একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_০২

0
695

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০২

ছুটির পর ব্যাগ কাঁধে বেরিয়েছে হিয়া। একটা আইসক্রিম কিনে, সেটাই খেতে খেতে হেলেদুলে বাড়ি ফিরছিলো। পথেই কাহনকে দেখে এগিয়ে এলো সে। উৎফুল্ল সুরে বললো,

— “আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”

মোড়ের দোকানে দাড়িয়ে সিগারেট টানছিল কাহন। উল্টো দিকে ঘুরে। অপরিচিত মেয়েলি কণ্ঠের ডাক শুনে ফিরে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হলো তার। একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে হাসিমুখে দাড়িয়ে!

মেয়েটাকে চেনে না কাহন। বোধ হয় কোনদিন দেখেও নি। কিন্তু এই মেয়ে তার কাছে কি চায়?

কাহনকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অস্বস্তি হলো হিয়ার। সালাম দিলে যে তার উত্তর দিতে হয় এটা কি জানে না সে? নাকি ইচ্ছে করেই হিয়াকে উপেক্ষা করে?

হিয়ার মন খারাপ হলো বেজায়। ইচ্ছে করলো উল্টো ঘুরে গট-গট করে হেঁটে চলে যেতে। কিন্তু সেটা খারাপ দেখায়। হতে পারে কাহন অন্য খেয়ালে মত্ত!

হিয়া মিষ্টি করে হাসলো,

— “কেমন আছেন?”
— “ভালো। তুমি?”
— “আমিও ভালো আছি।”

ঠোঁটের হাসিটা প্রসারিত হলো বেশ। একটু ভালোলাগলো। কাহন তবে তাকে উপেক্ষা করে নি। জানতে চেয়েছে সে কেমন আছে! কিন্তু ভুলটা ভাঙিয়ে দিলো কাহন নিজেই। তড়িঘড়ি করে বললো,

— “না, না, তুমি কেমন আছো সেটা জানতে চাই নি। আমি বলেছি তুমি কে?”
— “মানে?”

বিস্মিত হয়ে তাকালো। কাহন ইতস্তত করে বললো,
— “মানে তুমি কে?”
— “আপনি আমাকে চেনেন না?”
— “না– আসলে— কখনো দেখি নি।”

খুব কষ্ট পেল হিয়া। কাহন তাকে চিনতে পারছে না? ইতোমধ্যেই তার সঙ্গে ওর চার-পাঁচবার দেখা হয়েছে। ওদের বাড়িতেও তো গিয়েছে হিয়া। তবুও কখনো দেখে নি, বললো কেন?

লঘু স্বরে নিজের পরিচয় জানালো,

— “আমি হিয়া। কান্তার বান্ধবী।”
— “ওহ্।”

ব্যস! আর কোনো কথা বললো না কাহন। অন্য দিকে ঘুরে সিগারেটে সুখটান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভাবটা এমন যেন হিয়া নামের কারো উপস্থিতি সম্পর্কে সে অবগত নয়। সম্পূর্ণ অপরিচিত!

মন খারাপের মেঘে ঢাকা আকাশ নিয়ে হিয়া ফিরে চললো। সে ভাবতো কাহন তাকে চেনে, তাকে খেয়াল করে। অথচ এই ছেলেটা নাকি তাকে কখনো দেখেই নি!

ভীষণ রকমের খারাপ লাগলো তার। বিষণ্ণ চোখে-মুখে সে প্রস্থান করলো। বোকা মেয়েটা ভাবলোও না, জীবন ধারণ করাই যে ছেলের জন্য কষ্টসাধ্য, তার জন্য রূপবতী একটি মেয়েকে খেয়াল করে মনে রাখা বিলাসিতা বৈ কিছু নয়!
___

কলেজ থেকে ফিরে কান্তা দেখলো পবন কান ধরে দাড়িয়ে আছে উঠানে। এক পা উঁচু করে। চেয়ে আছে সূর্যের দিকে। প্রখর রোদের চোটে দরদর করে ঘাম ছুটছে বেচারার। কষ্ট হচ্ছে খুব, কিন্তু নড়ছে না একপাও!

