একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি,24,25,26

0
788

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি,24,25,26
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৪

‘ এতো অভিমান আমার প্রতি যে ফিরেও তাকাবে নাহ!’
আরাফের করুন কন্ঠস্বরটি কানে এসে পৌছালো হিয়ার।কিন্তু হিয়া এতে কোন হেলদোল করলো নাহ।হিয়া আনমনে পরিষ্কার আকাশে মেঘেদের লুকোচুরি দেখতে ব্যস্ত।আরাফ এগিয়ে আসলো হিয়ার কাছে।কন্ঠটা আরো করুন করে বললো,
‘ এইভাবে মুখ ফিরিয়ে রেখো না হিয়া।কষ্ট হচ্ছে আমার।’
হিয়া তবুও কিছু বললো নাহ।কষ্ট পাচ্ছে পেতে থাকুক।হিয়াকে যে কষ্ট দিলো এতোদিন তার বেলায় কি?এইযে পিছনে দাড়ানো লোকটা কি জানে নাহ?হিয়া লোকটাকে ভালোবাসে?বুঝে না সে?সব বুঝে শুধু বুঝেও না বুঝার ভান ধরে আছে।হিয়া কথা বলবে নাহ। কেন বলবে?এতোদিন তো হিয়ার সাথে কথা না বলে দিব্যি ভালো ছিলো। তাহলে এখন কেন এতো আদিক্ষ্যেতা দেখাতে আসছে?মানছে তার ভাই আর ভাবির জন্যেই সে ব্যস্ত ছিলো।কিন্তু এক।টা মেসেজ তো করতে পারতো ওকে।এতো কিসের ব্যস্ততা লোকটার?যে ওকে ভুলেই গিয়েছিলো।হিয়া ফোন করেছিলো সেটাও রিসিভ করেনি।কেন বলবে হিয়া কথা?একটুও কথা বলবে নাহ।হঠাৎ ভাবনার মাঝে আরাফ হেঁচকা টানে হিয়াকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।হিয়ার চোখজোড়া ভরে আসে।কতোদিন ঠিক কতোদিন পর প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য পেলো ও।তার গায়ের ঘ্রানে নিজের মাখামাখি হলো।হিয়া ফুৃফিয়ে কেঁদে উঠলো।আরাফের বুকটা ধ্বক করে উঠে। হিয়াকে নিজের সাথে আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘ কাঁদেনা প্লিজ।আমি অনেকগুলো সরি হিয়া।আর কখনো এমন করবো নাহ। কাঁদেনাহ!’
হিয়া শব্দ করে এইবার কেঁদে উঠলো।নিজেকে আরাফের থেকে ছাড়ানোর জন্যে প্রানপন চেষ্টা করতে লাগলো।কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ ছাড়ুন আমায়! আমাকে একদম ধরবেন না।একদম নাহ।এতোদিন তো ভালোই ছিলেন।তাহলে কেন এসেছেন?চলে যান।আমার কাছে একদম আসবেন নাহ!’
হিয়া এইভাবে ধস্তাধস্তি করায় আরাফের গায়ে অনেকি জায়গায় খামছি লেগে গিয়েছে।তাও আরাফ কিছু বললো না।হিয়াকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে নাহ। আরাফ এইবার হিয়ার দুগালে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরলো তারপর হিয়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।হিয়া আকস্মিক আক্রমনে পুরো জমে গিয়েছে।হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে ওর। নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দিতেই আরাফ হিয়াকে আগলে নেয় নিজের সাথে। আরেকটু ঘনিষ্টতম হয় দুজন।হিয়ার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।কিছুক্ষন বাদ সরে আসে আরাফ।হিয়া এখনো চোখ বুঝে আছে।ঘনঘন শ্বাস ফেলছে।আরাফ হিয়ার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
‘ ভালোবাসো আমায়।কেন স্বিকার করছো নাহ!’
হিয়া ক্রোদন কন্ঠে বলে,
‘ আমি কাউকে ভালোবাসি নাহ!’
‘ ভালোবাসো!’
‘ ভালোবাসি নাহ!’
‘ বাসো! ‘
‘ বাসি না।’
‘ ভালোবাসি নাহ!’
‘ ভালোবাসি!’
হিয়া চট করে চোখ মেকে তাকালো।অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়ায় একআকাশসম অভিমান আরাফের প্রতি তা আরাফ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।হিয়া আরাফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।লোকটা জঘন্য খারাপ কিভাবে ট্রিক্স খাটিয়ে ওকে দিয়ে ভালোবাসি বলিয়ে নিলো।তার ভালোবাসি বলতে এতো সমস্যা কিসের?কেন এতো ভণিতা করছে সে।কিসের এতো অপেক্ষা তার?হিয়ার রাগ হলো প্রচুর রাগ।রাগী কন্ঠে বলে,
‘ খারাপ লোক।আমার আশেপাশেও যেন আপনাকে না দেখি।আমার থেকে দূরে থাকবেন।একদম আমার কাছে ঘেসবার চেষ্টা করবেন নাহ।নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে। অসহ্য!’
