একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_০৭

0
302

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০৭

রাত এগারোটা। বাচ্চারা ঘুমে। পাগলির সাড়া শব্দ নেই। মুজাহিদ সাহেবও রোজকার হিসেব নিয়ে বসেছেন। একটু পরেই হয় তো ঘুমোবেন। কিন্তু রাহেলা খানমের শান্তি নেই। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসবার উপক্রম হলেও তা করবার জো নেই! কাহন এখনও বাড়ি ফেরে নি। সে ফিরবে, ভাত খাবে, তারপর রান্নাঘর গুছিয়ে ঘরে যেতে পারবেন রাহেলা। তবেই তার নিস্তার!

আরও দশ মিনিট পর কাহন ফিরলো। ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে রাহেলা খানম ওকে দেখলেন। ঘুম ছুটে গেল মুহূর্তেই! মস্তিষ্কে একরাশ রাগ আর বিরক্তি এসে ভর করলো। তারস্বরে হাঁকলেন,

— “নবাবপুত্রের বাড়ি ফেরার সময় হলো তবে? আমি বললাম ভেবেছিলাম আজ আর ফিরবেনই না!”

মামীর বিদ্রুপ বুঝতে অসুবিধে হলো না কাহনের। কোনো প্রতিবাদ নেই, নিরুত্তাপ মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,

— ” বাড়ি না ফিরে যাবো কোথায়, মামী? যাওয়ার কি আর জায়গা আছে?”

রাহেলা খানম তেঁতে উঠলেন,

— “নেই বলছিস? সারাদিন যেখানে ছিলি সেখানে যাওয়া যায় নি? ঘরে ফিরতে বলেছে কে তোকে? না-কি ওখানে খাওয়া দেয় না? তাই দুটো খাওয়ার জন্য বাড়ি ফিরিস?”

সহসা জবাব দিতে পারলো না কাহন। চুপ করে রইলো। রাহেলা বলে চলেছেন,

— “সন্ধ্যা থেকে তোর খাবার নিয়ে বসে আছি, রাজপুত্তুর বাড়ি নেই। ভাতের থালায় মাছি তাড়ানোর জন্য ঘুম নিয়ে জেগে আছি আমি। কেন রে? তোর আমার সাথে কীসের শlত্রুতা? সারাটা দিন খাটাখাটনি করে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোবো তারও জো নেই। তোদের যন্ত্রনায়–”

কিছু না বলে ঘরে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে ছিল কাহন। পেটে ক্ষিদে আছে; কিন্তু সেকথা মামীর কাছে বলা যাবে না। সে আরও ক’টা কথা শুনিয়ে ছাড়বে নির্ঘাত! কিন্তু ঘরে যেতে চেয়েও রক্ষে আর হলো না! ফুটন্ত গরম তেলে একফোঁটা পানি পড়লে যেমন হয় তেমন করেই ছ্যাঁত উঠলেন রাহেলা,

— “আবার ঘরের দিকে ছুটছিস কেন? ভাত খাবি কতো রাতে? আমি কতক্ষণ ধরে জেগে থাকবো? তোরা–”

— “তুমি ভাত বেড়ে রাখো, মামী। শার্টটা বদলে আসছি আমি।”

গটগট করে হেঁটে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন রাহেলা। একটা ক্লান্ত শ্বাস আকাশ ছুঁয়ে দিলো তখন। বেজায় পরিশ্রান্ত শরীরটা আর নড়তে চাইছিল না। তবুও সেটাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরে প্রবেশ করলো কাহন। ঘামে ভিজে যাওয়া বিদঘুটে দুর্গন্ধ যুক্ত শার্টটা খুলে আলনায় নেড়ে দিলো। মেলে দেবার সময় খেয়াল হলো কলারের দিকটা ছিঁড়ে গেছে কেমন। ভাঁজ হয়ে। পিঠের রং চটে গেছে অনেকখানি। আচ্ছা, কত বয়স হলো শার্টটার? ছয়মাস না একবছর? না তারও বেশি?

