একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_০৯

0
321

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০৯

ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় সকালের বাসে ঢাকায় ফিরে গেছেন মনজুর আলম। যাবার আগে মেয়েকে হাজারবার বলে গেছেন, ‘ মন দিয়ে পড়ো! মন দিয়ে পড়ো! এইচএসসি পরীক্ষা ভালো করে দিও!’ একান্ত বাধ্যগত সন্তানের মতো মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে সায় দিয়েছে হিয়া। বাবাকে বিদায় দিয়েছে।

দু’ দিন পর মডেল টেস্ট শুরু হলো কলেজে। বাপকে দেয়া কথা রাখতেই হয় তো হিয়াও মন দিয়ে পড়লো। কাহন নামক প্রেমাসুখকে মন পিঞ্জরে বদ্ধ রেখে। মডেল টেস্টের পরেই তো ফাইনাল এক্সাম। লেখাপড়ায় মন না দিলে চলে?

টিউশন থেকে ফিরছিল হিয়া। রিকশায় চড়ে। আগে অবশ্য হেঁটে হেঁটেই যাতায়াত করতো। কিন্তু ইদানিং রিকশা ছাড়া বেরোয় না কোথাও। মনজুর সাহেবের কড়া নির্দেশ, একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না। হেঁটে হেঁটে স্যারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট পড়তে গেলেই তো কতো সময় যায়! শেষ সময়; হিয়ার সিলেবাস এখনো শেষ হয় নি। স্বভাবতই বাবা-মা মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ করবে। প্রাইভেট পড়তে যাতায়াত করতে বাড়তি সময় নষ্ট হয় বলে সব স্যারকে বাসায় পড়াতে বলেছেন মনজুর সাহেব। কিন্তু সব স্যার তো আর বাসায় পড়াতে চান না! অগত্যা হিয়াকে যেতে হয়!

মোড়ের কাছে এসে কাহনকে দেখতে পেল হিয়া। কাহন সিগারেট কিনছে। ভাবলো ডাক দেবে; কিন্তু কি যেন ভেবে শেষ পর্যন্ত আর দিলো না। সোজা রিকশা থেকে নেমে এলো।

— “কেমন আছেন?”
— “ভালো।”

ওকে দেখেও কাহনের কোনো পরিবর্তন হলো না। প্যাকেট খুলে একখানা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে নিলো। দেশলাই থেকে কাঠি ঠুকে আগুন ধরালো দক্ষ ভঙ্গিতে। হিয়া তখনো দাড়িয়ে আছে। লোকটা তাকে কিছু বলছে না কেন? একটু কথা বললে কি হয়?

— “কি করছেন?”

কাহন জবাব দিলো না। ও আবারও শুধালো। এবার প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললো,

— “দেখতে পারছ না? সিগারেট খাই।”
— “দেখতে তো অনেক কিছুই পারি। কিন্তু আপনার কণ্ঠ তো শুনতে পারি না।”

বিড়বিড় করে বললো হিয়া। যদিও তা কাহন শুনতে পেয়েছে তবুও তার ভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হলো না। কেমন ভাবলেশহীন চোখে তাকালো। আচ্ছা, হিয়ার আবেগ, হিয়ার আচরণ কোনো কিছুই কি সে দেখে না? কিছু বুঝে না? তবুও এমন করে কেন? মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে এলো হিয়ার। সিগারেট খেতে খেতে চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালো কাহন। কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে বললো,

— “এভাবে রাস্তায় দাড়িয়ে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলবে না, বালিকা। লোকে কলঙ্ক রটিয়ে দেবে!”