হিয়া ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো। এদিকে আরাফ অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
‘ শশুড়ের মেয়ের বহুত রাগ।এই রাগ সামলে উঠবো আমি কিভাবে উপরওয়ালা ভালো জানেন।তার অভিমান ভাঙ্গাতে আমার অনেক কাঠখোর পোড়াতে হবে।যাক আরাফ একটু কষ্ট তো কর‍তেই হবে প্রেমে যেহেতু পরেছিস।চল কাজে লেগে পর।’
আরাফ নিজেও নিচে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো।
~~
আজানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে অর্থ’র। চোখ মেলে তাকাতেই সবার আগে চোখ যায় নিজের বাহুতে ঘুমানো ঘুমন্ত প্রাহির দিকে।মেয়েটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় আস্তো এক মায়ার রাজ্য মনে হয়।এতো মায়াময়ী কেন মেয়েটা? অর্থ’র মন চায় নিজের বুকের মাঝে ভরে রাখতে মেয়েটাকে। পুতুল বউ ওর।যাকে দেখলে শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে অর্থ’র।অর্থ ঝুকে গিয়ে প্রাহির কপালে চুমু খেলো।পর পর প্রাহির দুগালেও চুমু দিলো।ঘুমের মধ্যে এরকম আজব ফিলিংস হতেই চোখ মেলে তাকায় প্রাহি।অর্থকে এইভাবে নিজের দিকে ঝুকে থাকতে দেখে ভড়কে যায় প্রাহি।কিছু বলার জন্যে মুখ খুলবে তার আগেই অর্থ প্রাহির ঠোঁটে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে নেয়।প্রাহি হা করে তাকিয়ে আছে অর্থ’র দিকে।লোকটার কি হলো?হঠাৎ এমন ব্যবহার করছে কেন?প্রাহি কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,
‘ আপনি ঠিক আছেন?কি হয়েছে আপনার এমন করছেন কেন?’
অর্থ হাসলো।প্রাহির মাথা ঝিম ধরে গেলো।লোকটা হাসলে এতো সুন্দর লাগে দেখতে।যে প্রাহির মন চায় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে।এইযে প্রাহির হার্ডবিট ফাস্ট হয়ে গিয়েছে।শরীরের প্রতিটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছে।প্রাহির এমন মুগ্ধকর দৃষ্টি নিজের উপর নিবদ্ধ দেখে প্রান জুড়িয়ে গেলো অর্থ’র।প্রাহির গালে আলতো স্পর্শ করলো।প্রাহি আবেশে চোখ বুজে নিয়ে আবারও খুলে তাকালো অর্থ’র দিকে।অর্থ মোলায়েম কন্ঠে বলে,
‘ এইভাবে তাকাবে না প্রাহি।তোমার এমন দৃষ্টিতে যে আমার হৃদয়টা ধমকে যায়!’
প্রাহি ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,
‘ কি করবো বলেন?আপনি এতো সুন্দর করে হাসেন কেন?আমার বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়।মাথা ঝিম ধরে যায়।আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।’
অর্থ প্রাহির কানের কাছে মুখ নিলো।প্রাহির ওর বামহাত দিয়ে অর্থ’র ঘাড়ে হাত রাখে।অর্থ প্রাহির গলায় মুখ ডুবিয়ে ছোট ছোট ভালোবাসার আবেশে ভড়িয়ে দেয়।প্রাহি পা দিয়ে বিছানার চাদর আকড়ে ধরে।লোকটা কি করছে মেরে ফেলবে প্রাহিকে?এ কেমন অসহ্য সুখ দিচ্ছে লোকটা।প্রাহি অর্থ’র চুল খামছে ধরে।কিয়ৎক্ষন বাদে সরে আসে অর্থ।প্রাহি বন্ধ চোখজোড়ায় সময় নিয়ে দুটো চুমু দেয়।প্রাহি সিক্ত চোখজোড়া মেলে তাকায় অর্থ’র দিকে।অর্থ নরম কন্ঠে বলে,
‘ তোমাকে দেখলেই আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় প্রাহি।নিজেকে তখন নিয়ন্ত্রন করা অনেক কষ্ট সাধ্য হয়ে যায়।আমার ভীতরটা অস্থিরতায় ছেঁয়ে যায়।এই দুরত্ব আর কতদিন প্রাহি?তুমি কি আমায় স্বামি হিসেবে একটুও মানতে পারছো না?আমি কি তোমার উপর খুব জোড় করে ফেলছি?’
প্রাহির বুকটা অর্থ’র কথায় ছ্যাত করে উঠে।প্রাহি কি কোনভাবে অর্থকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছে?আসলেই তো আর কতো অপেক্ষা করবে লোকটা?দুটোমাস তো আর কম না।লোকটা ওর স্বামি।নিজের স্বামিকে তার হক থেকে প্রাহি বঞ্চিত করে ফেলেছে।অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছে।কি করবে প্রাহি?কিভাবে বুঝাবে লোকটাকে।যে প্রাহির কেমন লাগে।প্রাহি অস্থির হয়ে উঠে।অর্থকে সে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভাবতেই নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে।প্রাহি অস্থিরভাবে নড়ে উঠতে নিতেই ডানহাতটা গিয়ে বাড়ি খায় বিছানার সাথে এটাচ্ড টি-টেবিলটার সাথে।সাথে যাথে তীব্র যন্ত্রনায় বিকট আর্তনাদ করে উঠে। অর্থ লাফ দিয়ে উঠে বসে।প্রাহিকে দুহাতে নিজের বুকে টেনে নেয়।প্রাহির প্রায় শব্দ করেই কাঁদছে।একেতো মনের ব্যাথা তার উপর ও প্রচুর জোড়ে বারি খেয়েছে হাতে।হাতটা ব্যাথা এখনো টনটন করছে।অর্থ প্রাহিকে বুকে নিয়েই কাঁপা গলায় বলে,
‘ আমি সরি।আমার কারনেই এমন হলো।সব আমার দোষ।আমার কারনেই তুমি এতো কষ্ট পাচ্ছো।দেখি কাঁদে না।আমি ডাক্তার কে ফোন করে আসতে বলছি। নড়ে না প্লিজ।’
এদিকে প্রাহির এমন আর্ত্মনাদ শুনে বাড়ির সকলে ওদের রুমের সামনে এসে ভীর জমিয়েছে।হেমন্ত অস্থির কন্ঠে ডেকে উঠলো,
‘ ভাইয়া প্লিজ দরজা খুলো।কি হলো প্রাহির?ও এমন চিৎকার করলো কেন ভাইয়া?’