বারান্দা পেরিয়ে উঠানে নামলো কান্তা। উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো,

— “ভর দুপুরে কান ধরে দাড়িয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে?”
— “মা শাস্তি দিয়েছে!”

আশেপাশে তাকিয়ে সন্ত্রস্ত চোখে বললো পবন। কান্তা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে শুধালো,

— “কি করেছিলি আবার?”
— “গ্লাস ভেঙে ফেলেছি। সেই ভাঙা কাচে মার পা কেটেছে!”

কাঁদো কাঁদো গলা শোনালো ওর। ঠোঁট গোল করে একটা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো কান্তা। তার দুই ভাইয়ের মধ্যে এই পবন’টাই বেশি বিচ্ছু! আজ গ্লাস ভাঙে, কাল প্লেট ভাঙে, পরশু সাইকেল থেকে পড়ে আহত হয়ে পড়ে! এক্কেবারে দুষ্টুমির চূড়ান্তে! আবার মায়ের কাছে শাস্তি পেয়ে কান ধরে দাড়িয়ে থাকে। বোনকে দেখে আকুতি জানালো পবন,

— “মাকে একটু বল না, আপা? আমাকে যেন ছেড়ে দেয়?”
— “আচ্ছা। আমি বলবো। তুই যা ঘরে।”
— “ঠিক আছে।”

সঙ্গে সঙ্গেই কান ছেড়ে দিয়ে দৌড় লাগালো পবন। এক দৌড়ে বারান্দা টপকে সোজা ঘরে গিয়ে ঢুকলো। আবার ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এলো গলায় গামছা ঝুলিয়ে। অবাক হলো কান্তা,

— “যাচ্ছিস কোথায়?”
— “অলোকদের পুকুরে গোসল করতে!”

বলেই আর দাড়ালো না। ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করলো। কান্তা নিষেধ করতে যাচ্ছিল কিন্তু সে সুযোগটুকু মিললো না। তার আগেই পবন হাওয়া হয়ে গেছে!
___

খোলা বই সামনে রেখে বসে আছে হিয়া। কপালে হাত, বিষণ্ণ মুখ। পড়ায় মন নেই। শুধু উদাস চোখে চেয়ে দেখছে সাদার উপরে লেখা কালো কালো অক্ষরগুলোকে। বুঝছে না কিছুই। বুঝতে চাইছেও না। হঠাৎ কাঁধে কেউ হাত রাখতেই চমকে ফিরে তাকালো। তার মা মৌসুমি হাসিমুখে দাড়িয়ে। মাকে দেখেই হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে,

— “ওহ্, মা! তুমি?”
— “পড়ছিলি?”
— “ন-নাহ্। এমনই বসে ছিলাম। তুমি দাড়িয়ে কেন? বসো না?”

বলে নিজেই উঠে দাড়ালো। মাকে সাথে নিয়ে বসিয়ে দিলো বিছানায়। মৌসুমি হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

— “পড়ালেখা কেমন হচ্ছে, মা? সামনে পরীক্ষা না? প্রস্তুতি কেমন?”

নিমিষেই মুখ আমসি হয়ে গেল হিয়ার। মুখ কুঁচকে বললো,

— “তোমরা সবসময়ই পড়ালেখার কথা টেনে আনো কেন? এছাড়া আর কোনো কথা নেই?”
— “সে কি রে? পড়ালেখা ছাড়া জীবন চলে নাকি?”
— “চলে না বলছো? কতো লোকই তো চালায়। একজন দোকানদার, রিকশাওয়ালা, কেয়ারটেকার–এরা কি পড়ালেখা করেছে নাকি? ওদের জীবন চলে না?”
— “তাহলে তোকে রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেই?”

কপট রেগে বললেন মৌসুমি। হিয়া দাঁত বের করে হাসলো,

— “সত্যিই দিবে? দাও!”
— “মাlর খাবি? খুব পাকামো হয়েছে?”

