একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_০৪

0
371

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০৪

ছুটির পর একা একা ফিরছে হিয়া। আজ কান্তা কলেজে আসে নি। তাই মনটা একটু খারাপ। কান্তা না আসলে তার কলেজে আসতে একটুও ভালো লাগে না। ফাঁকা ফাঁকা লাগে সবকিছু।

আকাশে মেঘ করে এসেছিল। কালচে ধূসর অম্বরে ভরে আসছিল নভোস্থল। গুড়ুম-গুড়ুম ডাকছিল তারা। আপনমনে মত্ত ছিলো বলে হিয়া সেসব লক্ষ্য করে নি। হঠাৎ ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামতেই খেয়াল হলো। বড় বড় ফোঁটায় ঝরে পড়তে লাগলো বারিধারা রূপে!

হিয়া ছুটে এসে দাড়ালো একটা দোকানের নিচে। ইতোমধ্যেই সেখানে অনেকে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। নিজের গা বাঁচিয়ে সরে গেল একটু। তখনই নজরে পড়লো রাস্তার অপর পাশ থেকে ছুটে আসছে কাহন। পলকের মধ্যেই ছেলেটা এসে দাড়ালো ওর পাশে। দু’ হাতে চুল ঝাড়তে লাগলো নিজের মতো। হিয়াকে বোধ হয় দেখেই নি!

হিয়ার চোখ তখন কাহনের উপরেই নিবদ্ধ। ছেলেটা নিজের কাজে ব্যস্ত। হিয়া ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে কাহনের ভঙ্গিমা। তার আধভেজা রুক্ষ মুখটায় হাজারও বিরক্তি। বৃষ্টির পানিতে ভিজে ওঠা চুল ঝাড়তে আরও বিরক্ত হচ্ছে। খুব সাধারণ বিষয় অথচ হিয়ার কাছে মনে হচ্ছে কাহনের এই ভঙ্গিমাটা কতো অসাধারণ! আচ্ছা, প্রেমে পড়লে কি সবকিছুই এমন চমৎকার লাগে?

— “আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া। কেমন আছেন?”

কাহন চমকে তাকালো। হিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েকপল। যেন ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। তবে ঠোঁট নড়লো খানিক। সম্ভবত সালামের জবাবটা দিলো। কিন্তু কিছু শুনতে পাওয়া গেল না। হিয়া বললো,

— “চিনতে পারছেন না? আমি হিয়া!”
— “ও।”

মাথা নাড়লো কাহন। নিরাসক্ত হয়ে। পুনরায় শুধালো হিয়া,

— “কেমন আছেন?”
— “এইতো।”

কোনো সৌজন্যতা নেই। দ্বিতীয়বার কথা বলার কোনো ইচ্ছেও যেন নেই। কাহনের নির্বিকার ভাব দেখে মনে পীড়া লাগলো হিয়ার। লোকটা এমন কেন? চেয়েও আর কথা এগোলো না। চুপচাপ দু’ জন দাড়িয়ে রইলো অপরিচিত মানুষের ন্যায়।

আধঘণ্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে। এখনো তার তেজ কমে নি। হঠাৎ নিজে থেকেই কথা বলে উঠলো কাহন,

— “যা বৃষ্টি নেমেছে! সহজে থামবে না বোধ হয়!”

বৃষ্টির দিকে চেয়ে ছিলো হিয়া। কাহনের কথায় ফিরে তাকালো,
— “আধঘণ্টা হতে চললো।”
— “আরও ঘণ্টা দেড়েক চলবে নিশ্চিৎ। মেঘেদের আনা-গোনা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”

কাহন চুপ করলো। আশেপাশের মানুষও এই কথাই বলছে। গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ট প্রাণে হঠাৎ ঝুম বৃষ্টির আগমন। বহুদিন পর! বহুল প্রতীক্ষিত! ফেটে চৌচির হওয়া মাঠ-ঘাট আজ তাই মনভরে পানি শুষে নেবে। মানুষ, পশু-পাখি তৃষ্ণা মেটাবে শীতল জলে। দোকানটায় টিনের চালা। ছঞ্চার কাছে দাড়িয়ে ছিল হিয়া। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করছিল হিম-শীতল বারিধারা। জিজ্ঞেস করলো,

— “আপনি গিয়েছিলেন কোথায়?”

