একটু ভালোবাসা,পর্ব_২
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গান গাইতে বলা হলো রিশাদকে। আড্ডায় যেমন রিশাদকে চাই তেমনই গানের বেলাতেও রিশাদকে চাই। গান এবং গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাইকে খেতে ডাকা হলো। একটা বড় টেবিলে বসল রিশাদ, অনিক, মিনা, আশা, প্রিয়ু, মুহিত ও মুহিতের আরো কয়েকজন বন্ধু। খেতে খেতে অনিক মিনার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার বান্ধবী কথা বলতে পারে না?”
“কার কথা বলছেন?” জিজ্ঞেস করে মিনা।
“মাইয়া মানুষ তো চেনো না মামা! যখন চুপ থাকে তখন মনে হয় কী শান্তশিষ্ট! কিন্তু যখন একবার কথা বলা শুরু করবে তখন কান ঝালাপালা করে ফেলবে।” বলে রিশাদ।
রিশাদের কথায় ছেলেরা হেসে ফেললেও মেয়েরা ক্ষেপে যায়। অনিক যে মিনাকে প্রিয়ুর কথাই জিজ্ঞেস করেছিল সেটা প্রিয়ু বুঝেছে। এখন যে রিশাদ কথাটা প্রিয়ুকেই পিঞ্চ মেরে বলেছে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। প্রিয়ু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে রিশাদের দিকে। বলে রাখা ভালো রিশাদের পাশের চেয়ারেই বসেছে প্রিয়ু। তাই প্রিয়ুর তাকানো দৃষ্টি এড়ায় না রিশাদের। রিশাদ প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে নিজের প্লেটটা প্রিয়ুর মুখের সামনে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় প্রিয়ু।
“যেভাবে তাকিয়ে আছেন চোখগুলো তো খুলে বের হয়ে আসবে। নেন প্লেট ধরেছি এবার টুপ করে পড়লেও সমস্যা নেই।” বলে রিশাদ।
প্রিয়ু হেসে ফেলে। হাত দিয়ে রিশাদের প্লেটটা সরিয়ে দেয়। অনিক মুগ্ধ হয়ে দেখে। রিশাদ খাওয়ার সময় আরো হাসির সব গল্প বলে যেগুলো শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার মতো অবস্থা। কখনো বা হাসতে হাসতে আশার গায়ের ওপর পড়ছে। কেউ হাসিয়ে যাচ্ছে। কেউ হাসছে আর কেউ সেটা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। শুধু অনিকই যে মুগ্ধ হয়ে দেখছে তা নয়। রিশাদ বাদে টেবিলে উপস্থিত আরো কয়েকজনের দৃষ্টিও মুগ্ধ নয়নে প্রিয়ুকে দেখছে। আশার ভালো লাগছে প্রিয়ুকে দেখে। রিশাদের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় আশা। আর যাই হোক, প্রিয়ুর হাসির কারণ তো এই মানুষটাই!
আত্মীয়-স্বজন যারা এই বাড়িতেই থাকবে তারা সবাই রুমে চলে গেছে। বাকিরা যে যার বাড়িতে। রাতও হয়ে গেছে অনেক। মিনাদের বাড়ি থেকে প্রিয়ুদের বাড়িতে যেতে ১০ মিনিটের মতো লাগে। শহরের মতো এলাকা নয়। তাই যেখানে সেখানে আলোও নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এত রাতে আশা আর প্রিয়ুকে যেতে দিতে চাননি মিনার মা। কিন্তু বাড়িতে না গেলে মা জানতে পারলে বকবে ভেবে আশা রাজি হয় না। তখন অনিক বলে,
“আমরা এগিয়ে দিয়ে আসছি আন্টি।”
তিনি খুশি হয়ে বলেন,
“হ্যাঁ যাও।”
রিশাদ হাই তুলতে তুলতে বলে,
“তুই তাহলে এগিয়ে দিয়ে আয়। আমি ঘুমাই।”
“ধুর শালা! এত ঘুম ঘুম করিস কেন? চল যাই।”
অগত্যা রিশাদও যায় সঙ্গে। চারজনই চুপচাপ হাঁটছে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। রিশাদের অনেক ঘুম পেয়েছে এটা সত্যি। নয়তো এতক্ষণে কথার বন্যা বয়ে যেত। আশার অস্বস্তি লাগছে। মিনাদের বাড়ির মেহমান হলেও তো তারা অপরিচিত। যদি কেউ দেখে নেয় তো অন্যকিছুও ভাবতে পারে। অর্ধেক রাস্তা আসার পর আশা বলে,
“ঐযে আমাদের বাড়ি। আপনাদের আর কষ্ট করতে হবে না।”
“বাড়ি পর্যন্তই এগিয়ে দেই?” বলে অনিক।
“না, থাক!”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
আশা আর প্রিয়ু যায় বাড়ির পথে। রিশাদ আর অনিক ফিরে আসে। রিশাদের গা ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছে অনিক। বিরক্ত হয়ে রিশাদ বলে,
“এমন গা ঘেঁষে হাঁটছিস কেন?”