হাত উঁচিয়ে মারমুখি হতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো হিয়া। মাথা নাড়িয়ে বললো,

— “আমি তো জানিই তুমি আমাকে মারতে পারবে না। আমাকে মারার পর তুমি নিজেই কেঁদে ফেলবে!”

— “হ্যাঁ। আমার তো কাজ নেই! মাlরলে শক্ত করে মাlরবো। যেন সারাজীবন মনে থেকে। বুঝবি তখন!”

প্রতিবাদ করলেন তিনি। হিয়ার ঠোঁট থেকে হাসি সরলো না। কারণ মায়ের মিথ্যেটা সে জানে। তার প্রতি মায়ের অসীম দুর্বলতার কারণটাও সে জানে। সে তাদের একমাত্র সন্তান। বড় বোন জিনিয়া নয় বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়ায় মাlরা যাবার পর থেকেই তার প্রতি মায়ের দুর্বলতা বেড়ে গেছে। আগে ছোট মেয়ে হিসেবে আদর পেত, এখন সেই আদর বেড়েছে বহুগুণে। কারণ তার আর কোনো ভাইবোন হবার সম্ভবনাও নেই। অতি আহ্লাদে মানুষ হচ্ছে সে। যখন যা চাইছে, সবই পাচ্ছে। কোনো কিছুরই কমতি নেই!
___

অন্ধকার হাতড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো কাহন। রাত খুব বেশি হয় নি, তবুও বাড়ির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নিশুতি রাত! নয়টা-দশটা বাজলেই বাড়ির এ-পাশটাকে এরকম ভুতুড়ে লাগে। বারান্দায় কোনো বাতি জ্বলে না, বাইরের রাস্তায়ও কোনো ল্যাম্পপোস্ট নেই যে কোনো আলো আসবে। ফলশ্রুতিতে ঘোর তমসায় ছেয়ে থাকে বাড়ি-ঘর।

সামনে তাকাতেই আলো চোখে পড়লো কাহনের। মামীর ঘরের সামনের বারান্দায় একটা কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। হলদেটে আলোর আভা ছড়ানো। বাড়ির ওদিকটায় কান্তা-পবনদের নিয়মিত চলাচল বলেই বাতিটা জ্বলতে থাকে সারারাত। কিন্তু মূল ফটক থেকে কাহনের ঘর অবধি কেউ যাতায়াত করে না বলেই এদিকে কোনো বাতি লাগিয়ে অযথা বিদ্যুৎ খরচ করেন নি মামা-মামী। ভেবেই শ্বাস ফেলে এগিয়ে চললো কাহন।

একটু এগোতেই হঠাৎ ‘গোঁ-গোঁ’ আওয়াজ কানে এলো ওর। শব্দটা ওই বদ্ধ ঘর থেকে আসছে। কিন্তু উনি গোঙাচ্ছেন কেন? আর কিছু ভাবতে পারলো না সে। তড়ি-ঘড়ি করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। দরজার ডান পাশে থাকা সুইচ বোর্ডের সবগুলো সুইচ চেপে দিলেও আলো জ্বললো না। সম্ভবত লাইট ফিউজ হয়ে গেছে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়ালো।

গোঙানি থেমে গেছে হঠাৎ। ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। অন্ধকারে চেয়ে কাহন দেখলো এক কোণায় মূর্তির মতো বসে আছে একজন মানবী। এলোমেলো রুক্ষ চুল ছড়ানো মুখের সামনে। নিশ্চুপ বসে আছেন তিনি! কাহন খুব মৃদু স্বরে ডাকলো,

— “মা?”

কোনো সাড়া নেই। থমথম করছে পরিবেশ। সাহস করে কাহন এগিয়ে এলো কয়েকপা। মায়ের কাঁধে হাত ছোঁয়ালো,
— “মা গো!”

চটকা ভাঙলো যেন তার। কর্কশ কণ্ঠে বললেন,

— “কে তুই?”
— “আমি তোমার ছেলে, মা। তোমার কাহন!”
— “কা-হ-ন?”
অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালেন। কাহন মাথা নাড়লো,
— “হ্যাঁ।”

হঠাৎ কি হলো কে জানে! মহিলার চোখের দ্যুতি হারিয়ে গেল। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি,

— “কাহন! বাবা আমার! তুই আমার খোঁজ নিস না কেন? কেউ আমার কাছে আসিস না কেন? আমাকে ঘরে আটকে রাখিস কেন?”