ওর দিকে একপলক চেয়ে প্রত্যুত্তর করলো কাহন,
— “টিউশনিতে।”
— “আপনি টিউশনি করান বুঝি?”

আগ্রহী চোখে তাকালো হিয়া। জবাব গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লো সে। এতক্ষণে ওর দিকে ভালো করে তাকায়ও নি। কিন্তু এবার তাকালো। আড়চোখে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিলো। কলেজে পড়ুয়া বাচ্চা একটা মেয়ে! চোখে-মুখে কেন আহ্লাদী ভাব। ননীর পুতুল যেন। হিয়া সঙ্গে সঙ্গেই বললো,

— “ইংরেজী পড়ান? আপনার সাবজেক্ট তো ইংরেজী!”

কাহনের একটু খটকা লাগলো। সে কোন সাবজেক্টে পড়ছে সেটা এই মেয়ে জানলো কি করে? তথাপি কিছু বললো না। হিয়া কিন্তু তখনো থেমে নেই। বললো,

— “জিজ্ঞেস করবেন না, আপনার সাবজেক্ট জানলাম কি করে? কান্তা বলেছে। আপনি না-কি ইংরেজী খুব ভালোবাসেন? আমি অবশ্য এর উল্টো। ইংরেজী আমার দু’ চক্ষের বিlষ। সহ্যই করতে পারি না! এই রে, বেশি বলে ফেললাম– যারা ইংরেজী পছন্দ করে তাদের সামনে তো এর দুর্নাম রটানো যাবে না। ভুল করে–”

কাহনের বিরক্ত লাগছিল। মেয়েটা এত কথা বলছে কেন? আর ভঙ্গিটা দেখো? এমনভাবে হাত নেড়ে-নেড়ে কথা বলছে যেন কতোদিনের পরিচয় ওদের! আপনা-আপনিই ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর।

এরপর হিয়া নিজের মতো কথা বলে যাচ্ছিল। কোথা থেকে শুরু করে কোথায় যে ছুটছিল ওর কথার রেলগাড়ি! থামবার নাম নেই। কাহনের মনোযোগ ছিল না তেমন। কিছু শুনছিল, কিছু শুনছিল না। হঠাৎ কানে বাজলো দু’টো কথা। হিয়া ততোক্ষণে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে একের পর এক। বৃষ্টি নিয়ে কথা বলছে,

— “আমার বৃষ্টি ভীষণ ভালো লাগে। বৃষ্টি দেখলেই ভিজতে মন চায়, জানেন? কিন্তু আমার মা তাতে বকে খুব। ভিজতেই দেয় না। আপনার বৃষ্টি ভালো লাগে?”

— “হুঁ।”

মাথা নাড়লো কোনমতে। কিছুটা সময় চললো নীরবতা। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। দমকা বাতাসে ছাঁট এসে লাগছে গায়ে। ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। কাহন নিজমনেই বিড়বিড় করলো,

— “বাড়ি ফেরা দরকার। কিন্তু বৃষ্টি..”

দোকানির কাছ থেকে একটা পলিথিন ব্যাগ চেয়ে নিলো। সেটা মাথায় পড়ে দাড়ালো। বিড়বিড় করলেও ঠিক তা শুনতে পেয়েছে হিয়া। চট করে বললো,

— “আমার কাছে ছাতা আছে। আপনি চাইলে নিতে পারেন! এভাবে যাবেন না!”