— “তোর আসতে কতক্ষণ লাগবে আরও? হ্যাঁ, আমি কি একটু নিস্তার পাবো না? একটু শান্তি–”

মামীর কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল ওর। একটা পাতলা গেঞ্জি গায়ে চড়িয়ে ছুটলো রান্নাঘরে।

রাহেলা খানম প্লেট সাজিয়ে দিয়েছেন। কাহন চেয়ে দেখলো একখানা মাছের লেজ, আর কিছু সবজি পড়ে আছে একপাশে। ইতোমধ্যেই শক্ত হয়ে আসা ভাতে হাত দিতেই রাহেলা হঠাৎ বললেন,

— “এককাজ কর। ঘরে গিয়ে খা। আমি রান্নাঘরে তালা দিয়ে যাচ্ছি।”

মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। কণ্ঠ শুনেই বুঝলো কাহন। মাথা নেড়ে প্লেট নিয়ে চলে গেল। রান্নাঘরে তালা মেরে ঘুমোতে এলেন রাহেলা খানম। এই জীবন আর তার ভালোলাগে না! একঘেয়ে, নিরামিষ জীবন!
___

বিকেলে কোনো টিউশন ছিল না হিয়ার। কলেজ থেকে ফিরে বাসায় বসে বোর হচ্ছিল। বিকেল হতেই তাই ছুটলো কান্তার বাড়ির উদ্দেশ্যে!

কান্তা পড়ছিল নিজের পড়ার টেবিলে। হিয়া উচ্ছাস নিয়ে ঘরে ঢুকলো,

— “কি করছিস রে, কান্তা?”

হিয়ার আসবার খবর কান্তা আগেই পেয়েছে। হিয়ার যা গলা! মার সাথে যখন কথা বলছিল তখনই বুঝতে পেরেছে। তাই একটুও অবাক না হয়ে জানালো,

— “পড়া ছাড়া কি করবো?”
— “হ্যাঁ, সেই! তোদের কাছে তো পড়াটা ইম্পর্টেন্ট।”

মুখ কুঁচকে তাকালো। কান্তা হাসলো,

— “তোর কাছে নয়?”
— “নাহ্।”

মাথা নাড়লো হিয়া। তারপর দার্শনিকদের ভঙ্গি করে বললো,

— “এখন হলো আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ইয়্যুথ টাইম ইজ দ্য বেস্ট টাইম অফ্ লাইফ! এই সময়টা হেলাফেলা করে নষ্ট করা উচিৎ না। ঠিকঠাক ভাবে পার করতে হবে এই সময়টা–”

— “পড়ালেখা তো সেজন্যই করতে হবে। তাই না?”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো কান্তা। হিয়ার হাবভাব ওর বুঝে আসছে না। হিয়া বিরক্ত হলো বেজায়,

— “আরে পাগল না! পড়ালেখা করে সময় পার করা মানে হচ্ছে হুদাই টাইম ওয়েস্ট করা। হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘ জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা আমরা পড়ালেখা করে নষ্ট করি।’ ভাবিস না, বানিয়ে বানিয়ে বলছি। এটা বহুব্রীহি বইতে আছে।”

— “দূর! হুমায়ূন স্যার হয় তো অন্য কোনো কারণে বলেছে–”

ওর কথায় পাত্তাই দিতে চাইলো না কান্তা। হিয়াও কম নয়,

— “জ্বি না। উনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, পড়ালেখার মতো কাজে আমাদের সময় নষ্ট করা উচিৎ না। আমাদের উচিৎ এই সময়টা প্রেম করে–”

— “বকবক বন্ধ করবি তুই? না মাlর লাগাবো?”

মারমুখি হতেই চুপ করে গেল হিয়া। তার ফিলোসফি একে বুঝিয়ে লাভ নেই। হাত উঁচিয়ে মার্জনা চাইলো,

— “ঠিক আছে। ঠিক আছে। আর কিছু বলবো না। পাক্কা!”

— “আচ্ছা। বস্ তুই। আমি তোর জন্য নাশতা আনছি।”

কান্তা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। হিয়াকে বিছানায় বসতে বলে নিজে ছুটলো মায়ের কাছে। বান্ধবী বাড়ি এসেছে, অ্যাপায়ণ তো করতেই হবে!