কাহন আর দাড়ায় নি। চলে গিয়েছে। হিয়া একলা পথে দাড়িয়ে আনমনে উচ্চারণ করলো,

— “শুধু আপনাকে পাবার জন্যে যদি আমাকে কলঙ্কিনী হতে হয় তবে আমি তাতেও রাজী! নির্দ্বিধায় এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে বেঁচে রইবো চিরকাল!”
__

কাহন তিনদিন হলো বাড়ি নেই। কুষ্টিয়া গিয়েছে একটা চাকরির ইন্টারভিউ এর জন্য। ছেলেটা গতবছর মাস্টার্স পাশ করেছে। এখনো পর্যন্ত কোনো চাকরী পায় নি। এই নিয়ে রাহেলার ক্ষোভের সীমা নেই। দুনিয়ার সব মানুষ চাকরী পায় কিন্তু কাহন কেন পায় না? একটা চাকরী পেয়ে গেলেই তো তিনি মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। পাগলী মাকে নিয়ে সে আলাদা হয়ে যেতে পারবে। অন্যের গলগ্রহ থাকতে হবে না। সইতে হবে না কোনো কটাক্ষ, কটূক্তির। তবুও কেন চাকরীর জোগাড় করতে পারছে না কাহন?

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই রোজকার ব্যস্ত রুটিন মাফিক কাজ শুরু করলেন রাহেলা খানম। ছেলেমেয়েদের খাইয়ে-দাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে, পাগলীর খোঁজ নিয়ে, স্বামীকে দোকানে পাঠিয়ে তবে তার শান্তি। বর্তমানে উঠান ঝাড়ু দিতে লেগে পড়েছেন রাহেলা খানম। মেজাজটা তার বেশ ফুরফুরে। কাজ করতে ক্লান্তি লাগছে না। বরং বেশ আনন্দই লাগছে। গুনগুন করে গানও গাইছেন একটা।

হঠাৎ বাড়ির মূল ফটকে ‘টুকটুক’ শব্দ হলো। ভেতর বাড়ি থেকে গলা তুলে চেঁচালেন রাহেলা,

— “এ্যাই কে রে?”

একটু পরেই দরজা খোলার আওয়াজ হলো। ও গেট এমনই খোলা যায়। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করলেন একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। ফর্মাল পোশাক পরিহিত। রাহেলা খানম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বোঝার চেষ্টা করলেন লোকটি তার পরিচিত কি-না।

— “কে?”

লোকটার চোখে কালো রোদ চশমা ছিল। সেটা খুলে হাতে রাখলেন তিনি। বিনয়ের সাথে সালাম দিলেন রাহেলার উদ্দেশ্যে,

— “আসসালামু আলাইকুম, ভাবী।”
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

আনমনেই জবাবটা এসে গেল মুখে। সন্দিহান চোখে চেয়ে তখনো তিনি লোকটিকেই দেখছিলেন। কণ্ঠস্বর পরিচিত, চেহারাও মনে হচ্ছে আগে দেখেছেন– কিন্তু চিনতে পারছেন না। লোকটা একটু ইতস্তত করলো এবার,

— “আমাকে চিনতে পারছেন না বোধ হয়? আমি কায়সার। কায়সার মাহমুদ!”

‘কায়সার মাহমুদ’! নামটা শুনেই ছোটখাটো একটা চমক লাগলো রাহেলার। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো সামনে দাড়ানো লোকটার সঙ্গে আসল কায়সারের সাদৃশ্য কোথায়! কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে নিরীক্ষণ করতে লাগলো তাকে। রাহেলার নীরবতা দেখে আরো অস্বস্তি হলো কায়সার মাহমুদ নামক লোকটির,

— “ভাবী, রেবু–”

কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই তীব্র গলা ভেসে এলো,

— “কেন এসেছেন?”

রlক্তচক্ষু নিয়ে চেয়ে আছেন রাহেলা খানম। হঠাৎ ক্ষেপা বাঘিনী হয়ে উঠলেন যেন,

— “কেন এসেছেন এখানে? বারো বছর পর এই বাড়িতে আপনার কি দরকার পড়েছে? রেবুর জীবন তো ধ্বংসই করেছেন। ছেলেটাকেও একেবারে শেষ করে দিয়েছেন–”

— “ভাবী, আমার কথাটা শুনুন? আমি কোনো দরকারে আসি নি। আমি শুধু আমার ছেলের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

আকুতি জানালেন কায়সার মাহমুদ। রাহেলার মুখভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হলো না। তেঁতে উঠলেন আরও,

— “ছেলে? কীসের জন্য দেখা করতে এসেছেন তার সঙ্গে? বারো বছর আগে তার সঙ্গে দেখা করেন নি কেন? কেন তাকে আমার বাড়িতে ফেলে গেছিলেন? আর আজই বা এসেছেন?”

