একদিন নববর্ষা -১২,১৩

0
186

একদিন নববর্ষা -১২,১৩
অদ্রিজা আশয়ারী
১২

ক্রোধে দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটে গেলাম বর্ষাদের বাড়ি। বাহির বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোর আগেই বর্ষার মায়ের সঙ্গে দেখা। বর্ষার মা আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল।
-“বর্ষা কোথায়?”

উত্তরে বর্ষার মা মিনমিন করে কি বলল কিছুই বোঝা গেল না। আবার গলা উঁচিয়ে বললাম,
-” বসির শেখ কোথায়? ওর সাথে আমার কিছু বোঝাপড়া বাকি আছে। ডাকুন ওকে। ” বর্ষার মা জায়গা থেকে নড়ল না। কিছু বললও না। সেখানেই জমে দাঁড়িয়ে বিরবির করতে লাগল কিছু ।

তাকে পাশ কাটিয়ে আমি ভেতর বাড়িতে পা বাড়ালাম। উচু গলায় বসির শেখকে ডাকতে ডাকতে।

দিনের আলোয় আমি আর বসির শেখ কখনো একে অন্যের মুখোমুখি হইনি। বর্ষার মুখে শুনে ছিলাম বসির শেখের মুখে একবার থাবা বসিয়েছিল বাঘ। সেই ব্যাপার টা নিয়ে কখনো ভাবার প্রয়োজন অনুভব করিনি। তবে আজ ভেতর বাড়িতে পা রাখতেই একটা ব্যাপার আমার মনোযোগ সম্পুর্ণ রূপে কেড়ে নিল কয়েক মুহুর্তের জন্য। উচু গলায় হাঁকডাক থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরতে বাধ্য হলাম। উঠোনের মাঝখানে চেয়ার পেতে বসে থাকা পঞ্চাশোর্ধ লোকটিকে দেখে ।
লোকটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে নির্বিবার চাহনিতে আমার পর্যবেক্ষণ করছে। মুখের বা পাশে, চোখের নিচ থেকে চিবুক পর্যন্ত অংশটুকুর চামড়া থেতলানো। সেখানে এত বড় একটা গর্ত যে দেখলে মনে হয় কেউ এক খাবলা মাংস তুলে নিয়ে, ইচ্ছে করেই একটা কুহর বানিয়েছে।

রাতের আঁধারে দু’বার মাত্র দেখা হয়েছিল আমাদের। বসির শেখের গলার স্বর মাত্রার অতিরিক্ত বিগলিত মনে হয়নি কখনো। সে কথায় আমার প্রতি আন্তরিক ছিল বটে। কিন্তু এজন্য তাকে চাটুকার বলা চলে না। অন্তত দিনের আলোয় আমার সামনে বসে থাকা এই লোকটি যদি বসির শেখ হয়। তাহলে তো নয়ই।

-“বর্ষা কোথায়?” আমি অধৈর্য হয়ে বললাম।

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়ল বসির শেখ। উঠোনে একদলা থুতু ফেলে নিরুত্তেজ স্বরে বলল
-” ওর যেইখেনে থাকার কথা সেইখেনেই আছে বোধহয়। আপনি বসেন। বাড়িতে আইজ কুটুম আইব। ভালো রান্নাবান্না হইছে। দুই মুঠ খায়া যান।
বর্ষন, সাহেবরে একটা চেয়ার দিয়া যাও।”
বর্ষন সাথে সাথে আজ্ঞা পালন করল। হুট করে কোথা থেকে ছুটে এসে বসির শেখের মুখোমুখি একটা চেয়ার পেতে দিয়ে গেল আমার জন্য।
-” বসেন সাহেব।”

-“এখানে বসতে আসিনি আমি। আগে বর্ষাকে ডাকুন। আজ নাকি দেখতে আসবে ওকে?”