“দেখছিস না চারপাশ কেমন অন্ধকার?”
“তো কী?”
“ভূত তো থাকতে পারে।”
রিশাদ শব্দ করে হেসে বলে,
“এতক্ষণ তো খুব ভাব নিয়ে যাচ্ছিলি।”
“তখন তো সাথে মেয়ে ছিল।”
রিশাদ হাসে। তারপর দুজনই চুপ। মৌনতা কাটিয়ে অনিক বলে,
“প্রিয়ুকে তোর কেমন লাগে?”
“কেমন লাগবে?”
“সেটাই তো জিজ্ঞেস করলাম।”
“ভালোই লাগে। কেন বলতো?”
“এমনিই বললাম আরকি!”
“প্রেমে পড়েছিস নাকি?”
অনিক লাজুক হাসে। যদিও অন্ধকারে হাসিটা দেখা যাচ্ছে না। তবে রিশাদ বুঝে নিয়েছে। হাসতে হাসতে রিশাদ বলে,
“এই নিয়ে তো কম মেয়ের প্রেমে পড়লি না। আর কত?”
“কী জানি! হুটহাট ভালো লেগে যায়। কী করব?”
“ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখা।”
“আমি পাগল নাকি?”
“এটা তোর একটা বাজে রোগ।”
বাড়িতে পৌঁছে অনিক সোফায় শুয়ে পড়ে। রিশাদ রুমে যায়। রিশাদ ও অনিককে এক রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে। বিয়ে বাড়িতে সবাই এতটাই ব্যস্ত ছিল যে রুমটাও গোছানো হয়নি। সকালে বিছানা যেমন এলোমেলো ছিল। এখনো তেমনই আছে। রিশাদ শার্টটা খুলে লেপের ভেতর ঢুকে যায়। যত শীত বা গরম যাই হোক না কেন খালি গায়ে না ঘুমালে ঘুম হয় না রিশাদের। অদ্ভুত লাগছে তাই না? কী আর করার! সে যে মানুষটাই অদ্ভুত। বালিশের সাথে মুখ ঘষাঘষি করতে গিয়ে কিছু একটার সাথে ব্যথা লাগে গালে। অন্ধকারে হাতিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কীসের সাথে লেগে ব্যথা পেল। কিছু শক্ত একটা জিনিস হাতে পেয়েছে। ফোনের ফ্লাশ অন করে দেখে চুলের কাটা। কার এটা? এখানে এলো কীভাবে? তখনই রিশাদের মনে হলো এটা প্রিয়ুর। সকালে ঘুমন্ত অবস্থায় ওর চুলেই দেখেছিল।’এটা কি এখানেই রাখব? কেউ এসে দেখলে অন্যকিছুও ভাবতে পারে।’
চুলের কাটা টা রিশাদ শার্টের পকেটে রেখে দেয়। আবার দেখা হলে ফিরিয়ে দেবে।
.
.