কান্তা বেরোতেই ঝট করে বিছানা থেকে নামলো হিয়া। এমন নয় এ বাড়িতে সে আজ প্রথম এসেছে। এর আগেও এসেছিল দু’ তিন বার। কিন্তু কখনো সেভাবে ঘুরে দেখা হয় নি। গুটিগুটি পায়ে বেরোলো ঘর ছেড়ে

কান্তাদের বাড়িটা বেশ পুরনো আমলের। একতলা বাড়ি। তিনপাশে বারান্দা ঘেরা ঘর; মাঝখানে উঠান। কান্তার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় হাঁটছিল হিয়া। পরপর দুটো রুম পেরোনোর পর দেখলো রান্নাঘর। কান্তা রাহেলার সঙ্গে কথা বলছিল। খোলা দরজা দিয়ে ওদের দেখে এগিয়ে গেল। এদিকে একটা স্টোর রুমে। অনেক বস্তা দেখা যাচ্ছে, আলু-পিঁয়াজও চোখে পড়লো বেশ। আরেকটা ঘরের দরজা বন্ধ। তবে মনে হয় না সেখানে কেউ থাকে। সেটা পেরিয়ে পরের ঘরের সামনে যাবে তখনই ডাক পড়লো কান্তার,

— “আরে তুই ওখানে? কি করছিস? এদিকে আয়!”

তৎক্ষণাৎ ফিরে তাকালো। চোখে-মুখে ইতস্ততা লেপ্টে। বললো,

— “এই একটু ঘুরে দেখছিলাম আর কি–”
— “আচ্ছা, পরে দেখিস। এখন ঘরে আয় তো!”

হিয়া ফিরে এলো। ফের কান্তার ঘরে গিয়ে বসলো। নাশতার ট্রে সাজিয়ে বসে আছে কান্তা। দু’ বান্ধবীতে গল্প জমলো। অধিকাংশই হিয়ার জন্মদিন বিষয়ক। কেমন সময় কাটলো, কি কি করলো–এইসব। কান্তা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো,

— “তুই কাহন ভাইয়ের ঘরের কাছে গিয়ে কি করছিলি, হিয়া?”
— “কোনটা? ওটা কাহন ভাইয়ের ঘর?”

পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো হিয়া। চায়ের কাপে চুমুক বসালো। কান্তা মাথা নাড়লো,

— “হ্যাঁ। জানিস না?”
— “না তো।”
— “ওহ্। আচ্ছা, শোন। ওদিকটায় যাওয়ার দরকার নেই। কাহন ভাইয়ের সাথে আমাদের অতো মেলা-মেশা নেই।”

বান্ধবীর অবগতির জন্য জানালো সে। হিয়া অবাক হলো,

— “কেন?”

একটু অপ্রস্তুত হলো কান্তা। একটু লজ্জিতও। বিচিত্র কারণে তার ফুপাতো ভাই কাহনের সঙ্গে উঠাবসা পছন্দ করেন না রাহেলা খানম। কান্তা থেকে শুরু করে পবন-পরাগদের উপরও এই নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। অথচ কাহন ওদের আপন ভাইয়ের মতন। গত বারো বছর ধরে এ-বাড়িতেই থাকে!

কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ করে বললো,

— “আসলে মা অতটা পছন্দ করেন না। বিশেষ করে আমার কথা বলা। বুঝিসই তো ছেলে মানুষ, আমি তো বড় হয়েছি। পবনদেরও মানা আছে। তাছাড়া উনি তো আমাদের চেয়ে বয়সে বড়। বনেও না তেমন—”

হিয়া কি বুঝলো কে জানে। শুধালো,

— “উনি কতোদিন ধরে এখানে আছেন রে? জন্মের পর থেকেই?”

— “না, না। অতোদিন হবে কেন। কাহন ভাই যখন ক্লাস নাইনে তখন ফুপি ওনাকে নিয়ে চলে আসে। ফুপার সঙ্গে ঝগড়া করে।”

— “ওনার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?”

ভারী অবাক হলো। মুখ কালো করে কান্তা বললো,

— “নাহ্। ফুপা দ্বিতীয় বিয়ে করে আর খোঁজ নেয় নি। ফুপি আর কাহন ভাইও সেই থেকে এখানে।”

— “তোর ফুপি বেঁচে নেই? কোথায়?”