রায়হানা বেগম বলছেন,
‘ আব্বা! দরজাটা খুলো আব্বা।আমাদের টেন্সন হচ্ছে।আব্বা!’
বাহিরে এমন চেঁচামেচি শুনে অর্থ হালকা ধমকে উঠলো,
‘ চুপ থাকো তোমরা।খুলছি আমি।প্রাহি ব্যাথা পেয়েছে ওকে একটু ভালোভাবে সুইয়ে দিয়ে আসি।’
অর্থ’র ধমকে সবাই চুপ হয়ে গেলো।অর্থ এইবার প্রাহিকে সুইয়ে দিলো।ওর ডানহাতটা আলতোভাবে উঠিয়ে হাতের নিচে বালিশ দিয়ে দিলো।যাতে ব্যাথাটা কম লাগে।প্রাহি ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু প্রচন্ড ব্যাথায় যেন ওর নিশ্বাসটাও আটকে আসছে।ঘা’টা এখনো পুরো তাজা।অর্থ ছলছল চোখে তাকালো।ধরা গলায় বলে,
‘ কাদেঁনা।আমি সব ঠিক করে দিবো।একটু সহ্য করে নেও।’
অর্থ প্রাহির কপালে চুমু খেয়ে উঠে চলে গেলো দরজা খুলতে।তখনই হুরমুরিয়ে বাড়ির সবাই ঘরে প্রবেশ করলো।রায়হানা বেগম তো প্রাহির এই অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন,
‘ ও আম্মা! মা আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে।ও আব্বা হাতের ব্যান্ডেজটা তো ভিজে গিয়েছে রক্তে।কেমনে হলো এইগুলো।’
হেমন্ত এসে রায়হানা বেগমকে সোফায় বসিয়ে দিলো,
‘ বড়মা কাঁদেনা।আমরা আছি তো।কিছু হবে নাহ!’
মায়ের মন কি আর মানে? রায়হানা বেগম কেঁদেই যাচ্ছে।অর্থকে এটা সবাই এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে কিন্তু অর্থ কারো কোন কথার জবাব দিলো না।শুধু শান্ত স্বরে বললো,
‘ হেমন্ত ডাক্তারকে আসতে বল।জলদি!’
ভাইয়ের কথা শুনে হিয়া এগিয়ে এসে বলে,
‘ ভাইয়া লাগবে না।আমি পারবো ভাবির ব্যান্ডেজটা করে দিতে।এটুকু আমি পারবো বিশ্বাস রাখো।’
অর্থ বোনের মাথায় হাত রেখে বলে,
‘ হুম! যা করার কর।বাট প্লিজ ওর যেন একটু কষ্ট না হয়।’
হিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।একটু তো যন্ত্রনা হবেই। হিয়া কিছু বললো না।ওর রুম থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার বক্সটা এনে।প্রাহির হাতের পুরনো ব্যান্ডেজটা খুলতে শুরু করলো।প্রাহির ব্যাথায় যেন দম আটকে গেলো।চিৎকার করে কেঁদে উঠে প্রাহি।
‘ হিয়া আস্তে প্লিজ হিয়া।আমার দম আটকে আসছে ব্যাথায়!’
অর্থ দ্রুত প্রাহির কাছে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলো।প্রাহি অর্থ’র বুকে মুখ গুজে দিয়ে কেঁদে উঠলো।হিয়ার চোখেও পানি।ও বললো,
‘ ভাইয়া ভাবিকে একটু সামলে রেখো।একটু কষ্ট তো হবেই ভাইয়া।ঘা’টা এখনো তাজা।তার উপর এইভাবে ব্যাথা পেয়েছে।কষ্ট তো হবেই ভাইয়া।’
অর্থ মাথা নাড়ালো।প্রাহি ব্যাথায় থেকে থেকে আর্তনাদ করে যাচ্ছে।সেই আর্তনাদে অর্থ’র হৃদপিন্ডকে ক্ষতবিক্ষত হলো বাজেভাবে।অবশেষে অনেকক্ষন পর ব্যান্ডেজ সম্পন্ন হলো।প্রাহির শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে।ঘামে পুরো শরীর ভিজে গিয়েছে।অর্থ প্রাহিকে বুকে নিয়েই হেলান দিয়ে বসলো। চোখ বুজে বললো,
‘ মা প্রাহি দুপুরে কিছু খায়নি।তুমি খাবার পাঠাও রুমে।আর হিয়া তুই একটু কষ্ট করে ওয়াশরুম থেকে একমগ পানি,একটা রুমাল আর আলমারি থেকে প্রাহির জন্যে একসুট জামা বের করে দে।’
হিয়া মাথা নাড়িয়ে উঠে চলে গেলো।সবাই একে একে রুম থেকে বের হয়ে আসলো। সবাই বেড়িয়ে যেতে অর্থ প্রাহির নিস্তেজ শরীরটা বালিশে সুইয়ে দিলো।তারপর উঠে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে প্রাহির জামা খুলে ওর শরীর মুছে দিলো।তারপর নতুন জামা পরিয়ে দিলো।প্রাহি নিভু নিভু চোখে দেখছে অর্থকে।ওর চোখ দিয়ে আবারও জল গড়িয়ে পরলো।অর্থ তা যত্নসহকারে মুছে দিলো।
‘ একদম কাঁদবে নাহ।আমার কষ্ট হচ্ছে প্রাহি!’