কাহন বিস্মিত চোখে তাকালো, প্রশ্ন না করে পারলো না,

— “তোমার কাছে ছাতা থাকা সত্ত্বেও দাড়িয়ে আছো কেন? তুমি নিজেই তো যেতে পারো!”
— “আমি তো যাবো না!” মাথা নাড়লো অবুঝ শিশুর মতো।
— “কেন?”
— “ছাতা নিয়ে বৃষ্টিতে নেমে মজা নেই। ইচ্ছে করবে ছাতা ছুঁড়ে ফেলে, ভিজে ভিজে বাড়ি যেতে। তারচে’ দোকানে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখা ভালো। ভিজতে ইচ্ছে করবে না।”

যুক্তি দেখালো। কাহনের হঠাৎ মনে হলো মেয়েটা পাগল! অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলে! ছাতা সাথে থাকলেও কারো ভিজতে ইচ্ছে করে না-কি? আশ্চর্য! অন্যমনস্ক হয়ে পা বাড়িয়ে ছিলো। হিয়া তৎক্ষণাৎ বললো,

— “আপনি কি ভিজে যাবেন? আমার ছাতাটা নিয়ে যান, প্লিজ।”
— “তোমার ছাতা আমি কেন নিবো? আর আমি নিলে তুমি কি করে যাবে?”

— “কেন নিবেন না? আপনি কান্তার ভাই নন? আমি তো বললামই আমি এখানে দাড়িয়ে থাকবো। বৃষ্টি কমলে বাড়ি যাবো।”

— “এই বৃষ্টি কমবে না। নিজের ছাতা নিয়ে নিজে বাড়ি যাও। আমার জন্য ভাবতে হবে না।”

কাহন এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু এগোতে পারলো না। হিয়া খপ করে ধরে ফেলেছে ওর হাত! অর্ধ অপরিচিত না, অপরিচিতই বলা যায়, এরকম একটি মেয়ের সরাসরি হাত ধরার দুঃসাহস দেখে চমকে উঠলো কাহন। হতবাক, হতবিহ্বল হলো। তার বিস্ফোরিত চাহনিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অনুরুদ্ধ কণ্ঠে হিয়া বললো,

— “এই বৃষ্টিতে ভিজবেন না, প্লিজ! অসুস্থ হয়ে যাবেন।”
— “তুমি আমায় নিয়ে ভাবছো কেন, বালিকা? আমি অসুস্থ হলে কি?”

বিড়বিড় করলো কাহন। সতেরো-আঠারো বছরের এই বালিকা মেয়েটি তাকে নিয়ে কেন ভাবছে? কেন মায়া দেখাচ্ছে? নাছোড়বান্দা হিয়া মাথা নাড়লো,

— “না। আপনি অসুস্থ হবেন না। আমার ছাতাটা নিয়ে যান। তবুও ভিজবেন না।”

একঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো কাহন। এই অষ্টাদশী বালিকাকে প্রশ্রয় দেয়ার মানে হয় না। অচেনা একটি যুবকের জন্য এতো দরদ কেন তার? কোনো দরকার আছে? দৃঢ় গলায় বললো,

— “অপরিচিত মানুষের হাত ধরাটা কোনো সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। ছাতা দিতে চেয়েছ, ধন্যবাদ। কিন্তু আমার প্রয়োজন নেই।”

আর দাড়ালো না। ঘোর বৃষ্টিতে নেমে গেল রাস্তায়। ঝড়ো হাওয়াকে উপেক্ষা করে দ্রুত পায়ে হেঁটে চোখের আড়াল হয়ে গেল নিমিষেই। আর পেছনে ফেলে গেল একটি আহ্লাদী বালিকার করুণ মুখশ্রীকে!
____

বাড়ির পেছনের অংশে কিছু গাছগাছালি আছে। পেয়ারা গাছ আছে একটা। পাগলীর জানালার কাছেই। কিন্তু গাছে উঠলে পাগলী রাগ করে উল্টোপাল্টা কিছু করে এই ভয়ে ও-গাছে চড়া নিষেধ। পরাগ তা মেনে চললেও ডানপিটে পবন তা কিছুতেই মানতে চায় না। তার প্রধান কারণ এই গাছের ফল। প্রতিবছর এই পেয়ারা গাছে প্রচুর পেয়ারা ফলে। বড়-বড়, ডাসা-ডাসা চমৎকার স্বাদের পেয়ারা। অথচ পাগলীর ভয়ে মা ওই গাছের আশপাশে অবধি যেতে দেয় না!