— “থাকবে না কেন? আছে। এ-বাড়িতেই থাকে।”
— “এখানেই? তুই আগে বলিস নি কেন? চল দেখা করে আসি।”

চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললো হিয়া। বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিল ওকে। কান্তা ইতস্তত করলো। তার ফুপি পাগল অবস্থায় ঘরবন্দী থাকে এটা ওর বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু হিয়ার যা জেদ! বললো,

— “তুই দেখা করে কি করবি?”
— “এমনই। কেন দেখা করতে কি?”
— “ফুপির সাথে দেখা হবে না, হিয়া। তুই শান্ত হয়ে বস্।”
— “হবে না? সে কি ঘুমোচ্ছে?”
— “জানি না। কিন্তু দেখা করা উচিৎ হবে না।”
— “কেন!”

আশ্চর্য হয়ে গেল সে। কান্তা না পারতেই বললো,

— “উনি বিরক্ত হবেন। রাগ করবেন। মা শুনলেও বকবে আমায়।”
— “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। দেখা করতে রাগ করবে কেন!”
— “কারণ উনি মানসিকভাবে অসুস্থ!”
— “মানে?”

এবারে চমকে উঠলো সে। অসহায় হয়ে মাথা নাড়লো কান্তা,

— “সে পাগল। কাহন ভাইয়ের ঘরের এক ঘর পরেই তার ঘর। সেখানে সে বন্দি হয়ে থাকে!”

কাহনের মা পাগল? তাই কি ছেলেটা এমন ছন্নছাড়া, ঘর বিবাগী? এই চরম সত্যটা শুনবার পর কেমন যেন হয়ে গেল হিয়ার। অনুভব করলো বুকটা ভার হয়ে আসছে। অসহ্য রকমের কষ্ট লাগছে। কাহনের কষ্টে চোখ ফেটে জল গড়াতে চাইছে! জীবন এতো নিষ্ঠুর কেন?

— “তুই কাঁদছিস?”

হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো কান্তা। বাঁ হাতের পিঠে চোখ মুছে ফেললো হিয়া। তবুও জল ঝরলো অঝোরে। কোনমতে বললো,

— “আমি কাহনের মায়ের সাথে দেখা করবো, কান্তা। কিচ্ছু বলবো না। শুধু দেখবো। একবার দেখা করাবি?”

— “অসম্ভব!”

আঁতকে উঠলো কান্তা। তড়িঘড়ি করে বললো,

— “উনি বদ্ধ উন্মাদ! যাকে-তাকে আঘাত করেন। একবার কাহন ভাইয়ের গলা চেপে ধরেছিল, জানিস?”

শেষ কথাটা শুনে আরও খারাপ লাগলো হিয়ার। বেদনায় নীল হলো মন। তবুও অনুরোধ করলো,

— “আমি দূর থেকে দেখবো। একবার নিয়ে চল না? প্লিজ?”

অনেক মিনতি চললো। শেষমেষ কান্তা রাজি হতে বাধ্য হলো। দু’ জনে পা টিপে টিপে বেরোলো ঘর ছেড়ে। পাগলীর ঘরের জানালায় উঁকি দিলো দু’ জন। পাগলী ঘুমোচ্ছে। অতএব দেখা হলো না। ওরা ফিরে আসছে তখনই হঠাৎ রাহেলার ডাক পড়লো,

— “কান্তা? এই কান্তা? শুনে যা তো।”
— “আসছি মা।”

হিয়াকে ঘরে যেতে বলে নিজে ছুটলো মায়ের কাছে। হিয়া মাথা নেড়ে সায় জানালো। আনমনে দু’ পা এগোতেই চোখে পড়লো একটা ঘর। কান্তা বলেছিল, কাহনের ঘর এটা। কি যেন ভাবলো হঠাৎ। কাহন কি বাড়ি আছে? দেখা করলে কেমন হয়?

আলতো খোলা দরজায় উঁকি দিলো হিয়া। ঘর ফাঁকা, কাহন নেই। হিয়ার মন খারাপ হবার কথা, কিন্তু হলো না। বরং খুশি হলো। দরজায় হাত রাখলো। এক পা এগোলো। কোনো এক বিচিত্র আকর্ষণ শক্তির বলে সে ঢুকে গেল ঘরটায়! কাহন নেই তো কি হয়েছে, ওর সবকিছু তো আছে? সেসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে ক্ষতি কি?

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

[আমার লেখা প্রথম ই-বই ‘বাতাসে বহিছে প্রেম’ পাওয়া যাচ্ছে বইটই অ্যাপে। পড়তে চাইলে মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে ক্রয় করে নিতে হবে বইটি! লিংক কমেন্টে… ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here