প্রাহি দূর্বলভাবে মাথা দুলালো।কিছুক্ষন পর রায়হানা বেগম খাবার পাঠাতেই অর্থ প্রাহিকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলো অবশ্য খাওয়ার ইচ্ছে নিলো না।প্রাহি জোড় করায় খেয়েছে।খাওয়া শেষ হতে দেরি।প্রাহিকে বুকে জড়িয়ে নিতে অর্থ’র দেরি হয়নি।বুকটা এখনো ধরাস ধরাস করছে।এই মেয়েটার কিছু হলে অর্থ নিজেকে সামলাতে পারবে না একটুও।একটুও পারবে নাহ।

#চলবে________

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৫
নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হাটছে ইশি।গন্তব্যে এখন শিকদার উদ্দেশ্যে।মনটা বিষাক্ত হয়ে আছে ওর।পারছে না চিৎকার করে কাঁদতে।জীবনটা কেন এমন দূর্বিষহ ওর?কেন এতোটা নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে হয় ক্ষনে ক্ষনে।কেন একটা নরমাল ফ্যামিলির মতো জীবনটা উপভোগ করতে পারে না ও।ইশির দু চোখ বেয়ে টসটসে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।তা সন্তর্পনে মুছে নিলো ইশি।শিকদার বাড়ি এসে পরেছে।মনটা ভালো নেই।সেই উদ্দেশ্যেই এখানে আসা প্রাহি আর হেমন্ত কেউ ওর ফোন রিসিভ করছে না।ভার্সিটিতেও আসিনি ওরা।তাই সোজা এখানে দুজনের সাথে দেখা করার জন্যে চলে এসেছে।ইশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিংবেলে দুবার চাপ দিলো।কিয়ৎক্ষন বাদে দরজা খুলে দিলো বাড়ির একজন সার্ভেন্ট।ওপাশ থেকে হেমন্ত’র কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
‘ কে এসেছে?’
‘ আমি হেমন্ত!’ ইশির ধীর জবাব।
হেমন্ত শীতল দৃষ্টিতে তাকালো ইশির দিকে।আজ সারাদিনে মেয়েটার সাথে একটুও কথা হয়নি।মনটা কেমন ছটফট করছিলো।ভেবেছিলো সন্ধ্যার পরেই ইশির সাথে দেখা করার জন্যে বেরোবে।কিন্তু এখন দেখি না চাইতেও চাঁদ হাতে পেয়ে গিয়েছে হেমন্ত।হেনা বেগম ইশির কন্ঠস্বর শুনেই গলা উচিঁয়ে ডাকলেন,
‘ ইশি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?এখানে আসো!’
ইশি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।কিন্তু ড্রয়িংরুমে সোফায় বসা সবার কাছাকাছি আসতেই ও থমকে গেলো।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রাহির দিকে।ওর থমকানো দৃষ্টিতে এক আকাশসম বিষ্ময়।সেই সাথে ওর হাত-পা থরথর করে কাঁপছে।অর্থ’র কাধে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকা প্রাহির দিকে তাকিয়ে আছে ও এলোমেলো চাহনী।হেমন্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দ্রুত এগিয়ে গেলো ইশির দিকে।অসহায় কন্ঠে বলে,
‘ ইশি হাইপার হবি না একদম।আমি তোকে সবটা বলছি।প্লিজ এরকম করিস নাহ।’
হেমন্ত ইশির হাত ধরতে নিতেই ইশি ছিটকে সরে গেলো।অর্থ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।ও জানে প্রাহি,ইশি আর হেমন্ত কতোটা আপন একে-অপরের জন্যে। একজনের কিছু হলে অপরজনের কলিজা ফেটে যায় তা খুব ভালোভাবে জানে।তবে আপাততো ইশিকে বুঝাতে হবে।অর্থ বলে উঠে,
‘ ইশি দেখো হেমন্ত আর আমাদের সবাইকে বলার সুযোগ দেও একটু ওকে।’
ইশি ঢোক গিললো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
‘ কিভাবে হলো ওর এরকম?’
হেমন্ত অসহায়ভাবে একে একে সবটা বললো ইশিকে।ইশি সবটা শুনে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো প্রাহির দিকে।ডাকলো,
‘ এই প্রাহি! উঠ।তাকা আমার দিকে।আমার কথা শোন।তাকা!’
ঘরে ভালো লাগছিলো না দেখে অর্থ’র সাথে জিদ করে ড্রয়িংরুমে আসে প্রাহি।কিন্তু ঔষুধের করা ডোজে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলো ওর খেয়ালই ছিলো না।ইশির অনবরত ডাকে চোখ মেলে তাকায় প্রাহি। ইশিকে ওর সম্মুখে দেখে।চট করে চোখজোড়া স্বাভাবিকভাবে মেলে তাকায় প্রাহি।ওর দৃষ্টিতে ভয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ইশি ভাঙ্গা গলায় বলে,
‘ আমি কি তোদের এতোটাই পর যে তোর সাথে এতো বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেলো আমাকে একবার ইনফোর্ম করার সুযোগ দিলি নাহ?আমি কি তোদের আপন কোনদিন হতে পারিনি?’
প্রাহির বুকটা ধ্বক করে উঠলো ইশির কন্ঠস্বর শুনে।প্রাহি অস্থির কন্ঠে বলে,
‘ ইশি আমি জানাতাম তোকে। এমন হয়ে যাবে ভাবিনি আকস্মিক এসব হওয়ায় তোকে জানানোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। তুই প্লিজ এইভাবে কথাগুলো বলিস নাহ!’
