো কথা ভাবলো না? মহিলার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো না, কাহন বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে!

হাসপাতাল এখান থেকে দশ মিনিটের পথ। হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আজ যেন সবকিছু বিদ্রোহ করেছে কাহনের বিরুদ্ধে। রাস্তায় একটাও অটো বা রিকশা নেই! সেগুলোর জন্য অপেক্ষা করবার সময় কিংবা মানসিকতাও নেই কাহনের। সে ছুটতে শুরু করলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে! তার প্রেয়সীর কাছে!

আজ যেন পথ শেষ হতেই চাচ্ছে না। কাহন প্রাণপনে ছুটছে। তাকে যে পৌঁছতেই হবে। অবুঝ ওই কিশোরীটি যদি আজ অভিমান করে তাকে ছেড়ে চলে যায়, তবে সেও যে বাঁচতে পারবে না! মেয়েটার সুখের জন্য সে তাকে ত্যাগ করতে পারতো; কিন্তু তাই বলে সে জীবন দিয়ে দিলে ও নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে কি করে? বেঁচে থেকেও লাlশ হয়ে থাকতে হবে! কাহন কি সেটা হতে দিতে পারে?

তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, হিয়ার কাছে পৌঁছতে হবে। শেষ মুহূর্তে হলেও ওই মেয়েটাকে তার মনের কথা জানাতে হবে। বলতে হবে, কাহন নামের এই ছন্নছাড়া ছেলেটিও হিয়াকে ভালোবাসতো। তার একটুখানির প্রেমের জন্য কাতর ছিল!

________[সমাপ্ত]__________
#মৌরিন_আহমেদ

(শেষটা পাঠকের উপর ছেড়ে দেয়া হলো। নিজেদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে আপনারা বাকিটুকু ভেবে নিন! ভালোবাসা ❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here