-” তা আসব। বোঝেন ই তো। গায় গেরামে থাকি। মাইয়া ডাংগর হইছে। কহন কি কলঙ্ক লাইগা যায়। বড় ভয় হয়। যত তাড়াতাড়ি বিয়া দেওন যায় ততই ভালো। একদিন দুইদিন কইরা তো অনেক দিন হইল। এইবার আর দেরি করুম না।
এই ঝামেলার জন্যেই করিমনরে আপনের বাড়িতে কাজ বন্ধ করতে হইল। ভালোই হইছে আপনে আইসেন। এইসব ব্যাপারে একটা শিক্ষিত, বুঝদার মানুষের বড় প্রয়োজন। আপনে আর কিছুক্ষণ থাকেন সাহেব। ওরা অহনি আয়া পরব। আপনে সাথে থাকলে আমি একটু ভরসা পামু। ” বসির শেখ এতো বিনীত স্বরে বলল কথাগুলো যে আদৌ আমাদের বিষয়ে সে পুরোপুরি অবগত কিনা এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ জাগলো মুহুর্তের জন্য। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ল লোকটা ভয়ানক ধুর্ত। তাছাড়া তার গলার স্বর অসম্ভব দৃঢ়। সহসা বসির শেখের নিরীহ সাজার এই অভিনয় অসহ্য ঠেকল আমার কাছে।

-“বাজে কথা রাখুন। বর্ষা আর আমার সম্পর্কের ব্যাপার টা আপনি অবশ্যই জানেন। বর্ষার অন্যত্র বিয়ে হতে পারে না। আমি বিয়ে করবো ওকে। ” হিসহিসিয়ে বললাম আমি।

বসির শেখ যেন এক পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলের মুখে বিশ্বভ্রমণের গল্প শুনছে এমন চোখে তাকাল। সেই সাথে হাসল। যে হাসির মানে কঠিন না।
-” সাহেবের রসিকতা মন্দ না। এমন কথা শোনা আমার কানেরও সৌভাগ্য। তবে একটা ভুল হইছে সাহেব। আপনে বষ্যারে ভাবছেন বাজারের মেয়ে। গৃহকর্মের সাথে সাথে সে দেহকর্মও করবে। এই ধারণা ভুল।
তয় আমার মাইয়্যাও বিরাট ভুল কাম করছে। আপনেরে নাগর বানায় চৌদ্দ এলাকা ঘুইরা বেরাইছে। নাইলে আপনের এরকম ধারনার কোনো কারণ দেখি না। যাইহোক ওর অপকর্মের শাস্তি ও পাইসে।
এইবার শোনেন সাহেব। গরিব হইলেও এই বাড়ির মেয়ালোক কোনোদিন বাজারে যাইব না। অবশ্য আপনের একলা দোষ দেহি না। বড় বড় মানুষের বড় বড় সব ব্যাপার। গরিব মেয়া লোক দেখলেই গা চুলকায়। টাকা দিয়া কিন্না নিতে মন চায়। ”

কথাগুলো এত ভয়ংকর বাজে শোনালো আমার কানে যে কান গরম হয়ে গেল, ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল কানের দুপাশ । আমি শ্যেন দৃষ্টি হেনে তাকিয়ে রইলাম সামনে বসা বিকৃত মস্তিষ্কের লোকটির দিকে। সে ঘটনাকে কোন দিকে ঘোরাতে চাইছে বুঝতে চেষ্টা করলাম।

অবশেষে শান্ত গলায় বললাম,
-” বর্ষা ঠিকই বলেছিল। আপনি তার আসল বাবা নন। হতেই পারেন না। নিজের বাবা হলে কখনো মেয়ে সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারতেন না।
তবে সে আপনাকে বাবার মতো সম্মান করে। নাহয় আজ আপনার প্রতিটি কথার বিনিময় সুদে আসলে পরিশোধ করে দিতাম।”

বসির শেখ নিরুত্তর থেকে তাকিয়ে রইল। দুচোখে ইষৎ হাসির আভাস। সহসা উঁচু গলায় হাঁক ছাড়তে ছাড়তে ফজলু মিয়া প্রবেশ করল বাড়িতে। আমাকে দেখে এক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল সে।
-“সাব এইহানে?”
বলে অবাক হয়ে দেখল আমাকে৷ কিন্তু তার কথাটা বোধহয় আরো বেশি জরুরি যার দরুন পরমুহূর্তেই আমাকে ডিঙিয়ে বসির শেখের কাছে চলে গেল একলাফে। বসির শেখের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কিসব বলতে শুরু করল। কিন্তু উত্তেজনার বসে ফিসফিস করে বলা কথাটাও জোরে শোনাল বেশ।