ইশির চোখ ভরে উঠলো।গাল গড়িয়ে পরতে লাগলো কষ্টের জলগুলো।ইশি তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বলে,
‘ আমি তোদের কাছে কোন ইম্পোর্টেন্ট ব্যাক্তি না যে আমাকে তোরা কিছু জানাবি।ইম্পোর্টেন্ট হলে অবশ্যই আমাকে এইসব জানাতি।আমাকে তোরা তোদের জীবনে কিছুই মনে করিস না।আজ ফোন দিতে ভুলে গেছিস।দু’দিন পর পুরো এই আমিটাকেই তোরা ভুলে যাবি। মিছে মায়া সৃষ্টি করে আর কি লাভ বল?তোরা মুখেই বলে দে আমাকে তোরা আর চাস না।এখানেই নাহয় আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে।’
হেমন্ত আর প্রাহির ইশির প্রতিটা কথায় হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ওদের। হেমন্ত ইশির দুহাত ওর হাতে নিয়ে বলে,
‘ দেখ ইশি পরিস্থিতি ওরকম ছিলো না…..!’
ইশি একঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ আরে কিসের কি পরিস্থিতি?হ্যা! প্রাহি অসুস্থ মানলাম।কিন্তু তুই?তুই কি একটাবার একমিনিটের জন্যে আমাকে ফোন দিয়ে এসব জানাতে পারলি নাহ?পরিস্থিতির কথা বলছিস আমাকে?’
একটু থেমে আবার তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,
‘ হাহ্ যারা আমাকে আপনই ভাবে না তাদের কাছে এসেছিলাম আমি আমার দুঃখগুলো সেয়ার করতে।এই জীবনে বোধহয় উপরওয়ালা আমার কপালে সুখ লিখেনি।না লিখেছে আপন বলতে কোন মানুষ।তোদের আপন ভেবেছিলাম কিন্তু তোরা তো আমাকে দু পয়সারও দাম দিলি নাহ।জীবনটা আমার এমন কেন বানালো আল্লাহ্! আত্মহত্যা পাপ না হলে তো কবেই এই নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দিতাম।কেন মা’র সাথে সাথে আমাকেও নিয়ে গেলেন নাহ আল্লাহ্! ‘
প্রাহি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ এইভাবে বলিস না ইশি!’
ইশি দুহাতে চোখের জল মুছে নিলো।জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বলে,
‘ আমি তোদের উপর রেগে নেই যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।আর হ্যা কাল আমার এংগেজমেন্ট তোদের সবার দাওয়াত রইলো।পরিবার নিয়ে চলে আসিস।বাবা এদিক দিয়ে ভালোই করেছেন জলদি বিয়ে সাদি করে অনেক দূরে চলে যেতে পারবো তোদের থেকে।তোরা ভালো থাকিস।আসি!’
ইশি দৌড়ে চলে গেলো।এদিকে ইশি আর প্রাহি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ইশির প্রতিটা কথা শুনে।কি বলে গেলো ইশি এই মাত্র?ওর এংগেজমেন্ট তাও কাল?কিন্তু কিভাবে কি?কিসের দুঃখের কথা বলতে এসেছিলো ইশি?তবে কি ওর বাবা ওকে জোড়-জবরদস্তি বিয়ে দিচ্ছেন?মেয়েটা অনেক আঘাত পেয়েছে।অজান্তেই ওরা আজ ইশিকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।এমনিতেই মেয়েটা ছোট থেকে কষ্ট পেতে পেতে বড় হয়েছে।আর আজ ওদের থেকে এতোবড় একটা কষ্ট পেলো।মেয়েটা সহ্য করতে না পেরেই এইভাবে আজ কথাগুলো বলেছে।প্রাহি বামহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো।অর্থ প্রাহির মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে,
‘ কাঁদে না।সব ঠিক হয়ে যাবে।ইশি এখন একটু বেশি কষ্ট পেয়েছে।তাই এইভাবে কথাগুলো বলেছে।একটু পর ও নিজেই সব বুঝতে পেরে ও নিজেই আসবে তোমার কাছে দেখো! আর হেমন্তকে আমি পাঠাচ্ছি ওকে আনতে।তুমি কেঁদোনা।’
প্রাহি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ মেয়েটা এইভাবে কোনদিন আমাদের সাথে কথা বলেনি।আজ ও আমার আর হেমন্ত’র থেকে অনেক বড় একটা আঘাত পেয়েছে আমার আর হেমন্ত’র ওকে সবটা জানানো উচিত ছিলো।ও আমাদের দুজনকেই ওর সবচেয়ে আপন মানে।কিন্তু আমরা তা ধরে রাখতে পারলাম।আমরা বন্ধু নামে কলংক।’
হঠাৎ চট করে মাথা তুলে প্রাহি তাকালো হেমন্ত’র দিকে।হেমন্ত এখনো বিষ্ময় নিয়ে সেইভাবেই দাঁড়িয়ে।প্রাহি চিৎকার দিয়ে বললো,
‘ হেমন্ত হুশে আয়! ইশি কি বলে গেলো শুনিস নি?ওর কাল এংগেজমেন্ট।তুই না ওকে ভালোবাসিস?তাহলে যা ওকে আটকা।ইশিকে নিজের মনের কথা বলে দে হেমন্ত।এইটাই সুযোগ।ভালোবাসা একবার হারিয়ে গেলে কিন্তু আর পাবি নাহ।’
হেমন্ত চোখ বড়বড় করে প্রাহির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ ওর এংগেজমেন্টের খবর দিতে এসেছিলো ও? ও ইচ্ছে করে এটা করছে না আমি জানি।ওর বাবা ওকে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছেন।আমি এটা হতে দিবো না প্রাহি।’
‘ হ্যা! যা হেমন্ত আটকা ওকে।’
হেমন্ত বেড়িয়ে যেতে নিয়েও থেমে গেলো।দৌড়ে বাড়ির সকলের কাছে এলো।এতোক্ষন সবাই নীরব দর্শক হয়ে দেখছিলেন সবটা। বাচ্চাদের ব্যাপার তাই তারা কিছু বলেনি। কি আর বলবে?বন্ধুদের ব্যাপার তারাই মিট-মাট করে নিবে।এখানে তো তাদের কথা বলার কোন দরকার নেই।হেমন্ত সবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ মা,বড়মা,বাবা,বড় বাবা,হিয়া,ভাই তোমাদের কি কারো কোন সমস্যা আছে ইশিকে এই বাড়ির ছোট পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে?’