স্কুল থেকে ফিরবার পথে হঠাৎ গাছটাকে নজরে পড়েছে পবনের। বাইরের পাঁচিলের উপরে হেলে পড়েছে সেটা। শাখা ভর্তি পেয়ারা। কয়েকটা আবার বড়ও হয়েছে ইতোমধ্যে! পবনের লোভ লেগে এলো। জিভের জল গিলে ফেলে ভাবলো,

“আপনে ঘরকো ফল খানে কে লিয়ে কিছিকা ডারুঙা কিউ?”

যেই কথা সেই কাজ! দ্বিপ্রহরের খাবার খাওয়ার পর সবাই যখন ভাতঘুমে মগ্ন তখন একা একা বাড়ির পেছনে চলে এলো পবন। পাগলীর খোলা জানালায় উঁকি মেরে দেখলো মেঝেতে উপুড় হয়ে বসে কি যেন করছে সে। এদিকে খেয়াল নেই। অতএব, চিন্তা নেই! পা টিপে টিপে গাছের গোড়ায় এসে দাড়ালো পবন। গাছটা অনেক পুরোনো। বাবা বলেন, এটা পাগলী ফুপির নিজের লাগানো। পাগল হবার আগে প্রতিবছর এই গাছের সব ফল পাগলীর শশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন তিনি। পেয়ারা তার অত্যন্ত পছন্দের ছিল। অথচ আজ—

তরতর করে উপরে উঠে গেল পবন। একটা ভালো দেখে ডালে বসে পা ঝুলিয়ে দিলো। টপাটপ পেয়ারা ছিঁড়তে লাগলো। দু’ হাত ভর্তি করে নিয়ে বসলো খাওয়ার জন্য।

খসমস আওয়াজে দারুণ বিরক্ত হয়ে জানালা আটকাতে এসেছিল পাগলী। এইসব শব্দ-টব্দ তার পছন্দ নয়। তবুও এরা ওকে আরামে থাকতে দেয় না। সবসময় যন্ত্রণা করে। খেতে দেয় না ঠিকঠাক। দিলেও কীসব হাবি-জাবি তরকারি দেয়। দরজায় খিল আটকে রাখে সারাবছর। কাউকে কাছে ডাকলে আসে না। এখন আবার এই বেলা শব্দ করছে খসমস্!

জানালাটা লাগাতে গিয়েই পবনকে চোখে পড়লো তার। গাছের উপরে চড়ে আছে। কেমন করে ঝুলে আছে যেন। একহাতে চেষ্টা করছে একটা পেয়ারা ছিঁড়তে। যেটা তার নাগালের একদম বাইরে!

এক মুহূর্তের জন্য কি যেন হয়ে গেল তার। ভাইপোর আসন্ন বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে উঠলো অবচেতন মন,

— “প-ব-ন!”

আর তখনই ঘটলো বিপত্তি। আচমকা চিৎকারে ভয় পেয়ে ডাল ছেড়ে দিলো পবন। যেটা তার আঁকড়ে ধরবার একমাত্র অবলম্বন ছিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই ‘ধপাস’ করে পরে গেল নীচে!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

(আমার লেখা প্রথম ই-বই ‘বাতাসে বহিছে প্রেম’ পাওয়া যাচ্ছে বইটই অ্যাপে। পড়তে চাইলে মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে ক্রয় করে নিতে হবে বইটি! লিংক কমেন্টে… ❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here