আশা ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয়ু গায়ে শাল জড়িয়ে জানালার ধারে বসে আছে। জানালা দিয়ে তিরিতির করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। আশা শীতে লেপের ভেতর গুটিয়ে আছে। প্রিয়ুর শরীরে কাঁপন ধরেছে। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কথা বলছে। সব কথার শেষে প্রিয়ুর একটাই কথা থাকে। ‘কেন ছেড়ে গেলে মা?’ ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসে না। আসবেও না কখনো। প্রিয়ু এটা জানে। খুব ভালো করেই জানে। তবুও অবুঝ মন এই প্রশ্নটিই করবে। সব প্রশ্নের বোধ হয় উত্তর পেতে নেই। বিছানার পাশে ফোন বাজছে। প্রিয়ুর নয়। আশার একটা বাটন ফোন আছে। ওটাতেই কল এসেছে। কে কল দিয়েছে না দেখেই প্রিয়ু আশাকে ডাকে।
“আপু তোমার ফোন আসছে।”
আশার কোনো উত্তর আসে না। সে ঘুমে কাতর। এখন যদি কেউ কোলে করে পুকুরেও ফেলে দিয়ে আসে তাও বুঝতে পারবে না। ফোনটা বেজে চলেছে তো বেজেই চলেছে। কে এত রাতে ফোন দিচ্ছে? বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয় প্রিয়ু। তখনই আবার ফোন আসে। সেভ করা নাম্বার। দুলাভাইর ফোন থেকে কল এসেছে।বড় আপা! ফোনটা যে বড় আপাই করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রিয়ুর খুশিতে কান্না চলে আসে। আজ দুইটা মাস পরে আপা ফোন করেছে। তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে পিংকি বলে,
“আশা প্রিয়ুকে দে।”
প্রিয়ু এবার কেঁদেই ফেলে। খুব সাবধানী স্বরে বলে,
“আপা আমি প্রিয়ু!”
এবার দুপাশেই নিরবতা। দুজনই দু’পাশে কাঁদছে। শব্দহীন কান্না। তবে দুজনই বুঝতে পারছে দুজনের অনুভূতি। কান্নারত কণ্ঠেই পিংকি বলে,
“ভালো আছিস?”
“ভালো আছি। তুমি খুব বাজে আপা খুব! আমায় তুমি ভুলে গেছ।”
“মরে যাব তবুও তোকে ভুলতে পারব না। তুই জানিস না তুই আমার কে? আমার আপন বলতে দুনিয়ায় তুই ছাড়া আর কে আছে বল?”
প্রিয়ু নিঃশব্দে কাঁদে। পিংকি বলে,
“আমার তো ফোনও নেই যে প্রতিদিন ফোন দেবো। তোর দুলাভাই এখন ঘুমে তাই লুকিয়ে ফোন নিয়েছি। প্রতিদিন সুযোগ হলে তোকে লুকিয়ে ফোন দিতাম।”
“দিয়ো না আপা। এভাবে ফোন দিও না। দুলাভাই জান…”
পুরো কথা বলা হয় না প্রিয়ুর। ওপাশ থেকে দুলাভাইর রাগী গলা শোনা যায়। আপাকে ধমক দিয়ে বলছে,
“এত রাতে কার সাথে কথা বলছ?”
আপা কলটা কেটে দেয়। ছোট ফোনটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে প্রিয়ু। কবরটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমায়ও তোমার কাছে নিয়ে যাও মা!”
—————————-
পরেরদিন সকালে প্রিয়ু আর আশাকে নিয়ে মুহিতের বিয়েতে যায় আমিন। যদিও ওর এসব বিয়ে-টিয়ের অনুষ্ঠান ভালো লাগে না। বাবার আদেশ! বাবা-মা বাড়িতে থাকলে আমিনের এসব বিয়ের ঝামেলায় আসা লাগত না। যাওয়ার আগে মনসুর আলী বারবার করে বলে গেছেন ওদের দুজনকে নিয়ে বিয়েতে যেতে। মিনার বাবার সাথে মনসুর আলীর সখ্যতা বহু বছরের। বরযাত্রী হিসেবে ওরা তিনজনই গেল মুহিতের সাথে। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে আমিন নিরিবিলি জায়গায় চলে গেল। নেশা করা দরকার এখন! নয়তো মাথা ঠিক থাকবে না। মিনা সবার সাথে আশা আর প্রিয়ুর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এক ফাঁকে অনিক প্রিয়ুর কাছে আসে।
“কেমন আছো?”
প্রিয়ু একবার তাকায়। মৃদু হেসে বলে,
“ভালো আছি। আপনি?”
“ভালো। তোমায় আজ সুন্দর লাগছে।”
“আপনাকেও।”
অনিক কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলে,
“তোমায় একটা কথা বলব।”
প্রিয়ু তখন রিশাদকে ছাদে দেখতে পায়। অনিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আচ্ছা। একটু পর কথা বলছি আপনার সাথে।”
অনিককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রিয়ু চলে যায়। ছাদে গিয়ে দেখে রিশাদ বোম্বাই মরিচের গাছ থেকে মরিচ ছিঁড়ে পাঞ্জাবির পকেটে পুরছে। প্রিয়ু পা টিপে টিপে রিশাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আস্তে করে বলে,
“কনের বাড়ি এসে মরিচ চুরি করা হচ্ছে বুঝি?”