সবাই তো আগেই বুঝে গিয়েছিলেন প্রাহির কথায়।তাই সবাই জানালো তাদের কোন সমস্যা নেই ইশিকে এই বাড়ির ছোট বউ হিসেবে গ্রহন কর‍তে।হেমন্ত প্রাপ্তির হাসি দিয়ে বলে,
‘ তাহলে সবাই তৈরি হয়ে নেও।আমি আজ এক্ষুনি গিয়ে ইশিকে বিয়ে করে নিয়ে আসবো।তোমরা বউ বরন করার জন্যে প্রস্তুতি হেও।’
আরাফকে উদ্দেশ্য করে হেমন্ত আবার বলে,
‘ আরাফ ভাই।অর্থ ভাইয়া তো যেতে পারবে না প্রাহিকে রেখে।তুমি এক কাজ করো তুমি হিয়া,বাবা,মা, বড় মা,আর বড় বাবাকে নিয়ে কাজি অফিসে চলে যাও।আমি সেখানেই ইশিকে নিয়ে আসছি।সব কিছুর দায়িত্ব তোমাকে দিলাম।’
আরাফ মুচঁকি হেসে সম্মতি দিতেই হেমন্ত দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির বাহিরে এখন সমস্যা একটাই যে করে হোক ইশিকে মানাতে হবে।তারপর ওর এতোদিনের আশা ইশিকে ও আজ বিয়ে করবে।যেভাবেই হোক আজ বিয়ে করেই ছাড়বে।ইশির হিটলার বাপকে যদি হেমন্ত সায়েস্তা না করতে পারে তবে হেমন্ত ওর নিজের নাম পাল্টে রাখবে।ব্যাটার কতোবড় সাহস ওর ইশিকে অন্যকারো গলায় ঝুলানোর ফন্দি আটছিলো।এসব করার জন্যে উনাকে হারে হারে পস্তাতে হবে।

#চলবে___________

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৬
‘ মাফ করবো না কিছুতেই মাফ করবো না।কি করে পারলো ওরা এমন করতে আমার সাথে।ওই হেমন্ত’র বাচ্চাকে তো পঁচা পুকুরের পানি চুবাবো আমি।কুত্তা কোথাকার।’ বিরবির করে ইচ্ছে মতো বকছে ইশি,প্রাহি আর হেমন্ত’কে।আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পরা চোখের জলগুলো দুহাতে বারবার মুছে নিচ্ছে।তাও যেন কান্না থামছে না।ইশি হাটার মাঝেই ওর সামনে একটা বাইক এসে জোড়ে ব্রেক মারতেই ইশি ভয় পেয়ে দু-পা পিছিয়ে যায়।সাথে সাথে বুকে থু থু দেয় ইশি।জানটা বের হয়ে যেতো আরেকটু হলে।ইশি বাইকের দিকে তাকায়।তাকাতেই রাগ যেন সাত আসমানে উঠে গিয়েছে ওর।এটা তো হেমন্ত’র বাইক।এই ছেলে এখনো ঠিক হলো না।কিভাবে বাইক চালায়।যদি কিছু হয়ে যেতো।ইশি তেড়ে গিয়ে হেমন্ত’কে বাইক থেকে ওর কলার ধরে নামায়।হেমন্ত মাথার হেলমেট কোন রকম খুলে কিছু বলতে নিবে।তার আগেই ইশি ধুমধাম করে ওর পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো।ব্যাথায় চোখ উলটে নিয়েছে হেমন্ত।দ্রুত সরে আসে ইশির থেকে।ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে,
‘ মেরে ফেলার প্লান করেছিস?কি খাস তুই মুটকি?এতো শক্তি কোথা থেকে পেলি?মাগো আমার পিটটা শেষ।হাত না যেন হাতুরি!’
ইশি আবারো রাগে ফুসতে ফুসতে এগিয়ে যেতে নিতেই হেমন্ত ভয়ে দ্রুত সরে যায়।ইশি রাগী গলায় বলে,
‘ আমার সামনে আয় তুই।আজ তোমাকে বাইক চালানোর শখ জন্মের মতো গুচিয়ে দিবো।হারামি কোথাকার।’
হেমন্ত দুহাত মাফ চাওয়ার মতো করে বলে,
‘ নাহ! আর করবো না মাফ কর আমায়।বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে।’
ইশি কর্কশ কন্ঠে বলে,
‘ কি চাই?কেন আবার আমার সামনে এসেছিস?’
‘ বিয়ে করবো!’
