একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি,10,11,12

0
865

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি,10,11,12
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১০

‘ এইভাবে একটা যুবতি মেয়েকে নিজেদের বাড়িতে রাখার কোন মানে আছে ভাবি?বাড়িতে দু দুটো জোয়ান ছেলে আছে আপনার। বলা তো যায়না ছেলে মানুষের মন কখন ভুলভাল কিছু করে ফেলে।আর সেইভাবেও অন্যের মেয়েকে আর কতোদিন নিজের কাছে রাখবেন?মেয়েটার আত্মীয়স্বজন থাকলে তাদের কাছে দিয়ে আসুন।’

আজ এরশাদ সাহেবের জন্যে মিলাদ রেখেছেন শিকদার বাড়িতে।দশদিন কেটে গিয়েছে সেই ঘটনার পরে।আর এই মিলাদেই অর্থ’দের এলাকার অনেক মানুষদের নিমন্ত্রন করা হয়েছে।সেইখান থেকেই একজন মহিলা কথাগুলো বললো।প্রাহি হিয়ার সাথে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো।এতিম খানায় তোবারক পাঠাবে সেই বিষয়ে।কিন্তু আচমকা এমন কথা শুনে ওর কথা থেমে যায়।বাকরুদ্ধ হয়ে যায় প্রাহি।সত্যি তো এইভাবে তো কোনদিন ভাবিনি প্রাহি।দশদিন যাবত এই বাড়ির মানুষদের উপর নির্ভর করে চলছে প্রাহি।কিন্তু এইভাবে আর কতোদিন?ঠিক কতোদিন তারা ও এইভাবে এই মানুষগুলোর কাঁধে বোঝা হয়ে থাকবে?নাহ,এইভাবে আর চলবে না।প্রাহি এখন অনেকটাই সুস্থ্য। শুধু মাথার আঘাত গুরুতর হওয়ায় একটু আধটু ব্যাথা হয়।এ আর তেমন কিছু না।প্রাহি ভাবলো আজ মিলাদ শেষ হলেই নিজের বাড়ি চলে যাবে প্রাহি।অনেক তো হলো আর কতো করবেন তারা।তাছাড়া নিজের জীবনের আগামী পথটুকু তো ওর একাই পাড়ি দিতে হবে তাই নাহ?তাহলে এখন থেকেই নাহয় সেটা শুরু হোক।

এদিকে মহিলাটার সেই তিক্ত কথাগুলো শুনে রায়হানা বলেন, ‘ আসলে কি ভাবি জানেন?মেয়েটার মা ছাড়া আর কেউ নেই।মা তো থেকেও নেই।তাই মেয়েটা সুস্থ্য না হওয়া অব্দি আর নিজের আগামি পথচলার জন্যে কিছু একটা না করা পর্যন্ত ওকে আমি এখানেই রাখবো।আর আমরা এতো নির্দয় আর পাষাণ হৃদয়ের মানুষ না ভাবি যে মানুষের বিপদের সময় মুখ ফিরিয়ে নিবো।আর আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকেও সেই শিক্ষা দেইনি।যে অল্প কিছু হলেই ওরা ভুল কাজে লিপ্ট হবে।আমরা ওদের তেমনভাবেই মানুষ করেছি যাতে আমাদের সন্তানদের নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র দোষ না বাহির করতে পারে।আর দেখুন আমরা সফল।আমাদের ছেলে মেয়ে তিনটাই মাশা-আল্লাহ। সবদিক থেকে পার্ফেক্ট।’

মহিলাটার মুখ একটুখানি হয়ে গেলো কথাগুলো শুনে কোনরকম তালবাহানা করে ওখান থেকে উঠে চলে গেলো।রায়হানা বেগম তাকালেন প্রাহির দিকে। তারপর প্রাহির কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘ একদম মন খারাপ করবে না এইসব মহিলাদের কথা শুনে।এদের কাজই হলো কুটনামি করা।তুমি নিশ্চিন্তে এখানে থাকবে।আমরা আছি তো তোমার সাথে।’

প্রাহি মলিন হেসে মাথা নাড়ালো।বাহির থেকে হেমন্ত’র ডাক শোনা যাচ্ছে।প্রাহি আর হিয়াকে ডাকছে ও।রায়হানা বলেন, ‘ যাও হেমন্ত ডাকছে তোমাদের।সাবধানে যাবে।’

প্রাহি আর ইশি চলে গেলো বাহিরে।ওরা এখন এতিমখানায় যাবে। এদিকে নিজের লোকদের ভালোভাবে কাজ করাচ্ছিলো অর্থ।গাড়িতে ভালোভাবে যেন রাখা হয় সেদিকে খেয়াল রাখছিলো। কাজের মাঝে হঠাৎ ওর চোখ যায় সদর দরজার দিকে।সাথে সাথে ওর দৃষ্টি থেমে যায় একজনের উপর।।রক্ত চলাচল দ্রুতগামীতে ছুটতে থাকে।এখনি বোধহয় ও হার্ট এট্যাক করবে।ওর সামনে যে একটা সাদাপরি এগিয়ে আসছে।সাদা ফোতুয়া,সাদা স্কার্ট,সাথে মাথায় সাদা উড়না দেওয়া।মুখমন্ডলে কোন প্রসাধনীর ছাপ নেই।একদম স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।আর কতোভাবে এই মেয়েটা অর্থকে ঘায়েল করবে?এই দশদিনে প্রতিনিয়ত এই মেয়ের রূপে নিজেকে ডুবিয়েছে অর্থ।এই মেয়ের মায়ের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছে।সেই সমুদ্রের কোন কূলকিনারা নেই।হেমন্ত’র ডাকে হুশ ফিরে অর্থ’র, ‘ ভাইয়া?যাবে নাহ?সেই কখন থেকে ডাকছি।’

অর্থ কোনরকম বলে, ‘ হ্যা খাবার গুলো পিক-আপে তোলা শেষ।এইবার আমাদের রওনা হওয়া উচিত।’

অর্থ গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো।পাশে বসেছে হেমন্ত।পিছনে হিয়া আর প্রাহি। প্রাহি রিনরিনে কন্ঠে হেমন্ত’র উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘ ইশি কোথায় রে হেমন্ত?’