কাহনের হঠাৎ খুব কষ্ট হলো। শত হলেও এই পাগলিনী মহিলা তার মা। তার জন্মদাত্রী, জননী। তার এহেন নিষ্ঠুর পরিণতি দেখলে মায়া হবে না কেন? সে মাকে শান্ত করতে চাইছিলো কিন্তু তিনি শান্ত হচ্ছিলেন না কিছুতেই,

— “তোরা আমাকে খাবার দিস না কেন? আমার খিদে লাগে না? আমি মানুষ নই? বল– বল—”

কাঁদতে কাঁদতেই তার কি যেন হলো। ভেতরের মাতৃ সত্ত্বাটা হারিয়ে গেল কোথাও। উন্মাদ হয়ে গেলেন মুহূর্তেই! নিজের ধারালো নখর যুক্ত হাত দিয়ে ছেলের গলা চেপে ধরলেন। একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল কাহনের মেরুদণ্ড। শিরশির করে উঠলো সারা শরীর। মা তাকে মেরে ফেলতে চায়? আতঙ্কে শিউরে উঠে কোনোমতে উচ্চারণ করলো,

— “ম-মা! ক-কি করছো?”

— “মেরে ফেলবো! একদম মেlরে ফেলবো। কি ভেবেছিস কি তোরা? ঘরে বন্ধ করে রাখলেই আমার হাত থেকে পার পেয়ে যাবি? তাই আমাকে না খাইয়ে মেরে ফেলতে চাস? এত্তো সোজা—”

হাতের বাঁধন শক্ত হচ্ছে; গলায় চেপে বসছে নখ। দম আটকে আসছে কাহনের। কি করবে সে? চিৎকার? কিন্তু তারই কি উপায় আছে? প্রাণপনে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে সে। দুহাতে আঁকড়ে ধরেছে পাগলি মায়ের হাত। লিকলিকে দু’টি হাত অথচ কি শক্তি! অসুরের মতো! মায়ের হাতে নিজের আসন্ন মৃlত্যুকে দেখতে পেল যেন। ভয়-শঙ্কা-আতঙ্ক বাড়লো তরতর করে। কি হবে এখন?

বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলেন রাহেলা খানম। পাগলীর ঘর থেকে ধস্তা-ধস্তির আওয়াজ শুনে ছুটে এলেন। দরজা খোলা! ত্বরিৎ গতিতে ভেতরে প্রবেশ করে বাতি জ্বালতে গেলেন। কিন্তু বাতি জ্বললো না। মামীকে দেখে কাহন কোনমতে ডাকলো,

— “মামী!”

পাগলীর অগ্নিরূপ দেখে আঁতকে উঠলেন রাহেলা। নিজের ছেলের গলা চেপে ধরে ঝাঁকাচ্ছে সে! আর পশুর মতো হিংস্র সুরে বলছে ‘মেরে ফেলব! মেরে ফেলব!’ দ্রুত দরজার কাছে এসে চেঁচালেন রাহেলা,

— “কান্তা? পবন? দ্রুত আয়!”

সবাই আসবার পর অনেক চেষ্টা করে কাহনকে ছাড়ানো হলো। তার তখন নির্জীব অবস্থা। গলা লাল হয়ে আছে, নখের দাগ বসেছে স্পষ্ট। মুখের উপরও কিছু আঁচড়ের দাগ!

পাগলিকে ঘরে আটকে রেখে কাহনকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে বের করে আনলেন রাহেলা। রাগে বারুদ হয়ে বললেন,

— “হঠাৎ মায়ের দরদ উৎলে উঠছে, না? জানিস না, তোর মা পাগল? তাও এসেছিলি কেন? মরতে?”

কাহন সে কথার জবাব দিলো না। তীব্র হতাশাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে শুধু প্রশ্ন করলো,

— “আপনি মাকে খাবার দেন না, মামী?”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here