ইশি অবাক হলো হেমন্ত’র কথায়।ও তো ভেবেছিলো হেমন্ত ওকে মানাতে এসেছে।কিন্তু এই ছেলে তো ওকে ওর বিয়ের খবর দিতে এসেছে
ইশি লাল লাল চোখ নিয়ে তাকালো।পারলে এক্ষুনি ধ্বংশ করে দিবে হেমন্ত’কে।চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘ তুই বিয়া কর নাহলে হা*ঙ্গা কর তাতে আমার কিছু যায় আসে না।তুই শুধু আমার সামনের থেকে সর।নাহলে জুতা মেরে তোর চেহারার নকশা বদলে দিবো।’
হেমন্তকে ক্রোশ করে সামনের দিকে হাটা শুরু করলো।হেমন্ত বাঁকা হেসে এইবার ইশির কাছে গিয়ে ওকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো।ইশি হচকচিয়ে গেলো। ভয়ে হেমন্ত’র গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে,
‘ এইগুলো কি ধরনের অসভ্যতা হেমন্ত।এটা একটা পাবলিক প্লেস।তুই এমন করছিস কেন?’
হেমন্ত সামনের দিকে হাটা অবস্থায় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই বলে,
‘ আমি আমার হবু বউকে কোলে নিয়েছি।তাতে কার কি সমস্যা হবে?আর সমস্যা হলেও আমার তাতে কিছু যায় আসে নাহ!’
ইশি অবাক হলো অনেকটা।কি বলছে কি এসব হেমন্ত?হবু বউ মানে?ও কবে আবার হেমন্ত’র হবু বউ হলো?ইশি বিষ্মিত নয়নে তাকিয়ে বলে,
‘ আমি তোর হবু বউ মানে?এই আমি তোর কোন জন্মের হবু বউ হ্যা? তোর আমার বিয়ের কথা কবে হয়েছে? এইসব আজগুবি কথা একদম বলবি নাহ!’
হেমন্ত ইশিকে বাইকের উপর বসালো।খুব সাবধানে বাইকের কিনারা থাকা ধরি দিয়ে ইশির হাত দুটো বেধে দিলো।ইশি ভয় পেয়ে গেলো।কি শুরু করলো হেমন্ত এসব?ওর হাত বাধছে কেন?ইশি কিছু বলতে নিবে তার আগে হেমন্ত ওর মুখে রুমাল বেধে দেয়।এতে মুখের কথা মুখেই রয়ে যায় ইশির।শুধু হাত মুচঁরামুচঁরি করছে আর অস্পষ্ট স্বরে গোঙ্গাচ্ছে ইশি।না পেরে শেষ বাইক থেকে লাফ দিয়ে পালাতে নিলেই হেমন্ত ওকে ধরে ফেলে।গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘ আমাকে রাগাবি না ইশি।তুই এমন করলে কিন্তু আমি তোর পা’টাও বেধে দিবো।এখন সোজা কথায় আসি তুই কি আমার সাথে ভালোভাবে যাবি না-কি এইভাবে আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে তোকে নিয়ে যাবো?কোনটা ভালো মনে হবে বল?আমার এতে কোন সমস্যা নেই।একটু দূরে আমার গাড়িও দার করানো আছে।আমি চাইলেই তোকে এইভাবে নিয়ে যেতে পারি।’
ইশি বুঝলো এই ছেলে সব কিছু প্লান করেই এসেছে।ইশি মাথা নাড়িয়ে বুঝালো যে ও ভালোভাবেই যাবে।হেমন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশির হাত-মুখ খুলে দিলো।ইশি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।হেমন্ত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
‘ জলদি বাইকে উঠ।সবাই অপেক্ষা করছে।’
হেমন্ত বাইকে উঠতে নিলেই ইশির ফোপাঁনোর আওয়াজ ওর কানে আসে।থেমে যায় হেমন্ত।তাকিয়ে দেখে ইশি ওর দিকে করুন চোখে তাকিয়ে কাঁদছে।হেমন্ত চোখ বুছে নিশ্বাস নিলো।ইশির কাছে গিয়ে ওর গালে আলতো স্পর্শ করে বলে,
‘ আমি আর প্রাহি অনেকগুলো সরি তোকে প্রাহির অসুস্থতা সম্পর্কে না জানানোর জন্যে।আসলে পরিস্থিতি এমন ছিলো না।প্রাহির এরকম অবস্থা দেখে আমাদের ভয়ে অবস্থা পুরো খারাপ ছিলো।যাও কিছু বলবো তোকে।তার আগে ও আবারও সেই জায়গায় আঘাত পায়।আবারও আমাদের মাথায় একগাদা টেন্সন ভর করে।তুই তো সব বুঝিস বল।তুই আমাদের কাছে কি তা তো আর তোকে আর বলতে হবে নাহ তাই নাহ?তুই নিজেও জানিস আমরা তোকে কতো ভালোবাসি।’
ইশি হেমন্ত’র কথায় ওর বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে।হেমন্ত’ও দুহাতে ওকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।ইশি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ আমার আর এসব ভালো লাগে না হেমন্ত।আমার জীবনটাই কেন এতোটা কঠিন বলতে পারিস?কেন আমি একটু মনমতো বাঁচতে পারি নাহ?আমার জীবনের কোন সিদ্ধান্ত আমি নিজের মতো নিতে পারি নাহ। সবাই শুধু তাদের সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দেয়।কেন বুঝে না আমিও তো একটা মানুষ।আমারও তো কিছু চাওয়া পাওয়া আছে।বাবা বলা নেই কওয়া নেই।হুট করে কাল ফোন দিয়ে আজ সকালে ফোন দিয়ে বলে কাল নাকি আমার এংগেজমেন্ট তার পছন্দ করা ছেলের সাথে।উনি এমন কেন?সারা জীবনেও তো ভালোভাবে দুটো কথা আমার সাথে বলেনি শুধু আমার উপর জোড় খাটিয়ে গিয়েছে।আমি ঘৃনা করি তাকে।আমি আর চাইনা এই লাইফ।আমি একটু শান্তি চাই।মন ভরে বাঁচতে চাই।প্লিজ আমাকে মুক্ত কর এই জীবন থেকে!’
হেমন্ত’র চোখজোড়াও ছলছল করে উঠলো নিজের প্রেয়সীর এমন বাধভাঙ্গা আর্তনাদে।হেমন্ত ইশিকে আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে মায়াভরা কন্ঠে বলে,
‘ বিয়ে করবি আমাকে?’
ইশি কেঁপে উঠলো হেমন্ত’র কথায়।মুখ উচু করে তাকাতেই হেমন্ত ইশির দুগালে হাত রেখে ওর চোখে চোখ রেখে বলে,
‘ প্রমিস করছি আমাকে বিয়ে করলে আজকের পর থেকে তোকে আর কখনো কষ্ট পেতে দিবো না।সারাজীবন তোকে আগলে রাখবো বুকের মাঝে।তোকে তোর স্বাধিনতা পুরোটা দিবো।তুই নিজের মতো বাঁচবি।আর আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো।একজন যোগ্য স্বামি হয়ে সবসময় তোর পাশে থাকবো।তোর সব সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করবো। আমি ভুল পথে গেলে তুই আমাকে সঠিক পথ দেখাবি ঠিক তেমনভাবে আমিও তোকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিবো তুই ভুল পথে গেলে।আমরা দুজন দুজনের পরিপূরক হবো ইশি।বল তুই রাজি আমাকে বিয়ে করবি?’
ইশি মনো্যোফ দিয়ে সব কথা শুনলো।ভীতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে হেমন্ত’র কথায়।ইশি পা উচু করে হেমন্ত’র বারাবর হলো।একটু অন্যরকম কন্ঠে বলে,
‘ কেন করবি আমাকে বিয়ে? কি কারনে আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তুই?যেখানে আমার থেকেও বেশি সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা তোর জন্যে পাগল সেখানে আমাকেই কেন বিয়ে করবি?করুনা করছিস আমাকে?কিন্তু আমি তো চাইনা তোর করুনা।’
ইশি ওর ভালোবাসাকে করুনা বলছে?হেমন্ত বেজায় রেগে গেলো।শক্ত করে ইশির দুবাহু ধরে বলে,
‘ আর একবার করুনা বলবি তো থাপড়ে তোর গাল লাল করে দিবো। কেন বুঝিস না ভালোবাসি তোকে আমি।এখন থেকে নাহ যখন ভালোবাসার মানেও বুঝতাম না তখন থেকে তোকে ভালোবাসি আর তুই কিনা আমার ভালোবাসাকে করুনা বলছিস।তোর সাহস দেখে আমি অবাক।মন তো চাচ্ছে তুলে একটা আছাড় মারি তোকে।’
রাগে মেজাজ খারাপ করে হেমন্ত উলটো দিকে ফিরে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলতে লাগলো।এদিকে ইশি সিক্ত চোখেও হেসে দিলো।আজ ওর ঠোঁটের হাসি হলো পূর্ণতার হাসি।ইশি ঝট করে হেমন্তকে পিছন হতে জড়িয়ে ধরলো।এতে হেমন্ত খানিকটা সামনের দিক ঝুকে গেলো।পরক্ষনে নিজেকে সামলে নিলো হেমন্ত।আলতো হেসে নিজের বুকের মাঝে ইশির নরম তুলতুলে হাত দুটোর উপর নিজের হাত রাখলো।ইশি কান্নাজড়িত কন্ঠেও খুশির আভাস,
‘ কেন আমায় এতোটা দিন অপেক্ষা করালি?কেন ভালোবাসি বলতে তোর এতো দ্বিধাবোধ ছিলো।তুই কি বুঝিস?যে তুই আমায় ভালোবাসিস তা আমি জানিনাহ?আরে বোকা কোথাকার।আমি তোর বেষ্টফ্রেন্ড।যদি বেষ্টফ্রেন্ড হয়ে তোর মনের কথা আর চোখের ভাষা বুঝতেই না পারি তাহলে কেমন বন্ধু হবো আমি।তুই এতো ডোরুকু আমি আগে জানতাম নাহ!’
হেমন্ত চট করে ইশির দিকে ঘুরে গেলো।ইশির দু কোমড়ে হাত রেখে ওকে নিজের কাছে টেনে এনে বলে,
‘ তুই যেহেতু জানতি আগে থেকে তাহলে করুনা করছি আমি তোর উপর এসব বললি কেন?কেন আমায় রাগিয়ে দিলি?’
ইশি হেসে দিলো।বললো,
‘ আমি এই কথাগুলো না বললে কি আজ তুই নিজের মনের কথাগুলো এভাবে আমার সামনে প্রকাশ করতি বল?’
হেমন্ত ইশির নাক টেনে দিলো,
‘ ওরে আমার বুদ্ধিমান রে।এখন চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে।’
ইশি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই।হেমন্ত ওকে ছেড়ে দিয়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করলো।ইশারায় ইশিকেও বসতে বললো।ইশি বাইকে উঠে বসতেই বাইক নিয়ে শা করে চলতে লাগলো।ইশি হেমন্তকে ঝাপ্টে ধরে ওর পিঠে মাথা রাখলো।সাথে সাথে ওর চোখের কোণ বেয়ে সুখের অশ্রু গড়িয়ে পরলো।হেমন্ত আর ইশির ঠোঁটে আজ তৃপ্তির হাসি সরছেই না।এইভাবেই পূর্ণতা পেতে থাকুক সবার ভালোবাসা। ওদের দেখলেই যে কেউ বলবে ভালোবাসা সুন্দর।

#চলবে___________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here