হেমন্ত সিটবেল্ট বাধঁতে বাধঁতে বলে, ‘ ও সোজা এতিমখানায় এসে পৌছাবে আমাদের চলে যেতে বলেছে।’

প্রাহি আর কথা বললো না চুপ করে রইলো।অর্থ খুব সাবধানে লুকিংগ্লাসটা প্রাহির দিক করে দিলো।তারপর গম্ভীর গলায় বললো, ‘ আপনি ঠিক আছেন প্রাহি?’

আকস্মিক অর্থ’র এমন কথায় ধড়ফড়িয়ে উঠে প্রাহি।লোকটার কন্ঠস্বর যতোবার শুনে ওর অবস্থা ঠিক এমনি হয়।লোকটার গলার স্বরেও যেন মাদকতা আছে।মুহূর্তেই কিভাবে যেন প্রাহির ভীতর শুদ্ধ কাঁপিয়ে দেয়।প্রাহি জোড়ে শ্বাস ফেলে নিজের স্বাভাবিক করলো।অতঃপর বললো, ‘ হুম! আমি ঠিক আছি।’

‘ বসতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?আই মিন পায়ে বা মাথায় ব্যাথা লাগছে?’

প্রাহি অবাক হলো ভীষন।লোকটাকে এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন? প্রাহি অবাক কন্ঠেই বলে, ‘ আমি ঠিক আছি।আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না।’

অর্থ একটা সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।সারাদিনের কাজের ঝামেলায় মায়াময়ীর সাথে দু-দন্ড কথা বলতে পারিনি ও।মেয়েটার সাথে কথা না বলতে পেরে কেমন যেন অস্থির লাগছিলো।এখন কথা হওয়ায় একটু ভালো লাগছে। এই ক’দিনে মেয়েটা ওর অভ্যাসে পরিনত হয়েছে একপলক একে না দেখতে পারলে অর্থ’র কেমন যেন দম আটকে আসে।এদিকে অর্থ’র দিকে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে আছে হেমন্ত।বুঝার চেষ্টা করছে ওর ভাইয়ের মতিগতি।গত দশদিন যাবত ভাইকে অন্য একরূপে আবিষ্কার করেছে হেমন্ত।যেই অর্থ মেয়েদের দেখতেই পারেনা।মেয়েরা কাছে আসলেই রেগে জোয়ালামুখি হয়ে যায়।আজ কিনা সেই ভাই সেধেসেধে একটা মেয়ের সাথে কথা বলে, হুট-হাট মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়।মেয়েটার ব্যাথায় অস্থির হয়ে উঠে।তবে কি ও যা ভাবছে সেটা কি সত্যি হতে চলেছে?অবশেষে কি ওর ভাই প্রেমে পড়েছে?হ্যা, প্রেমেই তো পরেছে।হেমন্ত’রও তো এমন লাগে ইশির জন্যে।ইশির কথা মনে পড়তেই আনমনে হাসে হেমন্ত।মেয়েটা যে কখন আসবে আজ সারাদিনে কাজের চাপে একটু কথা হয়নি ইশির সাথে ওর।এদিকে গাড়ি ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে বার বার লুকিংগ্লাসে প্রাহির দিকে তাকাচ্ছে অর্থ।প্রাহি জানালার সাথে হেলান দিয়ে বসে বাহিরে তাকিয়ে আছে।দমকা হাওয়ার কারনে ওর ঘোমটা অনেক আগেই পরে গিয়েছে।সামনের ছোট ছোট চুলগুলো সারা চোখেমুখে বিচড়ন করছে ওর।অর্থ’র ইচ্ছে করছে নিজ হাতে ওই চুলগুলো প্রাহির কানের পিঠে গুজে দিতে।কিন্তু আপাততো সেটা সম্ভব না।মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিয়ে নিজের ইচ্ছেটাকে দমন করে নিলো অর্থ।আবারও প্রাহিকে দেখায় মত্ত হলো ও।

_____________
রেডি হয়ে সিড়ি দিয়ে নামছিলো ইশি।হঠাৎ ওর মামির কর্কশ কন্ঠে থেমে যায় ও।

‘ আজ শুক্রবার তোর তো ভার্সিটিও নেই।তাহলে তুই কোথায় যাচ্ছিস?ঘরে কতো কাজ পরে আছে দেখছিস না?’

ইশি বিরক্ত হলো।রাগ হলো ওর প্রচুর।শুভ কাজে রওনা হয়েছিলো কিন্তু শুরুতেই এই অশুভ মহিলার মুখটা ওর দেখতে হলো।নিজের রাগটাকে দমন করে নিয়ে ইশি বলে, ‘ এরশাদ আঙ্কেলের জন্যে আজ মিলাদ রাখা হয়েছে।এতিমখানায় তোবারক্ত দেওয়া হবে। সেইখানেই যাচ্ছি আমি।আর ঘরের কাজ?সেটা আমার কাজ না।ঘরে কাজের লোক আছে ওইগুলা তারা করবে।’

ইশির মামি যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন ইশির কথা শুনে।রাগে কটমট করে বলে, ‘ মুখে মুখে কথা শিখেছিস।তোকে কি এখানে বসে বসে খাওয়ার জন্যে রেখেছি?এখানে আমরা খেটে মরবো আর তুই বাহিরে ঢেং ঢেং করে ঘুরে বেড়াবি?’

ইশি রাগী চোখে তাকালো ওর মামির দিকে।কন্ঠে তেজ ঢেলে দিয়ে বলে, ‘ আমি তোমাদের উপর বসে বসে খাইনা মামি।আমার বাবা কিন্তু মাসে মাসে তোমাদের একাউন্টে আমার জন্যে মোটা অংকের টাকা পাঠান।সেইগুলো দিয়ে তো ভালোই ফুর্তি উল্লাস করো।ওইগুলো আমারই টাকা।আমার টাকা তোমরা খরচ করো।আর আমি এখানে দুবেলা দুমুঠো ভাত খাই।হিসেব তো এতেও বরাবর হয়না মামি।তোমাদের খাবার খরচ থেকেও আমার টাকা তোমরা তার থেকে দ্বিগুন নেও।তাহলে আমি বসে বসে তোমাদের ঘারের উপর কিভাবে খাই মামি? আর একটা কথাও শুনতে চাইনা আমি।আসছি আমি।’

ইশি চলে গেলো।আর ওর দুই মামি গালাগাল করতে শুরু করলেন ওকে।কিন্তু ইশি ওসব কানে নেয়নি।সে চললো নিজের গন্তব্যে।

____________________

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।ড্রয়িংরুমে বসে আছে সবাই।এরশাদ সাহেবের দোয়া মাফফিরাতের আয়োজন ভালোভাবে হয়েছে।এখন সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে।বাকিরা নিজেদের মতো কথা বললেও অর্থ গম্ভীর মুখে বসে চুপচাপ ল্যাপটপে নিজের কাজ করছে।আর কতোক্ষন পর পর প্রাহির রুমের দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটা এসে বললো ও ফ্রেস হতে যাবে।সেইযে গেলো আর আশার খবর নেই।অস্থির লাগছে অর্থ’র।কিছু হলো নাতো আবার মেয়েটার?পরেটরে ব্যাথা পায়নি তো আবার?আচ্ছা অর্থ কি একবার উঠে দেখে আসবে?পরক্ষনে সবার দিকে তাকিয়ে নিজের ইচ্ছা দমন করলো অর্থ।

এরই মাঝে হঠাৎ ল্যাগেজ হাতে প্রাহিকে সিড়ি নামতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেলো।হেমন্ত দাঁড়িয়ে গেলো।অবাক হয়ে বলে, ‘ প্রাহি?তুই এইভাবে?আর ল্যাগেজ হাতে কেন তোর?’

প্রাহি একপলক সবার দিকে তাকালো। ধীর কন্ঠে বলে, ‘ আমি চলে যাচ্ছি হেমন্ত নিজের বাড়িতে।’

হিয়াজ সিকদার নরম কন্ঠে বলেন, ‘ কেন মা?হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন?এখানে থাকতে কি তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে?আমাদের কারো ব্যবহারে কি তুমি কষ্ট পেয়েছো মা?’

‘ না, না আঙ্কেল এইভাবে বলবেন না।এইভাবে বললে আমি নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাবো।আপনারা তো আমার জন্যে যথেষ্ট করেছেন।কিন্তু একদিন না একদিন তো আমাকে আমার পথ একাই চলতে হবে তাই না আঙ্কেল? তাহলে সেটা আজ থেকেই শুরু করি!’

হেনা বেগম বলেন, ‘ কিন্তু তুমি তো এখনো অসুস্থ!’

প্রাহি মলিন হাসলো বললো, ‘ ও কিছুনা আন্টি আর দু তিনদিনেই ঠিক হয়ে যাবো আমি।’

রায়হানা বেগম এসে প্রাহির গালে হাত রাখলেন।মমতাময়ী কন্ঠে বলেন, ‘ এইভাবে চলে যাবে মা?আর কটা দিন থাকো মা।’

প্রাহি রায়হানা বেগমের হাত ধরলো।ধরা গলায় বলে, ‘ এইভাবে বলবেন না আন্টি।আমি আসবো তো আবার মাঝে মাঝে।’

প্রাহি এগিয়ে এসে হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।হিয়া কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে, ‘ আমি মিস করবো তোমায়!’

‘ আমি তোমায় খুব মিস করবো।’

প্রাহি এইবার হেমন্ত আর অর্থ’র দিকে তাকালো।দুজনেই রাগি চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।প্রাহি শুকনো ঢোক গিললো।আশ্চর্য এই দুইভাই এইভাবে তাকিয়ে আছে কেন?যেন ওকে কাচা গিলে খেয়ে ফেলবে।প্রাহি ভয়ে ভয়ে হেমন্তকে বললো, ‘ হেমন্ত পৌছিয়ে দিয়ে আসবি না আমাকে?’

হেমন্ত কিছু না বলে হনহন করে চলে গেলো।ইশি বললো, ‘ প্রাহি শোন আজ থেকে আমি তোর সাথেই থাকবো।মামারা রাজি হয়ে গিয়েছে।তাছাড়া ওই বাড়িতে আমারও থাকতে ভাল্লাগে না। তুই একা থাকবি।তাই ভাবলাম আজ থেকে আমিও তোর সাথে থাকবো।’

প্রাহি খুশি হয়ে ইশিকে জড়িয়ে ধরলো।তারপর দুজনে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।যাওয়ার আগে প্রাহি অর্থ’কে ফিসফিসিয়ে বলে গেছে, ‘ ধন্যবাদ।আমাকে সাহায্য করার জন্যে।আপনি না থাকলে আমি নিজেকে এতো সহজে সামলাতে পারতাম না।ভালো থাকবেন।আসি।’

অর্থ কিছুই বলেনি।শুধু দাঁতে দাঁত চিপে প্রাহির কথাগুলো হজম করে নিয়েছে।সে কি এই সামান্য ধন্যবাদ পাবার আশায় প্রাহির জন্যে এতো কিছু করেছে?উহুম না মোটেও না।এই মেয়েটাকে অর্থ’র চাই।খুব করে চায় ও।কেন চায় জানে না শুধু চায়।তবে আজ প্রাহি যেই দুঃসাহস দেখালো এর শাস্তি ওকে পেতে হবে।এতোদিন অর্থ’র শান্ত রূপটা ও দেখেছে।এইবার অর্থ’র রাগ আর পাগলামি দেখবে প্রাহি।

এদিকে প্রাহি যেতেই রায়হানা বেগম থপ করে সোফায় বসে পরলো।আহত কন্ঠে বলে, ‘ মেয়েটা বোধহয় ওই সায়মের মা’র কথাগুলো শুনেই চলে গিয়েছে।অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।তাই তো এইভাবে চলে গেলো।’

মায়ের কথায় ভ্রু-কুচকে ফেললো অর্থ।গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘ কে কি বলেছে আম্মু?কার কথায় প্রাহি চলে গেলেন?’

রায়হানা ছেলের দিকে তাকালেন।তারপর সকালের ঘটনা সব খুলে বললেন।সবটা শুনে সবাই আশ্চর্য। হিয়া রেগে বললো, ‘ উনার মেয়ে যে রাজমিস্ত্রী পোলার লগে ভাইগা গেছে তখন কি আমরা কিছু বলেছি ওই মহিলারে?ওই বেয়াদপ মহিলা এখানে আইসা কুটনামি মার্কা কথা কইতে আসছে।ইচ্ছে তো করছে এখনি গিয়ে চুলগুলো সব ছিড়ে দিয়ে আসি।’

আরাফ হিয়ার মুখে এমন কথা শুনে মুখ টিপে হাসলো।রেগে গেলে মেয়েটাকে কিউট লাগে।মনে মনে হাসলো আরাফ।

মায়ের কথা শুনে রাগে থরথর করে কাঁপছে অর্থ
পারলে এখুনি গিয়ে ওই মহিলার বাড়ি শুদ্ধ ও সেই মহিলাকে উড়িয়ে দিতো।।সবাই নিজেদের মতো কথা বলছে।কিন্তু অর্থ রাগে বোম হয়ে আধা ঘন্টা যাবত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবছে।এরই মাঝে হেমন্ত প্রাহিদের পৌছে দিয়ে এসেছে।এসেই ধোপ করে সোফায় বসে রাগে ফোসফোস করছে।অর্থ হেমন্ত আসতেই সবার দিকে তাকালো।তারপর আকস্মিক অর্থ বললো, ‘ কাল তৈরি থেকো সবাই।আমি কালই যাবো প্রাহিদের বাড়িতে।সবাই কান খুলে শুনে রাখো প্রাহি হবে তোমাদের বাড়ির বড় পূত্রবধু।আমরা কাল গিয়ে আমাদের বাগদান সেরে আসবো।মা তুমি তো আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছো।এখন প্রাহি নিজের পূত্রবধু হিসেবে গ্রহন করে নেও।আমি প্রাহিকেই বিয়ে করবো।’

কথাগুলো শেষ করে অর্থ হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।এদিকে সবাই হা কি বললো এটা অর্থ।অর্থ বিয়ে করবে প্রাহিকে?অতি আশ্চর্য বিষয়।এদিকে হেমন্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো অর্থ’র কথা শুনে।এইবার খুশির চোটে এক চিৎকার দিয়ে ও তৎক্ষনাত সেইখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো।

#চলবে__________

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১১
প্রাহিকে শাড়ি পরাচ্ছে ইশি আর হিয়া। এদিকে প্রাহি তব্দা খেয়ে আছে।আসলে ওর সাথে হচ্ছেটা কি?ও কিছুই বুঝতে পারছে না।আজ সকাল থেকে ইশি’র হাবভাব কেমন যেন লাগছিলো।মেয়েটা কোন কারন ছাড়াই যেন খুশি সারাবাড়ি সকাল থেকে নেঁচেকুদে যাচ্ছে।সেই সকাল থেকেই নানান পদের রান্না করে যাচ্ছে।আর কতোক্ষন পর পর প্রাহিকে এটা ওটা এনে দিয়ে টেস্ট করতে বলছে।প্রাহি শুধু বসে বসে তামাশা দেখেছে এই মেয়ের।বেলা বারোটা বাজতেই ওকে ঠেলেঠুলে গোসলে পাঠিয়ে দিয়েছে।আর রুম থেকে বের হতে দেয়নি।বাহির থেকে অনেক মানুষের আওয়াজ আসছিলো সব ওর চেনাজানা লোকেরাই।সবাই যে শিকদার বাড়ির লোকেরা তা বুঝতে বেশি অসুবিধে হয়নি প্রাহির।কিন্তু গিয়ে যে দেখবে নিচে গিয়ে তা আর করতে দিলো কোথায় ওকে?রুমের ভীতরে এসে বাহির থেকে দরজা আটকে রেখে চলে গেছে ইশি।বিরক্ত হয়ে রুমে বসেই ইশিকে ইচ্ছামতো বকতে লাগলো প্রাহি।ঠিক তখনি হাতে করে শাড়ি গহনার বাক্স নিয়ে হাজির ইশি আর হিয়া।তারপর ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রাহিকে সাজাতে লেগে পরেছে দুজনেই।এতোক্ষন প্রাহি চুপ ছিলো কিন্তু এইবার না পেরে প্রশ্ন করেই ফেললো, ‘ আশ্চর্য কি শুরু করেছিস তোরা? এমন হুট করে এসে আমাকে এইভাবে সাজানোর মানে কি?’

হিয়া অতি এক্সাইটেড হয়ে মুখ ফোসকে বলেই ফেললো, ‘ আজ তো তোমার আর অর্থ ভাইয়ার বাগদান হবে।সম্ভবত আজই তোমাদের আকদ ও হয়ে যেতে পারে। তারপর তোমার, ইশি আপুর আর হেমন্ত ভাইয়ার অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম শেষ হলে তোমাকে একেবারে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।অবশ্য তা সম্পূর্ণ তোমার মতামতের উপরে।তুমি চাইলে আজই নিয়ে যাবে।তারপর একটা বড় করে রিসিপশন পার্টি রাখবে।’

হিয়া নিজের মতো বকরবকর করেই যাচ্ছে।ইশি যে ওকে থামানোর জন্যে এতো চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হলো না।এই মেয়ে গড়গড় করে সব বলে দিয়েছে।বলা শেষে ইশির দিকে চোখ যেতেই দেখে ইশি ওর দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।পরক্ষনেই ওর মনে পরলো অধিক উত্তেজনায় ও পেটের কথা সব উগলে দিয়েছে।হিয়া কানে হাত দিয়ে সরি বুঝালো।এইবার ইশি আর হিয়া ভয়ে ভয়ে প্রাহির দিকে তাকালো। প্রাহি তো সেই কখন থেকেই স্ট্যাচু হয়ে আছে।ও কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।অবশেষে কি ওর ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে?ও কি সত্যি শুনলো সব?হৃদস্পন্দনের গতি দ্রুত থেকে দ্রুত হয়েছে।অদ্ভুত শিহরনে পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।মাথাটাও ঘুরাচ্ছে।প্রাহি আর সহ্য করতে পারলো না এইসব।জ্ঞান হারিয়ে ইশির গায়ে পরে গেলো।এদিকে ইশি আর হিয়া বেক্কল হয়ে তাকিয়ে আছে।হলো কি এটা?কাল হেমন্ত বিয়ের কথা শুনে জ্ঞান হারিয়েছে আর আজ প্রাহিও? এ কি হলো? হিয়া শুকলো ঢোক গিললো।বললো, ‘ তুমি প্রাহি আপুকে সামলাও আমি নিচে গিয়ে বলে আসি যে প্রাহি আপু সেন্সল্যাস হয়ে গিয়েছে।’

ইশি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।হিয়া এক দৌড়ে নিচে আসলো।তারপর দু হাটুতে ভর দিয়ে হাপাতে লাগলো। হিয়া এইভাবে হাপাতে দেখে আরাফ বললো, ‘ কি হয়েছে হিয়া? তুমি এইভাহে হাপাচ্ছো কেন?’

হিয়া জোড়েজোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেক স্বাভাবিক করে বললো, ‘ প্রাহি আপু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বিয়ের কথা শুনে।’

অর্থ কথাটা শোনার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পরলো।চেঁচিয়ে বললো, ‘ হোয়াট? কি বলছিস এসব?’

অর্থ একদৌড়ে উপরে চলে গেলো।হেমন্ত নিজের মাথা চুলকাতে চুলকাতে নিজেও ভাইয়ের পিছে পিছে গেলো।হেমন্ত জানে প্রাহি কেন জ্ঞান হারিয়েছে।প্রাহি যে ওর ভাইকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে এটা জানে হেমন্ত।আর আকস্মিক এইভাবে প্রাহির আর অর্থ’র বিয়ের কথা শুনে যে প্রাহিও যে হেমন্ত’র মতো অতিরিক্ত শক সহ্য করতে না পেরে যে জ্ঞান হারিয়েছে সেটা হেমন্ত ভালো করেই জানে।হেমন্ত উপরে এসে দেখলো ইশি প্রাহির পাশে বসে আছে।হেমন্ত একপলক ওর ভাই আর প্রাহির দিকে তাকিয়ে।এগিয়ে গিয়ে ইশির হাত ধরে টেনে হিছড়ে রুমের বাহিরে এনে রুম বাহির থেকে লক করে দিলো।এদিকে ইশি হেমন্ত’র এমন ব্যাবহারে কপট রাগ নিয়ে বললো, ‘ আশ্চর্য এইভাবে টেনে আনলি কেন?দেখছিস না প্রাহি ওখানে অসুস্থ?’

‘ তোর মতো মাথামোটারাই এমন প্রশ্ন করে।দেখেছিস ভাইয়া ভীতরে গিয়েছে।তাহলে তুই ওখানে গাম্বার মতো বসে ছিলি কেন?’

‘ তো কি করবো?প্রাহির জ্ঞান ফিরাতে হবে না?মেয়েটা এইবাবে আচানক অজ্ঞান হয়ে গেলো।’

‘ সেটা তোকে ভাবতে হবে না।যার জিনিস সেই সামলে নিবে চল এখন চার চোখা মেয়ে।’

ইশিকে হেমন্ত চার চোখা বলায় ইশি বেজায় রেখে গেলো।রেগে দাত কিরমিরিয়ে বললো, ‘ দেখ হেমন্ত’র বাচ্চা আমি চশমা পড়ি বলে তুই আমাকে এইভাবে অপমান করতে পারিস না।’

হেমন্ত ইশিকে চোখ টিপে বললো,, ‘ অবশ্যই বলবো।আর আমি শুধুই হেমন্ত।আমার এখনও কোন বাচ্চা হয়নি।অবশ্য তুই চাইলে সেটাও হতে পারে।আমি তো এক পায়ে রাজি।’

হেমন্ত চলে গেলো শিষ বাজাতে বাজাতে।আর এদিকে ইশি কনফিউজড হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।হেমন্ত বলে গেলো কি এটা?সব ওর মাথার উপর দিয়ে গেলো।

_____________

চোখে মুখে পানির ছিটা পরতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো প্রাহি। ঝাপ্সা চোখজোড়া স্পষ্ট হতেই এইভাবে মুখের উপর অর্থকে ঝুকে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে নিলেই অর্থ প্রাহির মুখ চেপে ধরলো।প্রাহি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে অর্থ’র।অর্থকে নিজের এতোটা কাছে দেখে ওর পুরো শরীর কাঁপছে।অর্থ লাল রাগি চোখ নিয়ে তাকিয়ে প্রাহির দিকে।

‘ চেঁচাতে কেন যাচ্ছিলেন স্টুপিট?’

প্রাহি অসহায় চোখে অর্থ’র দিকে তাকালো।অর্থ বুঝতে পেরে প্রাহির মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো।অর্থ এইবার একটানে প্রাহিকে শোয়া থেকে উঠিয়ে নিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরলো।প্রাহি ভয় পেয়ে গেলো।দু হাত অর্থ’র বুকে রেখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো অর্থ’র দিকে।কাঁপা গলায় বলে,

‘ কি..কি করছেন আপনি?’

অর্থ তেজি কন্ঠে বলে, ‘ কাল কার থেকে অনুমতি নিয়ে আপনি চলে এসেছেন এই বাড়িতে হ্যা?আমি দিয়েছিলাম অনুমতি?কেন আসলেন?একটুও বুক কাঁপেনি যে আমাকে রাগালে কতোটা খারাপ হবে আপনার জন্যে?সামান্য বাহিরের মানুষের কথা শুনে আপনি হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে এলেন এই বাড়িতে?আপনার তো দেখি বড্ড বেশি পাখা গজিয়েছে।পাখা গজালে এই অর্থ সেই পাখা কেটেও দিতে পারি গট ইট?’

প্রাহি ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেলো।কোনরকম তুতলিয়ে বলে, ‘ দেখুন……! ‘

প্রাহিকে বলতে না দিয়ে ওর দিকে আরো গভীরভাবে তাকালো অর্থ বললো, ‘ দেখছিই তো।এখন আপনি আরো অন্য কিছু দেখাতে চাইলে আই হেভ নো প্রোবলেম।’

অর্থ’র ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জায় প্রাহির গাল,কান গরম হয়ে উঠলো।সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো প্রাহি।এই লোকটা যে এমন ঠোঁটকাটা স্বভাবের হবে জানা ছিলো না প্রাহির।এইভাবে লাগামহীন কথা বলে ফেললো ওর সামনে।ছিঃ! অর্থ প্রাহির গাল চেপে ধরে প্রাহিকে নিজের মুখোমুখি করলো দাঁতে দাঁত চিপে বলে, ‘ লিসেন আর কোনদিন আমার মতামত বিহীন কোন কিছু করার দুঃসাহস করবেন না।তাহলে কিন্তু ভালো হবে না।’

প্রাহি ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে ছিলো।গালে ব্যাথা পাচ্ছে প্রাহি।তাও নিজের ব্যাথাটুকু সামলে নিয়ে সাহস জুগিয়ে বললো, ‘ কেন আপনার সব কথা শুনতে হবে কেন?’

অর্থ ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকালো প্রাহির দিকে।মনে হয় এক্ষুনি ওকে এই চোখ দিয়ে ধ্বংশ করে দিবে।রাগি কন্ঠে বললো, ‘ আমাকে রাগাবেন না প্রাহি।আর আমার কথা কেন শুনতে হবে তা একটু পরেই টের পাবেন আপনি।ভেবেছিলাম আজ শুধু বাগদান করে রাখবো।আপনার উপর কোন প্রেসার দিবো না।কিন্তু কাজটা আপনি ভালো করলেন না।এইটার শাস্তি হিসেবে।আজ এক্ষুনি আপনার আর আমার বিয়ে হবে।কাগজে কলমেও আর শরিয়ত মোতাবেকও।আমি আজই আপনাকে আমার সাথে নিয়ে যাবো।তারপর আপনাকে হারে হারে বুঝাবো আমার কথা আপনার কেন শুনতে হবে। মিস প্রাহি বি রেডি ফোর বিয়িং মিসেস প্রাহি।’

প্রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অর্থ’র দিকে।প্রাহি এতোক্ষন ভাবছিলো শিকদার বাড়ির লোকেরা বুঝি অর্থকে জোড় করে ওকে বিয়ে করার জন্যে। কিন্তু এখানে তো অন্য কিছু এই লোক নিজের নেঁচেকুদে এখানে চলে এসেছে।আর ওরই সামনে ওরই বাড়িতে এসে এমন ট্রেড দিলো।
প্রাহিকে এইভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠে অর্থ, ‘ উঠুন।নিজেকে ঠিকঠাকভাবে রেডি করুন।আমি কিন্তু কাল থেকে প্রচন্ড রেগে আছি আমার রাগ আর বারিয়ে দিয়েব না।লক্ষি মেয়ের মতো রেডি হয়ে নিচে আসুন।আমি হিয়া আর ইশিকে পাঠাচ্ছি।’

অর্থ কথাগুলো বলেই হনহন করে চলে গেলো।আর ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকেই প্রাহির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

#চলবে________

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১২
‘ কবুল বলো মা!’
‘ কবুল, কবুল,কবুল!’ আস্তে ধীরে তিনবার কবুল বললো প্রাহি।অর্থ অনেক আগেই কবুল বলে বসে আছে।শুধু প্রাহির কবুল বলার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো।প্রাহি কবুল বলাতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।প্রাহি চোখ বুঝলো।দু চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো।ওর বিয়েটা তো এইভাবে হওয়ার কথা ছিলো না।ও তো আশা করেছিলো একপাশে ওর মা থাকবে আরেকপাশে বাবা।দুজনের হাত ধরে কবুল বলবে।বাবা,মা’র বুকে মুখ গুজে অনেক কাঁদবে।ওর বিয়ে নিয়ে ওর বাবা মা’র কতো আশা ছিলো।কিন্তু আজ সব ধোঁয়াশা।ওর জীবনটা এখন এলোমেলো বইয়ের পৃষ্টার মতো।যেই বইয়ের পৃষ্টাকে একটু আগে কবুল বলে স্বামি বলে মানা মানুষটা আদৌ কি গুছাতে পারবে কোনদিন?না-কি একদিন বিরক্ত হয়ে ওকে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে যাবে?জানে না প্রাহি জানা নেই।নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পেয়েও খুশি হতে পারছে না প্রাহি।বাবা মা’র শূন্যতায় ওর হৃদয়টা খাঁখাঁ করছে।প্রাহিকে কাঁদতে দেখে অর্থ ওর মাকে ইশারা করলো।যাতে প্রাহিকে এই মুহূর্তে সামলাতে পারে তিনি।রায়হানা এগিয়ে গিয়ে প্রাহির মাথায় হাত রাখলো।প্রাহি চোখ খুলে রায়হানা বেগমের দিকে তাকায়।তিনি বলেন,
‘ কাঁদে না মা।আমি জানি তোমার আজ অনেক কষ্ট হচ্ছে।বাবা মা আমিও হারিয়েছি তাই এটার কষ্ট ঠিক কতোটা তা আমি খুব ভালোভাবেই জানি।চিন্তা করো না মা।শুধু আল্লাহ্’র কাছে দোয়া করো তিনি যেন তোমার আব্বুকে জান্নাত নসিব করেন আর তোমার আম্মুকে জলদি সুস্থ্য করে দেন।’
প্রাহি ছলছল চোখে রায়হানা বেগমের দিকে তাকিয়ে থেকেই হুট করে রায়হানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে উনার বুকে মাথা আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো।কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ আমার সাথেই কেন এমন হলো?আমি কেন আজ এতিম হলাম।এইভাবে তো আমি বিয়ে করতে চাইনি।আমার বাবা মা দুজনকেই চেয়েছিলাম তারা যেন আমার পাশে থাকে এই সময়টায়।কিন্তু আল্লাহ যে আমার থেকে সব কেরে নিলেন। আমি আজ একা। আমার কেউ নেই।’
রায়হানা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
‘ কে বলেছে তোমার কেউ নেই?আজ থেকে তোমার দুটো মা আর দুটো বাবা।আমি আর হিয়া তোমার দুটো মা।হিয়াজ আর হিয়ান্ত ভাই তোমার দুটো বাবা।তুমি একা নও।তোমার পুরো পরিবার আছে।হেমন্ত তোমার ভাই, হিয়া তোমার বোন।আর মেয়েদের সবচেয়ে বড় শক্তি আর ভরসা হলো তাদের স্বামি।আজ থেকে তাও আছে তোমার।তুমি কেন একা হবে বোকা মেয়ে।’
প্রাহি কিছু বললো না।ওইভাবেই রায়হানা বেগমের বুকে পরে রইলো।হেমন্ত আর ইশি ওদের চোখের কোণে জমা জলটুকু মুছে নিলো।আজ থেকে আর কোন চিন্তা নেই।মেয়েটা আজ থেকে একটা পরিবার পেয়ে গিয়েছে।ওকে আগলে রাখার মানুষ পেয়েছে।আর কি চাই?তবুও বাবা মা’র শূন্যতাটা তো থেকেই যায়।কিন্তু নিয়তির লেখা তো কেউ আর বদলাতে পারে না। ভাগ্য যা লিখা থাকে তাই হয়।
——————
রহমান ভিলার গেটে তালা মেরে দিলো হেমন্ত।আজ থেকে এই বাড়িটা খালি থাকবে।একসময় হৈ-হুল্লোড় লেগে থাকা বাড়িটা একটা ঘটনার তাগিতে একদম নিস্তব্ধ হয়ে পরে আছে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো হেমন্ত।সবার উদ্দেশ্যে বললো,
‘ বাবা,চাচ্চু,আম্মু আর কাকিমা এক গাড়িতে চলে যাও।আমি ইশিকে বাইকে করে ওদের বাসায় ড্রোপ করে দিয়ে আসি।হিয়া আরাফের সাথে চলে যাস।আর ভাই আর প্রাহি একটা গাড়িতে করে আসো।’
সবাই হেমন্ত’র করামতো চলে গেলো।হেমন্ত বাইকে উঠে বসতেই ইশিও উঠে বসলো।কিন্তু দুরুত্ব বজায় রেখে।হেমন্ত ভ্রু-কুচকালো।রাগ নিয়ে বললো,
‘ এমন ভাব করতাছোস লাগে জীবনেও আমার সাথে বাইকে বসোস নাই।আজাইরা ধং না কইরা আমারে ধরে বস।নাহলে চার চোখা তুই যেই চিকনা পিছনের থাইকা কখন বাতাসের সাথে উইড়া যাবিগা টেরই পামু না।’
ইশি ধুপ করে একটা ঘুশি মেরে দিলো হেমন্ত’র পিঠে।হেমন্ত হালকা আর্তনাদ করে বলে,
‘ উফফ মারোস কেন সকিনার মা।’
ইশি রাগে ফোঁসফোঁস করে বলে,
‘ দেখ হেমন্ত এইসব ফাউল নামে আমাকে ডাকবি না।আর এইসব আজাইরা কথাও বলবি না।তাড়াতাড়ি বাড়ি দিয়ে আয় আমায়।নাহলে আরেকটা ঘুশি খাবি।’
হেমন্তর কাঁধে আর কোমড়ে হাত রাখলো ইশি।হেনন্ত মুচঁকি হেসে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
__________
‘ তুমি সবসময় আমার সাথে এইভাবে কথা বলো কেন?’ আরাফের প্রশ্নে হিয়া কাটকাট জবাব দেয়,
‘ জানিনা!’
‘ কেন জানোনা?’
‘ তাও জানি না!’
‘ তাহলে জানোটা কি?’
‘ আপনার মাথা!’
‘ আমার মাথা?কিন্তু আমার মাথা সম্পর্কে কি জানো?’ আরাফের এতো এতো প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হিয়া।সেই কখন থেকে পটরপটর করেই যাচ্ছে লোকটা।হিয়া বিরক্ত হয়ে বলে,
‘ এতো কথা কেন বলছেন আপনি?চুপ-চাপ বাইক চালান।মাথা খারাপ করে দিচ্ছেন পুরো।’
আরাফ বাঁকা হেসে বলে,
‘ তাহলে আমি বলবো নিজেকে তৈরি করে নেও।সারাজীবনই তোমাকে এতো এতো কথা শোনার ধৈর্য রাখতে হবে।’
হিয়া বুঝতে না পেরে বলে,
‘ মানে?’
‘ মানে কিছুনা সময়মতোই বুঝতে পারবে।’
হিয়া ভেংচি কাটলো আরাফকে।তার ঠেকা পরেছে এই লোকের এতো কথার মানে বুঝার। এদিকে আরাফ বাইকের গ্লাসে হিয়ার দিকে তাকাচ্ছে বারবার।বাতাসের কারনে মেয়েটার চুলগুলো ওর সারা চোখে মুখে এসে বারি খাচ্ছে।চাঁদের আলোয় অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।মনে মনে আরাফ বললো আর বেশিদিন না অর্থ বিয়ে করে নিয়েছে এইবার তোমার আর আমার বিয়ের পালা।তৈরি হয়ে নেও সোনা।হাসলো আরাফ কথাগুলো ভেবে।
—————–
গাড়ি ড্রাইভ করছে অর্থ ওর পাশেই চুপচাপ বসে আছে প্রাহি।জানালার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে চোখজোড়া সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্থ ড্রাইভ করার ফাঁকে বারবার প্রাহির দিকে তাকাচ্ছে।লাল বেনারসি শাড়ি,মাথায় লাল ওড়না দেওয়া,হালকা পাতলা গহনা পরা,হালকা মেক-আপ এতেই যেন অপ্সরী লাগছে প্রাহিকে অর্থ’র কাছে।বউরূপে যে কাউকে এতোটা অমায়িক লাগতে পারে জানা ছিলো না অর্থ।মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।একটু ধরবে কি?যদি কিছু মনে করে প্রাহি?থাক ক’টা দিন সময় দিক মেয়েটাকে।সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক হোক তারপর নাহয় এইসব ভাবা যাবে।আচ্ছা,হাতটা তো ধরতে পারবে ও।এতে তো আর খারাপ ভাবার কিছু নেই।অর্থ শুকনো ঢোক গিললো। বারবার হাতটা এগিয়ে নিয়েও পিছিয়ে নিচ্ছে।হাতটা কেমন যেন কাঁপছে ওর।একটা মেয়ের সান্নিধ্যে এসে যে ওর এমন অবস্থা হবে জানা ছিলো না অর্থ’র। যতোবার মেয়েটাকে ছুঁয়েছে অর্থ।ততোবার সারাশরীরে ঝংকার তুলে দেয় এই মেয়ে।ওইযে তখন যে রাগের মাথায় প্রাহিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছিলো।তখন কিন্তু অর্থ’র বুক কাঁপছিলো ভীষনভাবে।শুধু নিজেকে প্রাহির কাছে দূর্বল না করার জন্যে নিজেকে সামলে রেখেছিলো অর্থ।এইসব ভাবাভাবি করতে করতে ওরা কাঙ্খিত স্থানে পৌছে গেলো।অর্থ’র আর হাত ধরা হলো না প্রাহির।দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্থ।আদ্র কন্ঠে ডাকলো,
‘ প্রাহি শুনছেন?আমরা পৌছে গেছি।’
অর্থ’র ডাকে হুঁশ ফিরে প্রাহির।এতোক্ষন সে অন্য ভাবনায় মশগুল ছিলো। প্রাহি তাকালো অর্থ’র দিকে।তারপর হালকা আওয়াজে বলে,
‘ আমি আপনার থেকে যথেষ্ট পরিমান ছোট।আর এখন আমি আপনার স্ত্রী তাই প্লিজ বার বার আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করার দরকার নেই।আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন।’
অর্থ মাথা নাড়ালো।তাদপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ আচ্ছা ডাকবো।এখন নামো গাড়ি থেকে আমরা এসে পরেছি।’
প্রাহি গাড়ি থেকে নামতেই অর্থও নেমে দাড়ালো।লম্বা একটা শ্বাস ফেলে প্রাহি হাত চেপে ধরলো অর্থ।প্রাহি চমকে তাকালো অর্থ’র দিকে।পরক্ষনেই মনটা ভালো হয়ে গেলো নিমিষেই।প্রাহিও নিজের ছোট্ট হাতটা দিয়ে অর্থ’র হাতটা আকঁড়ে ধরলো।প্রাহি এইবার চারদিকে তাকালো। তারপর ধরা গলায় বলে,
‘ এটা তো বাবার কবরস্থানের যাওয়ার পথ।’
অর্থ নিষ্প্রভ চোখে তাকালো প্রাহির দিকে।বললো,
‘ হ্যা! আজ আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। বাবা’র থেকে দোয়া চাইবো না বলো?চলো দুজন মিলে তার কবরটা জিয়ারত করে আসি।’
প্রাহির চোখজোড়া ভরে এলো।কৃতজ্ঞতা জানালো অর্থকে,
‘ ধন্যবাস আপনাকে।’
‘ চলো!’
প্রাহি আর অর্থ মিলে এরশাদ সাহেবের কবর জিয়ারত করে নিলো। জিয়ারত শেষে অনেক্ষন প্রাহি কাঁদলো বাবার কবরের উপর সুয়ে সুয়ে।অর্থ কিছু বললো না প্রাহিকে। কাঁদুক মেয়েটা। কাঁদলে মনটা হালকা হয়।কিছুক্ষন প্রাহি উঠে আসলো।অর্থ যত্ন সহকারে ওর গায়ে লেগে থাকা ময়লা ঝেরে দিলো।প্রাহি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো অর্থ’র দিকে।তারপর প্রাহির হাত ধরে আবারও গাড়িতে ফিরে আসলো।গাড়ি স্টার্ট দিতেই অর্থ একপলক তাকালো প্রাহির দিকে।মেয়েটা কেমন যেন ছটফট করছে। অর্থ গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘ কিছু বলতে চাও প্রাহি?’
প্রাহি আমতা আমতা করছে,
‘ হ্যা আসলে ওই একটু……!’
অর্থ চেহারাটা আরো খানিকটা গম্ভীর করলো। গভীর ঠান্ডা গলায় বললো,
‘ আমার কাছে এতোটা আনইজি ফিল করার কিছু নেই প্রাহি।আজ থেকে আমি তোমার স্বামি।সো আমার কাছে নির্দ্বিধায় সবকিছু বলবে।আবদার করবে।এইভাবে তোতলানোর তো কোন মানে হয়না প্রাহি।আর আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছো।মা’য়ের সাথে দেখা করবে তো?তাই নাহ?আমি সেইখানেই নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।সো এতো অস্থির হওয়ার কোন দরকার নেই।’
প্রাহি কিছু বললো না মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো অর্থ’র দিকে।লোকটা কতো সুন্দরভাবে ওকে সবটা বুঝিয়ে বললো।আর কতোটা অনায়াসে ওর মা আর বাবাকে মা, বাবা বলে ডাকছে।একটা মানুষ এতোটা ভালো কিভাবে হতে পারে।নাহ,প্রাহি কোন ভুল করেনি জীবনে নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে।ও নিজের জন্যে বেষ্ট একজন মানুষকেই ভালোবেসেছে।প্রাহি জানে একদিন না একদিন এই লোকটাও ওকে ভালোবাসবে।খুব ভালোবাসবে।আর প্রাহি ওর সবটা দিয়ে চেষ্টা করবে এই লোকটার সাথে একটা হ্যাপিলি ম্যারিড লাইফ লিড করার।এই মানুষটা যেন ওর কাছ থেকে কোন প্রকার কষ্ট না পায় সেই চেষ্টা করবে।এই মানুষটা ওর দুঃখের সময় প্রতিটা পদে পদে ওর পাশে ছিলো।প্রাহিও নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করবে অর্থকে আর ওর পরিবারকে সামলে রাখার।উফ ভুল বলেছে এটা তো এখন ওরও পরিবার। আর নিজের পরিবারকে কিভাবে আগলে রাখবে সেটা খুব ভালোভাবেই জানে প্রাহি। কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোণে মুচঁকি হাসি ফুটে উঠলো প্রাহির।

#চলবে____________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here