ভারী বিপদে পড়লেন তিনি। রাহেলা খানম খুব রেগে গেছেন। রাগের পারদ চড়ছে তুঙ্গে! কিন্তু কায়সার মাহমুদের মনের অবস্থাটা তিনি বুঝতে চাইছেন না। না চাইছেন তার কোনো কথা শুনতে। বলার চেষ্টা করলেন,

— “আমি বুঝতে পারছি আপনারা আমাকে সহজ ভাবে নিতে পারছেন না। আমি সেটা আশাও করছি না। কিন্তু ভাবী, আমি শুধু আমার ছেলের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। শহর ছেড়েছিলাম তো আরও আগেই। শুধু একটুখানি দেখবো কাহনকে, রেবুকে!”

একটু সময় নিলেন রাহেলা খানম। তার কথা শেষ হওয়া মাত্রই সিদ্ধান্ত জানালেন,

— “কোনো দরকার নেই! কাহন, রেবু– দু’ জনেই নিজের মত আছে। আপনার সেসব জানতে বা দেখতে হবে না। আপনি কি মানুষ বলুন তো? চোদ্দ বছরের ছেলে সহ বৌ থাকতে আরেকটা বিয়ে করলেন? বৌ বাপের বাড়ি চলে এলো তো আর খোঁজও নিলেন না? ছিঃ! আপনার জন্য, শুধুমাত্র আপনার জন্য রেবুর আজ এই দশা।”

একটু চমকালেন কায়সার মাহমুদ,

— “রেবেকার কি হয়েছে?”
— “কি আর হবে? মlরে যায় নি, পাগল হয়েছে। তাও শুধু আপনার কারণে! কাহনটা হয়েছে ছন্নছাড়া!”

রেবেকার পাগল হওয়ার খবরটা জানতেন না কায়সার। ভীষণ রকমের চমক খেলেন তাই। অবাক, বিস্মিত হয়ে কিছু বলবেন তার আগেই তেড়ে এলেন রাহেলা খানম,

— “আর এতদিন পর আপনি এসেছেন ঢং দেখাতে? বেরিয়ে যান বলছি এ-বাড়ি থেকে। এখনই বেরিয়ে যান!”

— “ভাবী আমি–”

— “কোনো কথা শুনতে চাই না। আপনি এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে। নইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে—”

আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন কায়সার মাহমুদ। কিন্তু রাহেলা খানমের তোপের মুখে পড়ে বলা আর হলো না। অর্ধচন্দ্র পাবার চেয়ে স্বেচ্ছায় মানসম্মান নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সমীচীন ভাবলেন তিনি। নতমুখে ফিরে গেলেন নিজ ঠিকানায়!
___

সময়ের পালাবদলে তিনটি মাস গড়ালো। হিয়া, কান্তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পার হলো। পরীক্ষায় বেশ মনোযোগীই ছিল হিয়া। যতোই মনোযোগী থাকুক, কাহনকে কিন্তু সে ভুলতে পারে নি একমুহূর্তের জন্য! পরীক্ষা শেষ করে কাহনকে নিজের মনের কথা জানাবে বলে ঠিক করেছে। তাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছে শেষ পরীক্ষার জন্য!

পরীক্ষা শেষ। কিন্তু সেখানেই হয়েছে নতুন সমস্যা। আজকাল কেন-যেন তাকে বাইরে যেতে দেন না মৌসুমি। একটু বেরোতে চাইলেও বলেন,

— “খামোখা বাইরে গিয়ে কি হবে, মা? বাসায় থাকো না!”
ও রাগ করে বলে,
— “বাসায় আর কত থাকবো আমি? ভালো লাগছে না তো!”
— “তাহলে অর্পিদের বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। যাবি? আমি কল দেব তোর খালামণিকে?”

হিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছে,
— “সে যাবো না হয়। কিন্তু এখন বাইরে যাই, না?”
মৌসুমি অজুহাত দেখিয়ে জানান,
— “বাইরে রোদ। এখন গেলে মাইগ্রেনের ব্যথা হবে তো! শুধু শুধু অসুস্থ হয়ে–”

হিয়া বুঝতে পারে কোনো এক বিচিত্র কারণে মৌসুমি চান না ও বাইরে যাক। তিনি চান না মেয়ে আগের মত স্বাধীন হয়ে যা খুশি করুক। ইদানিং মেয়েকে ঘরের কাজ শিখাচ্ছেন। রান্না করার সময় ডাকছেন। এটাওটা দেখাচ্ছেন। বলছেন কি করে কি রাঁধতে হয়। কি করে মাছ কাটে, মাংস রাঁধে। আদব-কায়দা শিখাচ্ছেন। কার সামনে কি করতে হয়। কি করা যায় না সেসব বলছেন। হিয়া ঠিক বুঝতে পারছে না মায়ের এই পরিবর্তনের কারণ। তবে আন্দাজ করতে কষ্ট হচ্ছে না। মা কি তার বিয়ের কথা ভাবছেন?

কাহন চাকরীর খোঁজ নিচ্ছে হন্যে হয়েই। বহুদিন হয়ে গেছে মামার হোটেলে খাওয়ার। এখন নিজের ঠিকানা তৈরি করা উচিৎ। যদিও চেষ্টাটা অনেক আগে থেকেই করছে; তবে এবার খুব আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে। একটা চাকরী পেতেই হবে! শেষ করতে হবে এই বঞ্চনার গল্প!
___

বিদ্যুৎ বিল দিতে ব্যাংকে এসেছিল কাহন। মামার বাড়িতে থাকবার দরুণ বাড়ির নানান কাজ তাকে করতে হয়। বাজার করা, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পেপার বিল দেয়া। তারই একটা অংশ হিসেবে আজ ব্যাংকে এসেছে। আজ অবশ্য ভীড় হয়েছে প্রচুর। ভিড়ে মুখরিত জায়গায় দাড়িয়ে থাকতে অত্যন্ত বিরক্ত লাগছে কাহনের। কিন্তু কিছু করবার নেই। বিল দেয়ার আজ শেষ দিন! আজ না দিলে জরিমানা দিতে হবে। মামী কথাও শুনাবেন সেজন্য খুব!

সুদীর্ঘ লম্বা লাইন পেরিয়ে আড়াই ঘণ্টা পর বিল দিয়ে সে মুক্তি পেল। ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাবার সময় হঠাৎ কে যেন পিছু ডাকলো,

— “কাহন!”

চমকে ফিরে তাকালো কাহন। তাকিয়েই হতবাক, হতবিহ্বল হলো। কায়সার মাহমুদ দাড়িয়ে! অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো একটি শব্দ,

— “আপনি!”
— “আমাকে চিনতে পারছিস না তুই? আমি তোর বাপ!”

লোকটা এগিয়ে এলো হন্তদন্ত হয়ে। হাত ধরে ফেললো চট করে। কাহন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ সংবিৎ ফিরতেই ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিলো নিজের হাত। বললো,

— “Don’t dare to touch me! আমার বাবা মlরে গেছে!”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

[আমি জানি, আমি দেরি করে ফেলেছি। এতো দেরি করা উচিৎ হয় নি। সেজন্য দুঃখিত। আমি আসলেই খুব ব্যস্ত ছিলাম। এখনো গ্রামের বাড়িতে আছি। শহরে ফিরলে তারপর নিয়মিত হবো। 😑]

[আমার প্রথম ই-বই ‘বাতাসে বহিছে প্রেম’ পাওয়া যাচ্ছে বইটই অ্যাপে। পড়তে চাইলে ঝটপট কিনে ফেলুন মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে! লিংক কমেন্টে… ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here