রিশাদ হকচকিয়ে পেছনে তাকায়। এখানে প্রিয়ুকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তবুও মুখে হাসি রেখে বলে,
“আপনি!”
“কেন আপনি কি অন্য কাউকে আশা করেছিলেন?”
“অন্য কাউকে কী? আমি কাউকেই আশা করিনি। তাছাড়া চুরি করার সময় কি কেউ কাউকে আশা করে বোকা মেয়ে! কে চায় ধরা খেতে?” মনে মনে বলে রিশাদ।
প্রিয়ু বলে,
“ভয় নেই। আমি কাউকে বলব না।”
“ভয়ের কী আছে? আর বললেই বা কী? মরিচই তো নিয়েছি। অন্যকিছু তো না।”
“তাহলে বলে দেবো বলছেন?”
“এইটা কিছু হলো? আমরা হলাম বরযাত্রী। আপনজন আমরা। এভাবে ধরিয়ে দেওয়াটা ঠিক না।”
প্রিয়ু শব্দ করে হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,
“আচ্ছা বলব না।”
“থ্যাঙ্কিউ। চাইলে আপনিও কয়েকটা নিতে পারেন। আমিও কাউকে বলব না।” হেসে বলে রিশাদ।
“না, লাগবে না। আমাদের বাড়িতে বোম্বাই মরিচের গাছ আছে।”
“তাই নাকি? খাওয়াইয়েন তো একদিন।”
“আচ্ছা খাওয়াব।”
“বাই দ্যা ওয়ে, একদিনেই অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছেন।”
“যেমন?”
“কাল ছিলেন একদম শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে। আজ দেখছি আপনি খুব চঞ্চল। এভাবে একটু সহজ-সরল থেকে প্রতিবাদীও হয়ে উঠুন। খুশি হব। এখন যাই হ্যাঁ? নিচে হয়তো অনিক আমায় খুঁজছে।”
কথাগুলো বলে রিশাদ চলে যাওয়া ধরে। পেছন থেকে প্রিয়ু ডাকে।
“শুনুন।”
“হ্যাঁ?”
প্রিয়ু রিশাদের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
“আজ আপনি আমায় যেমন দেখছেন আমি তেমনই ছিলাম। চঞ্চল, হাসিখুশি একটা মেয়ে। যার জীবনে ছিল না কোনো বিষাদের ছায়া। কষ্ট কী যে জানত না! একটা সময়ে প্রকৃতি আমায় স্বচক্ষে দেখিয়ে গেল কষ্ট কাকে বলে! যখন আমার মা মারা যায় তখনই আমি প্রথম উপলব্ধি করি কষ্টকে! বুকের ভেতর সেদিন কী যে হচ্ছিল সেটা আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। ভেঙেচুরে গিয়েছিলাম আমি। মা মারা যাওয়ার ঠিক ছয় মাস পর আব্বা আবার বিয়ে করে আমার এই সৎ মাকে। চোখের পলকে আমার পরিচিত আব্বা পাল্টে যায়। মায়ের কথামতো চলতে শুরু করে। সৎ মা আমার ওপর খুব অত্যাচার করতো। আমার সৎ ভাইও আমায় খুব মারতো। আমি চুপ থাকতাম না। মুখে মুখে তর্ক করতাম। আমার মায়ের সাজানো সংসারে আমি সৎ মাকে মেনে নিতে পারিনি। তখন আমার জেএসএসি এক্সাম চলে। সৎ মা আমায় পরীক্ষা দিতে দেবেন না। আব্বাও মায়ের কথামতো আমার ফর্মফিলাপের টাকা দেবে না জানালো। বাড়ির সবকিছু ভাঙচুর শুরু করি। তখন আমার সৎ মা আমায় অনেক মারে। খুব ব্যথা পাচ্ছিলাম আমি। আমার জেদ হয় প্রচণ্ড। খাটের নিচ থেকে বটি নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে বলি, ‘আর একবার আমার গায়ে হাত তুললে কোপাইয়া মাইরা ফেলব।’ মা আর মারেনি আমায়। হয়তো ঐটুকুন বয়সে আমার এই প্রতিবাদকে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেই নিয়েছিলেন আমি সত্যিই কোপাব!” এতটুকু বলে চাপা হাসে প্রিয়ু। যেই হাসিতে হাজারো কষ্টের বসবাস। রিশাদ চুপচাপ শুনছে। প্রিয়ুর চোখে পানি টলমল করছে। উচ্ছাস নিয়ে প্রিয়ু আবার বলে,