-” ওরা আর আসব না। আমগর গায়ের এক লোক সৈয়দ বাড়ি গিয়া খবর রটাইসে বষ্যার এক সাহেবের লগে পিরিত আছে। সেই ভিনদেশী নাগরের বাড়িতে রাইত কাটাইছে হে। এই খবর শুইনা সৈয়দ বেপারির মুখ চূন। কইসে এই বিয়ার সম্মন্ধ ক্যান্সেল। আমি নিজের কানে শুইনা আইছি।”

বসির শেখের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই। অর্ধ বিকৃত মুখখানা ভয়ানক ক্রোধে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। সহসা উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল সে ফজলুর উত্তেজিত মুখের পানে।

আজকের মতো এখানেই ব্যাপার টা থেমেছে ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি।
-” দ্বিতীয় বার বর্ষাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। আপনার জন্য সেটাই ভালো হবে। ”
কথাগুলো বলে সরু চোখে বসির শেখকে দেখে ঘুরে হাটা ধরলাম বাড়ির দিকে।

***

সুন্দরবনের সকালের আকাশে ঝকঝকে রোদ। আকাশের মধ্যেখানটা কড়া নীল। পেজা তুলোর মতো সাদা মেঘে মেঘে সমাকীর্ণ দু’ধার। দেখলে মনে হয় যেন গাঢ় নীল আকাশ থেকে রাশি রাশি তুলোর পুঞ্জ গুলো ভার বহনে অসমর্থ হয়ে ক্রমে ক্রমে নিচে সরে এসেছে মাটির খুব কাছে।

বসে আছি বনের ভেতর ছোট্ট সেই নদীর তীরে। কি ভীষণ সুন্দর আজকের প্রকৃতি। এতো সুন্দর একটা সকাল কতদিন দেখা হয়নি দুচোখ মেলে। স্বচ্ছ জলরাশির প্রবল বয়ে চলায় আন্দোলিত নদীর গতিপথ। সবুজ গাছের পাতায় হিল্লোল তুলছে শীতল সমীরণ। তার মাঝে এই বালুময় তটভূমিতে আমি বসে একা।
এই সময় বর্ষার শূন্যতা টা প্রকট ভাবে অনুভূত হচ্ছে।
কিন্তু কোথায় সে রহস্যমানবী?
স্মৃতিতেই কেবল জেগে আছে ধূসর হয়ে…

ভাবনাটা ভাবতেই দূরে দৃষ্টি মেলে থমকে গেলাম। হাহ! বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘ শ্বাস। আজকাল দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দুই চোখ। তাই হয়তো দূরের তীর ঘেঁষে হেটে আসতে দেখছে বর্ষাকে। গায়ে জড়ানো আমারই দেয়া সেই লাল তাঁতের শাড়িটা। দুহাত ভর্তি কাঁচের রেশমি চুড়ি। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ছে তার ভীষণ অবাধ্য চুল।

আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। রোদের প্রবল উত্তাপে সরু হয়ে এসেছে দুটি চোখ। অলীক ছবি দেখার এটা আরও একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ। হাটু মুরে বসে একহাত ক্লান্ত ভাবে হেলিয়ে দিয়ে, মাথা নুইয়ে, অন্যহাতে বেছে বেছে পাথর ছুড়তে লাগলাম ক্ষর স্রোতা নদীতে বুকে। হঠাৎ মনে হল কিসের একটা ছায়া যেন এসে পরেছে গায়ে। চোখের কোন দিয়ে ভীষণ লাল কিছু একটা নজরে পড়ল তখনি। আমি ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকালাম। মনে মনে প্রবল ভাবে চাইলাম। যা ভাবছি তা যেন আমার ভ্রম না হয় কিছুতেই।

কিন্তু সামনের মানুষটির উপস্থিতি আমার হৃদকম্পন থামিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। কয়েক মুহুর্ত সেদিকে থমকে তাকিয়ে থেকে সহসা চোখ বুঝলাম। ভাবতে চেষ্টা করলাম প্রকাশ্য দিবালোকে কোনদিন অশরীরীরা নেমে আসতে পারে কিনা!
কারণ সামনের মানবী টি যতটুকু না পার্থিব, তার চেয়ে অনেক খানি বেশি ঐশ্বরিক আভায় পরিব্যাপ্ত। আমার বর্ষা কোনো কালে এত অপার্থিব ছিল কিনা মনে করতে চেষ্টা করলাম। চোখ খোলার আগেই অনুভব করলাম সেই মানবী আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রবল সমীরে ওড়া তার আঁচল এসে বাড়ি খাচ্ছে আমার গায়ে।
তারপর সেই সুধা কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দমালা। নাহ! কোনো ভুল নেই। বর্ষা ছাড়া এই গলার স্বর আর কারো হতেই পারে না।
-“এই! কি হইলো? আপনি চোখ বুজলেন কেন? আমারে বুঝি খুব খারাপ লাগতাছে দেখতে? এইজন্যই আমি আসতে চাইনাই। ধুর…..”

আমি চোখ খুললাম। আমার সামনে উপস্থিত আকাশলোক থেকে নেমে আসা পরীর মুখখানি মুহুর্তে ভার হয়ে এল কালো মেঘে। সে নৈরাশা মেশানো করুন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নদীর স্রোতের দিকে।

হঠাৎ আমার ভীষণ বেপরোয়া হতে ইচ্ছে জাগল। চিৎকার করে পৃথিবীকে বলতে ইচ্ছে হল,
-“শুনছো, শুনছো তোমরা কেউ? এই যে আসমানী মেয়েটিকে দেখছো ভীষণ অপার্থিব, সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে। তার সব সুন্দরেরা শুধু আমারই প্রতিক্ষায় রত। আহ! কি ভীষণ সৌভাগ্যবান আমি! ”

চলবে ইন শা আল্লাহ

একদিন নববর্ষা -১৩
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

বর্ষার মুখভার। বিবশতায় আচ্ছন্ন দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইলাম আমি। একটা কবিতার কিছু পঙক্তি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আনমনে গুঞ্জন করে উঠলাম।

“কোথায় পাইমু কলসী কইন্যে, কোথায় পাইমু দড়ি,
তুমি হইও গহীন গাঙ, আমি ডুইব্যে মরি!”

কবিতার কথামালা শুনে বর্ষা খিলখিল করে হেসে উঠল।
ভেঙচি কেঁটে, ” ঢঙ। ” বলেই আমার পাশে এসে বসল।

বালু তীর ঘেঁষে একে অন্যের হাত ধরে আমরা সেদিন বসে রইলাম বহুক্ষণ। কত কথাই যে বলা হলো সেদিন বর্ষার সঙ্গে। আমাকে যেন কথা বলা রোগে পেয়েছে। অনুরাগের আতিশয্যে আমার রাশভারি চরিত্রের সকল সঙ্গিনতা যেন ছুটি কাটাতে চলে গেছিল সেই দুপুরে। মনে হলো আমাদের বয়সটাই উল্টে গেছে। আমি হয়েছি সদ্য কৈশোরে পড়া ষোলো বছরের মাতাল প্রেমিক। আর বর্ষা যেন সাতাশ বছরের ভীষণ গম্ভীর, ঔদার্যপূর্ণ, সমঝদার লেখক।

কত সময় পেরিয়েছে। তার হিসেব রাখা অনাবশ্যক মনে হচ্ছিল। বর্ষা ভীষণ আড়াল করতে জানে। কিভাবে কাটছে তার দিন, বাবা তাকে কষ্ট দিচ্ছে কিনা, কালকের ব্যাপার টা আবারো পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে কিনা….. এতগুলো প্রশ্নের একটিরও যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিল না সে। বারবার শুধু হেসে এড়িয়ে গেল। আমাকে আশ্বাস দিল একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনকি একটা নিগূঢ় সত্য, যা সেই প্রথম থেকে আমি বর্ষার মুখে শুনতে চাইছি। সে আমাকে ভালোবাসে কিনা। তার উত্তর স্পষ্ট করে কখনো দেয়নি বর্ষা। কখনো প্রতুত্তরে বলেনি।
-” আমিও ভালোবাসি নাব্য।”

তবে একটা ব্যাপারে আমার কৌতুহল নিবৃত্ত হল। বর্ষার প্রকৃত বাবার পরিচয়।
অনেক প্রশ্নের পর বর্ষা নিশ্বাস ফেলে বলল,
-” আমার বাবা আছিল ইস্কুল মাস্টার। এহনো মনে আছে ছয় বছর বয়সেও বাবার হাত ধরি তার সঙ্গে ইস্কুলে যেতাম আমি। কিন্তু হঠাৎ বাবার খুব অসুখ করল। কি যে হইল আমরা কেউ বুঝলাম না। বাবা খালি দিনরাত ঝিমাইতো, আর কাশতো। এত কাশতো যে কাশির সাথে রক্ত আসতো মাঝে মাঝে। একসময় তারে ইস্কুলও ছাড়তে হইল। তারপর একদিন কাশতে কাশতে বাবার মুখ দিয়া জমাট বান্ধা রক্ত বেরইতে শুরু করল। বাবা মারা গেল সেইদিনই বেহানবেলাতে। তার চারমাস পর মামারা মা’রে আবার বিয়া দিল। আমিও মায়ের সাথে সাথে তার নতুন স্বামীর বাড়িতে থাকার অনুমতি পাইলাম। আর বর্ষন…. বর্ষন হইল আমার দ্বিতীয় বাপের সন্তান। আমার সৎ ভাই।”

খেয়াল করলাম বর্ষার চোখের কোণায় ঝিলিক দিচ্ছে অশ্রু। সে একটু থেমে বলল,
বাবা যে আমারে কত্ত ভালোবাসতো! বাবার মতন কেউ আর কোনোদিন ভালোবাসে নাই।”

আমার হঠাৎ ভীষণ কষ্ট হল। বুকের ভেতরে চাপা আর্তনাদে সৃষ্ট ব্যাথাতুর হৃদয় চেঁচিয়ে বলতে চাইল,
-“কে বলেছে ভালোবাসেনি? এইযে আমাকে দেখছো। আমার সবটুকু শক্তি দিয়ে আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। এমনিভাবে আর কেউ কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। তুমি মিলিয়ে নিও। ”

***

প্রকৃতির খেয়াল বোঝা দায়! যে রোদ ঝলমলে আকাশ দেখে মুগ্ধতায় ভাসছিলাম। ঘন্টার ব্যবধানে সে জায়গা দখল করে নিয়েছে ছাই বর্ণের জলপূর্ণ গুরুগম্ভীর মেঘেদের দল। প্রকৃতির এই রূপের সঙ্গে কোথায় যেন বিচ্ছেদের সুরের একটা মিল রয়েছে। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়। এই দলছুট কালো মেঘেরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রচুর বিরহের সরঞ্জাম আর হাহাকারের নিরব আর্তনাদ। তবে এই আয়োজন কখনো আমার অন্তঃকরণে ভয়ের সঞ্চার করে নি এর আগে। হয়তো তখনো কাউকে হারানোর ভয় ছিলনা বলেই। অথচ আজ এই মেঘ আপনা থেকেই অশুভ একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে খুব অস্পষ্ট ভাবে। খুব ভয়ংকর একটা ভাবনা থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে মনে। বর্ষার দিকে ফিরলাম। সে আমার পাশে বসে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে উত্তাল নদীর তরঙ্গায়িত ঢেউ। কি সুন্দর তার মুখখানি। মেঘের আলোয় ধূসর চারদিক। বর্ষার গালে এসে পড়ছে সেই আলোর রূপোলী ছটা। এত মায়া যে আর কোথাও নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে এই মুখ আজকের পর আমি আর কখনো দেখব না। আমার দৃষ্টি থেকে ভালোবাসারা প্রজাপতি হয়ে উড়ে আর কখনো ছুঁয়ে দেবে না বর্ষাকে। কি ভয়ংকর কল্পনা। বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ভাবলেও বুক কেঁপে ওঠে!

এমন সময় কখনো না আসুক। যখন আমি চোখ মেললে বর্ষাকে দেখবো না, নিশ্বাস নিলে বর্ষার অস্তিত্ব টের পাব না, হাত বাড়ালে ছুঁতে পারবো না আমার প্রাণভোমরা কে।
কিন্তু নিয়তি যদি সহায় না হয়? আমি ভাবতে চাইনা আর সেইসব দুঃসহ সময়ের কথা…!

হঠাৎ বন থেকে ভেসে আসা একটা প্রকট শব্দ ঢেকে দিল নদীর কল্লোল আর বিষন্ন মেঘেদের গুড়ুম গুড়ুম শব্দকে। বর্ষা চমকে ফিরে চাইল। ভ্রুতে কুঞ্জন এঁকে উঠে দাঁড়িয়ে হাটা ধরল বনের দিকে। শব্দের উৎস কোনদিকে সেটা খুঁজতে। আমি বনের দিকে ফিরে তার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের একান্তে সময় কাটানোর ক্ষণে, এই বাঁধা আরও দীর্ঘায়িত হোক সেটা কোনোভাবেই চাইনা।

অথচ কয়েক মুহূর্ত পর বর্ষা ফিরে এল সম্পুর্ন অপরিচিত রূপে। শঙ্কিত গলায় বলল,
“বাজান বনে লোক নিয়া আসিছে গাছ কর্তনের জন্যি। বাজান কিংবা দলের অন্যকেউ যেকোনো সময় এদিকে চলে আসতি পারে। আপনি চলি যান। ”

আমার বুকে এক আকাশ ভার নেমে এল। ভীষণ দমে গেলাম আমি। কেন এত প্রাচীর আমাদের মাঝে!
-“কিন্তু বর্ষা….।”

আমাকে থামিয়ে দিয়ে বর্ষা ত্বরিতে বলল,
-“আর কোনো কথা না। আমি আসি। ভালো থাকবেন। আরেকটা কথা, কক্ষনো আমার খোঁজ করতে যাইবেন না অনুরোধ রইল। সময়ে সময়ে আমিই আপনেরে দেখা দিমু।” বলে বর্ষা ফিরতি পথ ধরল।

আমার বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দে হাতুড়ি পেটাচ্ছে একটা অজানা আশংকা। মনে হচ্ছে সবকিছু থেকেও কিছুই রইল না আমার। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি আমি এই কালহরণে। এই সময়ের পর কোনো কিছুই আর এরকম থাকবে না। মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে মনে আর মস্তিষ্কে ওঠা এই অদ্ভুত, অপরিচিত চিন্তার ঝড় আমাকে বিহ্বল করে দিল৷ বর্ষার কথা অমান্য করে এই প্রথম ওর আঁচল টেনে ধরলাম আমি। অভিমানী স্বরে বললাম,
-” বর্ষা, তুমি কেন এত আড়াল হও? আমাদের কি কোনোদিন একসাথে একটা শংকামুক্ত ভোর দেখা হবে না? এইযে তুমি আর আমি ক্রমে সরে সরে যাচ্ছি……. এই দূরত্ব একদিন মিটবে তো?
আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। একটা শেষ প্রশ্নের উত্তর দাও।
বর্ষা, তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছিলে?”

বর্ষা পেছন ফিরে, গাঢ় অঞ্জন খচিত টলমল আঁখি মেলে চাইল আমার দিকে। উত্তরের অপেক্ষায় আমি চাতকের মতো চেয়ে রইলাম। প্রকৃতি তার প্রলয়নৃত্য থামিয়ে দিল আচমকা। বাতাসের শো শো গর্জন নেই, আকাশে মেঘের রণহুংকার নেই। সকলেই যেন নাব্য নামের এক নিঃস্ব, পাগলাটে প্রেমিকের সাথে তার প্রেয়সীর থেকে ভালোবাসি কথাটা শোনার অপেক্ষা করছে।
তাদের সবার অনুসন্ধিৎসা কে পরাভূত করল সেই মেয়েটি। প্রেমিকের সকল অনুরাগ, অভিমানকে অগ্রাহ্য করে বিষাদক্লিষ্ট ওষ্ঠে কেবল অদ্ভুত ভাবে হাসল। আমার হাত থেকে আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে পরমুহূর্তেই রক্তিম আঁচল উড়িয়ে গহীন অরণ্যের মাঝে হারিয়ে গেল সবসময়কার মতো।

আমি হাটু মুড়ে বসে পড়লাম। আমার আর কোনো জোর নেই। ভালোবাসা নামক মরণব্যাধি শুষে নিয়েছে আমার সকল জীবনাশক্তি। এইবার আমি কেবল বাঁচার জন্যেই বেঁচে থাকবো।

অথচ আমি বুঝিনি। নিয়তি সেদিন থেকেই বদলে নিয়েছিল তার পথ। বর্ষার সাথে সে-ই ছিল আমার শেষ দেখা……।

***

ফজলুর সাথে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল সেদিন বিকেলে বসির শেখের বাড়ি। তারপর থেকে ফজলু আর আসছে না। কিছু জিনিস কেনা দরকার, তার ওপর মফস্বলে না গেলে শহরের কোনো খবরাখবর পাওয়া যায় না। এইসব ভেবে তাই অবশেষে ঠিক করলাম আমিই একবার যাব মফস্বলের বাজারে। এমনিতেও দুপুরে নদী তীরে বর্ষার ওভাবে চলে যাওয়ার পর থেকে মন ভালো নেই।
বিকেলেই তাই বাড়ি তালাবদ্ধ করে বেরিয়ে পরলাম মফস্বলের উদ্দেশ্যে। গায়ে একটা ছাই রঙা সার্ট, হাতাটা ফোল্ড করে কনুই পর্যন্ত ওঠানো। পকেটে অকেজো সেলফোন। অকেজো বলার কারণ এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়ার আশা করা বৃথা। তার ওপর চার্জ শেষ হয়েছে তারও কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে।

মফস্বলের বাজারে কিছু লোকের সঙ্গে ইতোমধ্যে আমার পরিচয় ঘটেছে। মাঝে মাঝে বাড়ির খবরাখবর নেয়ার জন্য এখানে আসতে হয়। পুরনো দিনের মতো টাকার বিনিময়ে ফোনে কথা বলার সিস্টেম এখনো সচল আছে এখানে। অবশ্যি এসব ছাড়া উপায়ই বা কি! যেনতেন সিমের নেট পাওয়া দুষ্কর এই গহীন অঞ্চলে। তাই দোকানের বাটন ফোনে টাকার বিনিময়ে কয়েক মুহূর্তের আলাপনই ভরসা।

দোকানদার কায়সার দূর থেকে আমাকে দেখে হাসল। হাত নেড়ে বলল,
-“সাব, যাওয়ার সময় একবার ঘুইরা যায়েন দোকান থাইকা। জরুরি দরকার আছে। ”
আমি অন্যসময়ের অপেক্ষা না করে তখনি হাজির হলাম সেখানে। কায়সার ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে বলল,
-” সাব, কাল রাত থাইকা মেলা নম্বরের তন কল আইতাসে আমার এইনে। সবাই খালি আপনেরেই খোঁজে। একবার একটা মাইয়া ফোন কইরা খুব কানলো। কান্দার চোটে কি কইল কিছুই বুঝবার পারলাম না। কল কাইটা গেল। এদিকে আবার ঝড়বৃষ্টির লাইগ্যা নেটওয়ার্কএ ডিসটাব। তিনবার কল করলে একবার রিং হয়।”

কায়সারের কথা ভয় পাইয়ে দিল আমাকে। কে এতবার কল করে খুঁজেছে আমাকে। যে মেয়েটি কল করে কাঁদছিল কে সে? নিশ্চয়ই নিতিন! কিন্তু কেন। কি এমন হয়েছে।

কায়সারের কথায় সম্বিত ফিরল।
-“সাব, এইযে একটা নম্বর খুইজা পাইছি। আজ দুপুরেই কল আইছিল এই নম্বর থাইকা। ”

আমি অস্থির হয়ে বললাম,
-” তাড়াতাড়ি কল দাও তো এই নাম্বারে।”

কায়সার কল করে ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। রিং হচ্ছে। আমার হৃদস্পন্দন ভয়ানক বেড়ে গেছে। কয়েকবার রিং হয়ে কলটা কেটে গেল। আমি ফের কল করলাম। আবারও রিং হচ্ছে।
কয়েক মুহূর্ত পর। ওপাশ থেকে কান্নায় বসে যাওয়া গলায় নিতিন বলল,
-“হ্যালো। ”

-“নিতু, কি হয়েছে নিতু? সব ঠিক আছে তো?”

আমার কথা শেষ হতেই নিতিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ফোনের ওপাশ থেকে।
-” দাভাই, দাভাই…..সব শেষ হয়ে গেছে।”

-“কি হয়েছে আপু? বল প্লিজ। আমাকে এভাবে ভয় পাইয়ে দিস না। আম্মা, বাবা, দাদি সবাই ভালো আছে তো?”

নিতিন এবার বাবা শব্দটা বলে অন্যরকম একটা আওয়াজে চিৎকার করে উঠল।
-” দাভাই, বাবা…..বাবা কথা বলছে না। চোখও মেলছে না। ওরা বলছে বাবাকে দাদুর কাছে রেখে আসবে।”

আমার নিশ্বাস আটকে গেল। দাদু আমাদের ছেড়ে গেছে দশ বছর আগে। তার বসতি এখন আজিমপুর কবরস্থানে অন্যান্য পরপার বাসীদের সঙ্গে।
(গল্পের মোড় ঘোরা শুরু…..)

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here