“তারপর কী হলো জানেন? রাতে আব্বা বাড়িতে ফিরে আমার গালে জোরে একটা থাপ্পড় দিলেন। আমি ছোট থাকতে মায়ের কাছে শুনেছিলাম আব্বা কখনো আমার গায়ে হাত তোলেননি। যদি কখনো মা মারতো তাহলে আব্বা খুব বকত। আমরা দু’বোন ছিলাম আব্বার চোখের মণি। তারপর কী হলো শোনেন। একটা থাপ্পড় মেরেই আব্বার রাগ কমেনি। টেবিলের ওপর থেকে আমার স্টিলের স্কেল নিয়ে আমায় মারা শুরু করল। কী যন্ত্রণা! যেখানে যেখানে মার লেগেছিল সে জায়গাই কেটে গেছিল। আব্বা ক্লান্ত হয়ে মার বন্ধ করলেন। আব্বা চলে যাওয়ার পর সৎ মা বলল, ‘আরো আসবি বটি নিয়ে কোপাইতে?’ বিশ্বাস করেন আমার এতটুকুও রাগ তখন সৎ মায়ের ওপর হয়নি। আমি তখনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমার আব্বাকে আমি চেনার চেষ্টা করছিলাম। ওটা কি সত্যিই আমার আব্বা ছিল? আমার আব্বা এভাবে আমায় মারল? কী কষ্ট! শরীরের ব্যথার চেয়েও আব্বার পাল্টে যাওয়ায় আমার ঢের বেশি কষ্ট হচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতেই দেখি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আমার আশা আপু। তখন আশা আপু পড়ত নাইনে।আমি তখনো আশা আপুকে দেখতে পারতাম না। সৎ বোন তো সৎ বোনই! মায়ের মতোই ভাবতাম। ভুল ছিলাম আমি। সেরা মানুষ আমার আশা আপু। দেখি যে দরজার পর্দা ধরে কাঁদছে। আমি ছোট হলেও আমায় ভয় পেত। বদমেজাজি ছিলাম তো! আমি আপুকে ডাকলাম। আপু আমায় অবাক করে দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আমার তখন মনে হলো আমার বড় আপা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমি নিজেও আশা আপুকে জড়িয়ে ধরি। কাউকে জড়িয়ে ধরে কান্নার শান্তি সেদিন অনুভব করি। আপু আমার ব্যথার জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে দেয়। সে রাতে আমার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে। আশা আপু আমার সেবাযত্ন করে। সেদিন থেকেই আশা আপুকে আমি এত ভালোবাসি। এরপর আমার পরীক্ষার ফি আব্বা সত্যি সত্যিই দিল না। তখন মিনার আব্বা স্কুলে গিয়ে আমার ফর্ম ফিলাপ করিয়ে দেয়। সেদিনও আমি খুব কেঁদেছিলাম। মিনার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম।
মা মারা যাওয়ার তিন মাস পরই বড় আপার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর শুধু একবারই বাড়িতে এসেছিল। যখন আব্বা বিয়ে করে তখন। এরপর আর কখনো দুলাভাই আসতে দেয়নি। আমি মাঝেমাঝে যেতাম। আপার শ্বাশুরী আমায় দেখতে পারত না। অনেক কথা শুনাতো আমায়। আব্বাকে নিয়ে বাজে কথা বলত। আপাকে বকত। একদিন আপা আমায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘একটা কথা বলি বোন। রাগ করিস না। তুই আর কখনো এই বাসায় আসিস না।’ আমি সেদিন কিছুই বলিনি। শুধু আপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তারপর আর যাইনি। আমার জেএসএসির রেজাল্ট বের হলো। আপাকে ফোন ব্যবহার করতে দেয় না দুলাভাই। আমি আব্বার ফোন থেকে দুলাভাইকে ফোন দিলাম। রেজাল্টের কথা বলে আপাকে দিতে বললাম। দুলাভাই বলল আপাকে বলে দেবে। খট করে ফোন কেটে দিল। আবার ফোন দিলাম। বলল, বারবার বিরক্ত যেন না করি। তখন ওপাশ থেকে আমি আপার কণ্ঠ শুনেছি। আপা বলছিল, ‘ফোনটা একটু দাও না। কথা বলি। কতদিন কথা বলিনা!’ আপা যে কাঁদছিল আমি সেটাও বুঝেছিলাম। দুলাভাই তবুও কথা বলতে দেয়নি। সেদিনই বুঝে গেছিলাম আপা সুখী হয়নি। শ্বাশুরীর কাছেও নয়, স্বামীর কাছেও নয়। আমার জন্য আপার যেন অশান্তি না হয় তাই আর ফোন দেইনি আমি। আপা লুকিয়ে লুকিয়ে হঠাৎ ফোন দিয়ে এক/দুই মিনিট কথা বলত। কথা বলত বললে ভুল হবে। দুজনই কাঁদতাম! আপাকে দেখি ঠিক তার এক বছর পর। যখন আপার বাবু হয়। হাসপাতালে আপাকে দেখতে যাই। আপার শ্বাশুরী বাবুকে আমার কোলে দেয়নি। সেদিনও আপা কেঁদেছিল। আমি আপাকে বলেছিলাম, ‘কেঁদো না আপা। যখন তোমার ছেলে বড় হবে দেখো ঠিকই ওর খালামনিকে খুঁজে নেবে। তখন আমি ও’কে কোলে নেব।’ আপা কাঁদতে কাঁদতে আমায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল। আব্বা গেছিল হাসপাতালে আপাকে দেখতে। দেখা করেই চলে এসেছে। তার এত সময় নেই আর আমাদের জন্য।”
কথা বলতে বলতে যে গাল বেয়ে পানি পড়ছে সেদিকে খেয়াল নেই প্রিয়ুর। একটু থেমে আবার বলে,
“কালও আপা ফোন দিয়েছিল লুকিয়ে। দুলাভাই জেগে গেছিল। আমি জানি আপাকে কাল দুলাভাই মেরেছে। এমনটাই হয়।
আপনি কাল বললেন, প্রতিবাদ না করতে পারলেও যেন জবাব দেই। আপনি কি আমার জায়গায় নিজেকে একবারও দাঁড় করিয়ে এসব ভেবেছেন? যেদিন চোখের সামনে আব্বাকে বদলে যেতে দেখলাম সেদিন থেকেই আমি প্রতিবাদ করা বাদ দিয়েছি। আমার যে শক্ত খুঁটি নেই! যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি আপা সুখে নেই সেদিন থেকেই জবাব দেওয়া বন্ধ করেছি। মানুষ জবাব বা প্রতিবাদ তখনই করতে পারে যখন তার নিজের কেউ থাকে। আমার কেউ নেই! আমার নিজের একটা মানুষ নেই। সাহস জুগিয়ে দেওয়ার মতো ভরসার একটি হাত নেই। জীবন এত সহজ নয়। যতটা আমরা ভাবি। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে কখনোই অন্য কারো পরিস্থিতি, অনুভূতি উপলব্ধি করা যায় না। এই যা! কেঁদে ফেলেছি আমি।”
দু হাতে চোখের পানি মুছে প্রিয়ু। বলে,
“এতগুলো কথা আমি আপনাকে কেন বললাম আমি জানি না। মন বলল বলেই হয়তো বললাম। আবার হতে পারে আপনাকে চিনিনা বলেই! কেন বললাম এর উত্তর খুঁজিনি। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেই। আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। আপনাকে দেখেই ছাদে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম অল্পকিছু কথা বলব। কিন্তু দেখুন কতকিছু বলে ফেললাম!”
রিশাদ নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিই কি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যের অনুভূতি উপলব্ধি করা যায় না?চোখের কোণে বোধ হয় পানি চিকচিক করছে। রিশাদ নিজেই সেটা বুঝতে পারছে। প্রিয়ু দেখেনি তো আবার!
চোখের পানি মুছে প্রিয়ু।ভালো করে চোখ মুছতেই প্রিয়ু দেখতে পায় চিলেকোঠার ঘরের সামনে আমিন দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে…